• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অনিমেষের সঙ্গে আর হবে না দেখা


নাইস নূর
প্রকাশিত: মে ৯, ২০২৩, ০৯:৪১ এএম
অনিমেষের সঙ্গে আর হবে না দেখা

টেলিভিশনের এক সাক্ষাৎকারে উপস্থাপিকা আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনি তো অনেক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। কয়েকটির স্মৃতি বলুন।” সবার আগেই বলেছিলাম দুই বাংলার জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদারের প্রথম সাক্ষাৎকারের কথা।

সালটা সম্ভবত ২০১৪ সালের মার্চ। এক বন্ধুর কাছে জানতে পারলাম সমরেশ মজুমদার ঢাকায়। আমার তো তার একটা ইন্টারভিউ চাই-ই। আসলে ইন্টারভিউর থেকে জরুরি তার সঙ্গে একটু দেখা করা। অন্তত একটা অটোগ্রাফ।

জানতে পারলাম আবিষ্কার প্রকাশনার প্রকাশক দেলোয়ার হাসান ভাইয়ের সঙ্গে সমরেশ মজুমদারের সুসম্পর্ক। বাংলাদেশে আবিষ্কার থেকেই সমরেশ মজুমদারের সব বই প্রকাশিত হয়। জানার পরপরই দেলোয়ার হাসান ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। বললাম, সমরেশ মজুমদারের একটা সাক্ষাৎকার নিতে চাই। প্রথমে উনি বললেন, “সাক্ষাৎকার নেওয়ার সব শিডিউল অলরেডি হয়ে গেছে। দেখি, আপনার জন্য কোনো সময় বের করা যায় কি না।” আমি অপেক্ষা করছি। প্রথমে না-ই হয়ে গিয়েছিল। পরে আমাকে জানানো হলো পরদিন সকাল সাড়ে ৯টায় ঢাকা ক্লাবে উনি সাক্ষাৎকার দেবেন। শর্ত একটাই, এক মিনিটও দেরি করা যাবে না।

আমিও বললাম, “হবে না। সময়মতো চলে আসব।” কিন্তু পরদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙল সকাল ৯টায়। সময় আছে আর ৩০ মিনিট। রেডি হব কখন? ব্রেকফাস্ট করব কখন, যাব কখন? এই ভাবতে ভাবতে আমি একটু ফ্রেশ হয়েই ঝটপট একটা মাথায় ঝুঁটি করলাম। হাতে একদম সময় নেই। শার্ট আর একটা প্যান্ট পরে দিলাম দৌড়। চোখে আমার ঘুম ঘুম আছেই। ভাগ্য ভালো, সেদিন ঢাকায় জ্যামটা ছিল না। শাহবাগে তাড়াতাড়ি পৌঁছালাম। মোবাইলটা বের করে দেখলাম সাড়ে নয়টা পার হচ্ছে। কী আর করা। শাহবাগ থেকে ঢাকা ক্লাব আমি দৌড়ে গিয়েছি। পৌঁছানোর পর তখন পৌনে ১০টা। আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। লবির সোফা থেকে তিনি উঠেছেন মাত্র, এক্ষুনি চলে যাবেন। আমি তখনই ঢুকলাম। আমার অস্থিরতা দেখে তিনি বুঝতে পারলেন আমার কী অবস্থা।

প্রথমে সরি বলে বললাম, “ঘুম থেকে জাগতে পারি নাই।” আমাকে বসতে বলে শান্ত হয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। আমি সাক্ষাৎকারের জন্য কোনো প্রশ্ন আগে থেকে রেডি করিনি। একদম জিরো প্রস্তুতি। কিন্তু ঝটপট বলতে শুরু করলাম তার লেখা প্রতিটা উপন্যাসের কথা। চরিত্রের কথা। উনি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর আমার সম্পর্কে উল্টো তিনিই জানতে চাইলেন। আমার পড়াশোনা কোথায়! ভাইবোন এসব। একে একে সব বললাম। খুব বিনয়ের সঙ্গে তিনি বললেন, “তোমার চোখ স্পার্ক করে। তোমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।”

এবার আমার একটু অভয় হলো। অনুমতি নিয়ে সাক্ষাৎকার শুরু করলাম। সাক্ষাৎকারের একটা প্রশ্ন ছিল “আপনার দৃষ্টিতে সাহিত্য এবং চলচ্চিত্র।” উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “দুটি আলাদা মিডিয়াম। কাবাব ও কালিয়া একই মাংসের হলেও স্বাদ কিন্তু আলাদা।” আর একটা প্রশ্ন ছিল ‘আপনার লেখা গল্পের চলচ্চিত্র আপনার কেমন লাগে?’ বলেছিলেন, “আসলে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার পর বাবা যদি চিন্তা করে শ্বশুরবাড়িতে মেয়ে কখন কী দিয়ে ভাত খায়, তাহলে সে বাবা তো মূর্খ।” তবে সেদিন সময়ের অভাবে আর খুব বেশি প্রশ্ন করার সুযোগ হয়নি।

বিদায় নেওয়ার আগে সমরেশ মজুমদার বললেন, “আল মাহমুদ এখন কেমন আছেন? আল মাহমুদের সঙ্গে দেখা হলে আমার নমস্কার জানাবেন। আমি অনেক শ্রদ্ধা করি তাকে। অনেক বড় মাপের কবি তিনি।” আমাকেও নমস্কার দিয়ে বিদায় জানালেন।

এত বড় একজন সাহিত্যিক কিন্তু কোনো অহংকার নেই। প্রথম দেখায় শ্রদ্ধা এবং মুগ্ধতা বেড়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়বার তার সঙ্গে আবার ঢাকা ক্লাবেই আমার দেখা হয়েছিল। আমাকে চিনতে পেরেছিলেন তিনি। বললেন, “চলো, ব্রেকফাস্ট করতে করতে কথা বলি।” সেদিন গল্প, ইন্টারভিউ খুব জমে উঠেছিল। কথার শেষে তিনি আমার একটা নাম দিলেন। নামটা হলো ‘শোভানালো’। প্রথমে আমি বুঝতে পারলাম না। পরে ভেঙে বললেন শোভন যে আলো। যেহেতু ইন্টারভিউ রেকর্ড হচ্ছিল, তখন এই কথাও রেকর্ড হয়েছে। তবু আমি অনুরোধ করলাম কাগজে নামটা লিখে তার সিগনেচার দিতে। এর কারণ একটাই, কেউ পড়ে এটা আর বিশ্বাসই করবে না। প্রথমে এই আবদার রাখতে তিনি রাজি হলেন না। পরে ঠিকই লিখে দিলেন। আমি খুশি হয়ে মৃদু হাসি দিলাম। ইন্টারভিউ নেওয়ার পাশাপাশি সেদিন জীবনবোধ সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি। বুঝতে পেয়েছি কেন তিনি অসংখ্য নারীর প্রিয় লেখক। যখন জানলাম সমরেশ মজুমদার আর নেই। একটু নীরবই থেকেছি। রিফাত আপু মেসেঞ্জারে লিখল, “সমরেশ মজুমদার আর নেই শুনলাম। তোমার সঙ্গে তো দেখা হয়েছে? তুমি লাকি।”

সন্ধ্যার পর অবেলায় ফেসবুক ব্রাউজিং করি প্রতিদিন। তবে এই সন্ধ্যা অন্য রকম। প্রিয় লেখককে নিয়ে সবার কত শত রঙিন পোস্ট। উপস্থাপিকা সোনিয়া রিফাত স্ট্যাটাসে লিখেছেন, “মনে পড়ে ক্লাস নাইনে ফাইনাল পরীক্ষার সময় ইংরেজি পরীক্ষার হলে বসে চিন্তা করছিলাম শেষমেশ অনিমেষ কি মারা যাবে? মাধবীলতা কি তাকে ফিরিয়ে নেবে? কারণ, কয়েকটি পাতা বাকি রেখে যেতে হয়েছিল পরীক্ষার হলে।”

আমার মনেও নাড়া দিল এই কথাগুলো। সমরেশ মজুমদার কিংবা অনিমেষ কারও সঙ্গে আর আমাদের দেখা হবে না। না বাস্তবে, না চরিত্রে। বিদায় অনিমেষ।

Link copied!