• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
রম্য গল্প

রোগী কোরবানি


শফিক হাসান
প্রকাশিত: জুন ১৬, ২০২৪, ০৩:০৫ পিএম
রোগী কোরবানি

স্বর্ণলতা মেডিসিন স্টোর দিনের অর্ধেকের বেশি সময় সদাব্যস্ত থাকে। রোগীদের গিজগিজ-করা ভিড় থাকেই। একদিকে ওষুধ ক্রেতাদের সামলানো অন্যদিকে রোগী কিংবা তাদের আত্মীয়স্বজনের বিচিত্র ফিরিস্তিতে দফারফা হয় প্যারামেডিকেল ডাক্তার মজনু মিয়ার। এরমধ্যেই ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের নানা প্রলোভন, নিম্নমানের ওষুধ চালিয়ে দেওয়ার আবদার তো আছেই। যেন ফাঁদে পড়ে আছে মজনু; ফাঁদটা মধুর, সুখেরও। হাত বাড়ালেই টাকার ঝনঝনানি!

মহল্লায় যতগুলো মুদি দোকান আছে, বোধকরি তারচেয়ে কম নেই ওষুধের দোকান। কোথাও কেউ নতুন মুদি দোকান খুললে পাল্লা দিয়ে যেন ওষুধের দোকানও বাড়ে একটা। এত দোকানপাট, তবুও পাল্লা দিয়ে মজনুর খদ্দের বাড়ছে। যে লোকটাই মুদিখানা থেকে চাল ডাল তেল আটা কিনবে, ভক্ষণপরবর্তী সময়ে তারই যেন আগমন ঘটবে স্বর্ণলতায়। কি চমৎকার সাম্য পরিস্থিতি!

ছয় মাসের প্যারামেডিকেল কোর্স শেষে দোকানটা খুলে বসেছিল মজনু। টাকা বানাতে সময় লাগেনি। বছরের মাথায় ছোটভাইকে সাত লক্ষ টাকা ব্যয়ে পাঠিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। পরের একবছরে ছোটভাই এক লক্ষ টাকাও পাঠাতে পারেনি। বাধ্য হয়ে মজনুকে নিতে হলো সময়োপযোগী পদক্ষেপ। কল দিয়ে বলল, ‘ভাই, তুই জলদি দেশে ফিইরা আয়।’ 

ছোটভাই আকাশসমান আতঙ্ক নিয়ে বলল, ‘সাত লাখ টাকা পানিতে ফালাইয়া দিমু নাকি!’

‘ছোড চিন্তা বাদ দে। মনে কর, তুই বিদেশে ঘুরতে গেছস! এখন ভ্রমণ ভিসার মেয়াদ শেষ। ফিইরা আইলে তোরে আমি এমবিবিএস ডাক্তার বানাইয়া দিমু!’
‘এইডা কী কও? আমি তো মেট্রিক পাসও করি নাই।’
‘বহুত বড় বড় স্যারেও মেট্রিক পাস করে নাই। তাতে কারও ক্ষতি অয় নাই। আর ডাক্তার অইতে পাস লাগে না রে। আমি ডাক্তারি পাস করছি নাকি? ওই প্যারার অল্প অল্প বিদ্যা নিয়াই শত-শত রোগীর চিকিৎসা করি না প্রতিদিন?’
পরামর্শমতো ছোটভাই দেশে ফিরেছে। মজনু তাকে এমবিবিএস ডাক্তার সাজিয়ে বড় চেম্বারে বসিয়েও দিয়েছে। সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে—ডা. শাহাদাত উল্লাহ চৌধুরী : সব ধরনের জটিল-কঠিন রোগের চিকিৎসা করা হয়। 
পসার জমতেও সময় লাগেনি, রোগীর ভিড় লেগেই থাকে দিনে-রাতে।

কোনো রোগীর সমস্যা কঠিন মনে হলে মজনু ছোটভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়। সে মওকা বুঝে অদরকারি টেস্ট লিখে দিতে পারবে। ওখান থেকেও আসবে মোটা অংকের পার্সেন্টেজ। নিজে কখনো কাউকে টেস্ট দেয়নি। যেহেতু মজনু গরিবের ডাক্তার, টেস্ট লিখে কাস্টমার হারাবে নাকি! কিন্তু ডা. শাহাদাত উল্লাহ চৌধুরী বড় ডিগ্রিধারী; তিনি টেস্ট দিলে রোগীরা মনোক্ষুণ্ণ হবে না। ছোটভাইকে কয়েকটি হাসপাতাল, ল্যাবরেটরি ও প্যাথলজির ঠিকানা বুঝিয়ে দিল। মূল-মন্ত্রও পড়ে দিল কানে। এবার মজনু মিয়া ভাবল— সাহস বাড়িয়ে অল্প-স্বল্প টেস্ট-পরীক্ষা দেবে।

মজনুর রোগীরা দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির। উচ্চবিত্তরা সর্দি-কাশি হলেও বিদেশে যায় চিকিৎসা নিতে, তাদের নাগাল আর পাওয়া যায় না। অথচ তারা দেশমুখী থাকলে মজনু হয়ে উঠতে পারত সর্বশ্রেণির মানুষের ডাক্তার! গরিব-গুবরো রোগী নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতে হতো না! বড় দা-ও মারা যেত।

সেদিন কেন যেন দোকানে খদ্দের কম ছিল। দুপুরের পরে একজন মধ্যবয়স্ক রোগী এলেন। জানালেন মাথাব্যথায় ভুগছেন। মজনু সাহস করে চটজলদি প্রেসক্রিপশন লিখে দিল। বলল, ‘আগে টেস্টগুলো করিয়ে আনুন!’

রোগী ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ‘মাথাব্যথার জন্যও টেস্ট-ফেস্ট লাগবে কেন!’
বিরক্ত মজনু ডাক্তার বললেন, ‘ক্যানসারের মাথাব্যথা নাকি টেনশনের কারণে, টেস্ট না করলে বুঝব কীভাবে?’
‘ভাবলাম, এখানে অন্তত চিকিৎসার নামে জোচ্চুরি হয় না, ঠিকই টেস্ট-ফেস্টের ব্যবসা ফেঁদে বসলেন!’
এবার মেজাজ চড়ল মজনু ডাক্তারের— ‘নিজেই যদি ডাক্তারি করবেন, তাহলে ডাক্তারখানায় এলেন কেন! আর শুরু থেকেই আপনি টেস্ট-ফেস্ট বলে যাচ্ছেন। টেস্ট না হয় বুঝলাম, ফেস্ট জিনিসটা কী?’
‘ফেস্ট বোঝেন না? ফেস্টিভ্যাল। রোগীকে বেশি টেস্ট দিতে পারলেই আপনাদের ফেস্টিভ্যাল শুরু হয়ে যায়। উৎসবের আমেজ আসে দেহে-মনে!’
কথাটা মিথ্যা নয়। সত্য হলে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিক দেশে ফিরে পরপর সাতটা বহুতল ভবন বানাতে পারত না। তাই বলে রোগীর কাছে নতি স্বীকার করা যায় না। ছোঁ মেরে প্রেসক্রিপশনটা কেড়ে নিল মজনু। বলল, ‘মনে উৎসবের রং নেই, আপনি ওই রকম কোনো ম্যান্দামারা ডাক্তারের কাছেই যান!’
‘রঙবেরঙ নিয়ে আপনারা থাকুন। আমার ডাক্তার লাগবে না। নাম বলছি, চারটা ট্যাবলেট দিন।’
ঘোড়েল লোকটা বিদায় নেওয়ার পর হাঁফ ছাড়ল মজনু। বাপরে, কি জাঁদরেল রোগী, নিশ্চয়ই তারই মতো প্যারামেডিকেল কোর্স করা! কথাবার্তায় যে প্যারা দিল, তাতে মজনুর এমনটা মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
এরচেয়ে তো ওইসব রোগীই ভালো, যারা আকৃতি অনুযায়ী ওষুধের নামকরণ করে নিজেরাই— ‘হোঁয়ার দানা’, ‘বিস্কুটের বড়ি’, ‘রসগোল্লার ছা’, ‘বাচ্চাগো বেলুন’... এসব। শসার বীচির মতো আকৃতির ট্যাবলেটটাকে নিরক্ষর রোগীরা বলে ‘হোঁয়ার দানা’, বড় সাইজের গোল একটি ট্যাবলেটের নাম ‘বিস্কুটের বড়ি’ আর লাজুক শ্রেণির খদ্দেররা নিরোধকের নাম দিয়েছে ‘বাচ্চাগো বেলুন’!
সব মিলিয়ে দিনকাল খারাপ যাচ্ছিল না। নতুন যুক্ত হয়ে টেস্ট ফেস্টিভ্যাল ডোবাবে নাকি ভাসিয়ে দেবে উঁচুতে— বুঝে উঠতে পারছে এমবিবিএসের বড় ভাই মজনু মিয়া। পরিস্থিতি ভালো বুঝলে কর্মচারীদের হাতে দোকান ছেড়ে দিয়ে নিজেও অলটাইম ডাক্তার হয়ে বসতে পারবে! 
এমন সুখস্বপ্নের মধ্যেই আরেকজন রোগী এসে হাজির। আজ তিনদিন ধরে তার পেটে ব্যথা। মজনু পরিষ্কার হাতে টেস্ট লিখে দিল— ‘ল্যাব-প্যাথ থেকে এসব এখনই করিয়ে আনুন। নইলে শরীরের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাবে!’ 
রোগী অবাক হয়ে বলল, ‘ডাক্তার সাব, কোরবানির তো আরও তিনদিন বাকি আছে!’
‘বাকি থাকলে কী আর না থাকলেইবা কী! রোগ তো আর ঈদ-পার্বণ বোঝে না। আপনি কোরবানি ঈদের আগেই সুস্থ হন। সুস্থ পেটে গরুর মাংস খেতে চান না?’
‘আমি তো সেডাই কইছিলাম। সময়ের আগেই আপনে আমারে কোরবানি দিতাছেন ক্যান?’ 
‘কোরবানি দিচ্ছি মানে! আমি কসাই হলাম কবে?’
‘ও, কবে কী হইছেন এডাও ভুলে গেছেন? আপনেরা ডাক্তার, আপনেগো তো আবার কোরবানির সময়-অসময় নাই। সারা বছরই কোরবানি করেন। আমাগোর মতো রোগীর গোস্ত খান। গরু-খাসির গোস্তের চাইয়াও রোগীর গোস্ত বেশি বেশি স্বাদের-ডাক্তার সাব?’
রাগ-ক্রোধের বদলে মজনুর মুখ হাসি হাসি হয়ে উঠল। কল্পনায় ভাসল এবারকার ঈদের জন্য সদ্য কেনা গরুটার চেহারা। মহল্লার সেরা গরু, গরুর নামটাও ঢাকাই ছবির জনপ্রিয় নায়কের নামে। দামে-জৌলুসে মজনুকে টেক্কা দিতে পারবে এমন কেউই বর্তমানে ধারে-কাছেও নেই আর!

Link copied!