বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের পুরাতন জেলা নোয়াখালী। একসময়ে এর নাম ছিল ভুলুয়া। তার শাসক ছিলেন রাজা লক্ষ্মণ মানিক্য। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন সাহিত্যিক। সন্দ্বীপ, হাতিয়া, সুধারাম, বেগমগঞ্জ, রায়লিফারি, রামগঞ্জ, আমিরগাঁও, বালাদিয়া, ধনিয়ামালিয়া, ফিরি, মিরসরাইসহ আরও কয়েকটি অঞ্চল এ জেলায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। বার বার নদী ভাঙনে বাংলাদেশের সুপ্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি রয়ালডিস্ট্রিক খ্যাত ভুলুয়ার বিখ্যাত দিঘি, ফরাশগঞ্জ বন্দরসহ অনেক স্থাপনা বিলীন হয়েছে।
১৯০৫ সালে নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নোয়াখালীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যাওয়া কয়েকজন উদ্যমী ও প্রগতিশীল তরুণ একত্রিত হলেন। তারা ভাবলেন তাদের জন্মভূমি থেকে আসা মানুষদের পাশে দাঁড়াবেন। এ ভাবনা জায়গা থেকে অসাম্প্রদায়িক ও অরাজনৈতিক সংগঠন নোয়াখালী সম্মিলনী গড়ে তুললেন। পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভ্রাতৃত্ববোধের অবিসংবাদিত সম্প্রীতি-সৌহার্দ্য সম্পর্ককে আরও জোরদার করলেন। পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন সংগঠন নোয়াখালীর সম্মিলনীর উদ্যোগ ৮ থেকে ১০ ডিসেম্বর কলকাতার সল্টলেকের পূর্বাঞ্চল সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হবে ‘ইন্দো-বাংলা নোয়াখালী উৎসব ২০২৩’।
তিন দিনব্যাপী এ উৎসবে বাংলাদেশ থেকে শতাধিক প্রতিনিধি যোগ দেবেন। প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা প্রবীন সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী, উন্নয়ন সংগঠক আবদুল আউয়াল, বীর মুক্তিযোদ্ধা তোফায়েল আহমেদ, ঢাকাস্থ নোয়াখালী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন, নোয়াখালী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের প্রথম নারী সাধারণ সম্পাদক হায়দরী রেজিনা সুলতানা, নোয়াখালী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর আল হেলাল মো. মোশাররফ হোসেন, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মাইনউদ্দিন পাঠান, পোশাক পরিকল্পক তহমিনা তাবাসসুম রূপা, দৈনিক লাখোকণ্ঠের সম্পাদক ফরিদ উদ্দিন বাঙালি, নোয়াখালী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস নজরুল ইসলাম বিপ্লবসহ সমাজের বিভিন্ন অংশের নোয়াখালীর ব্যক্তিত্বরা এ উৎসবে যোগ দেবেন। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গ ও বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে যোগ দেবেন আরও ৭০০ প্রতিনিধি। এই অনুষ্ঠানে থাকছে গুণীজন সংবর্ধনা, আলোচনা সভা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দুই বাংলার নোয়াখালীর শিল্পী ছাড়াও সংগীতশিল্পী গঙ্গাধর তুলিকা, প্রতুল মুখোপাধ্যায় গান পরিবেশন করবেন।
রোববার (৩ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় কলকাতার গড়িয়াহাটে এক সংবাদ সম্মেলনে উৎসবের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন নোয়াখালী সম্মিলনীর সভাপতি ধীরাজ মোহন চন্দ, কার্যকরী কমিটির সভাপতি রাখাল মজুমদার, সম্পাদক মনোজ রায় ভৌমিক উৎসব কমিটির আহ্বায়ক সাংবাদিক রক্তিম দাস, বস্ত্র ব্যবসায়ী সুকান্তি সাহা।
ধীরাজ মোহন চন্দ বলেন, “দুই বাংলার মানুষকে যদি একত্রিত করতে পারি, সকলে মিলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে পারি, সেটা খুব ভালো হয়। সেটা মাথায় রেখেই আমেরিকায় যেমন বঙ্গ সম্মেলন হয়, তেমনি নোয়াখালীর মানুষদের নিয়ে এ উৎসব।”
সাংবাদিক রক্তিম দাস বলেন, “গোটা বিশ্বের নোয়াখালী মানুষদের একত্রিত করতে একটা মঞ্চে নিয়ে আসার লক্ষ্যে এই উৎসব। কারণ ১৯০৫ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ হয়েছিল তখন নোয়াখালীর মানুষ ঠিক করেছিল কলকাতায় নোয়াখালী সম্মিলনী করতে হবে। কারণ তারা বঙ্গভঙ্গ মানেননি। এবছর কলকাতায় হচ্ছে। আশা করি আগামী বছর বাংলাদেশের নোয়াখালীতে এরকম উৎসব হবে।”
নোয়াখালীর মানুষ বস্ত্র ব্যবসায়ী সুকান্তি সাহা বলেন, “এপার বাংলা-ওপার বাংলা বলে কিছু নেই। আমরা যে ভাষায় কথা বলি সেটাই আমাদের বাংলা। আমার জন্মস্থান নোয়াখালী। সেই অঞ্চলের প্রসিদ্ধ লোকেরা এই উৎসবে আসবেন। তিন দিন আমরা সেই উৎসবে গা ভাসাবো।”
১৯৬৫ সালে হীরক জয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে তৎকালীন সভাপতি মহেন্দ্রকুমার ঘোষের লেখা থেকে জানা যায়, দেশবন্ধুর একান্ত সচিব, বঙ্গীয় আইনসভার অধ্যক্ষ স্বাধীনতাসংগ্রামী সত্যেন্দ্রচন্দ্র মিত্র, অধ্যক্ষ অম্বিকাচরণ, মনমোহন কাঞ্জিলাল, কবিরাজ যদুনাথ গুপ্ত, অ্যাডভোকেট রায় বাহাদুর শুভময় দত্ত, আজিজুর রহমান, বাহারুদ্দিন সাহেবের প্রচেষ্টায় নোয়াখালীর সম্মিলনীর প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। সম্মিলনীর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক দুর্গাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত। যিনি পরে নোয়াখালী পৌরসভার চেয়ারম্যান ও নাথ ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন।
১৯১০ সাল পর্যন্ত নোয়াখালীর সম্মিলনীর সভাপতি কারা ছিলেন তা জানা যায়নি। তবে ১৯১১ সাল থেকে টানা ৩০ বছর ভুলুয়া ও পাইকপাড়ার জমিদার কুমার অরুণ চন্দ্র সিংহ এ সম্মিলনীর সভাপতি ছিলেন। তিনি ১৯১৪ সালে নোয়াখালীতে তার নামে অরুণ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া নোয়াখালী সম্মিলনীর বিভিন্ন সময়ে সভাপতি ছিলেন কমরেড মুজফফর আহমদ, স্বাধীনতা সংগ্রামী অধ্যাপক রাজকুমার চক্রবর্তী, সাহিত্যিক গোপাল হালদার, ঐতিহাসিক অনিল বন্দ্যোপাধ্যায়, রমেশ ভট্টাচার্য, প্রাক্তন মন্ত্রী প্রশান্ত কুমার শূর।