• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথ

কতটা মৌলিক সৃজন তারা, কতটা প্রভাবিত


আকিমুন রহমান
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৬, ২০২২, ০৪:১২ পিএম
কতটা মৌলিক সৃজন তারা, কতটা প্রভাবিত

কাহিনিগুলো
 

মার্ক টোয়েনের দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব টম সয়্যার বেরোয় ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে, আর দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন প্রকাশিত হয় ১৮৮৪ সালে।
 

দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব টম সয়্যার আখ্যানটি অতীব ঘটনাবহুল, আর বিচিত্ররকম রোমাঞ্চ অভিযানের বিবরণে ভরা। এ উপাখ্যানের নায়ক টম সয়্যার। টম এক অনাথ বালক। তাকে আর তার সৎভাই সিদকে শেষে আশ্রয় নিতে হয় তাদের আত্মীয় পলি আন্টির কাছে। সেটা তখন ১৮৪০-এর আশপাশের সময়, মিসৌরির সেন্ট পিটার্সবুর্গ নামের শহরের এক প্রান্তে পলি আন্টির বাস। আন্টি চায় টম সমাজ-সংসারের সব নিয়মবিধি শিক্ষা করে করে, সভ্যভব্য একটা ছেলে হয়ে উঠুক, প্রতিদিন সে ঠিকঠাকমতো স্কুলে যাক। রোববার সকাল করে করে, সে, চার্চের প্রার্থনায় যোগ দিক। খাওয়ার টেবিলের আদবকেতাও ভালোভাবে শিখে উঠুক টম। আর তারপর, লোকে যেন ভালো ছেলে বলে টমকে ধন্য ধন্য করতে থাকে।
কিন্তু অত নিয়ম মানামানি, অত নিত্যনিয়মিত স্কুলে যাওয়া-যাওয়ির বিষয় আশয় টমের ভালো লাগে না। তার ভালো লাগে স্কুল পালাতে। কেবলই তার মন চাইতে থাকে, যখন খুশি তখন নদীতে সাঁতার কাটতে যেতে। তাই সে প্রায় প্রায়ই আন্টির চোখ এড়িয়ে, স্কুল ফাঁকি দিতে থাকে। স্কুল বাদ দিয়ে সে, আশ মিটিয়ে খেলতে থাকে। নইলে চলে যায় নদীতে সাঁতার কাটতে।
 

তবে ওই সবের কোনো কিছুই আন্টির খর-নজরের অগোচর থাকে না। ফলে স্কুল ফাঁকি দেওয়ার জন্য শাস্তিও পেতে থাকে টম। একবার শাস্তি হিসেবে আন্টি তাকে দেয় বাড়ির বাইরের বেড়াটাতে রং-করার কাজ। টম কাজে হাত লাগায় বটে,তবে অচিরেই তার মাথায় একটা অভিনব বুদ্ধি খেলে যায়। সে তার বয়সী অড়শী-পড়শী সকল ছেলেকে বোঝাতে থাকে যে, অমন করে বেড়াকে রং করতে পারাটা কোনো হালকা ব্যাপার নয়। এটা হচ্ছে দারুণ মজার কাজ।  ছেলেরা টমের ফুসলানিতে পড়ে প্রলুব্ধ হয়ে ওঠে,আর একে একে এসে রং-করার কাজে হাত লাগাতে থাকে। ফলে টমকে আর কষ্ট করে সমস্তটা বেড়াকে রং করার কাজটাতে লেগে থাকতে হয় না। 
 

এক রোববারে টম, অমন বুদ্ধির জোরে, চার্চের সেরা পুরস্কারটাও জিতে ফেলতে পারে। তখন তার সহপাঠীরাই শুধু তাকে ঈর্ষা করতে থাকে না, পড়শী বড়রাও বিস্মিত হয়ে ওঠে।
একটু বড় হতে হতেই টম প্রেমেও পড়ে যায়। মেয়েটির নাম বেকি থ্যাচার। ওটি তার প্রথম প্রেম। ওই প্রেমে খানিকটা ভুল-বোঝাবুঝি থাকে, একটু দূরে চলে যাওয়া, আবার কাছে আসার বিষয়ও চলতে থাকে। ওই প্রণয়পর্ব শুরু হবার আগেই অবশ্য টমের সঙ্গে সেই ছেলেটির দেখা হয়ে যায়! সেই ছেলেটা! যে কিনা অতি ছন্নছাড়া আর আত্মীয়পরিজনহীন একজন। যার কিনা থাকার মধ্যে আছে এক বাবা; সেই বাবা অতি ভয়ংকর রকমের মদখোর আর হিংস্র ও গোলমেলে এক লোক। তার মদ কেনার পয়সা জোটাতে হয় হাককেই, ওই ওইটুকু বয়সেই। টাকা জোটাতে না-পারলে সে হাককে কঠিনরকম মারধর করে, নিত্যদিন। এই বাবাটা নিজে তো  নোংরা আর বিদঘুটে হয়ে থাকেই, নিজের সাথে সাথে তার ছেলেটাকেও সে অমন বদখত হয়ে থাকতে বাধ্য করে। 
 

অমন বাপের সেই ছেলেটার নাম হাকলবেরি ফিন। লোকে অবশ্য তাকে ডাকে হাক নামে। শহরের অন্য সব বালকের মতো টমও তাকে গভীর রকম পছন্দ করে! অন্য সবার মতো টম সয়্যারেরও, হাকলবেরি ফিনের মতো, হয়ে উঠতে ইচ্ছা হতে থাকে। 
 

এই হাকের সাথে মিশতে মিশতে টম পেতে থাকে অন্য এক দুনিয়ার সন্ধান। সেই দুনিয়ায় কত অদ্ভুত অপরূপ কিছু যে আছে! কত কত রকমের জাদুটোনা আছে, রাতের গহনে কত না ভয়-জাগানিয়া জায়গায় যাওয়া-যাওয়ি আছে। নিজের শরীর কেটে রক্ত বার করে, সেই রক্ত ছুঁয়ে শপথ করাকরিও আছে। 
হাকের সাথে অমন মধ্যরাতে, একবার, কবরখানায় তুকতাক করতে যাওয়ার সময়ে, টম এক ভয়াল ঘটনার সাক্ষী হয়ে ওঠে। সেই নিশুথি কবরখানায়,গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে হাক এবং টম দেখে যে,তাদের শহরের ড. রবিনসন, মাফ পটার আর ইনজুন জো নামের তিন লোক নিজেদের লুটের জিনিসপাতির ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে বিবাদ করতে করতে একজন আরেকজনকে খুন করে ফেলেছে। সঙ্গী দুজনকে হত্যা করে সব জিনিসের একলা মালিকানা নিয়ে নেয় ইনজুন জো। তারা যে বিষয়টার প্রত্যক্ষদর্শী এই কথা জেনে ফেললে, ইনজুন জো যে টম এবং হাককে নিস্তার দেবে না,এটা ওরা স্পষ্ট বুঝতে পারে। তাই তারা নিজেদের মধ্যে রক্তশপথ করে যে, এই ভয়ানক বিষয়টির কথা তারা কদাপি কাউকে বলবে না। 
 

কিন্তু দুষ্টের দমন ও ন্যায়ের শাসন বহাল রাখার তাগিদে অবশেষে তারা দুজন নিজেদের শপথ ভেঙে, আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দেয়। ইনজুন জো অপরাধী সাব্যস্ত হয়, তবে তাকে বন্দী করার আগেই, সে আদালত কক্ষ থেকে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। ফলে টম এবং হাকের জীবন হয়ে ওঠে বিপন্ন। কারণ তারা জানে, অপরাধী জো তাদের এই আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার বিষয়টাকে ক্ষমা করবে না।
এদিকে, স্কুলের নিয়মনীতি মেনে মেনে ক্লান্ত হতে হতে একদিন টম বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। যায় সে জ্যাকসন’স আইল্যান্ডে। তাদের শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মিসিসিপি নদী। সেই দিয়ে অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়ার পরে, অনেক দূরের নিরালায় আছে ওই জনমনুষ্যশূন্য দ্বীপটি। 
টম কি সেখানে একা যায়! না! তার সঙ্গে যায় তার পরানের বন্ধু হাক। আর যায় টমের সহপাঠী-বন্ধু জো হারপার। সকল শহরবাসী ধরে নেয়, ওই তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। শহরজুড়ে তাদের মৃত্যু নিয়ে শোকের মাতম শুরু হলে, ওই তিনজন আবার ফিরেও আসে। টমের সাথে তখন আবার ভাব হয়ে যায় বেকি থ্যাচারের।
 

ক্রমে জ্যাকসন আইল্যান্ডে আরও আরও আসা-যাওয়া করে, আর নানা রকমের তল্লাশি চালিয়ে টম আর হাক গুপ্তধনের খোঁজ পায়। তখন, ওই কিশোর বয়সেই তারা হয়ে ওঠে বেশ বিত্তশালী।  হাককে দত্তক নেয় শহরের ধনী বিধবা মিসেস ডগলাস। যে কিনা হাককে সভ্য ও আদব-কেতাদুরস্ত বানানোর জন্য কঠিন পণ গ্রহণ করে। অমন সভ্য হয়ে উঠতে যদিও হাকের কিছুমাত্র ভালো লাগে না,তা-ও তাকে নিতান্ত অনিচ্ছা নিয়েই যেতে হয় মিসেস ডগলাসের সাথে; সভ্য মানুষ হওয়ার নিয়মকানুন শিখে ওঠা ও মেনে চলার জন্য।
দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব টম সয়্যারে হাকলবেরি ফিন হচ্ছে টম সয়্যারের একজন সহযোগী মাত্র,অন্যদিকে দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ হাকলবেরি ফিন হলো সম্পূর্ণতই হাকের আখ্যান। এই আখ্যানেও বিচিত্র ঘটনাবলির সমাবেশ ঘটেছে, এখানেও আছে ভয়ভীতি মোড়ানো এক দীর্ঘ রোমাঞ্চকর নৌযাত্রা; আছে  দূর অজানার দিকে অনিশ্চিত ভেসে চলার বিবরণ। ওই সমস্ত পরিস্থিতি ও অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ অভিযাত্রার নায়ক এখানে শুধুই হাক। তবে এইখানে আমরা হাকের পাশে পাই পলাতক ক্রীতদাস জিমকে।
 

দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব টম সয়্যার উপন্যাসের শেষাংশে আমরা দেখি, হাক টমের সাথে অভিযানে গিয়ে যে গুপ্তধনের খোঁজ পায়, সেটার অর্ধেকটার ভাগ পেয়ে গেছে সে। ফলে হাক হয়ে উঠেছে ধনী এক কিশোর। অন্যদিকে দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিনের শুরুতে আমরা দেখতে পাই নিরাশ্রয়, অনাথ হাককে মিসেস ডগলাস দত্তক নেয়ে তাকে ‘সভ্য’ ও ‘ভদ্র’ বানানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে। মিসেস ডগলাসের সাথে এসে যোগ দিয়েছে তার বোন মিস ওয়াটসন। হাকের ওপর তাদের দুজনের যত্ন ও খবরদারি চলতে থাকে প্রবলরকমে।  
 

কিন্তু এসবের কোনো কিছুই হাককে কিছুমাত্র সুখ দেয় না। বরং তার মনে হতে থাকে যে, সে দমবন্ধকর এক পরিবেশে একরকমের দণ্ড ভোগ করে চলেছে। তার ইচ্ছা করতে থাকে আগের মতো বিধিবন্ধনহীন, বুনো, মুক্ত জীবনকে ফিরে পেতে। প্রিয় বন্ধু টমের সাথে সেই যে নানা রকম রোমাঞ্চকর অভিযানে বেরিয়ে পড়ার দিন ছিল একদিন! মধ্যরাতে কবরখানায় গিয়ে জাদুটোনা করার রোমাঞ্চভরা রাত ছিল! সেগুলো ফিরে পাওয়ার জন্য তার আকুলি-বিকুলি লাগতে থাকে।
 

এর মধ্যে দীর্ঘদিন নিরুদ্দেশে থেকে, আচমকাই শহরে এসে হাজির হয় হাকের বাবা প্যাপ। মায়াদয়াহীন সেই মদখোর লোকের কাছে খবর পৌঁছে যে তার পুত্র এখন টাকাপয়সাওয়ালা হয়ে উঠেছে। ওই টাকাকড়ির মালিকানা এখন এই লোকের চাই-ই। মদের খরচা নির্বিঘ্নে মেটানোর এই মওকা সে হাতছাড়া করবে কেন! সে এসে পুত্রের অভিভাবকত্ব ফেরত চাইতে থাকে, এবং নাবালক পুত্রের সকল টাকাকড়ির দায়দায়িত্ব পাওয়ার জন্য হুজ্জোত শুরু করে। কিন্তু কোনোভাবেই এই দাবিকে বাস্তব করে তুলতে না-পেরে, শেষে, সেই নেশাখোর লোকটা একদিন, হাককে অপহরণ করে  নিয়ে যায় দূরের দুর্গম বনে। সেখানে থাকা পরিত্যক্ত এক কুঁড়েঘরে সে হাককে বন্দী করে রাখে।
 

তবে সুযোগ বুঝে, সেই বন্দীদশা থেকে একসময় হাক পালিয়েও যেতে সক্ষম হয়। সে যায় সেই তার পুরোনো জ্যাকসন আইল্যান্ডে। যাওয়ার আগে, সকল ঘটনা হাক এমন ভাবে সাজায় যে, তার বাবার মনে বিশ্বাস জন্মে, যেকোনো কারণেই হোক, হাককে কেউ খুন করেছে। জ্যাকসন আইল্যান্ডে গিয়ে নিজেকে থিতু করতে করতেই হাক, তার অভিভাবক মিস ওয়াটসনের পলাতক ক্রীতদাস জিমের নাগাল পায়। মিস ওয়াটসন জিমকে বিক্রি করে দেবার তোড়জোড় শুরু করেছে, এই খবর পেয়েই জিম পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় ওই জনহীন দ্বীপে। জিমকে কীভাবে রক্ষা করা যায়? কীভাবে! অনেক ভেবে হাক স্থির করে, জিমকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই তাদের চলে যেতে হবে কায়রো শহরে। ইলিনয়ের ওই মুক্ত শহরটাতেই তখন শুধু, ক্রীতদাসরা, স্বাধীন নিরাপদ জীবন কাটাতে পারছিল।
 

হাক তখন জিমকে নিয়ে মিসিসিপি নদীতে ভেসে পড়ে। নদীপথে ভেলায় চড়ে যেতে যেতে তারা নানা রকম বিপদ ও বিঘ্নের মুখোমুখি হতে থাকে। তারা প্রচণ্ড বান, তুমুল স্রোতের বিরুদ্ধতা পেরোতে থাকে। ওই যাত্রাকালেই স্রোতে ভেসে যেতে থাকা একটা আস্ত কুঁড়েঘরের ভেতরে একটা মৃতদেহ খুঁজে পায় জিম। ওটা ছিল হাকের মদ্যপ নৃশংস বাবা প্যাপের লাশ।
 

এর মধ্যেই হাক গোপনে একবার নিজের শহর সেন্ট পিটার্সবুর্গে এসে জানতে পারে, পলাতক ক্রীতদাস জিমকে ধরিয়ে দেবার জন্য শহরে চড়া পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ শহরের সকল লোকের বিশ্বাস, ওই পলাতক ক্রীতদাসটিই হাককে গুমখুন করেছে। হাক এবং জিম আবার তাদের ভেলা নিয়ে ভেসে পড়ে।
যেতে যেতে পথে বিপত্তির আর শেষ থাকে না। অনেকখানি ভেসে যাওয়ার পরে তারা দুইজন দেখে, এক জায়গায় তীরঘেঁষে একটা স্টিমার দাঁড়ানো আছে। সেই স্টিমারটার নাম  ওয়াল্টার স্কট। কৌতূহল সামলাতে না পেরে হাক আর জিম ওই স্টিমারের ভেতরে যায় তল্লাশী চালাতে। ওটা করতে গিয়ে তারা দুজনে  এক মারাত্মক ষড়যন্ত্রের কথা জেনে উঠতে পারে। ওই জনশূন্য স্টিমারটিতে বসে তখন দুইজন ষন্ডা-খুনে লোক, অন্য আরেকজনকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করে চলছিলো। হাক ও জিম কোনোমতে নিজেদের গোপন রেখে, পালিয়ে আসার সময় দেখে, তাদের ভেলাটাকে মিসিসিপির পাগলা স্রোতে জানি কোন নিরুদ্দেশের দিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।
 

অমন ভয়ের কালেও মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারে তারা দুইজন। তারা তখন করে কী, ষণ্ডা-খুনেদের নৌকাটাকে নিয়ে ভেসে পড়ে। তবে কিছুদূর গিয়েই অবশ্যি নিজেদের ভেলাটাকেও আবার তারা ফিরে পায়। ষণ্ডা-খুনেদের নেীকা প্রায় বোঝাই ছিলো চুরি-ছিনতাইয়ের নানা দামী জিনিসপত্রে। সেগুলো নিজেদের ভেলায় তুলে নিয়ে নৌকাটাকে তারা ডুবিয়ে দেয়। 
 

এদিকে, হাক জিমকে রক্ষা করার কঠিন পণ করে নদীতে ভেসে চলেছে ঠিকই;কিন্তু তার মনের ভেতরে কতো যে জ্বালা-যন্ত্রণার ঝড় বইছে,সেটা শুধু হাকই জানে। চিরকাল ধরে সে কী জেনে আসেনি, কোনো ক্রীতদাসকে এইভাবে পালাতে সাহায্য করাটা হচ্ছে কঠিন এক পাপ! এই যে এমন পাপ সে করে চলেছে, সেটা তো খুব খারাপ ব্যাপার! এমন পাপ সে কীভাবে করছে! কী সর্বনাশা ব্যাপার! এমন মনস্তাপের জ্বালা একা একলা সহ্য করতে থাকে হাক। আর এর মধ্যেই হঠাৎই হাকের নজরে আসে, একটা বিষম সর্বনাশা কাণ্ড ঘটে গেছে! নদীতে ঘন কুয়াশা থাকার কারণে তারা কখন যে কায়রো শহরটিকে পেরিয়ে চলে এসেছে- তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই! তারা চলে এসেছে আরো বহু দূরে। এখন আর ভরা গাঙের স্রোতে ঠেলে পেছনের দিকে ফিরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।
 

এই বিপত্তির সাথে সাথে আরো আরো বিপাক-মুশকিলের মুখোমুখি হয় তারা। ওই যাত্রাকালে বারে বারে হাক ও জিম বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে,আবার তারা একে অপরের সাথে মিলিতও হতে থাকে। তবে শেষপর্যন্ত ভাগ্য অমন সুপ্রসন্ন থাকে না তাদের জন্য। সেবার তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় না, কিন্তু তাদের বন্দী করে নেয় দুষ্ট-তস্করদের একটা দল। সেই বন্দীদশা থেকে হাক পালিয়ে আসতে পারল্ওে, জিম সেটা করতে ব্যর্থ হয়। তখন জিমের কপালে জোটে খুব দুর্গতি। তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয় ওই অচেনা অঞ্চলের ধনী ফেল্পস ফ্যামিলির কাছে। অমন দুঃষ্কালে, হাক তখন নিজের কাছে নিজে এক কঠিন শপথ করে। সে শপথ করে যে, মরার পরে তাকে যদি নরকে যেতে হয়,তো তাতেও তার পরোয়া নেই। কিন্তু জিমকে এই নতুন দাসত্বের দশা থেকে সে মুক্ত করবেই করবে।।
 

এই পণ নিয়ে হাক গিয়ে হাজির হয় ফেল্পসদের বাড়িতে। ওই বাড়ির সকলে তাকে বেশ সাদরেই বরণ করে নেয়। কারণ তাদের মনে হয়, এটা বুঝি তাদের সেই অদেখা ভাতিজা টম। তাদের ভাতিজা- ওই টমকে -তারা কখনো দেখেনি, কিন্তু ঠিক ওই সময়টাতেই এই বাড়িতে তার বেড়াতে আসার কথা। 
এই টম হচ্ছে আমাদের টম সয়্যার। টম এসে হাকের কাছ থেকে সব কথা শোনে। তারপর হাক-কে নিয়ে টম জিমের মুক্তির জন্য নানা চেষ্টাচরিত্রও করে, তবে বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারে না। এমন সময় টমকে দেখতে ওই শহরে আসে পলি আন্টি।
 

পলি আন্টির কাছ থেকে সকলে জানতে পারে, জিমের আদত মালিক মিস ওয়াটসন মারা যাবার আগে উইল করে জিমকে মুক্তি দিয়ে গেছে। এদিকে, হাকের বাবারও তো অপঘাতে মৃত্যু ঘটেছে বহু আগেই। ফলে জিম আর হাক- কারোরই আর তাদের সেন্ট পির্ট্সবুর্গ শহরে ফিরে আসতে কোনো ভয় নেই। এখন শুধুই স্বস্তি আর শান্তি সবখানে। 
 

কিন্তু হাকের কপালে সুখ বোধহয় লেখেনি প্রকৃতি। তাকে দত্তক নেয়ার জন্য ফেল্পস ফ্যামিলি উদগ্রীব হয়ে ওঠে। হাক তখন মনে মনে সাব্যস্ত করে, এই যন্ত্রণা থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য সে অতি অবশ্যই পালিয়ে যাবে। পালিয়ে সে চলে যাবে আরো পশ্চিমে। যেখানে রেড ইন্ডিয়ানরা স্বাধীনভাবে দাপটের সঙ্গে বাস করে,হাক চলে যাবে সেই অঞ্চলে। যাবেই সে।
 

মার্ক টোয়েনের এই উপাখ্যান দুটির মতো শ্রীকান্ত (প্রথম পর্ব) উপন্যাসটি অমন অতি ঘটনাবহুল নয়। বা, এটি  অমন দূরযাত্রার রোমাঞ্চজটিলতায়ও পরিপূর্ণ নয়। অনেক অনেক পাত্রপাত্রীর ভীড়ও এখানে নেই। আছে সামান্য কয়েকটি চরিত্র। তাদের  দু’একজন ছাড়া অন্যদের জীবন ধীর আর বিষাদ-মন্থর। শরৎচন্দ্রের এই আখ্যানে আছে বারোটি অধ্যায়। তার প্রথম সাতটি অধ্যায়েই মূলত বর্ণিত হয়েছে শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথ নামক দুই কিশোরের গল্প। সপ্তম অধ্যায়ের সাথে সাথেই ওই কিশোরবেলার গল্প শেষ হয়। আমরা দেখি, ইন্দ্রনাথ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, শ্রীকান্ত আবার হয়ে ওঠে মৌন, একাকী একজন। এরপর অষ্টম অধ্যায় থেকে শুরু হয় শ্রীকান্তের প্রথম তারুণ্যের কাহিনী। তার জীবনে ঘন একাকীত্ব যেমন আসে,তেমনি আসে প্রেম। তার সাথে পিয়ারী বাইজীর দেখা হয়। আসে আরো বিচিত্র বিস্মিয়মাখানো দিন ও রাত্রি, ভবঘুরে জীবন নিয়ে পরিব্রাজনের কাল আসে।
 

প্রথম সাত অধ্যায়ে দুই কিশোরের যেই গল্পটি আমরা পাই, তা এমন: 
শ্রীকান্ত নামের এক নিতান্ত নিঃসহায় বালক লালিত-পালিত হতে থাকে এক গ্রামে, তার পিসির সংসারে। পিসির সংসার ধনে ও জনে পরিপূর্ণ। সেইখানে সে নিতান্ত এককোণে থেকে,বয়োজ্যেষ্ঠ ভ্রাতাদের শাসন-তর্জনের পেষণ মেনে মেনে দিন কাটাতে থাকে। ঘরে ও বাইরে, সেইসময় সে নিতান্ত মৌনমুখ, নিরীহ একজন। 
 

এমন দিনে, এক আকস্মিক দুর্বিপাকের সময়ে,তার সাথে দেখা হয় ইন্দ্রনাথের। স্কুলের ফুটবল ম্যাচের বিকালে হঠাৎ শুরু হওয়া ভীষণ মারামারির সময়ে দর্শক শ্রীকান্ত অকস্মাৎই আক্রান্ত হয়ে পড়ে। প্রতিপক্ষরা তাকে ঘিরে ফেলে, ‘ আস্ত ছাতির বাট’ দিয়ে যখন উপর্যুপরি প্রহার করতে থাকে, ‘ঠিক সেই সময়ে যে মানুষটি বাহির হইতে বিদ্যুদগতিতে ব্যূহভেদ করিয়া’ শ্রীকান্তকে ‘আগলাইয়া’ দাঁড়ায়; সে-ই হলো ইন্দ্রনাথ। সেইসময় শ্রীকান্তকে উদ্ধার করে দিয়ে সে, ‘রাস্তার মোড় ফিরিয়া’ নির্বিকার এগিয়ে যায়, কিন্তু  শ্রীকান্তের ‘মনের উপর একটা প্রগাঢ় ছাপ মারিয়া দিয়া’ যায় সে। সেই ছাপ হয়ে ওঠে অমোচনীয়। তারপর অনেকদিন আর সেই ছেলেটির সাথে শ্রীকান্তের দেখাসাক্ষাৎ হয় না। তবে দূর থেকে তার নানা অদ্ভুত ও ডাকাবুকো কাজকর্মের কথা শ্রীকান্ত শুনতে পেতে থাকেই।
 

যেমন, সেদিন ছিলো বিষম এক গরমের রাত। সে-রাতে তখন ‘কোথাও গাছের একটি পাতা পর্যন্ত’ নড়ছিলো না। গরমের হাত থেকে খানিকটা হলেও নিস্তার পাওয়ার আশার শ্রীকান্তের পিসির বাড়ীর সকলে সেইরাতে ছাদে গিয়ে শুয়েছে। গরমে সবার তখন হাঁসফাঁস অবস্থা,রাত্রি ‘বারোটা বাজে’, তবুও তখন ‘কাহারো চক্ষে নিদ্রা নাই।’ তেমন সময়ে ‘হঠাৎ কি মধুর বংশীস্বর’ সকলের ‘কানে আসিয়া’ লাগে। অতো রাতে অমন বাঁশি  কোনখানে বাজে?  শ্রীকান্ত অনুমান করতে পারে, ‘বাড়ির পূর্ব-দক্ষিণ কোণে একটা প্রকাণ্ড আম-কাঁটালের বাগান। ভাগের বাগান, অতএব কেহ খোঁজখবর লইত না। সমস্ত নিবিড় জঙ্গলে পরিণত হইয়া গিয়োছিল। শুধু গরু-বাছুরের যাতায়াতে সেই বনের মধ্য দিয়া সরু একটা পথ পড়িয়াছিল। মনে হইল,যেন সেই বনপথেই বাঁশির সুর ক্রমশ: নিকটবর্তী হইয়া আসিতেছে।’ কে বাজায় বাঁশি? অমন গহন রাতে! 
শ্রীকান্তের জানায়: ‘পিসিমা উঠিয়া বসিয়া তাঁহার বড়ছেলেকে উদ্দেশ করিয়া কহিলেন, হাঁ রে নবীন, বাঁশি বাজায় কে- রায়েদের ইন্দ্র নাকি? বুঝিলাম ইঁহারা সকলেই ওই বংশীধারীকে চেনেন। বড়দা বলিলেন, সে হতভাগা ছাড়া এমন বাঁশিই বা  বাজাবে কে, আর ঐ বনের মধ্যেই বা ঢুকবে কে?
বলিস কি রে? ও কি গোঁসাইবাগানের ভেতর দিয়ে আসচে নাকি?
বড়দা বলিলেন,হুঁ।
পিসিমা এই ভয়ঙ্কর অন্ধকারে ওই অদূরবর্তী গভীর জঙ্গলটা স্মরণ করিয়া মনে মনে বোধ করি শিহরিয়া উঠিলেন। ভীতকণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন, আচ্ছা,ওর মা কি বারণ করে না? গোঁসাইবাগানে কত লোক যে সাচে-কামড়ে মরেচে,তার সংখ্যা নেই- আচ্ছা, ও-জঙ্গলে এত রাত্তিরে ছোঁড়াটা কেন?
বড়দা একটুখানি হাসিয়া বলিলেন, আর কেন! ও-পাড়া থেকে এ-পাড়ায় আসার এই সোজা পথ। যার ভয় নেই, প্রাণের মায়া নেই,সে কেন বড় রাস্তা ঘুরতে যাবে মা? ওর শিগগির আসা নিয়ে দরকার। তা, সে পথে নদী-নালাই থাক আর সাপখোপ বাঘ-ভালুকই থাক।
ধন্যি ছেলে! বলিয়া পিসিমা একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া চুপ করিলেন।’
‘বাঁশির সুর ক্রমশ: সুস্পষ্ট ’হয়ে ‘আবার ধীরে ধীরে অস্পষ্ট’ হয়ে ‘দূরে মিলাইয়া’ যায় বটে, কিন্তু শ্রীকান্তের অন্তরে জাগিয়ে রেখে যায় সুতীব্র এক ক্ষুধা। তার কেবলই থেকে থেকে মনে হতে থাকে, যদি ইন্দ্রের মতো হতে পারতাম!  
তারপর এক সন্ধ্যায় পিসিমার বাড়িতে আচমকাই একটা বিদঘুটে কাণ্ড ঘটে যায়। সন্ধ্যার অন্ধকারে বহুরূপী ছিনাথ বাঘ সেজে এসে হানা দেয়। উদ্দেশ্য, সকলকে মুগ্ধ করে কিছু বকশিশ আদায় করা। কিন্তু বহুরূপীর সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না। কারণ বাড়ির সকলেই ভয় পেয়ে গিয়ে হূলস্থূল বাঁধিয়ে ফেলে। তারা মনে করতে থাকে, সত্যিকারের বাঘই এসে হামলে পড়েছে বাড়িতে। ভয়ে সকলের যখন দমবন্ধ অবস্থা, তখন বিষয়টা যাচাই করতে আসে ইন্দ্রনাথ। পথ দিয়ে যাওয়ার সময়,সকলের হল্লাচিৎকারে সে উৎসুক হয়ে উঠে, ছুটে আসে বিষয়টার মীমাংসা করতে।
ইন্দ্রনাথ এসে সকল রহস্যের ফায়সালা করে। সকলে জানতে পারে যে, আদতে কোনো বাঘই এসে হামলে পড়েনি; কিছু উপার্জনের আশায় আসলে, এসে হানা দিয়েছে বাঘরূপী ছিনাথ। বহুরূপীর আতঙ্ক আর অকাজের হুল¯থূল থেকে পিসিমার বাড়িকে নিস্তার দেওয়ার পরে,ইন্দ্র দেখে, সেদিনের সেই শ্রীকান্তের আবাসস্থল হচ্ছে এই গোলমেলে বাড়ি। এবার তাদের আলাপ একটু এগোয়। শ্রীকান্ত জানতে পারে  অমন রাত্রির  অই ঘন প্রহরে ইন্দ্র যাচ্ছে মাছ ধরতে। যাচ্ছে একা। এমন অমন অদ্ভুত ব্যাপারও যে ঘটতে পারে,সেই বিস্ময় আত্মস্থ করে ওঠার আগেই শ্রীকান্ত শোনে,  ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্তকে ডাকছে! ডাকছে তার মাছধরার সঙ্গী হবার জন্য। ডাকছে আকুল অন্তর দিয়ে। যে ডাককে অগ্রাহ্য করার শক্তি বা সাধ্য শ্রীকান্তের নেই। 
 

শ্রীকান্ত মুহূর্তের মধ্যে ইন্দ্রনাথের হাত ধরে ‘নিঃশব্দে রাস্তার উপরে আসিয়া উপস্থিত’ হয়ে যায়। তারপর ‘ইন্দ্রকে অনুসরণ করিয়া স্বপ্নাবিষ্টের মত’ ‘গোঁসাইবাগানের সেই ভয়ঙ্কর বনপথ’ ‘অতিক্রম করিয়া .. .. গঙ্গার তীরে’ এসে দাঁড়ায়। বাড়ির কাউকে কিছু জানানোর কথা যেমন তার তখন মনে পড়ে না; তেমনি মনে পড়ে না যে, এমন আচমকা অবাধ্য একজন হয়ে ওঠার জন্য পরে তাকে কোন শাস্তি ভোগ করতে হবে! সেই কথ তার মনেও আসে নাা!  সে শুধু বোধ করে, তাকে ওই ডাকে সাড়া দিতে হবে। তাকে ইন্দ্রের যাত্রাসঙ্গী হতে হবে। শ্রীকান্ত বোধ করে: ‘যে আহ্বানে এই স্তব্ধ-নিবিড় নিশীথে এই বাড়ির সমস্ত কঠিন শাসনপাশ তুচ্ছ করিয়া দিয়া, একাকী বাহির হইয়া আসিয়াছি, সে যে কতো বড়ো আকর্ষণ!’
তারপর সেই মহা ঘোর-অন্ধকার রাতে ছোটো ডিঙিখানায় চড়ে ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্ত বর্ষার ভরভরন্ত গঙ্গার দুরন্ত স্রোতে সামলে, পাড়ি দিতে থাকে জলপথ। সেইপথ অতীব বিপদসংকুল। এই সে-পথের অনেকখানি জুড়ে থাকে পাড় ভেঙে ভেঙে পড়ার বিপাক, এই থাকে স্রোতের মহা ঘূর্ণি! থাকে কোষা নৌকাখানি সেই ঘূর্ণির তোড়ে পলকে ডুবে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। ভরা গঙ্গার মূল ধারাটাকে পাশ কাটিয়ে হঠাৎ-জেগে ওঠা চরের মধ্যিখান দিয়ে যাওয়ার পথেও বিপদের সীমা থাকে না। কারণ চরে চাষ করা ভুট্টা ও জনারের ক্ষেতের গাছে গাছে জড়ায়ে আছে জলে ভেসে আসা নানাজাতের সাপ। নৌকার তাড়া পেয়ে তারা ঝপাৎ ঝপাৎ জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকে। নৌকায় যে তারা পড়ে না, সেটা একান্তই ভাগ্যের কৃপা। 
ওই সমস্তকিছু পেরিয়ে, শেষে, সেই রাতে কোথায় যায় ইন্দ্রনাথ? যায় আদতে দূরের খালের মুখে জেলেদের পেতে রাখা জাল থেকে মাছ চুরি করতে। সেইরাতে নির্বিঘ্নে মাছ চুরি করতে পারে বটে সে, কিন্তু জেলেরা সেটা ঠিকই টের পেয়ে যায়। তখন ডিঙ্গিসহ পালিয়ে আসার জন্য ইন্দ্রকে চালাতে হয় প্রাণপণ ছুট। সকল রোমাঞ্চ ও বিপদের নির্বাক সাক্ষী হয়ে শ্রীকান্ত কেবল আতঙ্কে কম্পমান হতে থাকে।
তবে মাছ চুরি করার মধ্য দিয়েই সেই রাতের সকল কাজ শেষ হয়ে যায় না ইন্দ্রের। ওই মধ্যরাতেই সেই মাছগুলোকে অচেনা এক গাঁয়ে গিয়ে বিক্রির বন্দোবস্ত করতে হয় তাকে। তারপর সে ছোটে সেই পয়সা কয়টাকে কোনো একজনের হাতে পৌঁছে দিতে। আরেক অচেনা ঘাটে গিয়ে রাত্রি ওই দ্বিপ্রহরেই নাও ভেঁড়ায় ইন্দ্র। শ্রীকান্তকে সে নৌকায় একটুখানি অপেক্ষা করতে বলে, অজানা কোন এক জায়গার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে যায়। কিন্তু শ্রীকান্তের পক্ষে ওই ঘাটে-বাঁধা নাওয়ে একলা অপেক্ষা করার সাহস হয় না। ওটি হচ্ছে বিশাল এক শ্মশানের বাঁকাচোরা একটা ঘাট। 
তখন চারপাশের সকলখানে ভয়ানক কলেরা চলতে থাকার কারণে, লোক মারা যাচ্ছে ভয়াবহ রকমে। তখন মরাদের যথাবিধি দাহ করার অবস্থাটাও একেবারে নেই। কোনোরকমে লোকে তখন অধিকাংশ মরদেহের ‘মুখে একটুখানি আগুন ছুঁইয়ে দিয়ে’ লাশ জলে ফেলে, দায় সেরে চলছিলো। তারপরে সেইসব লাশ শেয়াল কুকুরের খাদ্য হতে থাকে, আর পঁচতে থাকে। সেই মৃতদেহ আকীর্ণ শ্মশানঘাটায় সেই মাঝরাতে একাকী বসে থাকার সাহস হয় না শ্রীকান্তের। তাই সে তখন ইন্দ্রের সাথে ছোটে অজানা এক গন্তব্যের দিকে।
তারপর অনেকদিন ইন্দ্রের সাথে শ্রীকান্তের দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ থাকে। কারণ সেইরাতে বাড়ি ফিরেই শ্রীকান্ত প্রবল জ্বরে পড়ে। সেই উচ্চ জ্বর শ্রীকান্তকে সাত আটদিন শয্যাগত করে রাখে। সেসবের পরে আবার যখন ইন্দ্রনাথের সাথে তার দেখা হয়,তখন ইন্দ্র তাকে নিয়ে যায়, এক দুঃখী দুর্গত পরিবারকে সাহায্য করার জন্য। 
আগের সেই রাতের মাছ চুরির পেছনেও ছিলো- ওই দুর্গত পরিবারটিকে সাহায্য করার তাগাদা। এইবার আর ইন্দ্রের কাছে কোনো টাকা নেই, কাজেই তাকে পাঁচটা টাকা ধারবাবদ চেয়ে নিতে হয় শ্রীকান্তের কাছ থেকে। তারপর আসে রবিবারের বিকেল। শ্রীকান্ত তার পিসির বাড়ির সবাইকে ফাঁকি দিয়ে এসে ইন্দ্রনাথের ডিঙিতে চড়ে বসে। ডিঙি এসে একসময় ভেঁড়ে শ্মশানের সেই সঙ্কীর্ণ ঘাটের পাশে। ডিঙি বেঁধে তারা দুইজনে শ্মশানের মধ্যদিয়ে হেঁটে এগোতে থাকে। এবং অনেকখানি এগিয়ে যাবার পরে, তারা পৌঁছে জঙ্গলের ভেতরের একটা পর্ণকুটীরের কাছে। 
 

শ্রীকান্ত এভাবে সেই বাসস্থানের বিবরণ দেয়:  ‘আমি তেমন বাসস্থান কখনো জীবনে দেখি নাই। একে তো চতুর্দিকেই নিবিড় জঙ্গল,তাহাতে মাথার উপরে একটা প্রকাণ্ড তেঁতুল গাছ এবং পাকুড় গাছে সমস্ত জায়গাটা যেন অন্ধকার করিয়া রাখিয়াছে। আমাদের সাড়া পাইয়া একপাল মুরগি এবং ছানাগুলা চীৎকার করিয়া উঠিল। একধারে বাঁধা গোটাদুই ছাগল ম্যঁ-ম্যাঁ করিয়া ডাকিয়া উঠিল। সুমুখে চাহিয়া দেখি-ওরে বাবা! একটা প্রকাণ্ড অজগর সাপ আঁকিয়া-বাঁকিয়া প্রায় সমস্ত উঠান জুড়িয়া আছে। চক্ষের নিমেষে অষ্ফুট চিৎকারে মুরগিগুলাকে আরও ত্রস্তভীত করিয়া আঁচড়-পিঁচড় করিয়া একেবারে সেই বেড়ার উপর চড়িয়া বসিলাম।’
ওই বাড়িতেই বাস করে অন্নদা দিদি ও তার অতি হিংস্র স্বামী শাহজী। শাহজী অতীতে বিস্তর অপকর্ম সম্পন্ন করে, এখন শেষে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমানই হয়ে ওঠেনি, হয়ে উঠেছে সাপুড়েও। গাঁজাখোর মদ্যপ শাহজীর নেশার পয়সা জোগানোর জন্য অন্নদা দিদিকে নিত্য কটু গালিগালাজ ও গঞ্জনা তো সইতে হয়ই,প্রহার লাঞ্ছনা ভোগ করাও বাদ যায় না। এই নিরুপায় দিদিকে কিছুটা অর্থসাহায্য করে,তাদের দুর্গতি একটুখানি হলেও, কমাবার পণ করে আছে ইন্দ্রনাথ। তাই সে মাঝরাতে জেলেদের জাল থেকে মাছ চুরি করে বিক্রি করতে ছোটে, কখনো বা শ্রীকান্তের কাছ থেকে ধার করে সুরাহা করতে চায়। শাহজীকে ইন্দ্রনাথ বিস্তর টাকাকড়ি দিয়ে উঠেছে, কারণ শাহজী তাকে আশ্বাস দিয়েছে যে, অচিরেই সে ইন্দ্রনাথকে সাপের মন্ত্র শিখিয়ে দেবে। 
শুধু অন্নদা দিদির দুঃস্থতা ঘোচানোর জন্যই ইন্দ্রনাথ তাকে অর্থ সাহায্য কওে চলছিলো না,সাথে ছিলো অন্য আরেকটা উদ্দেশ্যও। শাহজীর কাছ থেকে সাপ বশ করতে পারার মন্ত্র শেখার গভীর বাঞ্ছা কারণেও ইন্দ্রনাথ শাহজীকে টাকা দিয়েই চলছিলো। কারণ শাহজী তাকে ওসব শেখাবার আশ্বাস দিয়েছিলো।  
অবশেষে অন্নদা দিদি ইন্দ্রের মোহ ঘুচিয়ে দেয়। সে পরিষ্কার করে জানিয়ে দেয়, ওই যে মন্ত্রতন্ত্রের কথা শাহজী বলে চলছে, সেগুলো কেবলই শাহজীর বুজরুকি । অন্নদা দিদি বলে: ‘আর তুমি মিথ্যে আশা নিয়ে শাহজীর পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়িয়ো না। আমরা তন্ত্রমন্ত্র কিছুই জানিনে,মড়াও বাঁচাতে পারিনে; কড়ি চেলে সাপ ধরে আনতেও পারিনে। আর কেউ পারে কি না,জানিনে, কিন্তু আমাদের কোনো ক্ষমতাই নেই।’ নিজেদের জারিজুরি ফাঁস করে দিয়েছে স্বয়ং তার পত্নী, এইকথা জানতে পেরে শাহজী অন্নদা দিদিকে প্রহার করে করে প্রায় আধমরা করে ফেলে। সেই পাষণ্ডের হাত থেকে দিদিকে রক্ষা করার জন্য ইন্দ্রই আবার ছুটে আসে সেই বাড়িতে।
 

শাহজীকে ভালোমতো একটা শিক্ষা দিয়ে হাতপা বেঁধে উঠানে ফেলে রাখে সে, অন্নদা দিদি জ্ঞান ফিরে পেয়ে স্বামীকে মুক্ত করে দেয়। সবকিছু সামলে-সুমলে নিজেদের বাড়ি ফেরার পথে ইন্দ্র অকস্মাৎ শ্রীকান্তে ওপর মহাক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। শ্রীকান্তকে তার মনে হতে থাকে অপয়া, অলুক্ষণে। মুহূর্তে সে শ্রীকান্তের সাথে সকল সম্পর্ক ত্যাগ করার ঘোষণা দিয়ে দেয়। “ইন্দ্র কহিল, বাড়ি যা শ্রীকান্ত! তুই বড় অপয়া। তোকে সঙ্গে নিলেই একটা-না-একটা ফ্যাসাদ বাঁধে। আজ থেকে তোকে আর আমি কোন কাজে ডাকব না- তুইও আর আমার সামনে আসিস নে। যা!’
 

সম্পর্ক ছিন্ন থাকার অই অবস্থাটি চলতে থাকে অনেক অনেকদিন ধরে। তারপর এক রাতে আবার হঠাৎই ইন্দ্র এসে শ্রীকান্তের সামনে দাঁড়ায়। সেইরাতে কালীপূজা উপলক্ষে পাড়ার শখের থিয়েটারের “ মেঘনাদবধ” যাত্রাপালা দেখছে  শ্রীকান্ত। যাত্রাপালা এবং রাত - দুইই তখন প্রায় শেষ হয় হয়; এমন সময়ে ইন্দ্র এসে জানায়,  অন্নদা দিদির খুব বিপদগ্রস্ত। অমন বিপদের সময়ে দিদি শ্রীকান্তকে ডেকে পাঠিয়েছে। তারপর শাহজীর কুটীরে উপস্থিত হয়ে তারা দুইজন দেখে, ‘একটা কেরোসিনের ডিপা জ্বালাইয়া দিদি বসিয়া আছেন। তাঁহার ক্রোড়ের উপর শাহজীর মাথা। তাঁহার পায়ের কাছে একটা প্রকাণ্ড গোখরা সাপ লম্বা হইয়া আছে।’ ওই গোখরা সাপের দংশনে শাহজীর মুত্যু ঘটেছে। তবে মরার আগে শাহজী সাপটাকেও মেরে রেখে যেতে ভুল করেনি।
 

শাহজীর মৃতদেহটিকে কবরস্থ করে ব্যথিত ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্ত বাড়ি ফিরে আসে। দিদিকে অনেক অনুনয় করেও, কিছুতেই তাদের নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য সম্মত করাতে পারেনি ইন্দ্রনাথ। একাকী দিদি রয়ে যায় তার সেই জঙ্গলেঘেরা অন্ধকার কুটিরটিতেই।
এর তিনদিন পরে খবর পাওয়া যায়, স্বামী শাহজীর সকল দোকান-ঋণ উশুল করে দিয়ে,অন্নদা দিদি জানি কোন নিরুদ্দেশে চলে গেছে। তবে যাবার আগে দিদি শ্রীকান্তকে একটা চিঠি লিখে তার ও তার স্বামীর সকল দুরবস্থার কারণকে বিশদ করে জানিয়ে যেতে ভোলেনি।
এরপর ইন্দ্রনাথ আর একবার শুধু শ্রীকান্তকে  নিজের মাঝরাতের নৌযাত্রার সঙ্গী হতে ডাকে। ‘সেদিন কনকনে শীতের সন্ধ্যা। আগের দিন খুব এক পশলা বৃষ্টিপাত হওয়ায়,শীতটা যেন ছুঁচের মত গায়ে বিঁধিতেছিল। আকাশে পূর্ণচন্দ্র। চারিদিক জ্যোৎস্নায় যেন ভাসিয়া যাইতেছে।’ অমন সময়ে হঠাৎ ‘ ইন্দ্র আসিয়া হাজির।’ আবার সে ডেকে ওঠে দূর কোন এক গাঁয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে। যেতে হবে শীতের শুকিয়ে আসা গঙ্গা দিয়ে। কারণ ইন্দ্রের ‘ নতুনদা কলকাতা থেকে এসেছেন,তিনি গঙ্গা দিতে যেতে চান।’ নতুন দা ‘কলকাতার বাবু।’ তাকে দেখে গোড়াতেই শ্রীকান্ত একেবারে বিষম খেয়ে যায়। ‘কলকাতার বাবু- অর্থাৎ ভয়ঙ্কর বাবু।  সিল্কের মোজা,চকচকে পাম্প-সু, আগাগোড়া ওভারকোটে মোড়া,গলায় গলাবন্ধ,হাতে দস্তানা,মাথায় টুপি- পশ্চিমের শীতের বিরুদ্ধে তাঁহার সতর্কতার অন্ত নাই।’ এই শীতের রাতে তাকে নিয়ে সেই দূরের গাঁয়ে নিয়ে যেতে হবে, কারণ সেইখানের ‘ থিয়েটারে’ তাকে ‘ হারমোনিয়াম বাজাতেই হবে-তারা বিশেষ করে ধরেচে।’
 

কিন্তু গঙ্গা দিয়ে অল্প একটু এগোবার পরেই, হাওয়া  পড়ে যাবার কারণে, পাল উড়িয়ে এগোবার আর উপায় থাকে না। তখন ইন্দ্র আর শ্রীকান্তকে পালাক্রমে গুণ টেনে টেনে নৌকা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালতে হতে থাকে। অমন দুরবস্থার সময়েও  নতুন দা-র তামাক খাওয়ায় তেষ্টা প্রবল হয়ে উঠলে,গুণ টানা বন্ধ করে,তাকে তামাক সেজে দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে হয়। এরপর হঠাৎই তার ক্ষুধা প্রবল হয়ে ওঠে। তখন আবার গুণ টানা বন্ধ করে দিয়ে,অজানা  এক গ্রামে, ওই নিশুথি রাতে হন্যে হয়ে মুড়ির খোঁজ করতে হয় তাদের দুইজনকে। অবশেষে মুড়ি জোগাড় করে তারা যখন ফিরে আসে,তখন দেখে বাবুসাহেব নতুন দা নৌকায় নেই। সেই গ্রামের কুকুরগুলো অমন অদ্ভুত পোশাকপরা আগন্তুককে বিশেষ সুবিধাজনক মনে করতে পারেনি বলে তার দিকে তেড়ে আসে। আত্মরক্ষার আর কোনো উপায় না-পেয়ে শেষে নতুন দাকে গিয়ে গঙ্গার জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেকে বাঁচাতে হয়।
 

তারপর আর কোনোদিন ইন্দ্র এসে হাজির হয় না শ্রীকান্তের সামনে। কোনোদিন না। কেননা অকস্মাৎই একদিন ইন্দ্রনাথ কাউকে কিছু জানান না দিয়ে, এমনকী শ্রীকান্তকেও কোনো বিদায় সম্ভাষণ না জানিয়েই, নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। ‘ একদিন অতি প্রত্যুষে ঘরবাড়ি,বিষয়-আশয়,আত্মীয়-স্বজন সমস্ত পরিত্যাগ করিয়া সেই যে একবস্ত্রে সে সংসার ত্যাগ করিয়া চলিয়া’ যায়, ‘ আর কখনও ফিরিয়া’ আসে না। শুধু গঙ্গার বুকে একাকী ভেসে থাকে তার ‘কূলে বাঁধা’ ‘ডিঙি’খানা। ওটি দিনের পর দিন ‘ জলে’ ভিজতে থাকে,‘রৌদ্রে ফাটতে’ থাকে; কিন্তু তার মালিকের সাথে আর তার দেখা হয় না।
 

আমরা দেখতে পাচ্ছি, মার্ক টোয়েনের উপন্যাস দুটিতে টম সয়্যার ও হাকলবেরি ফিনের সকল রোমাঞ্চ অভিযান,  বা সকল কর্মকাণ্ড বর্ণিত হয়েছে অতি বিশদ ভাবে। এখানে আছে অসংখ্য পাত্রপাত্রীর আনাগোণা, সামান্য ঘটনা যেমন ঘটে এইখানে, তেমনি ঘটে বড়ো বড়ো অঢেল ঘটনা। এইখানের পৃথিবী বিশাল। সেই পৃথিবী কয়েকটি কিশোরের জন্য প্রায় প্রায়ই প্রীতিশূন্য ও কঠোর হলেও, এইখানে মধুরতাও আছে। ইচ্ছে-পূরণ হওয়া আছে। আছে গুপ্তধন পেয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি। এইখানে অনাথ দরিদ্র বালকের জীবনও সহজেই নিরাপত্তা-মোড়ানোও হয়ে উঠতে পারে।
অন্যদিকে, শ্রীকান্ত আর ইন্দ্র্রনাথের পৃথিবীতে অমন অসম্ভব কখনো সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেখানে কেবলই নিষেধ, কেবলই দুর্গতি, কেবলই বিপন্নতা ও আঘাত পাওয়া, আর নিরুদ্ধার থেতলে যেতে থাকা। কেবলই বিষাদগ্রস্ত হতে থাকা, আর একা থেকে একা হয়ে যাওয়াই শেষ সত্য এইখানে।

 

কতোটা প্রভাব আছে, কতোটা বৈসাদৃশ্য!
 

দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ টম সয়্যার ও দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ হাকলবেরি ফিন এবং শ্রীকান্ত (প্রথম পর্ব)-এর তুলনা করলে বোঝা যায় শরৎচন্দ্র যেমন প্রভাবিত হয়েছিলেন কাহিনী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে,তেমনি প্রভাবিত হয়েছিলেন প্রধান ও অপ্রধান চরিত্র সৃষ্টিতে। হাকলবেরি ফিনের সামাজিক অবস্থান আর ইন্দ্রনাথের সামাজিক অবস্থান একেবারেই এক নয়; কিন্তু তাদের দুজনের মধ্যে রয়েছে গভীর ও ব্যাপক সাদৃশ্য। আন্তর-বৈশিষ্ট্য,বাহ্য প্রবণতা তাদের অবিকল এক। চলাচলতি ও বিধিভাঙ্গার তাগাদা তাদের অভিন্ন। নির্বিকার এব বৈরাগ্য তাদের অন্তরে চিরস্থায়ী হয়ে আছে। তারা দুজনেই সকলের মধ্যে থেকেও, থাকে চির একাকী। তারা দুজন তাদের ওই কিশোর বয়সে, সেই বৈরাগ্যকে বিশেষ চেনে-জানে, তা নয়। কিন্তু তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ তাদের ওই প্রবণতাকে আমাদের সামনে স্পষ্ট করে তুলতে থাকে।  
 

তবে হাকলবেরি ফিনের প্রভাব শুধু ইন্দ্রনাথের ওপরেই যে পড়েছে এমন নয়; শ্রীকান্তের ওপরও আমরা লক্ষ্য করি হাকের গভীর ছায়া। শ্রীকান্ত টম সয়্যারের আদলে গড়ে উঠতে থাকলেও; শেষে আমরা দেখতে পাই,সেও হয়ে উঠেছে অন্য আরেক হাক ফিন  ইন্দ্র নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার পরে,যেই শ্রীকান্ত একাকী বেড়ে ওঠে, হঠাৎ উধাও হয়ে যেতে থাকে,সন্ন্যাসীর চেলা হয়ে যে ভিক্ষা করতে বেরিয়ে যায়,কোনো পিছুটানই যে বোধ করে না; অই পরোয়াশূন্য সদ্য তরুণটিকেও আমাদের কাছে অধিকাংশ সময়ই মনে হতে থাকে- এইই সেই হাকলবেরি ফিন! কখনো মনে হতে থাকে যেনো বা ইন্দ্রনাথ স্বয়ংই আবার তরুণ শ্রীকান্ত নামে হাজির হয়েছে।
 

রসাতলের যেই পশু-মানুষটির সাথে মার্ক টোয়েন আমাদের পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছেন,তাঁর উপাখ্যান দুটিতে; তার নাম প্যাপ। সে হাকলবেরি ফিনের বাবা। ন্যায়-অন্যায় বিবেচনাশূন্য,চরম আত্মসর্বস্ব, ক্রূর নির্দয় প্যাপ,বোঝে শুধু নিজের নেশার জোগানের নিশ্চয়তাটুকু। দরদ মমতা বা মানবিক সম্পর্কের দায় ও দায়িত্ব কিছুই,কদাপিও, তার কাছে মূল্য পায় না। নিজের সুবিধাটুকু বোঝে শুধু সে,ওটিকেই একমাত্র গুরুত্ব দেবার ব্যাপার বলে মানে। এই প্যাপই শরৎচন্দ্রের উপাখ্যানে হয়ে উঠেছে শাহজী। একই রকম রসাতলবাসী ও দুষ্কর্মকারী শাহজীও। দুর্মর পাষণ্ড ও নেশাগ্রস্ত সেও। একইরকম করে অপঘাতে মৃত্যু পায় দুজনেই।
শরৎচন্দ্রের ওপর মার্ক টোয়েনের  এই প্রভাবটিকে বলতে পারি প্রত্যক্ষ প্রভাব; যেটি তুলনামূলক আলোচনার মধ্য দিয়ে স্পষ্টভাবে নির্দেশ করা যায়। অন্য প্রভাবটিকে আমরা বলতে পারি পরোক্ষ প্রভাব। ওটিই গভীরতর প্রভাব। মার্ক টোয়েন-মানস গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিলো শরৎ-মানসের ওপর,যার ফলে রচিত হয়েছে এমন দুই কিশোর - শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথের আখ্যান,যারা ভিন্ন অবস্থানে থাকা সত্তে¡ও পরস্পরের জন্য বোধ করেছে টান ও মিত্রতা। পরস্পরের সহায় হয়ে উঠেছে,নিকট হয়েছে, আবার দূরেও গেছে। শেষে তারা জনমকার মতন বিচ্ছিন্নও হয়ে উঠেছে। শরৎচন্দ্রের কাহিনী এখানে অতি বিস্তারিত নয়,বরং বেশ সংহত এক আখ্যানই আমরা পাই।
 

কিন্তু সুদূরের জন্য আকুলতার যেই পরিচয় এইখানে ফুটিয়ে তুলেছেন শরৎচন্দ্র; আর, কিশোর আত্মার ভেতরেও যে বিরাজ করে এক মহা সমাজ-বহিরিস্থিত জন , যাকে থিতু-সংসারী লোকেরা চিনে উঠতে পারে না কিছুতেই; সেই খাপ-না-খাওয়া কিশোর সত্তার স্বরূপ উদ্ঘাটনের এই যে তাগিদ-এটি ওই পরোক্ষ প্রভাবেরই ফল। তবে শরৎচন্দ্র কেবল অনুকারী মাত্র নন,তিনি এক মেধাবী স্রষ্টা। সেই কারণেই তাঁর প্রভাবজাত  প্রধান চরিত্রদুটি হয়ে উঠেছে আরো ঘন মানবিক করুণা পরিপূর্ণ, জীবনকে দেখার গভীর অর্ন্তদৃষ্টিময় কিশোর, আরো চিত্তহর।
 

মার্ক টোয়েনের উপাখ্যান দুটি ও শরৎচন্দ্রের আখ্যানটির ঘটনাগত সাম্য নিম্নরূপ:
 

১. মার্ক টোয়েনের টম সয়্যার এক অনাথ নিঃসহায় বালক; যার আশ্রয় জোটে তার আত্মীয় পলি আন্টির গৃহে। সেখানে টমকে সভ্য সমাজের যাবতীয় আদব-কেতা শেখানোর জন্য সদা তৎপর হয়ে থাকে তার আন্টি। সামাজিক ব্যাকরণ শিক্ষা করতে গিয়ে, টম যতো ভুল করতে থাকে; যতো বেগড়াবাই করতে থাকে; আন্টি ক্লান্তিহীন ভাবে ততোই সেসব শুধরে চলতে থাকে। অগত্যা নিতান্ত অনিচ্ছায় সেইসব বিধিবিধান আত্মস্থ করতে থাকে টম।
১.শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তও নিতান্ত অনাথ। সে আশ্রয় পায় ধনে-জনে সম্পন্ন এক পিসিমার গৃহে। সেখানে তার পিসিমা গৃহস্থালির সহস্রকর্মে ব্যস্ত, গুঁড়োগাড়াদের দিকে খেয়াল দেয়ার ফুরসত তার কম। তবে সেখানে আছে পিসিমারই এক প্রতিনিধি। সে পিসিমার কট্টর, নিয়ম মান্যবাদী মেজো পুত্র। সে শ্রীকান্তকে এবং বাড়ির অন্য সকল কিশোরকে সভ্য করে তোলার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তার চালু করা কঠোর অনুশাসন মেনে-গুনে চলতে হতে থাকে শ্রীকান্তকে। সেখানে প্রতি কদমে কেবল নিয়ম মান্য করার, কেবল হুকুম তামিল করার কঠিন দিন-রাত পার করতে থাকে শ্রীকান্ত। 
 

২. টম সয়্যারকে ওই বিধি আর হুকুমদারি মান্য করে চলতে থাকার বন্দীদশা থেকে মুক্তি দেয় হাক। সে আসে গোপনে। প্রকাশ্যে আসার উপায় তার নেই, কারণ  ভদ্র গৃহস্থ মায়েরা কিছুতেই তাদের বাচ্চাদের হাকের সাথে  মেলামেশা করতে দিতে রাজি নয়। তারা হাককে ভালো ছেলে বলে মনে করে না। তাদের কাছে হাক হচ্ছে মহা  অভব্য আর বখাটে আর নোংরা এক ছেলে । কিন্তু সমস্ত তল্লাটের অন্যসব ছেলের সাধ ও স্বপ্ন হাকের মতো হয়ে ওঠা। হাকের বন্ধুতা পাওয়ার জন্য উদগ্রীব সকলে,সকল ভদ্রমায়ের ভদ্র ছেলেই চায় তার মতো হয়ে উঠতে। টমও তাইই চায়। প্রবলরকমে চায়। মার্ক টোয়েন সেই পরিস্থিতিটার যে বিবরণ দেন,তা এমন:
Shortly Tom came upon the jvuenile pariah of the village, Huckleberry Finn,son of the town drunkard. Hauckleberry was cordially hated and dreaded by all the mothers of the town, because he was idle and lawless and vulgar and bad – and because all their children admired him so, and delighted in his forbidden society,and wished they dared to be like him. Tom was like the rest of the respectable boys, in that he envied Huckleberry his gaudy outcast condition, and was under strict orders not to play with him. So he played with him every time he got a chance.
২) শ্রীকান্তের জন্য অমন অন্য রোমাঞ্চকর দিনরাত্রির আমন্ত্রণ নিয়ে আসে ইন্দ্রনাথ। কিন্তু ইন্দ্রনাথকে সংসারবাসী বয়স্কজনেরা সুনজরে দেখে না। কারণ সে ‘মন্দ’ ছেলে। হাকের মতোই সেও শ্রীকান্তের জন্য নিয়ে আসে রাত্রির পৃথিবীতে ঢোকার চাবি। আনে রহস্যের সংবাদ। নিত্যকার জীবনের বাইরের অন্য আরেক বাস্তবতাকে দেখায় তারা দুইজন - টম ও শ্রীকান্তকে। আবার, শ্রীকান্তও অবিকল টমের মতোই ব্যাকুল-উদগ্রীব,ইন্দ্রের বন্ধুতা পাওয়ার জন্য - ইন্দ্রের মতো হয়ে ওঠার জন্য। 
শ্রীকান্তের আকুলতা এমন সুতীব্র: ‘এই সেই ইন্দ্রনাথ। সেদিন ভাবিয়াছিলাম, যদি অতখানি জোর এবং এমনি করিয়া মারামারি করিতে পারিতাম! আর আজ রাত্রে যতক্ষণ না ঘুমাইয়া পড়িলাম, ততক্ষণ কেবল কামনা করিতে লাগিলাম-যদি অমনি করিয়া বাঁশি বাজাইতে পারিতাম!’
শুধু তার মতো হয়ে ওঠার সাধই শ্রীকান্তকে পোড়াতে থাকে না, তার সাথে বন্ধুতা করার জন্য শ্রীকান্তের প্রাণ-অন্তরও তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকে: “যিনি সব জানেন,তিনিই শুধু বলিয়া দিতে পারেন-কেন এত লোক ছাড়িয়া সেই একটা হতভাগার প্রতিই আমার সমস্ত মন-প্রাণটা পড়িয়া থাকিত, এবং কেন সেই মন্দের সঙ্গে মিলিবার জন্যই আমার দেহের প্রতি কণাটি পর্যন্ত উন্মুখ হইয়া উঠিয়াছিল।”

 

৩) বাকলবেরি ফিনের সাথে ইন্দ্রনাথের রয়েছে গভীর মিল। একইরকম স্বেচ্ছাচারী, সাহসী আর মানবিক করুণায় পরিপূর্ণ তারা দুজনই। দুজনই মানে যে, ভূতপ্রেত যেমন আছে, তেমনি যাদুটোনারও আছে অসাধ্য সাধন করার শক্তি। দুজনেই চলনে-বলনে, পোশাকে-আশাকে একইরকম বিশৃঙ্খল,অমনোহর এবং উদাসীন। তবে ওই নিয়েই তারা দুইজনেই কোনোপ্রকার অপরিতোষে ভোগে না,বরং নিজেদের ওই এলোমেলো বেশ-বাস বা শারীরিক গঠনের সঙ্গে বেশ পরিতোষের সাথেই অবস্থান করে তাদের দুজনের মনই:
Huckleberry was always dressed in the cast-off clothes of full-grown men, and they were in perennial bloom and fluttering with rags. His hat was a vast ruin with a wide crescent lopped out of its brim; his coat; his coat,when he wore one, hung nearly to his heels and had the rearward buttons far down the back;  but one suspender supported his trousers,the seat of the trousers bagged lwo and contained nothing,the fringed legs dragged in the dirt when not rolled up.
৩) নিজের দৈহিক গড়নের গোলমাল নিয়ে ইন্দ্রের কোনো অস্বস্তি নেই। ওটি যে মনে রাখার বিষয়,তাও সে মনে কওে না। এমনই আত্ম-উদাসীন ইন্দ্রনাথ। একেবারে প্রথম যেই সন্ধ্যায়,শ্রীকান্ত ইন্দ্রকে পায় উদ্ধারকর্তা হিসেবে,তখন শ্রীকান্ত দেখে: “ছেলেটি কালো। তাহার বাঁশির মত নাক,প্রশস্ত সুডৌল কপাল,মুখে দুই-চারিটা বসন্তের দাগ। মাথায় আমার মতই,কিন্তু বয়সে কিছু বড়।... ছেলেটির বুকের ভিতর সাহস এবং করুণা যাহা ছিল, তাহা সুদুর্লভ হইলেও অসাধারণ হয়ত নয়। কিন্তু তাহার হাত দুখানি যে সত্যই অসাধারণ,তাহাতে লেশমাত্র সন্দেহ নাই। শুধু জোরের জন্য বলিতেছি না। সে দুটি দৈর্ঘ্যে  তাহার হাঁটুর নীচে পর্যন্ত পড়িত। ইহার পরম সুবিধা এই যে, যে ব্যক্তি জানিত না,তাহার কস্মিনকালেও এ আশঙ্কা মনে উদয় হইতে পারে না যে,বিবাদের সময় ঐ খাটো মানুষটি অকস্মাৎ হাত-তিনেক লম্বা একটা হাত বাহির করিয়া তাহার নাকের উপর এই আন্দাজের মুষ্ট্যাঘাত করিবে। সে কি মুষ্টি! বাঘের থাবা বলিলে হয়।”

 

৪) যদিও ইন্দ্রনাথ  হাকের মতো সমাজের অমন নিম্নতলের অধিবাসী নয়,বরং সে সমাজের সম্মানিত এক নামী পরিবারের সন্তান; কিন্তু অবিকল হাকের মতোই  বেপরোয়া সে, আর একগুঁয়ে। যা তার মন চায়,তা-ই  করে ইন্দ্রনাথ। ভদ্রজনের চোখে তাই এই ছেলে শুধু “মন্দ” ছেলেই নয়, সেই ছেলে মস্ত হতভাগা আর পোড়াকপালেও।  হাকলবেরি ফিন আগাগোড়া চলে নিজ স্বাধীন ইচ্ছা অনুসারে। স্কুলে যাওয়ার কোনো তাড়া দেবার কেউ তার নেই সত্য,তবে সে নিজেও ওই বিষয়টাতে কোনো আগ্রহ বোধ করে না। থাকে সে তার নিজের অবাধ খেয়ালখুশী মাফিক: 
Huckleberry came and went,at his own free will.He slept on doorsteps in fine weather and in empty hogsheads in wet; he did not have to go to school or to church,or call aû being master or obey aûbody; he could go fishing or swimming when and where he chose,and stay as long as it suited him; nobody forbade him to fight; he could sit up as late as he pleased; he was always the first boy that went barefoot in the spring and the last to resume leather in the fall; he never to wash,nor put on clean clothes; he could swear wonderfully. In a word, everything that goes to make life precious that boy had. So thought every harassed, hampered, respectable boy in   St. Petersburg.  

৪) ইন্দ্রনাথও কোনো এককালে বিদ্যালয়ে ঢুকেছিলো। যেহেতু সে স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান,পরিবারের চাপে সে যায় বিদ্যালয়ে। কিন্তু সেখানে তার পক্ষে তিষ্টানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। সে বিদ্যালয় ত্যাগ করে , তারপর শুরু করে তার আপন-ইচ্ছেমতো জীবন যাপন। বেখেয়ালী , বিবাগী একজন সে। শ্রীকান্তের বর্ণনা থেকে আমরা যা জানতে পারি:
“ ইস্কুলেও সে আর পড়ে না। শুনিয়াছিলাম,হেড মাস্টার মহাশয় অবিচার করিয়া তাহার মাথায় গাধার টুপি দিবার আয়োজন করিতেই সে মর্মাহত হইয়া অকস্মাৎ পিঠের উপন কি একটা করিয়া ঘৃণাভরে ইস্কুলের রেলিঙ ডিঙ্গাইয়া বাড়ি চলিয়া আসিয়াছিল,আর যায় নাই।... অনেকদিন পরে তাহার মুখেই শুনিয়াছিলাম,... হিন্দুস্থানী পণ্ডিতজীর ক্লাশের মধ্যেই নিদ্রাকর্ষণ হইত। এমনি এক সময়ে সে তাহার গ্রন্থিবদ্ধ শিখাটি কাঁচি দিয়া কাটিয়া ছোট করিয়া দিয়াছিল মাত্র। ... তথাপি কেন যে পণ্ডিতের রাগ পড়ে নাই,এবং হেডমাস্টারের কাছে নালিশ করিয়াছিলেন- সে কথা আজ পর্যন্ত ইন্দ্র বুঝিতে পারে নাই।... মাথার উপর দশ-বিশজন অভিভাবক থাকা সত্তে¡ও কেহ কোনমতেই আর তাহার মুখ বিদ্যালয়ের অভিমুখে ফিরাইতে সক্ষম হইল না। ইন্দ্র কলম ফেলিয়া দিয়া নৌকার দাঁড় হাতে তুলিল। তখন হইতে সে সারাদিন গঙ্গায় নৌকার উপর। তাহার নিজের একখানা ছোটো ডিঙি ছিল; জল নাই, ঝড় নাই,দিন নাই, রাত নাই- একা তাহারই উপর। হঠাৎ হয়ত একদিন সে পশ্চিমের গঙ্গার একটানা-স্রোতে পানসি ভাসাইয়া দিয়া, হাল ধরিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল; দশ-পনর দিন আর তাহার কোন উদ্দেশই পাওয়া গেল না।”                  
 

(চলবে)

Link copied!