• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
প্রকৃতি

আকনাদি : পাতাগুলো যেন কথা


মোহাম্মদ আলি
প্রকাশিত: জুন ১৫, ২০২৩, ০২:৪৭ পিএম
আকনাদি : পাতাগুলো যেন কথা
আকনাদি। ছবি: লেখক

ধরা যাক, কোনো বাগানিকে বলা হলো—আপনি তো ফুল ও ফলের অনেক গাছ লাগিয়েছেন, পাতার জন্য কোনো গাছ লাগিয়েছেন কি? উত্তর হয়তো আসবে লাগিয়েছি তো, এই ধরেন পাতাবাহার, ফার্ন।—পাতার সৌন্দর্যবাহী কোনো লতা? হ্যাঁ মানিপ্ল্যান্ট, লতাবট। সত্যি বলতে কি, এগুলো সব দীর্ঘদিন চর্চিত ও গৎবাঁধা গাছের তালিকা। পাতার সৌন্দর্যের দিকে চেয়ে কেউ যদি বাগান করতে চান, তাহলে আমাদের আশপাশেই রয়েছে অনেক অনেক সুন্দরের হাতছানি। এই যেমন আকনাদির কথাই তোলা যাক। বাগানের জন্য আমরা কেন বেছে নিচ্ছি না রূপের খনি আকনাদিকে? প্রথম দেখায় লতাটি এমনই ভাবে তার সুন্দর পাতাগুলোকে পূর্ণভাবে আপনার সামনে উপস্থাপন করবে যে, ফুল নয়, যেন এর পাতাই হবে একেকটি কথা।

আমাদের বসতবাড়ির আশপাশ, পতিত জায়গা, বনতল, জলাভূমির ধার, পথের দুপাশে যখন-তখন দেখতে পাওয়া যায় যে-কয়টি লতা, তার মধ্যে আকনাদি অন্যতম। উদ্ভিদতাত্ত্বিক নামের পাছে japonica আছে বলে অনেকে আমরা ভড়কে যাই এই ভেবে যে লতাটি (Stephania japonica) নিশ্চয়ই জাপানের; আমাদের দেশে হয়তো জাপানের হাত ধরেই এটি এসে থাকবে—যে রকম এখন আসছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে। শৌখিন বাগানি ও অতিকায় দালানওয়ালাদের বিদেশি গাছগাছড়ার ক্ষুধা মেটাতে নার্সারিওয়ালারা থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের দেশে আলংকরিক উদ্ভিদসহ বিচিত্র ফুল ও ফলের গাছ ঢোকাচ্ছে অহরহ। এতে যেমন উদ্ভিদজগতে নতুনত্বের স্বাদ পাচ্ছি আমরা, তার সঙ্গে বাড়ছে উদ্ভিদ-অরাজকতাও।

পৃথিবীর অনেক দেশে এমন আইন রয়েছে যে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া এক দেশের গাছ অন্য দেশে আনা-নেওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদের স্বকীয়তা ও বৈচিত্র্যকে অন্য প্রজাতিগুলো যাতে হুমকির মুখে ফেলে দিতে না পারে, তার জন্য এ ব্যবস্থা। আমাদের দেশে সে রকম কোনো বিধিবিধান আছে কি না, জানা নেই, থাকলেও তার কোনো নমুনা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। লান্টানা বা লণ্ঠন (Lantana camara) নামের সুন্দর ফুলদায়ী বিদেশি গুল্মটিকে তো দেশের সব ঝোপঝাড়ে দেখা যায়ই, গহিন অরণ্যের মধ্যেও তার দেখা মিলবে। এমনভাবে দেখা মিলবে যেন সে এ মাটিরই একান্ত নিজস্ব গাছ! সে যাক, ফিরে আসি আকনাদির কথায়। এই ফাঁকে এটুকু শুধু বলে রাখি যে আকনাদি আমাদের দেশীয় লতা।

আকনাদির অনেকগুলো নাম রয়েছে আমাদের দেশে; তার মধ্যে নিমুখা, আকন্দি, মাকন্দি, মুছিলতা, মুছিন্দা, পাটামুছন্দি, মানিক, পাঠা, একলেতি ইত্যাদি। দেশ ও বঙ্গাল মুলুকজুড়ে এর আরো অনেক নাম থেকে থাকবে, আমার স্থির বিশ্বাস। নামের প্রকার-বাহার দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশজুড়ে এটি বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। ঢাকা জেলা ও এর আশপাশ এলাকাতে প্রচুর দেখা মিলবে। ইংরেজিতে এর নাম Snake vine; বাংলা করলে দাঁড়ায় সাপলতা। হ্যাঁ, সাপলতাই; কেননা এর লতাগুলো (ডালপালা) কোনো কিছুকে, বিশেষ করে কোনো গাছকে অবলম্বন করে আষ্টেপৃষ্ঠে, সর্পিলভাবে ওপরের দিকে বেয়ে ওঠে। গ্রামগঞ্জের জলাভূমির এদিক-ওদিক তাকালে আপনার চোখে পড়বে কোনো একটি গাছকে আঁকড়ে ধরে তলোয়ারের ঢালের মতো, মাকড়সার জালের মতো শিরা ছড়ানো পাতাগুলো যেন আপনার দিকেই চেয়ে আছে। পাতার পূর্ণ অভিব্যক্তি, লতার সর্পিল অবয়ব, ফলের বিচিত্র রঙিন আভা, ঔষধি হিসেবে এর কার্যকারিতা—সব মিলিয়ে সবুজ বাংলার অতি সুন্দর লতানো উদ্ভিদের নাম আকনাদি।

শুরুর প্রসঙ্গে আসা যাক। আসলে কোনো একটি গাছের থাকা, না-থাকাটা নির্ভর করে সে-দেশ কিংবা অঞ্চলের জলবায়ু কী রকম, তার ওপর। এ প্রসঙ্গে মূল্যবান একটা তথ্য দিয়ে রাখি : বাংলাদেশে যত গাছ রয়েছে, তার প্রায় সবই রয়েছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে—নির্দিষ্ট একটি গাছ কোনো একটি দেশে কম বা বেশি, পার্থক্য শুধু এই। (তবে বাংলাদেশের একান্ত দেশীয় উদ্ভিদ হিসেবে বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়াম ৭-৮টি উদ্ভিদকে শনাক্ত করে রেখেছে, যা দুনিয়ার আর কোথাও পাওয়া যাবে না। সে-কথা ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক।) সুতরাং কোনো একটি দেশের স্মারক দ্বিপদি বৈজ্ঞানিক নামের শেষ পদে থাকলেই সেটি যে সে-দেশের একান্ত সম্পদ হয়ে যাবে তা মনে করার কোনো কারণ নেই। আমাদের বট বা মাধবীর নামের পেছনে (যথাক্রমে Ficus benghalensis  ও Hiptage benghalensis) benghalensis রয়েছে বলেই সেটি আমাদের একান্ত দেশীয় হয়ে যাচ্ছে, তা তো নয়। আমাদের এই আকনাদির ভৌগোলিক ব্যাপ্তি দেখলেই আপনারা বুঝে যাবেন এর সত্যাসত্য। ভারত ও নেপাল থেকে একাধারে জাপান পর্যন্ত এবং শ্রীলঙ্কা, মালয় দ্বীপপুঞ্জ, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকার উষ্ণমণ্ডলীয় দেশগুলোতে এর দেখা মিলবে। আসলে এ লতাটির নমুনা প্রথমে জাপান থেকে জোগাড় করা হয়েছিল বলেই উদ্ভিদতাত্ত্বিক নামের পেছনে japonica যোগ হয়েছে কেবল।

একটা মজার কথা বলে রাখি এ প্রসঙ্গে: বিজ্ঞানীদের নিত্যনতুন গবেষণার ফলে দুনিয়াজুড়ে কোনো একটি নির্দিষ্ট উদ্ভিদের নাম কিছুদিন পরপর পাল্টে যায়। এমনও হয়েছে যে একটি গাছের নাম পাল্টেছে কমসে কম ৬৩ বার (কালোকেশী, Eclipta prostata)। সেটা কেন হয়, তার গল্প করা যাবে আরেক জায়গায়। এখানে কেবল আশা রাখতে পারি, অন্যান্য অনেক গাছের মতো উপযুক্ত গবেষণা-শেষে এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম থেকে japonica শব্দটি অচিরেই গায়েব হয়ে অন্য কোনো শব্দ বসবে।

আকনাদি লতা বহুবর্ষজীবী। চিকন-চিকন ডাল নিয়ে পরস্পরকে পেঁচিয়ে বাড়ে কোনো অবলম্বন, বিশেষ করে কোনো বৃক্ষকে ধরে। গোড়ার দিকের কাণ্ড কিছুটা কাষ্ঠল। কাণ্ড ও ডাল নলাকার, মসৃণ ও শিরাল। কচি ডাল অনেক সময় রোমশ—তা যে পোকামাকড়ের হাত থেকে কচি শরীরকে রক্ষা পাবার ফন্দি, তা আর নতুন কী। লাউয়ের মতো এর কোনো আকর্ষী (tendril) নেই, ডালগুলোই সে কাজ করে।

আকনাদির পাতা কালচে-ফিকে সবুজ, প্রশস্ত ত্রিভুজ-ডিম্বাকৃতির; ৩-১২ সেমি লম্বা ও ২-৯ সেমি চওড়া। আগার দিকটা, আমরা বলব লেজ, বেশ প্রসারিত, ক্রমশ চিকন। পাতার বোঁটা ২-৯ সেমি। সাধারণত বোঁটা যে রকম ফলকের গোড়ায় লেগে থাকে এটির ক্ষেত্রে তা লেগে থাকে পাতার মাঝামাঝি, বলা ভালো সেটির দুই-তৃতীয়াংশ অবস্থানে গিয়ে; আমাদের চন্দনার (Macaranga peltata) পাতা যেমন। পাতার দুপাশটাই মসৃণ, তবে নিচের দিকে মাঝেমধ্যে বোঁটাকে কেন্দ্র করে সামান্য রোম দেখা যেতে পারে। বোঁটার সংযুক্তির জায়গা থেকে শিরাগুলো চারদিক ছড়ানো থাকে, যা পাতার সৌন্দর্যের অন্যতম প্রধান কারণ।

আকনাদির একই লতায় দুই ধরনের ফুল ধরে। পুরুষ ফুল সবজেটে সাদা কিংবা হলদেটে, ফুলের বোঁটা প্রায় নেই বললেই চলে। বৃত্যাংশ ৬-৮, পাপড়ি ৩-৪টি। স্ত্রী ফুল পুরুষের মতোই কমবেশি দেখতে, বৃত্যাংশ ও পাপড়িসংখ্যাও তাই। তবে মাঝেমধ্যে এর বৃত্যাংশের সংখ্যা কম হতে পারে। বর্ষায় আকনাদির ফুল আসে। ফুলের অনুজ্জ্বৌল্য লতাটি পুষিয়ে নেয় ফলের রক্তিম উপস্থিতি দিয়ে। গুচ্ছে গুচ্ছে মটরদানা আকৃতির ফলগুলো ধরে শরতের শেষে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের পরিভাষায় ফলগুলো ড্রুপ, ১ সেমি ব্যাসের, গোল কিংবা লম্বাটে। কাঁচা ফলের রং সবুজ। এরপর হলুদ, কমলা হয়ে টকটকে লাল রং ধারণ করে পেকে গেলে, যে রকমটি হয় এর নিকটাত্মীয় গুড়ঞ্চলতাতে (Tinospora cordifolia)। আকনাদির ফলে বীজ হয় ১টি, বাঁকানো। বীজের মাধ্যমেই লতাটি তার বংশবিস্তার করে।

বাঙালি হিন্দু-বিয়ের রীতি অনুযায়ী বরকে বাঁধার অনুষঙ্গ হিসেবে আকনাদিকে ব্যবহার করা হতো একসময়। এ ছাড়া বিভিন্ন লোকাচারে এর ব্যবহার রয়েছে। সুপ্রাচীন অথর্ববেদে এর উল্লেখ রয়েছে ‍‍‘পাঠা‍‍’ নামে। এর কয়েকটি সংস্কৃত নাম রয়েছে, সেগুলো অম্বষ্ঠা, অম্বষ্ঠী, অম্বষ্ঠকী, শ্রেয়সী ইত্যাদি। আকনাদির পুরোনো নাম আকন্দি। পৃথিবীর সবকিছুই পাল্টায়, বিবর্তিত হতে থাকে কালচক্রের রীতি ধরে। লোকমুখে আকন্দিই আকনাদিতে রূপ পেয়েছে, এটা অনুমান করে বলা যেতে পারে।

রোগনাশিনী হিসেবে আকনাদির বেশ সুনাম রয়েছে চরক-সুশ্রুতের আমল থেকে। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔষধি। শিকড়সহ পুরো গাছটিই ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করার প্রচলন রয়েছে বৈদ্যসমাজে। দইয়ের সঙ্গে এর শিকড় খাওয়ালে কলেরায় উপকার পাওয়া যায়। পাতা ঘোলের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে আমাশয় ভালো হয়। উদ্ভিদটির রয়েছে পিত্তজ্বরনাশক গুণ। বদহজমজনিত অরুচিতে এর পাতার বাঁটা ঘিয়ে ভাজা ভাতের সঙ্গে খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। গর্ভসঞ্চার নিয়ন্ত্রণে এর পাতা ব্যবহার করা হয়। পাতা ও শিকড়ের রস গলাতে কফের ঘনঘটায় ব্যবহৃত হয়। পেটব্যথাতেও এ দুইয়ের যোগে উপকার পাওয়া যায়। পাতা ও গাছসেদ্ধ মায়েদের বুকের দুধ শোধনে ব্যবহৃত হয়। এর মূলের রস পেটস্থ ফোঁড়া ফাটাতে ব্যবহার করা হয়। শ্বেতপ্রদর বা যোনিস্রাবে চিনিসহ আকনাদির পাতা শরবতের মতো করে খাওয়ালে উপকার পাওয়া যায়। বাচ্চা প্রসবে দেরি হলে শিকড়-বাঁটা প্রসবদ্বারে রেখে দিলে প্রসব ঠিকঠাকমতো হয় বলে লোকবিশ্বাস রয়েছে উপমহাদেশের কোথাও কোথাও।

আগেই বলা হয়েছে এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Stephania japonica, উদ্ভিদটি Menispermaceae পরিবারের সদস্য। এর ইংরেজি নাম Snake vine।

সবার শেষে দু-একটা প্রশ্ন দিয়ে শেষ করা যাক আকনাদি-কীর্তন। এই যে এর পাতার এত গুণগান গাইলাম, এর পাতার গড়নটা এ রকম হৃদয়াকৃতি ঢালের মতো কেন, সেটা কি কেউ জানেন? আর ফলগুলো পাকার আগে সেগুলো যে কয়েকটি রঙে নিজেদের রাঙিয়ে নেয়, তারই-বা কারণ কী?

Link copied!