• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
আদিবাসী জীবনকথা ৪

রেংটাপাড়ার আনন্দ ও বেদনা


সালেক খোকন
প্রকাশিত: আগস্ট ১০, ২০২৩, ০২:৩০ পিএম
রেংটাপাড়ার আনন্দ ও বেদনা
পাড়া প্রধান রেংটা। ছবি: লেখক

দিনাজপুরের ভরাডাঙ্গি থেকে ছোট্ট খালটি চলে গেছে সীমান্তের দিকে। শীত মৌসুমে খালটি শুকিয়ে নিচু মাঠ হয়ে যায়। তখন মানুষের পায়ের ছাপ পড়ে খালের বুকে। কিন্তু ভরা বর্ষায় থাকে খালের ভরা যৌবন। তখন খালপাড় থেকে নৌকাই একমাত্র ভরসা। প্রতিবার জনপ্রতি এক টাকার বিনিময়ে চলে দুই পারের মানুষের পারাপার। ঘাটের দুই পাশে তাই বসে যায় দু-একটা দোকানও।

ঘাটটি ভান্ডারা ইউনিয়নের মধ্যে পড়েছে। প্রতিবছর ইউপি চেয়ারম্যান ঢাকঢোল পিটিয়ে ইজারা দেন ঘাটটিকে। ইজারা পেতে কয়েক গ্রামের প্রভাবশালীরা তদবির করেন নানা কায়দায়। ফলে বছর বছর বাড়ে ঘাটের ইজারা মূল্য।

সবার কাছে এটি রেংটা ঘাট। সরকারি নথিতেও নাম একই। ঘাটটির পাশেই রেংটাপাড়া। এটি মূলত আদিবাসী সাঁওতালদের একটি পাড়া। পাড়াটিতে রয়েছে ১৩টির মতো সাঁওতাল পরিবার। পাড়ার সবাই কোনো না কোনোভাবে একে অপরের আত্মীয়।

এ পাড়ার মহতের নাম রেংটা। বয়স ১০৫ বছরের মতো। এই রেংটার নামেই নামকরণ হয় পাড়া আর ঘাটটির। বছর বছর রেংটাঘাটের ইজারা মূল্যও বাড়ে। কিন্তু রেংটাপাড়ার রেংটার ভাগ্যের তেমন উন্নতি ঘটে না।

এক বৈশাখের ঠিক আগে গিয়েছিলাম রেংটাপাড়ায়। কঙ্কালসার দেহ নিয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে চলছিলেন তিনি। বাড়ির খাটিয়ায় বসে দু-একটা কথা হয় রেংটার সঙ্গে।

তার বাবার নাম মায়সা হেমব্রম। জন্মও হয় এখানেই। কিন্তু রেংটার দাদা লক্ষ্মণ হেমব্রম এসেছিলেন ভারতের দুমকা থেকে। লক্ষ্মণের যাযাবর জীবনের অবসান ঘটে এই ভান্ডারায় এসে। সে হিসেবে রেংটারা এখানে বাস করছেন শত বছর আগ থেকে। জঙ্গল কেটে এ অঞ্চলকে বসবাসের যোগ্য করে তোলেন তারাই। তখন এখানে বাঙালিদের কোনো আস্তিত্ব ছিল না। অথচ আজ তারাই হয়ে আছেন সংখ্যালঘু।

নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি আর আচার নিয়ে যুগ যুগ ধরে এ দেশে রেংটার মতো আদিবাসীরা বসবাস করলেও আধুনিক সভ্যতার লেবাস পরে তাদের নিয়ে আমাদের মধ্যে চলে নানা খেলা। আদিবাসী নামটিকে আড়ালে রেখে কখনো উপজাতি, কখনোবা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী নানা নামে নামকরণ করি তাদের। এভাবে নিজের জাতিকে উঁচুতে রাখার একধরনের হীন চেষ্টা চলে আমাদের মধ্যে। ফলে জাতি হিসেবে আমরা শুধু নিচুতেই থাকি। রেংটার মতো সাঁওতালদের কাছে এসেও কি আমরা বলব, তারা আদিবাসী নয়?

রেংটার সঙ্গে কথা হয় এটুকুই। সময় নিয়ে রেংটাপড়ায় যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। ইচ্ছা ছিল কালের ধারক রেংটার কাছ থেকে জানব আদিবাসীদের সংগ্রাম, সংস্কৃতি আর পরিবর্তনের নানা কাহিনি। কিন্তু ব্যস্ততার টানাপোড়েনে স্মৃতি থেকে হারিয়ে যান রেংটা।

এবার শেষ চৈত্রে বের হই আদিবাসীদের পাড়া বেড়াতে। সঙ্গী হন স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক সুবল। প্রথমেই চলে আসি ওই পাড়ায়। সময় নিয়ে কথা হবে রেংটার সঙ্গে, তেমনটাই পরিকল্পনা। কিন্তু তার বাড়িতে ঢুকে দেখি খাটিয়াটি শূন্য। গোটা বাড়িতে কেউ নেই। আমাদের দেখে পাশের বাড়ি থেকে এগিয়ে আসেন বুধু রায় হেমব্রম। রেংটার ভাতিজা তিনি। তার খোঁজ করতেই বুধুর উত্তরে আমরা স্থির হয়ে যাই। রেংটা মারা গিয়েছেন, তা-ও কয়েক বছর আগে। আফসোস হয়। তার তখনকার তোলা ছবিটি এখন আমাদের কাছে কেবলই স্মৃতি।

রেংটার বাড়ির এক কোণে বসে বুধু রায় হেমব্রমের সঙ্গে চলে আমাদের আলাপচারিতা। বাড়ির পাশেই সিঁড়ির আদলে সিমেন্ট আর বালুর সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়েছে উঁচু ডিবি। বুধু জানালেন এটি তাদের গ্রাম বোঙ্গা। সাঁওতালদের ভাষায় মাঝি থান। সেখানে ঝোলানো হয়েছে ধূপকাঠি। মাটিতে দেওয়া হয়েছে সিঁদুরের ফোঁটা। বুধু জানালেন তাদের পাড়ায় চলছে চৈত বিসুয়া উৎসব। রেংটার আমলে এ উৎসব হতো জমজমাট। উৎসবে অংশগ্রহণ করতেন আশপাশের গ্রামের আদিবাসীরা। সময়ের আবর্তে অর্থাভাবে এখন এ পাড়ার উৎসবগুলো চলছে ঢিমেতালে।

রেংটার পরে গোত্রে মহতের হাল ধরেছেন তার ছেলে মঙ্গল হেমব্রম। চৈত্র মাসের শেষ ও বৈশাখ মাসের শুরুর দিনের আনুষ্ঠানিকতাকে সাঁওতালরা বলেন চৈত বিসুয়া। রীতি অনুসারে মুণ্ডা আদিবাসীরা বৈশাখের প্রথম দিন দল বেঁধে শিকারে বের হলেও সাঁওতালরা শিকারে বের হয় শেষ চৈত্রে। সে কারণেই মহত মঙ্গল শিকারে বের হয়েছেন তার দল নিয়ে।

পূর্বপুরুষের আমল থেকেই তির-ধনুক আদিবাসীদের একমাত্র হাতিয়ার। সাঁওতালদের ভাষায় আ্-পরী। আ্ অর্থ ধনুক আর পরী অর্থ তির। যার ধনুকের আঘাতে শিকার মেলে, আদিবাসীদের নিয়মানুসারে সে পায় এক ভাগ বেশি অংশ।

বুধু জানালেন, মঙ্গলদের ১০ জনের দলে যদি ২ জনের তির-ধনুক থেকে শিকার আসে আর যদি শিকার বহনের জন্য কোনো ব্যক্তি দায়িত্বে থাকে, শিকারের ভাগ করা হবে ১৩টি। এর মধ্যে শিকারকারী ও বহনকারী পাবে দুই ভাগ করে আর বাকিরা এক ভাগ করে। এটিই সাঁওতালদের নিয়ম। তবে ভাগবণ্টন নিয়ে কখনো আদিবাসী সমাজে কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সৃষ্টি হয় না। বরং শিকার থেকে ফিরে এরা গোটা পাড়া দল বেঁধে আনন্দ করে আর হাঁড়িয়া খায়।

বুধু জানালেন তাদের প্রিয় শিকার কুলাই (খরগোশ), বিজি (বেজি), কাটাশ, রুন্ডা (বনবিড়াল) প্রভৃতি। খোরগোশের মতো বনের নিরীহ প্রাণীদের হত্যা করা ঠিক কি না, জানতে চাইলে বুধু খানিকটা লজ্জিত হন। জানা যায় তাদের আদি বিশ্বাসেও জীব হত্যা পাপ। তবে প্রথা অনুসারে তাদের পূর্বপুরুষরা যেভাবে শিকার ধরতেন বা খেতেন, তারাও তাই করে আসছেন। তবে এখন অনেক আদিবাসীই শিকারে যেতে চান না। নিজের উদাহরণ দিয়ে বুধু জানালেন অনেকেই পশুহত্যা কিংবা তাদের রক্তও দেখতে পারে না।

চৈত্রের শেষ দিন শিকার করলেও বৈশাখের প্রথমে এরা পান্তা খেয়ে ঠাকুরের কৃপা লাভের আসায় গ্রামপূজার স্থানে সবাই মিলে ধূপ ও সিন্দুর দিয়ে ভক্তি করে। সারা বছর ভালো থাকা আর নানা মনোবাসনার নিবেদন করে ঠাকুরের কাছে। এরপর দিনভর চলে নাচগান।

বুধু আবার ফিরে আসেন রেংটার কথায়। মৃত্যুর সময় রেংটা রেখে যান এক মেয়ে আর সাত ছেলে। মেয়ের বিয়ে হয় পাশের ইউনিয়নে। রেংটার যা জমি ছিল, তা ভাগ হয় ছেলেদের মধ্যে।

আদিবাসী সাঁওতালদের পূর্বপুরুষের নিয়ম অনুসারে পরিবারে মেয়েরা বাবার কোনো সম্পত্তি পান না। মেয়েদের বিয়ের পরে যখন স্বামীর বাড়িতে যান, তখনো স্বামীর সম্পত্তির অংশ তারা পান না। তবে যদি পরিবারে শুধুই মেয়ে থাকে, তবে তারা বাবার সম্পত্তির অংশ পান। বুধু জানালেন সম্পত্তি না পেলেও মেয়েরা সব সময় তাদের ভাইদের সহযোগিতা পেয়ে থাকেন। বিভিন্ন পূজা-পার্বণে উপহারের সঙ্গে মেলে স্বামীসহ দাওয়াত। বিপদের মুহূর্তেও পাশে পান ভাইদের। ফলে সম্পত্তি না পেলেও পান মমতাবোধ, সহযোগিতা আর ভালোবাসা। তাই পূর্বপুরুষদের এই নিয়মকে তারা কোনো বৈষম্য মনে করেন না।

কথায় কথায় আমাদের আসরে আসেন গোত্রের গেনে কুসকু। মহাজনদের মাঠ থেকে কাজ সেরে ফিরেছেন তিনি। তিনি জানালেন তার দৈনন্দিন কাজের কথা।

সারা দিনই কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় আদিবাসী নারীদের। ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে, সবার জন্য রান্না সেরে, তুলসী ঠাকুরকে দুই বেলা ভক্তি দিয়ে আর স্বামীকে খুশি রেখে আদিবাসী নারীদের রোজগারের জন্যও যেতে হয় বাইরের কাজে। তখন ছোট বাচ্চাকেও তাদের সঙ্গে নিতে হয়। গলার মধ্যে বাচ্চাটিকে বিশেষ কায়দায় ঝুলিয়েই কাজ করেন আদিবাসী মেয়েরা। সততার সঙ্গে কাজ করলেও আদিবাসী ও নারী হওয়ায় গেনে কুসকুকে হরহামেশাই মজুরি-বৈষম্যের শিকার হতে হয়। অন্যদের মজুরি এক শ টাকা হলেও গেনেকে দেওয়া হয় আশি টাকা।

রেংটাপাড়ার অভাবী আদিবাসীদের কাছে ধর্ম পরিবর্তনের প্রস্তাব এসেছে বারবার। দূর থেকে আসা খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাসী ফাদারদের পদধূলি পড়েছে কয়েকবার। পূর্বপুরুষদের ধর্মকে বিসর্জন দিয়ে সন্তানের শিক্ষা, পরিবারের চিকিৎসা আর ভবিষ্যতে ভালো থাকার নিশ্চয়তা দিয়েছেন তারা। তবু রেংটাপাড়ার সাঁওতালরা ধর্মান্তরিত হয়নি।

বুধু জানালেন পাশের পাড়ায় কয়েক দিন আগে এসেছিলেন ফাদাররা। গান্ধী মুরমুসহ দুজনকে ধর্মান্তরিত করেন তারা। যিশুর বাণী শুনিয়ে, পানি ছিটিয়ে আর গলায় ক্রুশ পরিয়ে খ্রিষ্টান করা হয় তাদের। বিনা পয়সায় ছেলেমেয়ের পড়াশোনা আর চিকিৎসা মিললেও ওই পাড়ার আদিবাসীদের তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বরং বোঙ্গা আর আদিবাসীদের পূজা-পার্বণের সময় একধরনের কষ্টে থাকেন তারা। পূর্বপুরুষদের আচার আর সংস্কৃতি তাদের কাছে আজ শুধুই কুসংস্কার। আর কুসংস্কার ভেবে এভাবেই ধর্মান্তরিত আদিবাসীরা হারিয়ে ফেলছে তাদের রক্তে মেশা সংস্কৃতিগুলো।

বিকেলের দিকে দল নিয়ে শিকার থেকে ফেরেন রেংটার ছেলে মঙ্গল। শিকার ভাগ করে আমাদের সঙ্গে বসেন তিনি। ঘরে ঘরে তখন রান্নার তোড়জোড়। দু-একজন ক্লান্তি মেটাতে মাটির হাঁড়ি থেকে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছে হাঁড়িয়াতে। টুং টাং করে বাজছে মাদল আর ঢোলগুলো। মঙ্গল জানালেন খ্রিষ্টান না হয়েও তারা এখন তাদের ছেলেমেয়েদের সরকারি স্কুলে পাঠাচ্ছেন। সচেতনতা আর আর্থিক সক্ষমতা লাভের জন্য নিজেদের জাত-ধর্ম বিক্রি করতে নারাজ তারা। বাবা রেংটার সাঁওতালি সংস্কৃতিকে তিনি টিকিয়ে রাখবেন, এটাই মহত হিসেবে তার প্রতিশ্রুতি।

সন্ধ্যা হতেই চৈতবিসুয়া উৎসব জমে ওঠে। রেংটাপাড়ায় শুরু হয় সাঁওতালদের নাচ। অভাব, অনটন আর নানা বৈষম্য বুকে নিয়েই নেচে-গেয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন রেংটাপাড়ার আদিবাসীরা।

Link copied!