অনাদরে বেড়ে ওঠা জীবনের প্রতীক যেন জীবনবৃক্ষ। নীরবে ডালপালা মেলে নিজের রূপমাধুরী ঢেলে দেওয়ার উদাহরণ যেন জীবনবৃক্ষ। কেন এ বৃক্ষের নাম জীবন, এ কথায় পরে আসা যাবে। আগে দেখে নেওয়া যাক গাছটি কেমন।
গাছটি মাঝারি বা ছোট আকারের বৃক্ষ। বনবাদাড়ে, ঝোপজঙ্গলে স্তূপীকৃত থাকে বলে একে অনেক সময় ঝোপ বা গুল্ম বলে ভুল হওয়াই স্বাভাবিক। উচ্চতায় ৮-১০ মিটার হয় বড়জোর। তরে কোথাও কোথাও এর চাইতে উঁচু গাছেরও দেখা মিলতে পারে। গাছটি দ্রুত বর্ধনশীল কিন্তু স্বল্পজীবী। সত্যিকার অর্থে, খুব দ্রুত বাড়ে, এমন গাছের মধ্যে এটি পৃথিবীতে অন্যতম। যদি কোনো কারণে পানি কম পায় গাছটি তাহলে সে ছোট বৃক্ষ কিংবা ঝোপঝাড় আকারে টিকে থাকে। চিরসবুজ এ গাছের কাণ্ড আর ডালপালা সাদাটে ধূসর ও মসৃণ। তবে বলে নেওয়া ভালো, চারা কিংবা অল্পবয়স্ক গাছের কাণ্ড ও ডালপালার রং অনেক সময় সবুজ। তবে মাঝারি আকারের কোনো কোনো গাছে এ সবুজের দেখা মিলতে পারে। কাণ্ডের গায়ে থাকে অনেক অনেক বায়ুরন্ধ্র। বাকল পাতলা। কাণ্ডের পাতলা ছালের ঠিক ভেতরেই উজ্জ্বল সবুজ অংশ রয়েছে। জীবনের কাণ্ড ঠিক গোলাকার নয়। ডালপালা ইতস্তত, ছড়ানো-ছিটানো। ডালপালার গায়ে ভেলভেটের মতো রোম রয়েছে।
জীবনের পাতাগুলো সাধারণত ম্লান সবুজ, তবে বয়স্ক বা পরিণত পাতা কালচে সবুজ হতে দেখা যায়। পাতার কিনারার করাতের ধারের মতো ও গোড়ার দিকের হৃদয়াকৃতি, বিশেষ করে বড় বড় পাতাগুলো জীবন গাছের সৌন্দর্যের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। পাতা একান্তর; মানে, একটার পর একটা করে পাতা থাকে পত্রাক্ষ বা অণুডালের দুই দিকে। পাতার গোড়ার দিকটায় অসম-হৃদয়াকৃতির। অসম-হৃদয়াকৃতির বলতে বোঝায়, পাতার ফলক ও বোঁটার মিলনস্থলে রেখা দুটা সমানভাবে মিলিত না হয়ে একটু ছোট-বড় আকার নিয়ে মেলে। অনেক সময় অবশ্য গোলাকারও হয় গোড়ার দিকটা। আগার দিকটা সুচালো। ফলক বল্লম-ডিম্বাকৃতির, ৫-১৫ ও ৩-৮ সেমি লম্বা চওড়া; ওপরের দিকটা ম্লান সবুজ ও খসখসে, নিচের দিকটা সাদাটে ও নরম রোমে আবৃত। তবে বলে নেওয়া ভালো, নবীন পাতাগুলো খসখসে, রোমশ। পরিণত পাতাগুলো কালক্রমে মসৃণ হয়ে যায়। আগেই বলা হয়েছে, পাতা করাতের দাঁতের মতো, পরিভাষায় বলে দন্তক। এই দন্তকগুলো আবার অসমান। পাতার উপরিভাগের চেয়ে নিচের শিরার গ্রন্থন বেশি স্পষ্ট। বৃন্ত বা বোঁটা নলাকার, রোমহীন, ২-৩ সেমি লম্বা। এর উপপত্র আছে। সেগুলো আশুপাতি বা দ্রুত ঝরে পড়ে।
জীবনের ফুল প্রায় সারা বছরই ফোটে। কোথাও কোথাও যদিও লেখা আছে, এর ফুল ফোটে গরমে। ফুলগুলো ছোট আকারের ও ছড়ানো, মোটেও আকর্ষণীয় নয়, সবুজাভ রঙের; ধরে নিয়ত-বিন্যাসে। ফুলের বোঁটা সাধারণত পাতার বোঁটার চেয়ে বড়। এর ক্ষুদ্রকায় পুরুষ ও স্ত্রী ফুল একই গাছে ধরে। মজার ব্যাপার আলাদা আলাদা গাছেও এরা ধরতে পারে। পুরুষ ফুল গোলাকার, বৃত্যাংশ ও পাপড়িসংখ্যা ৫। বৃত্যাংশগুলো রোমহীন, দেখতে ডিম্ব-বল্লমাকার। স্ত্রী ফুলের বৃত্যাংশগুলো অপক্ষোকৃত ছোট, কিছুটা রোমশ। পুংকেশর ৫টি। গর্ভদণ্ড ছোট কিন্তু প্রশস্ত। ফলগুলো উদ্ভিদবিজ্ঞানের ভাষায় ড্রুপ। এগুলো প্রায় গোলাকার, খুব ছোট। কাঁচা অবস্থায় ফলগুলো সবুজ, পাকলে কালো রং ধারণ করে। সজনা, জিগা কিংবা মান্দারগাছের মতো ডাল পুঁতে দিলে চারা হয়। তা ছাড়া গাছের গোড়া থেকেও চারা জন্মে। বেশ কয়টি প্রজাতির পাখি এর বীজ খায়, আর তাদের মাধ্যমেই বীজগুলো এখানে সেখানে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
জীবনের কাঠ হালকা, নরম কিন্তু শুকিয়ে গেলে ফাটে না; রং লালচে ধূসর। পাতা গবাদিপশুর খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কাঠ থেকে কয়লা তৈরি করা যায়। আবার তা থেকে গানপাউডারও তৈরি করা যায়। ইংরেজি নামে সে-স্মারক আছে। এ কাঠ জ্বালানি হিসেবে অহরহ ব্যবহার করা হয় গ্রাম-এলাকায়। যে কারণে আমাদের আশপাশের জীবন বৃক্ষগুলোকে আমরা বেশ বড় আকার হিসেবে দেখতে পাই না। আর গাছটিও বেশ চটপটে। কাঠ-কয়লার জন্য ডালপালা মুড়ে দিলে কী হবে, সে দ্রুত ডালপালায় গজায় এবং সে সঙ্গে দ্রুত উচ্চতাও বাড়িয়ে ফেলে। কাণ্ডের আঁশ থেকে দড়ি তৈরি করা যায়। কাগজও তৈরি হয় কোথাও কোথাও। তা ছাড়া চাইলে এর আঁশ দিয়ে মোটা কাপড়ও বানানো যেতে পারে। এর কাঠ দিয়ে ঘরের ছাদের ফ্রেম ও প্যাকিং বাক্স বানানো যায়। আফ্রিকার জুলু সম্প্রদায়ের লোকেরা এর কচি পাতা খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। মহাদেশটির কোথাও কোথাও এটি ছায়াদায়ী বৃক্ষ হিসেবে লালিত।
জীবনবৃক্ষ তার নামটি পেয়েছে সংস্কৃত-নাম ‘জীবন্তী’ও ‘জীবনী’ থেকে, সেটা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। এর বেশ কয়েকটি স্থানীয় নাম রয়েছে আমাদের দেশে। চিকন, গোবরিজগা, বনজিগা, নাইলতা, কাপাইসা, বন নাইল্লা, জিগনি, গাদুবা, কয়লা, গোবরগাছ, পানি বাউসা, নারিচা, বনজিরা, বনপটাশি, ধলাগুইয়া ইত্যাদি হেলাফেলার নামগুলো রাখার কারণ আছে। সে তো প্রচুর সংখ্যায় সহজে জন্মে গ্রামের ঝোপেঝাড়ে, আদাড়ে-বাদাড়ে, আনাচে-কানাচে, পরিত্যক্ত জায়গায়, গোবরের গাদায়, খানাখন্দকে, আস্তাকুড়ে; পাওয়ামাত্রই ডাল ভেঙে নাও, কাঠ কেটে নাও—ব্যস! যা সবচেয়ে কাছে থাকে তাকেই তো মানুষ কাজে লাগায়, উপকৃত হয় দারুণভাবে কিন্তু সুযোগ পেলেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে ছাড়ে না।
জীবনের ঔষধি গুণও আছে। পাতা ও ছাল গনোরিয়া, ব্রংকাইটিস, কফ, গলার ক্ষত, শ্বাসকষ্ট, দাঁতের ব্যথাসহ নানা রোগে ব্যবহৃত হয়। এ দুটি অংশ কোথাও কোথাও বিষের প্রতিষেধক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। পাকস্থলীর শূল, প্রসাবে রক্ত পড়া, মৃগীরোগ, মাংসপেশির ব্যথায় এর শেকড়, ছাল ও পাতার ব্যবহার রয়েছে। ছালের রস ডিসেন্ট্রিতে ব্যবহৃত হয় কোথাও কোথাও।
বলা হয়ে থাকে, মানুষসহ প্রায় ১৫০ রকম জীবপ্রজাতিকে আশ্রয়প্রশ্রয় দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে এই জীবনবৃক্ষ। বেশ কয়েকটি প্রজাতির প্রজাপতি তার লার্ভার খাদ্য হিসেবে এর পাতার ওপর নির্ভরশীল। কত প্রজাতির পাখি যে এর ফল খায়, তা বলে শেষ করা যাবে না। ফল ছাড়াও এ গাছের ওপর জীবনধারণকারী পোকামাকড় খেয়েও পাখিগুলো বেঁচেবর্তে থাকে। বিশেষ করে ঘুঘু-কবুতরজাতীয় পাখিদেরকে এর গাছের ওপর প্রায়ই বসে থাকতে দেখা যায়, এবং সেটি সম্ভবত আফ্রিকায়। মৌমাছিসহ নানা ধরনের পোকামাকড় এর গায়ে জীবন ধারণ করে। এত এত প্রজাতিকে যে লালন করে তার নাম তো জীবনই হওয়া উচিত, তাই না? আর তার কাঠ পুড়িয়ে কয়লা পাওয়া—এ-ও তো নিজের জীবন দিয়ে হলেও অন্যের উপকার করা!
প্রাণী ও পরিবেশের অশেষ উপকারী এ বৃক্ষটি কমবেশি পাওয়া যাবে বাংলাদেশের সবখানেই। এর ভৌগোলিক বিস্তৃতি রয়েছে বিশাল এলাকাজুড়ে। উষ্ণমণ্ডলীয় আফ্রিকা থেকে শুরু করে মাদাগাস্কারসহ দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত এবং মধ্যপ্রাচ্য হয়ে একেবারে নেপাল, ভারত, মিয়ানমার, চীন, মালয়েশিয়াসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলো জুড়ে একে দেখতে পাওয়া যাবে। উত্তর অস্ট্রেলিয়া তো এর দেখা মিলবে। যেহেতু আমাদের পাহাড়ি এলাকাগুলোতেও বৃক্ষটি জন্মায়, স্থানীয় ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীদের দেওয়া কিছু নাম রয়েছে এর। আমাদের গারোরা একে বলে ফাক্রাম। চাকমারা বলে সিমুত্তা। গারোরা এ গাছের আঁশ দিয়ে পাটি তৈরি করে।
আগেই বলা হয়েছে, গাছটি জলাভূমির আশপাশের সিক্ত মাটিতে জন্মাতে পছন্দ করে। এবং জলমগ্ন অবস্থায় কিছু দিন টিকেও থাকতে পারে। শুধু তা-ই নয়, এর শিকড় মাটির খুব গভীরে যেতে পারে বলে খরাতেও বেশ কয়েক দিন নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারে সে। ওই যে বলা হলো জীবন রক্ষার আকর এই জীবনবৃক্ষ, তা শুধু প্রাণিপ্রজাতি রক্ষার বেলাতে নয়, আশপাশের উদ্ভিদপ্রজাতিগুলোকেও সে আগলে রাখে এর গুণের ভাণ্ডার দিয়ে। এর রয়েছে মাটিতে নাইট্রোজেন পরিশুদ্ধ করার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা। অনুর্বর মাটিকে এর মাধ্যমে জীবন দিতে পারে সে। শুধু তা-ই নয়, যে বনে বা জঙ্গলে থাকবে নিজের প্রজাতিসহ অন্যান্য প্রজাতির উদ্ভিদের প্রসারেও দারুণ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় তাকে। এ কাজটি করে তার ডালপালার বিস্তারজনিত ছায়া দিয়ে। আর এ ছায়ার আশ্রয় পেয়ে প্রজাতিগুলো তরতর করে বেড়ে উঠে ছোট একটা বনকে বড় বনে রূপান্তরিত করতে পারে। ‘জীবন’ তো আর শুধু শুধু বলা হয় না একে, দারুণ সব জীবদরদি গুণের জন্যই তা বলা হয়।
জীবনের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Trema orientale, পরিবার Cannabaceae। দ্বিপদী নামের প্রথম অংশ Trema এসেছে গাছটির ফলের বীজের গর্ত-ভাবটি থেকে; শেষের অভিধা orientale এসেছে পুবদেশীয় বোঝাতে। এর ইংরেজি নাম Indian Nettle Tree, Charcoal Tree, Pigeonwood Tree।