আষাঢ় মাস তখন। কিন্তু ব্যাঙের ডাক আর বৃষ্টির টাপুর টুপুর শব্দকে ভুলিয়ে দিয়েছে তীব্র দাবদাহ। চারদিকে লু হাওয়া বইছে। গ্রামের লোকেরা বার কয়েক ঘাম গোসল দিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে। আকাশে ছিটে ফোটা মেঘেরও দেখা নেই। প্রকৃতি এ কীসের প্রতিশোধ নিচ্ছে কেউ জানে না।
একটু স্বস্তি পেতে বের হয়েছি সবুজের কাছাকাছি। যতই সবুজের পরিমাণ বাড়ছে ততই শীতল হচ্ছি। বেশ কিছু দূর যেতেই মনের ভেতর অন্যরকম ভয়ের অনুভূতি। চোখের সীমানায় কোনো জনবসতি নেই। চারদিকে ঘন সবুজ শালবন। বনের একেবারে ভেতরে চলে এসেছি। খানিক পরেই ধূতি পরা এক বৃদ্ধের দেখা মিলল। কথা হতেই নাম বললেন বুদরে মারডি। তার বয়স সত্তরের ওপরে। নামের শেষে টাইটেল শুনেই বুঝে গেলাম আদিবাসী সাঁওতাল।
এ শালবনটি চলে গেছে ভারতে সীমান্ত অবধি। সীমান্তের কাঁটা তারের বেড়া আদিবাসীদের পৃথক করলেও পৃথক করতে পারেনি শালবনকে। বনের নামেই দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী এ গ্রামটির নাম ‘কুকরী বন’।
কথা বলতে বলতে চলে আসি বুদরে মারডির বাড়ির সামনে। বনের পাশেই তার বাড়িটি। ছনে ছাওয়া গায়ে গায়ে লাগোয়া তিনটি মাটির ঘর। ভেতরটা বেশ পরিচ্ছন্ন। সাঁওতালরা তাদের বাড়ি বেশ পরিচ্ছন্ন রাখেন। বাঁশের বেড়া সরিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই একটি শিশু ‘দিকু’, ‘দিকু’ বলে ঘরের মধ্যে চলে গেল। সাওঁতালী ভাষা বলে কিছুই বুঝতে পারলাম না।
বুদরে মারডি জানালেন, সাঁওতালরা তাদের ভাষায় বাঙালিদের ‘দিকু’ বলে ডাকে। এখানের বাঙালিদের সঙ্গে তাদের ভালো সম্পর্ক থাকলেও সাঁওতাল বিদ্রোহের সময়ে দিকুদের তারা শক্র মনে করতেন। সে সময়ে বাঙালি বা দিকুরাই ছিল জমিদার, মহাজন, দোকানদার, রেলওয়ে শ্রমিক ও ঠিকাদার। যারা কম-বেশি সকলেই সাঁওতালদের ওপর নির্যাতন করত।
শিশুটিকে নিয়ে ঘরের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে বুদরে মারডির স্ত্রী চানসুরুজ টুডু। তার হাতে শোভা পাচ্ছিল বেশ কয়েকটি শাখা।
শাখা কেন পড়েন? প্রথমে মুচকি হাসি, অতঃপর উত্তরে বলেন, ‘ছাংকা কুমি আবু অনাব কুশিয়া’ অর্থাৎ হাতের মধ্যে আমরা শাখা পড়তেই পছন্দ করি। ঘরের মেঝেতে বেছানো মাদুরে বসতে বসতে এক গ্লাস পানি চাইলাম। কিন্তু পানি না দিয়ে দুইজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আবারও জানতে চাইলেন সত্যিই পানি খাব কিনা। সম্মতি পেয়ে তাদের চোখে-মুখে আনন্দের ঝলক ছড়িয়ে পড়ে।
পরিষ্কার একটি গ্লাসে পানি এনে দেন চানসুরুজ টুডু। পানি নিয়ে এ রকম অবাক করা আচরণের কারণ প্রথমে বুঝতে পারলাম না। পরে জানলাম, এ অঞ্চলের অধিকাংশ বাঙালি মুসলমানরা সহসা আদিবাসীদের বাড়িতে কিছু খায় না। পাছে তাদের জাত চলে যায়। এ নিয়ে মুচকি হেসে বুদরে মারডি বলেন, ‘যারা হাড়িয়া খেতে আসেন, তাদের অবশ্য জাত যায় না।’
এ বাড়ির উঠানের এক কোণায় মাটি দিয়ে তৈরি উঁচু একটি জায়গা চোখে পড়ল। পাশেই একটি জুঁই ফুলের গাছ। জানা গেল এটি বোঙ্গার উদ্দেশে প্রার্থনার স্থান।
বুদরে মারডি জানায়, তারা প্রকৃতি পূজারি। তাদের দেবতাকে তারা ডাকে-বোঙ্গা। বোঙ্গার কোনো আকার নেই। তারা বিশ্বাস করে ভালো-মন্দ নিয়ন্ত্রণ করেন তিনিই। সাঁওতালদের বিশ্বাসে বোঙ্গার প্রভাব অসীম। তাই প্রতিদিন গোসল সেরে ওই উঁচু জায়গায় কিছু পানি ছিটিয়ে সাঁওতালরা বোঙ্গার উদ্দেশে প্রার্থনা করেন।
আদিবাসী এ পরিবারটির মতোই সকল সাঁওতালরা খুবই উৎসবপ্রিয়। তাদের রয়েছে বারো মাসে তেরো পার্বণ। সাঁওতালদের বছর শুরু হয় ফাল্গুন মাসে।
উৎসব নিয়ে যখন কথা বলছি তখন বুদরে মারডির চোখে মুখে হাঁসির ঝলক। কী কী উৎসব হয়? এক নিঃশ্বাসে তিনি বলে যান নববর্ষে ‘স্যালসেই’, চৈত্রে ‘বোঙ্গাবোঙ্গি’, বৈশাখে ‘হোম’, আশ্বিনে ‘দিবি’, পৌষে ‘সোহরাই’ উৎসব।
আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না হলেও সাঁওতালরা এখনো উৎসবগুলোতে আনন্দ করে প্রাণভরে। নাঁচ-গান আর হাড়িয়া ছাড়া তাদের কোনো উৎসবই প্রাণ পায় না।
গল্প যখন জমে উঠছিল তখন কয়েক বাড়ির ওপাশ থেকে মাদলের চমৎকার তাল মাতাল শব্দ কানে আসে। জানা গেল বিয়ের উৎসবে নাচ-গান চলছে সেখানে। বিয়ের কথা শুনে আগ্রহ নিয়ে চলে যাই বিয়ে বাড়িতে।
বিয়েবাড়িতে প্রচলিত সাজসজ্জার লেশ মাত্র নেই। গাছের তাজা পাতা দিয়ে বাড়ির উঠোন প্রকৃতির কায়দায় সাজানো। মাদলের তালে মেয়েরা হাত ধরাধরি করে নাচছে। বাড়িতে ঢোকার মুখেই খালি জায়গায় চোখে পড়ল একটি ছোট গর্ত। গর্তের তিন পাশে ৩টি ধনুক দাড় কারানো। প্রশ্ন করতেই পেছন থেকে গোত্রের মহত বা পারগানা (গোত্র প্রধান) জানালেন, এটি ‘দা বাপলা’র (গ্রাম পূজার) স্থান।
অন্যান্য আদিবাসীদের মতো সাঁওতালদের পরিবারিক ও সামাজিক জীবনের সবখানেই মহত বা গোত্র প্রধানকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। এখানকার গোত্রের মহতের নাম ‘শাহা বাসকি’। তিনি চমৎকারভাবে তুলে ধরে বলতে থাকেন সাঁওতালদের বিয়ের কিছু আচার।
বিয়ের পূর্বে দা বাপলা বা গ্রামপূজা বাধ্যতামূলক। ছেলে বা মেয়ের মা, খালা, ফুফুরা (কাকি) গ্রাম পূজা করে থাকেন। দেবতার আশীর্বাদ নেওয়াই এ পূজার উদ্দেশ্য। ছোট একটি চারকোনা গর্ত করে তার তিন দিকে তিনটি ধনুক দাড় করিয়ে সিঁদুর দিয়ে এই পূজা করতে হয়। গর্তের মধ্যে দিতে হয় ‘সিটাকা’(এক টাকার কয়েন), চাউলি (অল্প চাউল), হানডি ( (হাড়িয়া)। শুধু আদিবাসী সংস্কৃতিতেই নয় সাঁওতালদের ধর্মাচারের সঙ্গেও অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে আছে হানডি বা হাড়িয়া।
মহতসহ সাঁওতালদের নৃত্য দেখতে বিয়েবাড়িতে প্রবেশ করি। অপরিচিত চেহারা দেখে হঠাৎ নৃত্য ও মাদলের শব্দ থেমে যায়। তারা তাদের ভাষায় কথা বলতে লাগল। সে কথাগুলো খানিকটা বোঝার চেষ্টা করি। এই ফাঁকে তাদের ছবি তোলার প্রস্তুতিও নিচ্ছি। এমন সময় গান্দি মুরমুসহ বেশ কয়েকজন ছবি তুলতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
তাদের এই অগ্নিশর্মা আচরণের কারণ ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। এগিয়ে এলো গোত্র প্রধান। পরে জানলাম বেশ কিছুদিন আগে স্থানীয় কয়েকজন এনজিও প্রতিনিধি নানা সুবিধার আশ্বাস দিয়ে সাঁওতালদের ছবি তুলে নেয়। পরে তারা জানতে পারেন তাদের ছবি দেখিয়ে, তাদের টিকিয়ে রাখার কথা বলে বিদেশ থেকে লাখ লাখ টাকা পেয়েছে ওই এনজিওর কর্তা-ব্যক্তিরা। ফলে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে শুধু এনজিও কর্মকর্তাদের। কিন্তু সাঁওতালদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি চুল পরিমাণ।
গান্দি মুরমুর সাফ কথা, তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন না ঘটুক। কিন্তু তারা তাদের জাতিকে আর বিক্রি হতে দেবে না।
পরিবেশ শান্ত হলে কথা হয় তার সঙ্গেও। খানিক পরেই গান্দি একটি বড় ঢোল বাজিয়ে নৃত্য শুরু করেন। সাঁওতালী মেয়েরা তখন দল বেধে চমৎকার ভঙ্গিতে নাচতে থাকেন। ছেলেরা তুনডা (মাদল), তামাক (ঢোল), বানাম (হারমনিয়াম), তিরীয়া(বাঁশি), করতাল (মন্দিরা) বাজাতে থাকেন।
এদিকে বাড়ির মধ্যে একজন বৃদ্ধা পাতা নিয়ে ব্যস্ত। কাছে গিয়ে তার শিল্প কর্মে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। শালপাতা দিয়ে চমৎকার কায়দায় তৈরি করা হচ্ছে হাড়িয়া খাওয়ার ‘খোড়া’। তালমাতাল অবস্থায় এগিয়ে এলো ওই গ্রামের দুলালী মারডি। বললেন, ‘বাবু, হাড়িয়া নিউইয়া, ডালমারা হইওয়া’ (আজ হাড়িয়া খাওয়া হবে, নাচগান ও অনেক আনন্দ হবে)।
ক্রমেই সাঁওতালদের মাদলের শব্দ বাড়তে থাকে। মনে হলো কোনো এক আনন্দময় সুখী জাতির মাঝে মিশে আছি। নানা অভাব-অনটনের মাঝেও আনন্দ করতে পারা জাতি সাঁওতালরা।
যখন ফিরছি, সারা গ্রাম তখন হাড়িয়ায় ভাসছে। দূর থেকে মাদলের তাল আর সাঁওতাল নারীদের গান ভেসে আসছে-‘হে গো বিডি, গো বিডি, ঘরে ঘরে যবেক মেয়ে, আমিতো চললাম লংকা লংকা’।কুকরী বনের কথা মনে হলে আজও আনমনা হয়ে যাই।