• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
গল্প

প্রতিশোধ


সাদাত উল্লাহ খান
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৯, ২০২৩, ০৩:০৯ পিএম
প্রতিশোধ
প্রতিশোধ। ছোটগল্প।

মানবজীবনে অনেক সময় অনেক ঘটনা ঘটে, যা হাজার চেষ্টা করেও মন থেকে সরানো যায় না। মনে না রাখতে চাইলেও কেন যেন সময়ে-অসময়ে হঠাৎ হঠাৎ মনের দর্পণে ভেসে ওঠে। স্মৃতির দরজায় মাঝে মাঝে কড়া নাড়ে। প্রকৃতিতে যেমন ঋতু বদল হয়, মানুষের মনেও ভাবের ও আবেগের জোয়ার-ভাটা চলে। পুরোনো হার না-মানা স্মৃতি বা ঘটনা প্রবলভাবে মনের দরজা খুলে বের হয়ে আসে। কোনো কোনো স্মৃতি এমন শক্তি অর্জন করে যে কোনোমতেই তা অবদমিত থাকে না। কীভাবে যেন আত্মপ্রকাশ করেই করে। ঘটনার প্রায় ত্রিশ বছর পর সবুজ যিশুর মনে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ঘটনার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়। একদিন ফেসবুকের পাতায় রূপা কামালকে খুঁজে পায় সবুজ যিশু। যিশুর মনে আনন্দ ও স্মৃতি দুটোই লাফিয়ে ওঠে। পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলো তরতাজা হয়ে উঠলেও রূপার জীবনে অনেক পরিবর্তন ঘটে যায়। তার রূপ পাল্টায়, চেহারা পাল্টায়, শরীর পাল্টায়। দেরিতে হলেও খ্যাতনামা একজন নেতার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। তাই টাকা, ক্ষমতা ও অহংকার সবই হয়েছে রূপার। মানুষের হাতে টাকা, ক্ষমতা যা-ই আসুক না কেন, পুরোনো অপমান বা আঘাত সে ভুলতে পারে না। ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করে। রূপাও তার ব্যতিক্রম নয়। তার কাছে অর্থ ও ক্ষমতাই সব, অন্য কিছু নয়। জ্ঞানবিদ্যা তুচ্ছ। বন্ধুত্ব মূল্যহীন।

যিশু অন্য স্বভাবের মানুষ। জ্ঞানবিদ্যা নিয়ে সর্বদা নিজেকে ব্যস্ত রাখে। জ্ঞানবিদ্যা ও মানুষকে সমান ভালোবাসে। সহপাঠী হলে তো কথাই নেই। তবে সবখানে নয়। অনেক না-বলা কথা জমা থাকে কারও কারও মনে। কারও মনে দুঃখের কথা, আবার কারও মনে অপমানের কথা।

সবুজ যিশু ফেসবুকের পাতায় রূপা কামালকে বন্ধুত্বের প্রস্তাব পাঠায়। জবাবের অপেক্ষায় থাকে। একদিন দুদিন করে সপ্তাহের পর সপ্তাহ যায়। মাসের পর মাস যায়। জবাব আর আসে না। যিশু আবার বার্তা প্রেরণ করে। জবাবের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করে। অপেক্ষা শেষ হয় না। কত দিন অপেক্ষা করা যায়? তা-ও আবার ফেসবুকে বার্তা পাঠিয়ে। বার্তা বাতাসে মিশে যায়। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সেই কবিতা মনে পড়ে—

‘ভালো আছি ভালো থেকো

আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।’

আকাশের কোনো সীমা নেই, চিঠিরও কোনো জবাব নেই। মহাকালের গুদামে জমা থাকে। মহাকালের গুদামের অপর নাম স্মৃতি। স্মৃতির ভান্ডার দিন দিন বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হতে থাকে। আবার সেই পুরোনো স্মৃতির ভান্ডার থেকে কিছু কিছু স্মৃতির টুকরো আকাশে-বাতাসে উড়ে আসে। কিছু কিছু স্মৃতি বাধাগ্রস্ত হয়, কিছু কিছু স্মৃতি অনায়াসে ফিরে আসে। সে রকম কিছু স্মৃতি যিশুর মনোজগতে ফিরে আসে। যিশু নিজেই কল্পনায় ১৯৮০-এর দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সবুজ ক্যাম্পাসে ফিরে যায়। পুরোনো দিনের অনেক ঘটনা জীবন্ত হয়ে দেখা দেয়। মানুষের মন ও স্মৃতি কতই না রহস্যময়। মনের গতিবিধি বোঝা কঠিন। কোনো একটা অজুহাত পেলেই মন অনেক দূরে চলে যায়। সেই পুরোনো দিনে যিশু ও রূপার আনন্দময় স্মৃতি জেগে ওঠে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবনের প্রথম দিকে যিশু অনেক রঙিন স্বপ্নে বিভোর থাকত। সহজে কাউকে বিশেষ পাত্তা দিত না, বিশেষত মেয়েদের। কোন ধরনের মেয়ে তার পছন্দ, নিজেই জানত না। এমন মনের অবস্থায় অনেক মেয়ে যিশুর সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করে। সহপাঠীদের মাঝে যিশুর একটা খ্যাতি ছিল। একদিন ক্লাসে ফরাসি বিপ্লব সম্পর্কে অনেক তথ্যপূর্ণ আলোচনা উপস্থাপন করে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে। ইউরোপে, বিশেষ করে ফরাসি দেশে সমাজবিজ্ঞানের জন্ম কেন হলো এবং সমাজবিজ্ঞানের জন্মে ফরাসি বিপ্লবের ভূমিকা নিয়ে আকর্ষণীয় আলোচনা যিশুকে সহপাঠীদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। মেয়েদের মধ্যে রূপা বিশেষ কায়দায় যিশুর মনোজগতে স্থান পেতে তৎপর হয়। রূপা কথাবার্তা, চালচলন, পোশাক, পরিচ্ছদ, হাবভাব সব দিক থেকে নিজেকে আলাদা করে দেখাতে চায়। কিছুটা স্বভাবগত কারণেও সে অনেকটাই স্বতন্ত্র। তাদের পরিবার পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে, মানে ঢাকায় এসেছে। ভারত বিভাজনে যত লোকের প্রাণহানি হয়েছে, সম্পদ নষ্ট হয়েছে, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশবিভাজনে এমন ক্ষতি ও ক্ষত হয়নি। এমন ক্ষতি ও ক্ষত মানব মনে ও সংস্কৃতিতে দীর্ঘস্থায়ী যন্ত্রণার জন্ম দিয়েছে। এমন যন্ত্রণার ক্ষতচিহ্ন পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত সব বাঙালির সংস্কৃতিতে বিদ্যমান। রূপারাও এই ক্ষতচিহ্ন বহনকারী। ঢাকার বাঙালিরা এমন ধরনের বাঙালি সংস্কৃতি বিষয়ে সজাগ। তাই যিশুর সঙ্গে রূপার একটা অদৃশ্য সাংস্কৃতিক দূরত্ব আছে। মফস্বল থেকে আসা মানুষের সঙ্গে শহর ঢাকার মানুষের একটা দূরত্ব আছে। তারপরও মিলন ও বন্ধুত্ব হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন সমাজবিজ্ঞান বিভাগে তুলনামূলকভাবে ছাত্রের চেয়ে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি। তা ছাড়া বলা হয় সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে সুন্দরীদের বিয়ে অনেক আগেই হয়ে যায়। তাই সমাজবিজ্ঞান বিভাগে সুন্দরী ছাত্রীদের অধিকাংশই বিবাহিতা। স্বামী ধনাঢ্য ব্যক্তি অথবা সম্পদশালী পরিবারের সন্তান। বাংলাদেশের মতো উঠতি দেশে হঠাৎ সম্পদের মালিক হওয়া পরিবারে অঢেল অর্থ-সম্পদ থাকলেও শান্তি তেমন থাকে না। অর্থের অহংকার ও ক্ষমতার দাপটে শান্তির পলায়ন ঘটে। সেসব পরিবারের পুত্রবধূ বা কন্যা হয় কিছুটা উগ্র ধরনের, হাবভাব বা আচার-আচরণ, সংস্কৃতি, এককথায় জীবনপদ্ধতি আলাদা। তারা এক পুরুষে আনন্দ পায় না। তাদের সংস্কৃতিতে বহু পুরুষের স্বাদ গ্রহণও অন্যায় কিছু নয়। চিন্তা করে, হয়তো সেটাই আধুনিকতা। সেই ধরনের আধুনিক বিবাহিত অনেক ছাত্রী সমাজবিজ্ঞান বিভাগে দেখা যায়। সেসব নারীর অজগর দৃষ্টি থেকে অনেক সময় অধ্যাপকরাও রেহাই পান না। সেখানে তরুণ ছাত্ররা তো স্বাভাবিক শিকারে পরিণত হয়ই। অনেকে আবার এমন নারীর সন্ধানে থাকে। আবার অনেকে ঘটনাচক্রে বা পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে তাদের সঙ্গে মেলামেশা করে। বুদ্ধিদীপ্ত ছাত্র হিসেবে যিশু অনেকের দৃষ্টিতে এসেছে। একই ক্লাসের কয়েকজন বিবাহিত সুন্দরী ছাত্রীর সঙ্গে যিশুর মেলামেশা ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হয়েছে। অবিবাহিত অনেক ছাত্রীই বিষয়টা সহজভাবে নিতে পারছে না। অনেকে ইশারা-ইঙ্গিতে যিশুকে কটাক্ষ করেছে। যিশু সেটা আমলে নেয়নি। তাতে কি, সুন্দরীরা যিশুকে আরও কাছে টানে। যিশুকে নিয়ে টিএসসিতে আড্ডা জমে। বলাকাতে সিনেমা দেখতে যায়। মাঝে মাঝে চায়নিজ হোটেলে খেতে যায়। এসব করে শারমিন নাহার। সে দামি পোশাক পরে। দামি গাড়ি চালায়। সে একজন বয়স্কা ধনাঢ্য বণিকবধূ। শারমিন নাহারের সঙ্গে যিশুর ঘনিষ্ঠভাবে চলাফেরা অনেকের নজরে আসে। শারমিন নাহারের অভিলাষ শুধু গেলমান সংসর্গ। তার স্বামীর অন্য রমণীতে আসক্ত। বহুগামী।

আলগিন দিলতাজ সেই দলের আরেক বিবাহিত রূপসী। তার স্বামী একজন দুর্নীতিবাজ আমলা। তার অর্থের অভাব নেই। তবে তার উদ্দেশ্য অন্য। যেকোনো উপায়ে ভালো ফলাফল করতে হবে। ছলে-বলে-কৌশলে। পরীক্ষায় ভালো ফল করতে যা কিছু করা দরকার, সবকিছু করতে তার কোনো সংশয় ও দ্বিধা নেই। তার কাছে অর্থ কোনো বিষয় নয়। প্রয়োজনে অভিনয়ও করতে পারে। এমনকি শরীরও খুলতে পারে। সহপাঠী বা শিক্ষক যখন যাকে প্রয়োজন, পরীক্ষায় ভালো করতে যা খুশি করতে কোনো বিলম্ব হয় না। যিশু যাবে কোথায়। সবাই তাকে চায়। আড্ডাতেও চায়, আবার বিছানাতেও চায়। অন্যদিকে এরই মধ্যে সেই আলগিন দিলতাজ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে একজন শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন অধ্যাপক। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন টিভি পর্দায় টক শোতেও দেখা যায়। সুবিধার জন্য সব জায়গায় যায়। তারা সবখানে যাবে। যখন যেখানে প্রয়োজন। তারা বাজার অর্থনীতি ভালো বোঝে। যখন যাকে দরকার ব্যবহার করে।

শারমিন নাহার ও আলগিন দিলতাজের মতো সুন্দরী ও গেলমানশিকারির সঙ্গে যিশুর মতো বুদ্ধিদীপ্ত সহজ-সরল ছাত্রের খোলামেলা মেলামেশা সহপাঠীদের অনেকেই মেনে নিতে পারছে না। তবে মুখ খুলে কেউ কিছু বলে না। অন্যদের মনে ও মগজে যা-ই থাকুক, রূপা বিষয়টা কেন যেন চুপচাপ মেনে নিতে পারছে না। সে অনেকবার ভাবছে যিশুকে কিছু বলবে। আবার ভাবে বলবে না। এমন করতে করতে একদিন রূপা সুযোগমতো একা পেয়ে যিশুকে বলে, ‘তুমি কেন এসব বিবাহিত মেয়ের সঙ্গে চলাফেরা করো?

: কেন?

: আমরা আছি না?

: তোমরাও আসো।

: তোমরা কী?

: তুমি? বেশ।

: আমি তোমাকে পছন্দ করি।

: চমৎকার। বেশ ভালো। তবে আমাকে পছন্দ করার কী আছে?

রূপা : তুমি একজন ভালো ছাত্র। তোমার একটা আলাদা জীবন হবে। চমৎকার ভবিষ্যৎ।

: তুমি বুঝলে কীভাবে?

: অন্তর দিয়ে।

: এসব আবেগ।

: পরকীয়া বাদ দাও। বাস্তবে ফিরে আস।

: আমি তো কোথাও যাইনি। এখানেই আছি।

: তুমি তো জান না। সেসব পরবধূ দুধের মাছি। সময় শেষ হলেই উড়াল দেবে। হাঁ করে দেখবে। পাখি উড়ে গেছে।

: আমি বোকা। তবে মৌসুমি পাখিও মাঝে মাঝে ধরা পড়ে।

: তুমি অনেক বুদ্ধিমান। দার্শনিক কথাবার্তা ভালোই বলতে পার। কথাগুলো ভেবে দেখ। পরে দেখা হবে। বাই।

রূপা চলে যাওয়ার পর যিশু আবার চা পান করে। সিগারেট ধরায়। সিগারেট জোরে জোরে টান মারে। যিশু ভাবতে থাকে। রূপা যা বলছে সবই সত্য। নগরে বেড়ে ওঠা মেয়েদের দুনিয়াবি বুদ্ধি অনেক প্রখর। এরা আবেগের চেয়ে বাস্তবিক। এরা যত না সামাজিক তার চেয়ে অনেক বৈষয়িক। গ্রাম থেকে আসা মানুষ জীবনকে পারিবারিক মাপকাঠিতে দেখতে চায়। শহুরে মানুষ জীবনকে বিচার করে গাণিতিকভাবে। গ্রাম থেকে আসা প্রত্যেক শিক্ষিত মানুষ দ্বিখণ্ডিত। তাদের অর্ধেক থাকে কর্মক্ষেত্রে আর অর্ধেক থাকে সেই গ্রামে। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশে নগরবাসী অনেকের দুটি ঠিকানা থাকে—স্থায়ী ও অস্থায়ী। যিশুও মনের দুই ঠিকানা ও চিন্তা নিয়ে ভাবতে থাকে। সময় হলেই মৌসুমি পাখি উড়ে যাবে। পাখি উড়ে যাবে। মনে পড়ে রূপার সেই কথা ‘আমরা আছি না। বিবাহিত মেয়েদের সঙ্গে কেন চলাফেরা কর? আমি তোমাকে পছন্দ করি।’ যিশু ভাবুক মানুষ। ভাবতে থাকে। সময় নিজের গতিতে চলতে থাকে। কিছুই থেমে থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিল, মিটিং চলতেই থাকে। মিছিল আসে। মিছিল যায়। স্লোগান চলতে থাকে। চারদিকে নানা ধরনের শব্দ।

একদিন ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ায় রূপা ও যিশু একা একা আলাপ করে। রূপা বলে, দেখ যিশু তোমার সঙ্গে আমার একটা মিল আছে।

: কী মিল আছে?

: দূরত্ব!

: কী দূরত্ব?

: তুমি বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণ থেকে এসেছ। আর আমি ওপার বাংলা থেকে। দূরত্বে প্রায় সমান।

: তাই তো, দূরত্বে সমান।

: চল আমরা এক হই।

: কীভাবে?

: কীভাবে মানে? আমরা বিয়ে করব।

: কাকে বিয়ে করবে?

: কাকে মানে? তোমাকে।

: আমাকে? কেন?

: তোমাকে। তুমি সহজ-সরল।

: কীভাবে বুঝলে?

: কথা দিয়ে চেনা যায়।

: শুনলাম তোমরা তিন বোন। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। তুমিই শুধু...। কেমন বর চাও?

: কেন? তুমি তো আছই। ঠিক তোমার মতো মানুষ চাই।

যিশু বলে, আমি তো পরিবারে সবার ছোট। পরিবারের সবার মতামতের মূল্য দিই। একা কোনো কথা দিতে পারব না।

রূপা বলে, তোমার মতামতের মূল্য আছে না?

যিশু : তোমার কথায় কর্তৃত্বের ইঙ্গিত।

রূপা : আমার দুলাভাইয়ের সঙ্গে এ নিয়ে আমার বিরোধ। পুরুষের একক কর্তৃত্ব এখন মেয়েরা মেনে নেয় না। মেয়েরা নিজেদের মতামতও দিতে চায়।

: তোমার যেহেতু ভাই নেই, তোমার কথাই পরিবারে প্রাধান্য পাবে। তাই না?

: ভাই আর বোন কী। মানুষ মানুষই।

: ঠিকই বলছ। তোমার মতো মেয়েই দরকার।

: আবার মেয়ে। বল মানুষ। আমরা মানুষ চাই। মানুষ হতে চাই। নারী নয়।

: তোমার জবাব এখন দিতে পারব না। আলাদা করে জানাব।

: ধন্যবাদ। বিয়ে করবে তুমি। জবাব দেবে তুমি। তোমার মতামতই আমার দরকার।

: আমি সমাজে থাকি। গ্রাম থেকে আসা মানুষ। নানা দিক বিবেচনা করতে হয়।

রূপা বলে, ওপার বাংলার মানুষ হয়তো কিছুটা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী। কিছুটা বাস্তববাদী।

কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক। বলা যায় আধুনিক।

: আমরা সামাজিক। পরিবার ও সমাজ সমান গুরুত্বপূর্ণ। পারিবারিক ও সামাজিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ত্যাগ করা অত্যন্ত কঠিন।

রূপা হাসে, সত্য বটে। সমাজের ওপর ব্যক্তিকে প্রাধান্য দিতে না পারলে সমাজের কোনো পরিবর্তন আসবে না। পরিবর্তনই আধুনিকতা।

: দেশ পরিবর্তনও কি আধুনিকতা? যেমন তোমরা পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে ঢাকায় এসেছ। আবার অনেকে বাংলাদেশ ছেড়ে ইউরোপ-আমেরিকাও যাচ্ছে। আধুনিক হচ্ছে? বেশ তো। রূপা বলে, স্বাধীনতা ও আধুনিকতা হাত ধরাধরি করে চলে। যিশু বলে, স্বাধীনতা ছাড়া তো আধুনিকতা অর্জন করা যায় না। আমরা স্বাধীন বলেই তোমরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকায় এসেছ। স্বাধীনতার একটা অন্য ধরনের মূল্য আছে।

রূপা বলে, ঠিক বলছ। পরাধীন মানুষ আসলে কোনো মানুষই নয়। পরাধীন মানুষের পূর্ণ মনুষ্যত্ব থাকে না।

যিশু হেসে বলে, সত্য সবাই বলেন না। আধুনিকতার সঙ্গে ভণ্ডামির একটা সম্পর্ক আছে। মানে পশ্চিমা সংস্কৃতির একটা গোপন দিক আছে। নিজের নারীর সঙ্গে দ্বিমুখী আচরণ। জাতির সঙ্গে প্রতারণা।

রূপা বলে, আমরা ভালো থাকতে চাই। দেশের মাটি ও মানুষকে ভালোবাসতে চাই।

: মানুষকে ভালোবাসা বড় কঠিন। দেশকে ভালোবাসা আরও কঠিন। যেমন পদানত ভারতে ব্রিটিশকে ভালোবেসে কি ভারতকে ভালোবাসা যায়? তাই তো বলি ব্রিটিশপ্রীতি ও দেশপ্রীতি এক ধারায় চলে না।

তোমার রাজনীতি বাদ দাও। নিজেকে নিয়ে চিন্তা কর। নিজের উন্নতির সঙ্গে দেশের উন্নতি। অর্থ ছাড়া জীবন অর্থহীন। জীবনকে অর্থময় কর। সংসার কর।

যিশুর দৃঢ় উচ্চারণ, তুমি যা-ই বল না কেন রাজনীতিই আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছে। এই বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। আসলে স্বাধীনতা ছাড়া জীবনের কোনো অর্থ হয় না। স্বাধীনতাই আসল। তোমার প্রস্তাব ভেবে দেখব—স্বাধীনভাবেই। জয় বাংলা।

সময় নিজের গতিতে চলতে থাকে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক হাওয়া বইতে থাকে। অনেক ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায় শিক্ষাজীবনে। জীবনযাত্রা বদলে যায়। চিন্তাভাবনা পাল্টে যায়। অনেকে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমায়। অনেকে কথা রাখে, অনেকে রাখে না। জীবন থেমে থাকে না। যিশুও ভাবতে যাকে। রূপাকে বিয়ে করে কী লাভ। দুনিয়াতে বিয়ে বিষয়টা হিসাব করেই করতে হয়। না হলে সমূহ বিপদ। মানবজীবনের ভবিষ্যৎ অনেকটা বিয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ভবিষ্যৎ বংশধর তো বিয়েরই ফসল। এ দেশে ভারত থেকে আগত মানুষের সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলাদেশের সংস্কৃতির একটা সূক্ষ্ম তারতম্য আছে। আবার রাজনীতিতে তারা তো এক প্রকারের উদ্বাস্তু। তদুপরি রূপার কোনো ভাইও নেই। যিশুর বিবেচনায় এ বিয়েতে কোনো সুফল ও সুফসল কোনোটাই নেই। সাত-পাঁচ ভেবে না-বোধক জবাব পায়। তাই নানাভাবে অনেক দিন বলে যায়।

যিশু আর কোনো দিন রূপার প্রস্তাবের জবাব দেয়নি। জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি তা নয়, কৌশলে বিষয়টা এড়িয়ে চলে। যিশু এড়িয়ে চললে কী হবে, রূপা তো আর ছাড়ার পাত্রী নয়। ভারতফেরত নারী। বুদ্ধি ও সংস্কৃতিতে অগ্রসর। সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সময় ও সুযোগ পেলেই একটা না একটা খোঁচা দেবেই। মনে হয় ভেতরে প্রতিশোধের আগুন সুপ্ত আছেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক পরিবেশ সর্বদা উত্তপ্ত ১৯৮০-এর দশকে। তখন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নানামুখী তৎপরতা। তবুও প্রেম-ভালোবাসা থেমে নেই। বিয়ের ব্যাপারে মেয়েরা অনেক অগ্রসর ও সচেতন। বিশেষত ওপার বাংলার মেয়েরা অধিকতর অগ্রসর। গ্রাম এলাকা থেকে আগত ছাত্ররা তাদের প্রথম শিকার। আজিজ সমুদ্র এমন একজন ছাত্র। দেখতে শুনতে চমৎকার। গৌর বর্ণ। দীর্ঘ দেহী। মিষ্টি ভাষী। যশোরবাসী। কলকাতার প্রভাব যশোরবাসীর ওপর অনেকটা কার্যকর। আজিজ সমুদ্রও এর ব্যতিক্রম নয়। রূপার নজরে পড়েছে। যেন অজগরের নিশ্বাস। উপায় কী, ধরা দিয়েছে। তবে রূপা যিশুকে আঘাত করতে ভোলে না। যিশু কোন দিকে যায় আর কার সঙ্গে কথা বলে পারলে সবই পরোক্ষে অনুসরণ করে। প্রতিশোধের আগুন কি জ্বলতেই থাকে? রূপা যতই যিশুর ছায়া অনুসরণ করুক না কেন, কেউ কারও চেয়ে কম যায় না।

যিশু একদিন তার আর এক বান্ধবীকে সঙ্গে টিএসসির ঘাসে দীর্ঘক্ষণ আড্ডা দেয়। রূপা মনে মনে ভাবে বাছাধন চিনতে পারলে না, কত ধানে কত চাল। আমি এই ক্যাম্পাসে থাকতে তুমি অন্যকে নিয়ে প্রেম করবে, আর আমি বসে বসে দেখব তা তো হবে না। মজা দেখাচ্ছি। এমনি ভাবতে ভাবতে দিন যায়। সপ্তাহ যায়। সময় পাল্টায়। প্রকৃতির চেহারা পাল্টায়। প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে রূপার স্বভাবও পাল্টায়। চিন্তাও পাল্টায়। দুষ্টবুদ্ধি পাকাতে থাকে। নানা ফন্দি আঁটে। দূর থেকে যিশুর গতিবিধি লক্ষ করে।

একদিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির দক্ষিণ মাঠে যিশু বান্ধবী নিয়ে খুব কাছাকাছি বসে হাতে হাত রেখে একাগ্রচিত্তে চোখে চোখ রেখে বসে আছে। হঠাৎ রূপা এসে হাজির। আর গালভরা মায়াবী হাসি দিয়ে বলে কয়জনের সঙ্গে প্রেম চলে? আমরা কি এসব দেখতে পাই না। আমার চোখে ধুলা দেওয়া এত সহজ নয়। যেখানেই যাও হঠাৎ আমি হাজির হব। সাধু হওয়ার ভান করো না, বুঝলে? প্রেম একদম ছাড়িয়ে দেব।

যিশু ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়। রাগত স্বরে বলে, রূপা তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এসব কী আজেবাজে বলছ? বন্ধুদের সঙ্গে কি খোলামনে আলাপ করতে পারব না? তাতে তোমার কী?

: বাহ! বাহ! কী চমৎকার কথা। কয়জনকে তুমি কথা দেবে? সেদিন না তুমি আমার সঙ্গে কী রঙের রঙের আলাপ করেছ। ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ায় বসে, ভুলে গেলে? তুমি ভুললেও আমি কিন্তু ভুলিনি। তবে ভুলতেও দেব না। মনে রেখ আমি তেমন মেয়ে নই।

: আরে রূপা থাম, থাম। আমি যিশু তোমাকে ভালো করে জানি। তবে মনে করো না আমরা এখানে শুটিং করতে এসেছি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমি ছাড়ব না।

: হাসালে। কে কাকে ছাড়ে আর কে কাকে রাখে। জগতের সবাই জানে মেয়েদের সঙ্গে কারা ঝামেলা পাকায়। সাবধান আমি বললাম, এই কথা বলে রূপা হন হন করে চলে যায়। রূপা চলে গেলে কী হবে যিশুর অবস্থা প্রাণ যায় যায়। পাশে বসা বান্ধবী তো তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। যিশু অসহায় বোধ করে। মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করে। জানে দুঃসময়ে মাথা ঠান্ডা রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। যিশু মুখ বন্ধ করে বসে থাকে। চুপচাপ সিগারেট টানে। আঃ কী শান্তি!

রূপার দাপটে এখন ক্যাম্পাসে টেকাই দায়। যিশু কোনোমতেই শান্তিতে সময় কাটাতে পারে না। যিশু চিন্তা করে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করার কোনো মানে হয় না। সংগ্রামই জীবন। জীবন মানে যুদ্ধ। যুদ্ধ আর প্রেম সমান। এসব ক্ষেত্রে কোনো দয়া-মায়া, অনুরাগ বা দুর্বলতা চলে না। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কৌশল নিতে হবে। কী কৌশল নেওয়া যায়। এমন কৌশলের কথা চিন্তা করতে করতে মনে এসে যায় চাণক্যের কথা। চাণক্যনীতি অবলম্বন করতেই হবে। যিশুর মুখে আস্তে আস্তে হাসির রেখা দেখা যায়। মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মনে মনে বলে পেয়ে গেছি। উপায় বের হয়েছে। কৌটিল্যকে ধন্যবাদ। প্রেম মানে যুদ্ধ। যুদ্ধ মানে কৌশল। কৌশল মানে বিজয়। বিজয় মানে সফলতা। সফলতা এখন হাতের মুঠোয়। যিশুর মুখেও এখন বিজয়ের হাসি। মুখে ও চোখে উৎফুল্ল ভাব। এমনিতেই যিশু ভাবুক। তাতে আবার নতুন ভাব।

কৌটিল্যবুদ্ধি নিয়ে যিশু ভাবতে থাকে। ভাবতে ভাবতে রূপার মুখ মনের আয়নায় দেখতে পায়। রূপাকে এবার আনতেই হবে কৌটিল্য কৌশলে। চালাকি কাকে বলে। যেভাবেই হোক রূপাকে চাই। এ কৌশল নিয়ে যিশু একদিন সকাল সকাল লাইব্রেরির সামনে দাঁড়ায়। বেশ হাসিমুখে রূপা এগিয়ে আসে। হাসতে হাসতে যিশু চলে, ‘এই মহারানি শুভ সকাল। তোমাকে দেখে দিনটা আজ রাজার হালেই যাবে মনে হচ্ছে। কী ভাগ্য আমার। সাতসকালেই তোমার মুখদর্শন।’

: এই যিশু থাম, থাম। এসব তেল দেওয়া রাখ। আসল উদ্দেশ্য বল। প্রেম করতে করতে হয়রান নাকি?

: কী যে বলে না আমার রানি। প্রেমে কোনো ক্লান্তি নেই। প্রেমে আনন্দ। প্রেমে শান্তি। প্রেমেই তৃপ্তি। এবার তোমাকেই চাই। শুধু তোমাকেই চাই। বুঝলে হে রানি।

: হে আমার রাজকুমার ধন্যবাদ। তোমার সেসব গৃহিণীর কী হবে তাহলে? সেই শারমিন নাহার, আলগিন দিলতাজদের কী হবে?

: দেখ রূপা, আমি সাগরসন্তান, সাগরতীরে আমার জন্ম। সবকিছু হজম করার ক্ষমতা আমার আছে। চল কক্সবাজার যাই। চল ঘুরে আসি। মনও ভালো হবে শরীরও জুড়াবে। চল কালই যাই। তোমাকে পেলে সবই ভুলে যাব।

এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। এমন কথা শোনার জন্যই রূপা অপেক্ষা করছিল। রূপা ভাবে সুযোগ হাতে এসে গেছে। যিশুর পাতানো ফাঁদে স্বেচ্ছায় ধরা দেয়। রূপা বিনা বাক্যে রাজি হয়ে যায়। যিশুর কৌটিল্য কৌশল সফল হয়। পরের দিনই রূপা যিশুর সঙ্গে কক্সবাজারের উদ্দেশে যাত্রা করে।
 

Link copied!