মধ্যদুপুর। কাঠফাটা রোদ। কৃষ্ণ কড়া অপেক্ষা করছে বাড়ির উঠানে। কয়েকদিন ধরেই তার মাথা ব্যথা। পাড়ার মাহান (কবিরাজ) বেড়াতে গেছে পাশের গ্রামে, আত্মীয়ের বাড়িতে। মাহান নেই, তাই চিকিৎসাও বন্ধ। ফলে মাথা ব্যথা নিয়েই কেটে যায় কৃষ্ণের দুটি দিন।
মাহান আজ বাড়ি ফিরেছে। খানিক পরেই শুরু হবে কৃষ্ণের চিকিৎসা। সে চিকিৎসায় মাথা ব্যথা সেরে যাবে এক নিমেষেই। এমনটাই আশা ও বিশ্বাস তার।
কী সে চিকিৎসা?
কৃষ্ণের ভাষায়, ‘মুড়িয়া পিরা হো ঝার দে’ (ঝার ফুঁকের চিকিৎসা)
নাম তার জগেন কড়া। বয়স ষাটের ওপরে। কিন্তু বয়সের ভারে এখনো নুয়ে পড়েননি। সুঠাম তার দেহের গড়ন। গোত্রের সবাই তাকে বিশেষ মান্য করে। কারণ গোত্রের মাহাতো বা প্রধানও তিনি। একইসঙ্গে মাহান হিসেবেও রয়েছে তার নাম ডাক। কেউ অসুস্থ হলেই খোঁজ করে তার। চিকিৎসায় অবলম্বন তন্ত্রমন্ত্র আর জঙ্গলের গাছগাছালির ওষুধ।
কৃষ্ণর ঠিক সামনে এসে বসেন জগেন। তার এক হাতে একটি কৈচা (কাঁচি)। অন্য হাতে চেপে ধরেন কৃষ্ণর কপাল। চোখ তার বন্ধ। বিড়বিড় করে পড়ছেন মন্ত্র। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে কাঁচি দিয়ে বৃত্তাকার দাগ এঁকে নেন। এটিকে ভেবে নেওয়া হয় কৃষ্ণর মাথা। এই মাথাকে ব্যথামুক্ত করতে হবে মন্ত্রের শক্তিতে। একবার মন্ত্র পড়া শেষ হতেই জগেন ফুঁকে দেন কৃষ্ণর মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে বৃত্তাকার দাগটিকে হাতের কাঁচি দিয়ে কেটে দেন। এভাবে চলে তিনবার ফুঁক দেওয়া। তিন ফুঁকে বৃত্তাকার দাগটিও তিন জায়গায় দাগ টেনে কেটে দেওয়া হয়।
এভাবেই চলে মাথা ব্যথার চিকিৎসা। দাগ কাটার মাধ্যমে তিনি মূলত কৃষ্ণর মাথা ব্যথাকেই কেটে দিয়েছেন। তিন ফুঁকের পর কৃষ্ণও বেশ আরাম অনুভব করেন।
কীভাবে এটি হয়?
কৃষ্ণ বলে, ‘বাবু, বিশ্বাসে বস্তু মিলে’। শিক্ষিত সমাজে যা কুসংস্কার, এ পাড়ার সকলের কাছে তা পূর্বপুরুষদের বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাসকে বুকে ধরেই বেঁচে আছে এখানকার মানুষ।
কী মন্ত্র পড়লেন?
এমন প্রশ্ন করতেই জগেনের মুখে এক চিলতে হাসি। গুরুর নিষেধ, তাই মন্ত্রের কথা বলা যায় না। একান্তভাবে অনুরোধ করতেই প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে যান মন্ত্রটি;
‘গুরু জ্ঞান/ জারাই সিঁড়ি/ কার দোহাই/ বাগনা সিং/ কামরুক্ষা/ কে জারে/ গুরু জারে/ গুরু জ্ঞান/ মাই জারে/ জারাই সিঁড়ি/ কার দোহাই/ মা মনসাক দোহাই/ কে জারে/ মা পদ্মা জারে।’
হারিয়ে যাওয়া বস্তু উদ্ধার, সাপের বিষ নামানো, পেট ব্যথা বা মাথা ব্যথা কমানো, রাতের বেলা পথ চলতে যেন সাপে না কাটে, সে কারণে সাপের মুখ বন্ধ করা- সবই চলে মন্ত্র দিয়ে। জগেন বলেন, ‘সবই সৃষ্টিকর্তা করেন, আমরা কিছু করি না। শুধু তার নাম নিয়ে মন্ত্র পড়ে যাই।’
তার মতে যে মাহান (কবিরাজ) মিথ্যা বলে না, পাপ কাজ থেকে বিরত থাকে-তার শক্তি তত বেশি থাকে। সে তত ভালো মাহান।
এ গ্রামের নাম ঝিনাইকুড়ি। দিনাজপুরের একেবারে সীমান্তবর্তী গ্রাম এটি। এখানে বাস করছে কড়া নামের একটি আদিবাসী জাতি। যারা এদেশ থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন। টিকে আছে মাত্র কিছু পরিবার। তাদের একমাত্র পাড়া এটিই।
গোত্রের মাহাতো বা প্রধান জগেনের ভাষায়, ‘কড়া মানে মাটি খোঁড়া’।এদের পূর্বপুরুষরা এক সময় দীঘি খোঁড়ার কাজে পারদর্শী ছিল। সে থেকেই এদের এমন নামকরণ। এরা নিজেদের নামের শেষে টাইটেল হিসেবে জুড়ে দেয় নিজ জাতির নামটি।
এদেশ থেকে কড়া সম্প্রদায় হারিয়ে যেতে থাকলেও ভারতের ঝাড়খণ্ডে এখনো তাদের একাধিক গ্রাম রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে রেললাইনের মাটি কাটার কাজের সূত্র ধরেই এ অঞ্চলে এদের আগমণ ঘটে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞানের ছাত্র সাজ্জাদ। থিসিসের জন্য বেছে নিয়েছেন আদিবাসী কড়াদের জীবন ও সংস্কৃতিকে। তার এমন প্রস্তাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের চোখ ওঠে কপালে। শুধু তা-ই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অনেক শিক্ষকেরই জানা নেই কড়া জাতির নামটি। তাই বিপত্তিতে পড়তে হয় তাকে।
এত বড় বড় জাতি থাকতে কড়াদের নিয়ে কেন থিসিসে আগ্রহী হলেন? সাজ্জাদ জানালেন, এক ধরণের দায় থেকে তিনি থিসিসটি করছেন। এদেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে কড়া নামক একটি জাতি। হারিয়ে যাচ্ছে একটি ভাষা ও একটি জাতির সংস্কৃতি। তাদের টিকিয়ে রাখতে নেই কোনো উদ্যোগ। তাই নৃ-বিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে কড়াদের বিষয়গুলো তুলে ধরতে চান নিজের থিসিসের মাধ্যমে।
সাজ্জাদকে নিয়েই গিয়েছিলাম কড়া পাড়াতে। আমরা যখন পৌঁছি, তখনো কৃষ্ণর মাথা ব্যথার চিকিৎসা শুরু হয়নি। চিকিৎসা শুরু হলে সেটিও কড়াদের বিষয়ে সাজ্জাদের তথ্যজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে। শেষে নানা বিষয়ে আলাপ হয় মাহাতো জগেনের সঙ্গে।
এমন সময় কাজ থেকে ফেরেন গোত্রের এক নারী, সোনিয়া কড়া। পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী সোনিয়া। নিজেদের জমি নেই, তাই কাজ করেন অন্যের জমিতে। অন্য আদিবাসীদের মতো কড়া নারীরাও সংসারের পাশাপাশি মাঠে কাজ করেন। চোখে চোখ পড়তেই সোনিয়া কড়া ভাষায় বলেন, ‘তোহনি কুরাং কে হে (আপনি কেমন আছেন)।’
প্রশ্নের জবাব দিয়ে প্রশ্ন করি। কী কাজ করছেন? সোনিয়ার উত্তর, ‘হামনি ধান রোপেইয়ে, কাম কারলে যাইহে মাহাজন ঘার।’ তিনি জানালেন, এ সময়টাতে ধান রোপনের পর আগাছা পরিষ্কারের কাজ করতেন তারা। কিন্তু এখন জমিতে কীটনাশক প্রয়োগের ফলে আগাছা হয় কম। ফলে কড়াসহ অন্য আদিবাসীরা এ সময়টাতে কর্মহীন হয়ে পড়ে।
আদিবাসীরা এক সময় জমিতে শুধুই গোবর সার ব্যবহার করতো। পোকা তাড়াতে তারা জমিতে ছিটাত ছাই। তখন জমিতে বিষের ব্যবহার একেবারেই ছিল না। প্রাকৃতিকভাবেই তারা চাষবাস করতো। কিন্তু এখন অধিক ফলনের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে সার। পোকা তাড়াতে জমিতে ছিটানো হচ্ছে ক্ষতিকর বিষ। ফলে তা মানুষের খাদ্যে প্রবেশ করছে।
সোনিয়ার বিশ্বাস প্রকৃতিই প্রকৃতিকে রক্ষা করে। একজন আদিবাসী নারীর মুখে বর্তমান কৃষি প্রযুক্তির কুফলগুলোর কথা শুনে আমরা বেশ অবাক হই!
হঠ্যাৎ সোনিয়া আমাদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেন- গ্যাস্ট্রিক কেন হয়?
উত্তরে নীরব থাকি আমরা।
সোনিয়ার মতে, জীবনকে সহজ করতে মানুষের জীবন পড়ছে হুমকির মুখে। এক সময় মানুষ মাটির হাঁড়িতে রান্না করত। মাটির হাঁড়িতে রান্না করলে কখনো গ্যাস্ট্রিক হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। তাই তখন মানুষের গ্যাস্ট্রিক তেমন হতো না। কড়ারা এখনো ঘরের রান্না করে মাটির হাঁড়িতে। ফলে গ্যাস্ট্রিক থেকে তারা মুক্ত।
সোনিয়া একে একে জানালেন তাদের পূর্বপুরুষদের কিছু লোকবিশ্বাসের কথা। বাতাস পূর্বে-পশ্চিমে প্রবাহিত হলে নাকি বড় ধরণের ঝড় হওয়ার আশঙ্কা থাকে, কোনো কাজে যাওয়ার সময় খালি কলসি দেখলে যাত্রা হয় অশুভ, গভীর রাতে কুকুর কাঁদা নাকি অমঙ্গলের লক্ষণ, মোরগ-মুরগি জোড়া ঝগড়া করলে বাড়িতে মেহমান আসে, রাতের বেলা পশ্চিমে বা দক্ষিণে সাপ ডাকলে দিকভেদে প্রচণ্ড বর্ষা বা খরা ভাব দেখা দিতে পারে, চলার পথে যদি বামদিক থেকে কোনো প্রাণী (শৃগাল, বেজি) রাস্তা পার হয়ে ডান দিকে যায়, তাহলে যাত্রা নাকি অশুভ হয় প্রভৃতি। এই বিশ্বাসগুলো এখনো মিশে আছে আদিবাসী কড়াদের জীবনের সঙ্গে।
কথায় কথায় জগেন গোটা পাড়া আমাদের ঘুরিয়ে দেখান। সাজ্জাদের ক্যামেরাটিও তখন ক্লিক ক্লিক শব্দ তোলে।
কড়াদের ঘরগুলো অন্যরকম। মাটিতে ঘেরা। কোনো জানালা নেই। তাদের বিশ্বাস বাইরে থেকে কোনো অপদেবতা যেন ঘরের ভেতর নজর দিতে না পারে, তাই এমন ব্যবস্থা।
জগেনের কাছে সাজ্জাদ জানতে চান ভূমিকম্প নিয়ে কড়াদের বিশ্বাসের কথা। কড়া ভাষায় এটি ‘ভূকম্পন আয়ো হে’। জগেন জানালেন, তারা মনে করে লরিক নামক একটি শক্তিশালী জন্তুকে রাখা হয়েছে একটি কুয়োর মধ্যে। কুয়োর মুখ বিশেষ ঢাকনা দিয়ে লাগানো। তার ঠিক ওপরেই রয়েছে পৃথিবী। মাঝে মধ্যে লরিক যখন নড়েচড়ে ওঠে তখনই পৃথিবী কেঁপে ওঠে।
নিজ জাতি ছাড়া কড়াদের বিয়ে নিষিদ্ধ। কিন্তু এখন কড়া পাড়ায় নেই কোনো বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে। তাই পূর্বপুরুষদের নিয়ম ভেঙ্গেই গোত্রের কেদু কড়া ও ভুপেন কড়া বিয়ে করে এনেছেন তুরি ও ওরাঁও জাতির দুই নারীকে।
কেন কড়ারা টিকে থাকছে না?
উত্তরে জগেন বলেন, ‘দারিদ্র্য আর স্থানীয় বাঙালিদের অবহেলা’। কড়াদের অভাবের মাস ভাদ্র। আর এ মাসেই তাদের পালন করতে হয় কারমা পূজা। এটিই তাদের প্রধান উৎসব। তাদের বিশ্বাস, কারমা তাদের অভাবমুক্তি আর সৌভাগ্য লাভের পূজা। প্রতিবছর এ পূজা পালন করলেও কড়াদের কর্মভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি এখনো। তবু বুকভরা আশা নিয়ে প্রতিনিয়ত ভাগ্যজয়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কড়া আদিবাসীরা।