• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
আদিবাসী জীবনকথা ৬

বাদামবাড়ির গারো গ্রামে


সালেক খোকন
প্রকাশিত: আগস্ট ২৪, ২০২৩, ০৩:৫৮ পিএম
বাদামবাড়ির গারো গ্রামে
বাদামবাড়ির গারো পরিবার, বাম থেকে সাইলো মারা, মিথিলা সাংমা, সিগ্ধা। ছবি: সালেক খোকন

এক দিন পর দুর্গাপূজা। সরকারি ছুটির দিন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে ২৮ জনের একটি দল যাবে সুসং দুর্গাপুরে। বন্ধু সুমন জানাল খবরটি। দুর্গাপূজায় দুর্গাপুরে। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিজনের কাছাকাছি যাওয়া। একবাক্যেই রাজি হয়ে গেলাম।


ভোরের দিকে রওনা হই সবাই। মহাখালী থেকে বাস ছাড়ে। পাঁচ ঘণ্টাতেই পৌঁছি নেত্রকোনার শুকনাকুড়িতে। অতঃপর গুদারাপাড় হয়ে শুরু হয় টেম্পোতে যন্ত্রণার পথচলা। ইটের খোয়ার রাস্তায় হাড় মরমর অনুভূতি। বিরিশিরির ওয়াইএমসিএর রেস্টহাউসে পৌঁছতেই সবাই গা এলিয়ে দেয়। 


দুর্গাপুরে রাজবাড়ি আর মণি সিংহের স্মৃতিসৌধ ঘুরে দেখতেই সন্ধ্যা নামে। চারপাশের অন্ধকার কাটিয়ে ওঠে পূর্ণিমার চাঁদ। আমরা তখন ঘাট থেকে নদীতে নৌকা ভাসাই। মায়াবী চাঁদের আলোয় পাহাড়ি নদী সোমেশ্বরকে দেখা। অসাধারণ সে অনুভূতি!


নৌকার মধ্যে পরিচয় হয় গোপালের সঙ্গে। কথায় কথায় জানালেন বাদামবাড়ির কথা। সেখানে সীমান্তবর্তী জিরো পয়েন্ট। পাহাড়ি এলাকা। তিন দিকে ভারতের মেঘালয়ের ডাইজাকুলা, কাংকুল বাড়ি আর রাঙাছড়া। আর মাঝখানে বাদামবাড়ি। সেখানে বাস করেন গারো আদিবাসীরা। শত কষ্টের মাঝেও তারা সেখানে টিকিয়ে রেখেছেন পূর্বপুরুষদের জাত ধর্মকে। সব শুনেই রাজি হয়ে যাই। গোপালের সঙ্গে পরিকল্পনা হয় পরদিন গারো গ্রামে যাওয়ার।
তখন মধ্য দুপুর। দুর্গাপুর হয়ে তিন নালির মোড় দিয়ে আমরা ডাহাপাড়ার পথ ধরি। ডাহাপাড়ার ওপাশেই বাদামবাড়ি। তবে পেরোতে হবে পাহাড়ি পথ। চারপাশে সবুজের আধিক্য। সবুজ ধানক্ষেত গিয়ে মিশেছে পাহাড়ঘেরা সবুজের ধারে। দূরে মেঘালয়ের বড় বড় সব পাহাড়। একেক জায়গার সৌন্দর্য একেক রকম। যেতে যেতে গোপাল কথা তুলে গারোদের নিয়ে।
গারোদের আদি নিবাস আসাম। ধারণা করা হয়, তাদের পূর্বপুরুষরা কোনো এক সময়ে তিব্বত থেকে ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। গারোদের নামানুসারেই আসামের পাহাড় শ্রেণির নাম ‘গারো পাহাড়’ রাখা হয়েছে।


ডাহাপাড়া পেরিয়ে আমরা বাদামবাড়ির পথ ধরি। পায়ে হাঁটা লালমাটির উঁচু-নিচু পথ। মিনিট বিশেক চলতেই টিলাসম একটি পাহাড়ে কয়েকটি গারো বাড়ি নজরে পড়ে। বাদামবাড়িতে ৫০টির মতো গারো আদিবাসী পরিবারের বাস। একটি টিলার ধারঘেঁষা পথে আমরা ওপরে উঠি।
বেশ কয়েকটি বাঁশের তৈরি মাচা ঘর। একটি ঘরের মাচায় পা দুলিয়ে বসে আছে কয়েকটি শিশু। দৃষ্টি আটকে যায় একটি ঘরের দিকে। উঁচু মাচায় ছোট্ট একটি মুরগির ঘর। গারো ভাষায়, দেক চি দিক। সেটিতে মুরগি ওঠার জন্য রয়েছে বাঁশের বিশেষ সিঁড়ি।


বাড়ির উঠানে বসা একজন বৃদ্ধ। বয়স আশির মতো। সামনে জাল ছড়ানো। মনোযোগ দিয়ে তিনি সেলাই করছেন জালের ছেঁড়া অংশ। কথা বলতেই নিজের নাম জানালেন রুগেন সাংমা। বৃদ্ধর পাশেই মাদুর বিছিয়ে আমাদের বসার জায়গা করা হয়। নামের শেষে টাইটেল কেন সাংমা? এমন প্রশ্নে তিনি উত্তরে বলেন কারণটি।


একবার এক গারো নারী দুটি যমজ পুত্রসন্তান জন্ম দেন। বড় হয়ে সে সন্তান দুটি হয় অসম সাহসী। সবার কাছে তারা বীর হিসেবে পরিচিতি পায়। একবার ভাইদের একজন দেশ জয়ের উদ্দেশ্যে পূর্বদেশে যাত্রা করে। যাত্রার আগে সে অপর ভাইকে গ্রাম ও গোষ্ঠী রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে যায়। ওই ভাই নানা আচার পালনের পাশাপাশি ভাইয়ের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের প্রহর গুনত। গ্রামে থাকা ভাইটি কখনো মাটিতে লম্বা হয়ে ঘুমাত না। তার বিশ্বাস, তার দেহে ও মাথায় ধুলাবালু লাগলে অপর ভাইয়ের অমঙ্গল হবে। তাই সে দণ্ডায়মান অবস্থায় কোনো কিছুর সঙ্গে হেলান দিয়েই ঘুমাত।


ছেলের এমন কষ্ট দেখে মায়ের মন কেঁদে ওঠে। তিনি ছেলের জন্য মাচাং ঘর তৈরি করেন, যাতে সে ধুলাবালুর সংস্পর্শ এড়িয়ে আরামে ঘুমাতে পারে। গারো সমাজে সেটিই ছিল প্রথম মাচাং ঘর। সে সময় সমাজের লোকেরা ওই মাকে সম্মানের সঙ্গে ডাকতেন ‘চাংমা’ অর্থাৎ মাচাং ঘরের মা বলে। কালক্রমে ‘চাংমা’ সম্বোধনটি ‘সাংমা’তে রূপান্তরিত হয়। পরে ওই মায়ের বংশধরেরা সাংমা হিসেবে পরিচিতি পায়।


আমরা তন্ময় হয়ে শুনছিলাম। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হয় এক গারো নারী। তার পিঠে বিশেষ ভঙ্গিতে এক শিশু বাঁধা। নাম তার মিথিলা সাংমা। ফিরেছেন কাজ থেকে। মিথিলা জানালেন দুই পাহাড়ের মাঝে সমতল জায়গায় ধান চাষ আর পাহাড়ে লেবুসহ নানা শস্যের চাষ করে যা পান তা দিয়েই চলে আদিবাসীদের পরিবারগুলো।


আমাদের কথা জমে উঠছিল। সে সময় ঘরের ভেতর থেকে মুড়ি হাতে আসেন এক বৃদ্ধা। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। কিন্তু বয়সের ভার এখনো তাকে নোয়াতে পরেননি। তিনি রুগেন সাংমার সহধর্মিণী। নাম সাইলো মারা। 


মুড়ির টানে পাশের বাড়ির বেলেমান সাংমা ও শাহজত সাংমাও আসরে যোগ দেন। গারোদের আদি বিশ্বাসগুলো নিয়ে আলাপ চলে রুগেনের সঙ্গে। তিনি গল্পের মতো করে বলেন একটি গারো কাহিনি।


তখন চারদিকে ছিল পানি আর পানি। কোথাও স্থলের চিহ্ন নেই। সবকিছু অন্ধকারে আচ্ছন্ন। এমন অবস্থা দেখে ভগবান তাতারা রাবুগা পৃথিবী সৃষ্টির ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তিনি নস্ত নুপাস্তকে স্ত্রীলোকের আকার দিয়ে পাঠালেন। সঙ্গে দিলেন কিছু বালু। নস্ত নুপাস্ত প্রথমে মাকড়সার জালে আশ্রয় নিয়ে সমস্ত জলরাশির ওপর সে জাল বিস্তার করলেন। অতঃপর তিনি সঙ্গে আনা বালু মুষ্টিবদ্ধ করে পানিতে নিক্ষেপ করে বললেন, ‘অনন্ত জলরাশির নিচ থেকে মাটি নিয়ে এসো।’ যথাসময়ে মাটি এলো এবং নস্ত নুপাস্ত সে মাটি দিয়ে পৃথিবী সৃষ্টি করলেন। গারো ভাষায় একে বলে, ‘মেন পিলটি’।


পৃথিবী সৃষ্টির পর ভগবান তাতারা রাবুগার কাছে তা ভিজে মনে হলো। তাই তিনি তা শুকাতে আসিমা দিংগাসীমার পুত্র ও কন্যাকে স্থাপন করলেন পৃথিবীতে। এরাই সূর্য (রেঙ্গরা বলসা) ও চন্দ্র (বীরে জিতজে)। তাই গারোদের কাছে চন্দ্র ও সূর্য ভাই-বোন। এভাবে পৃথিবী বসবাসের উপযোগী হয়ে তৈরি হয়।


গোপালের প্রশ্ন ছিল, চন্দ্র কেন কম আলো দেয়? উত্তরে রুগেন মুচকি হেসে বলেন, ‘চন্দ্র ছিল খুবই সুন্দরী। ভাই সূর্য থেকে ছিল অনেক বেশি উজ্জ্বল। এ নিয়ে তাদের মধ্যে তৈরি হয় মনোমালিন্য। সূর্য বোনের রূপলাবণ্যে হিংসা করতে থাকেন। তাই দু ভাইবোনে ঝগড়া চলে হরহামেশাই। তাদের মা তা থামাতেন। একদিন তাদের বাড়িতে রেখে জরুরি কাজে মা গেলেন বাইরে। সে সুযোগে ভাইবোনে শুরু হয় তুমুল ঝগড়া। সে ঝগড়া এক সময় রূপ নেয় হাতাহাতিতে। প্রচণ্ড ক্ষেপে যায় সূর্য। মুঠি ভরা কাদা নিয়ে বোন চন্দ্রের মুখে তা লেপ্টে দেয়।
এতে বোনও হয় উত্তেজিত। ভাই সূর্যকে শায়েস্তা করতে হবে। তাই মুখের কাদা না ধুয়ে সে অপেক্ষা থাকে মায়ের জন্য। মা বাড়িতে আসতেই চন্দ্র কাদা মাখা মুখ দেখিয়ে সব ঘটনা বলতে থাকে। মা এতে খুশি হন না। বরং চন্দ্রের এমন আচরণে ক্ষেপে যান। একপর্যায়ে তিনি মেয়ে চন্দ্রকে অভিশাপ দেন, চিরদিনই তোর মুখ যেন এমনি কর্দমাক্ত থাকে। গারোরা বিশ্বাস করে, সে থেকেই চন্দ্রের মুখে কলন্ক লাগে এবং সূর্যের চেয়ে কম আলোর অধিকারিণী হয়।
রুগেন কথা থামাতেই কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বজ্রপাতের কাহিনি শোনান সাইলো।


আকাশ দেবতার নাম গোয়েরা। একসময় সে মর্তে বাস করত। তার ছিল চমৎকার এক তরবারি। তিনি সে তরবারি দিয়ে একবার পাহাড়ের মতো এক প্রকাণ্ড দানবকে হত্যা করেন। তার এমন সাহসিকতায় ভগবান খুশি হন। তিনি পুরস্কারস্বরূপ তাকে আকাশে বাস করবার অনুমতি দেন। সে থেকেই তিনি আকাশে বাস করেন। কিন্তু এখনো তিনি তরবারি চালানোর অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেননি। তা নিয়ে খেলার সময় যে শব্দের উৎপত্তি হয়, গারোদের কাছে তাই বজ্রের শব্দ। আর তরবারির ঝলকানি হলো বিদ্যুৎ।


আলাপ ওঠাই ভূমিকম্প নিয়ে। তাহলে কেন পৃথিবী কেঁপে ওঠে? উত্তরে রুগেন বলেন, ‘পৃথিবীটা বিরাট এক ষাঁড়ের মাথায় অবস্থান করছে। ভারসাম্য রক্ষার জন্য ষাঁড় পৃথিবীটাকে মাঝেমধ্যে এক শিং থেকে অন্য শিংয়ে স্থানান্তর করান। তখনই পৃথিবী খানিকটা কেঁপে ওঠে বা ভূকম্প হয়।’ তিনি আরও বলেন, ষাঁড়ের কানের কাছে আছে এক বিরাটাকার মাছি। ষাঁড় এ মাছিকে ভয় করে। মাছি ষাঁড়কে মনে করিয়ে দেয় বেশিক্ষণ পৃথিবী কম্পিত হলে সৃষ্টি নষ্ট হয়ে যাবে। তখন ষাঁড়ও সতর্ক হয়ে যায়। ফলে কম্পনও থেমে যায়। এতে ভূমিকম্প খুব কম সময় স্থায়ী হয়।
আমাদের আলাপ আরও জমতে থাকে। বিকেল গড়িয়ে নামে সন্ধ্যা। চারদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক আর জোনাকির আলো ঘিরে ধরে। আমরা তখন ফিরতি পথ ধরি। রেস্টহাউসে ফিরে ব্যস্ত হয়ে পড়ি আড্ডায়। ক্রমেই আবছা হয়ে আসে গারোদের মুখগুলো।
 

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগের আরো খবর

Link copied!