পৃথিবীর প্রথম কবি এনহেদুয়ান্না। কবিতার জননী তিনি। স্বীকৃতি পেয়েছেন যিশুর জন্মের বহু-বহুযুগ আগেই। অথচ বাংলাদেশে এখনও কূটতর্ক চলে, নারীরা কবিতা লিখেতে পারেন কিনা। কবি বলতেই এখনও একজন পুরুষের অবয়বই অনেকের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তার মানে কবি মানেই পুরষ?
নিঃসন্দেহে কবিতা এক দুরূহ শিল্পকর্ম। শিল্পের সব শাখার মধ্যে সম্ভবত কবিতাই সবচেয়ে জটিল। আর এ শিল্পের জন্যে কবিকে মননে ও কল্পনায় রক্তস্রোতে বইয়ে দিতে হয় জীবনাবধি।
প্রাকধারণায় বিশ্বাসী হয়ে ধরেই নেয়া হয় এ ধরনের জটিল, কঠিন ও জীবন বিলিয়ে দেয়া শিল্প সাধনা আর যারই হোক নারীর কর্ম নয়। হ্যাঁ সমাজের সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা পুরুষের চেয়ে শিল্পের অসীম যাত্রায় নারীর শামিল হওয়া দুঃসাহসী পদক্ষেই বটে। আর এ দুঃসাহসেরই নামান্তর হয়ে ওঠেন একজন খনা, রামী রজকিনী, মাধবী কিংবা চন্দ্রাবতী। পুরুষতান্ত্রিক মিথ আর মিথ্যার ব্যুহ ভেদ করে তারা ঠিকই জ্বলে উঠতে পেরেছেন। কাব্যপ্রান্তরে আপন স্বাক্ষর রেখেছেন মেধা আর তেজস্বিতার আলোকবিভায়।
বাংলাদেশের নারী কবিরাতো তাদেরই যোগ্য উত্তরসূরি। এ কবিরা নারীদের পিছিয়ে রাখার নানা সামাজিক, সাংস্কতিক, ধর্মীয়, পারিবারিক সর্বোপরি পুরষতান্ত্রিক সকল বাধা ডিঙিয়ে ঠিকই কাব্য শিল্পের বেদিমূলে পূজার আচার সার্থক ভাবেই সাজাতে পেরেছেন।
এখন প্রশ্ন আসে কবিতায় কবির জেন্ডারের প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু? এ নিয়ে আলোচনা মানুষ হিসেবে নারীর ঊনতারই প্রকাশ নয় কি? কিন্তু গভীরে নজর দিলে দেখা যায় প্রসঙ্গটি দিনে দিনে চাবুকের মতো আরো ধারালো হয়ে আমাদের নিত্য শিল্পজীবিতাকেই যেন মশকরা করছে। পুরুষ নিয়ন্ত্রিত আমাদের চারপাশে নারী সহজেই উপেক্ষিত, প্রায়শই প্রসঙ্গহীন।
বাস্তবতা হলো এদেশের কবিতার প্রান্তর আরো বেশি পুরুষ নিয়ন্ত্রিত। নারী যেন এখানে উঁকিঝুঁকি মারা নিঃসঙ্গ এক উপলক্ষ্য মাত্র। কেবল কবিতার কথাই বলছি কেন, শিল্প সাহিত্যের অন্যান্য শাখাসহ যাপিত জীবনের সকল স্তরেই নারীর উপস্থিতিকে খাটো রাখার প্রয়াস ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও হয়তো থাকবে।
কিন্তু খাটো রাখার এ প্রয়াসকে উড়িয়ে নিতে কেবল কথায় নয় কাজেও এগিয়ে আসতে হয় কাউকে না কাউকে। সেরকমই একজন এ দেশেরই বিখ্যাত লেখক, সমালোচক ও অনুবাদক আলম খোরশেদ। তিনি হায়দ্রাবাদনিবাসী ভারতের প্রখ্যাত কবি, অনুবাদক ও সাহিত্যের শিক্ষক নবীনা দাসকে সাথে নিয়ে গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশে নারী কবিদের অর্জন তুলে ধরতে একটি সংকলন প্রকাশ করেছেন। নাম ‘অ্যারাইজ আউট অব দ্য লক’। এর মুখবন্ধ রচনা করেছেন ঢাকা লিট ফেস্টের পরিচালক কবি সাদাফ সিদ্দিকী। যা সংকলনটিতে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে প্রকাশিত সংকলনটিতে ৫০ জন বাংলাদেশী নারী কবির প্রত্যেকের এক কিংবা একাধিক কবিতার ইংরেজি অনুবাদ স্থান পেয়েছে, যা দিয়ে অনায়াসে বিগত পঞ্চাশ বছরে এ দেশের কবিতায় নারীর কন্ঠস্বরকে চিনে নেয়া সম্ভব হচ্ছে। সেদিক থেকে সংকলনটি অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যবাহী।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এদেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন এমনকি নারীর ক্ষমতায়নে আমরা কতোদূর এগুলাম তা নিয়ে অনেক চুলচেরা বিশ্লেষণ ও হিসেবনিকেশ দেখেছি। কিন্তু শিল্পসাহিত্য বিশেষত কবিতায় গত পঞ্চাশ বছরে নারীর অর্জন কোথায় কতোদূর পৌঁছালো তা জানার কি কোনো উপায় আছে? আমার জানা মতে নেই। আর এ উপায় মেটাতেই অনিবার্যভাবে আমাদের দ্বারস্থ হতে হবে এই সংকলনের।
এতে কবি সুফিয়া কামাল থেকে নবীনতম কবি শ্বেতা শতাব্দীকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে বিগত অর্ধশতাব্দী কালে বাংলাদেশের কাব্যাঙ্গনে নারীদের অর্জনের বিশ্বস্ত এক দলিল হয়ে উঠেছে এই সংকলন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ এবং তৎপরবর্তীকালের আর্থসামাজিক পরিবর্তনে জীবনাভিজ্ঞতার বাঁকবদলে নারীর পদচিহ্নের রূপায়ন কবিতায় কতোটুকু ফুটে উঠছে তা জানার এক সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করেছে ‘অ্যারাইজ আউট অব দ্য লক’ নামের সংকলনটি।
যে ৫০ নারী কবি এতে স্থান পেয়েছেন তারা হলেন সুফিয়া কামাল, খালেদা এদিব চৌধুরী, আনোয়ারা সৈয়দ হক, ফরিদা মজিদ, মেহেরুন্নেসা, জিনাত আরা রফিক, সুরাইয়া খানম, রুবি রহমান, কাজী রোজী, জরিনা আখতার, শামীম আজাদ, নাসরীন নঈম, দিলারা হাফিজ, অঞ্জনা সাহা, নুরুন্নাহার শিরীন, নাসিমা সুলতানা, শাহজাদি আনজুমান আরা, ঝর্না রহমান, তসলিমা নাসরিন, রহিমা আখতার কল্পনা, ফেরদৌস নাহার, বিলোরা চৌধুরি, শাহনাজ নাসরীন, কচি রেজা, লিসা গাজী, শাহনাজ মুন্নি, শেলী নাজ, নাহার মনিকা, আয়শা ঝর্না, শান্তা মারিয়া, মেঘ অদিতি, মণিকা চক্রবর্তী, অলকা নন্দিতা, ফারহানা রহমান, জুনান নাশিত, নাহিদা আশরাফী, অদিতি ফাল্গুনী, রহিমা আফরোজ মুন্নি, নভেরা হোসেন, জাহানারা পারভীন, সাকিরা পারভীন, সাবেরা তাবাসসুম, আসমা বীথি, নীতু পূর্ণা, আসমা অধরা, আফরোজা সোমা, রিমঝিম আহমেদ, শাফিনূর শাফিন, মাহি ফ্লোরা এবং শ্বেতা শতাব্দী এষ।
সংকলনে স্থান পাওয়া এসব কবির কবিতাগুলো অনুবাদ করেছেন নবীনা দাস। আমরা কম বেশি সকলেই জানি কবিতার অনুবাদ কবিতা লেখার চেয়েও কম দুরূহ কাজ নয়। আর মূল ভাব ঠিক রেখে কবিতার অনুবাদ প্রায়শই অসম্ভব হয়ে ওঠে। বলা হয় অনূদিত কবিতায় মূল কবিতার নির্যাস হারিয়ে যায়। তবুও ভিনদেশী পাঠকের কাছে কবিতা পৌঁছে দিতে অনুবাদই তো একমাত্র ভরসা। নবীনা দাস কৃতিত্বের সাথে দুরূহ কাজটি সামলে নিতে পেরেছেন বলেই অতি সহজেই এদেশের ৫০ জন নারী কবির কবিতা বহির্বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে, যা অত্যন্ত জরুরি ছিল। আলম খোরশেদ সার্বিক সম্পাদনার দায়িত্বে থেকে এ জরুরি ও অভিনন্দনযোগ্য কাজটুকু অত্যন্ত দরদ ও যত্নের সঙ্গেই করতে পেরেছেন। বিশ্বের দরবারে বাংলা কবিতাকে পৌঁছে দেয়ার গুরুদায়িত্ব তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গেই পালন করেছেন। তাই তাকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়।
সংকলনের শেষ প্রচ্ছদে বিশিষ্ট অনুবাদক ও প্রকাশক ডেবোরাহ স্মিথ এবং কবি ও অনুবাদক বিবেক নারায়ণনের মন্তব্য সংকলনটিকে করেছে আরো ওজনদার।
বালেসটিয়ার প্রেস, সেনচুরিয়ন হাউজ, লন্ডন থেকে ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছে। এর প্রচ্ছদ এদেশের বিশিষ্ট ভাস্কর নভেরা আহমেদের ভাস্কর্য অবলম্বনে করা হয়েছে যা দৃষ্টিনন্দন, হৃদয়গ্রাহী এবং অত্যন্ত রুচিশীলতারও পরিচায়ক।
সময়ের অসামান্য দলিল ও স্মারক হয়ে ওঠা সংকলনটি কাব্যামোদী সকলেরই সংগ্রহে রাখা উচিত বলে মনে করি।