আহমদ ছফা নিয়ে লিখতে বসলেই তার একটা লাইন মনে পড়ে `যে কোনো প্যাশনেট তরুন যদি অনেকদিন পর তার লেখা পড়ে আকৃষ্ট হয়ে চিন্তা করে সেটাই তার সার্থকতা।` সেভাবে চিন্তা করলে আহমদ ছফা সার্থক। এখনকার তরুণ-তরুণীদের অনেকের কাছেই তিনি প্রবাদপ্রতীম লেখক। মানুষ তার লেখা আজও পড়ছে, এই বাংলাদেশে তার চিন্তার `রেলিভ্যান্সি` আজও বিদ্যমান।
অনেক দিন আগে এক পত্রিকায় অখ্যাত এক পিইচডি ডিগ্রিধারী কলামিস্ট লিখেছেন, “ছফা নাকি আড্ডায় তাকে কেউ মূল্যায়ন না করলেই রেগে যেতেন।” এরকম ভয়াবহ রকমের মিথ্যা কথা অনেকদিন পরে শোনা গিয়েছিল। অন্যের মূল্যায়নের অপেক্ষায় ছফা কখনোই ছিলেন না, নিজেই বরং নিজের লেখাকে মহান কিছু ভাবতেন না। অনেক জায়গাতে বলেছেনও। ছফা ছফার মতোই। সমসাময়িক বিচার বিশ্লেষণে তিনি কখনোই আস্থা রাখেন নাই। বরং ফরহাদ মজহার বন্ধু হয়েও ছফাকে ভুল বুঝতেন প্রায়শই। যেমন একবার বললেন, ছফা তো বিএনপির লোক, ওর কথা কি শুনবো। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, কে এখন বিএনপি-জামাতের লোক তা সবাই জানে।
ছফার আরেক বন্ধু ছিল নাজিমুদ্দিন মোস্তান। শখের বসে বই পড়ে, পথ শিশুদের জন্য স্কুল খুলে দেখেন, এক বস্তিতে থাকা ছেলের মুখ বাজে, সারা দিন গালাগাল করে। মোস্তান ছেলেটিকে বাইরে রেখে বললেন, ‘যত খুশি গালাগাল করো শেষ হয়ে আসবে, ক্লাসে আর গালাগালি শুনতে চাই না।’
ছফার আরেক বন্ধু আবদুল হক। ছফার একমাত্র বড়লোক বন্ধু। তিনি বারভিডার সভাপতি ছিলেন। ছফাই তাকে বুদ্ধি দিয়েছিলেন জাপানের সঙ্গে ব্যবসা করার। ছফা চিন্তা করে বের করেছিলেন, জাপানিরাই আমাদের একমাত্র ভালো বন্ধু হতে পারে। দারিদ্র আর ক্ষুধায় জর্জরিত একটা দেশ কিভাবে কৃষি আর শিল্পতে এত এগিয়ে গেল তা নিয়ে খুব ভাবতেন। আবদুল হককে বোঝাতেন, জাপানের সঙ্গে ব্যবসা করুন, তাদের লোকজনের সঙ্গে মিশুন, ঘুরে দেখুন দেখবেন আপনার তো হবে, বাংলাদেশেরও উপকার হবে। আবদুল হক হতাশ হয়ে নাকি জানাতেন, আমি ছোট মানুষ, আমাকে দিয়ে কি হবে। উনি আবদুল হককে বলতেন, জাপানিরা আপনাকে ছোট ভাববে না, আপনি চেষ্টা করুন। আবদুল হক এরপর সেই চেষ্টায় অনেক সফল, ব্যবসা করেছেন, জাপান বাংলাদেশ চেম্বারের বড় পদে ছিলেন অনেক দিন।
ছফা আমেরিকাতেও গিয়েছিলেন। মার্কিন মুল্লুক তার ভালোই লেগেছিল। ভাল লাগেনি তার সফর সাথী দেশি বুদ্ধিজীবীদের। ওনারাও তাকে খুব একটা লাইক করত না। দেখা গেল তারা চলে গেছে ভেন্যুতে, ছফা এখনো পৌঁছান নাই। আবার ছফা সেই শহরেই আছেন, তারা দলবেঁধে অন্য কোথাও চলে গেছে। এতে সুবিধা হয়েছে ছফা বিভিন্ন প্রবাসীর বাসায় ছিলেন। কত বড় মনের মানুষ বলেই তিনি যাদের বাসায় ছিলেন তারা অনেক জিনিস ছফাকে দিয়ে পাঠিয়েছেন, ছফা সুন্দর মতো তা ঢাকা চিটাগাং নানা জায়গায় ঠিকঠাক দিয়ে দিয়েছেন। তার সঙ্গে ছিল দুর্বোধ্য হাতের লেখার চিঠি, জবাব দিলে আবার চিঠি লিখতেন খোঁজ নিতেন। এরকম এক ভদ্রলোক আমাকে বলেছিলেন, তার বাবা চিঠিগুলো খুব যত্নে রেখেছেন।
যেদিন ছফা মারা যান, তিনি নাকি হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন, সেই প্রবাসী ভদ্রলোক খুবই অবাক হয়েছিলেন, তার দাদার মৃত্যুর সময় ছাড়া তার বাবাকে এরকম ফোন করে কাঁদতে দেখেন নি। এসব গল্প আমরা কেন মনে করি? কারণ `পুষ্প বৃক্ষ বিহঙ্গ পুরাণ` যখন পড়ি তখন ছফার সেই কাদামাটির মনটাকে অনুভব করি। দেশ স্বাধীন হবার আগে পরে তাঁর যে রাগী তারুণ্য ছিল সেটা উপলব্ধি করি সে সময়ের লেখা পড়েই।
ফররুখ আহমদকে তিনি যে কলামটা লিখেছিলেন গনকন্ঠে, ওরকম লেখা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। বঙ্কিমচন্দ্র কিংবা জাসদ অথবা পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে তার যে লেখনী সেটার সমতুল্য বিকল্প চিন্তা তাঁর সময়ের কেউ পারেনি। বাঙ্গালি মুসলমানকে নিয়ে তিনি যা বলেছেন, আজো অক্ষরে অক্ষরে সত্য। ছফা তাঁর সময়কে বুকে ধারণ করে এগিয়েছেন। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত মনন ও বুদ্ধিজীবিতাকে বুঝতে ছফা পাঠের বিকল্প নাই। আহমদ শরীফ চিনতে পেরেছিলেন এরকম রত্নকে। তাই আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, ` আরো কিছু ছফার মত মানুষ পেলে দেশ বদলানো যেত`! জন্মদিনে তাই বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ এই মনিষীকে। বাংলাদেশে আহমদ ছফা চর্চা ও পাঠ আরও বিস্তৃত হোক।