• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
স্মৃতিচারণা

আমাদের মা শিরিন বানু মিতিল


তাহসিনূর রহমান
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২, ২০২২, ০৪:৩১ পিএম
আমাদের মা শিরিন বানু মিতিল

(অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিলের জন্ম ১৯৫০ সালের ২ সেপ্টেম্বর পাবনায়। তার মা সেলিনা বানু ছিলেন পাবনা জেলার ন্যাপের সভাপতি এবং পরে যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। বাবা খন্দকার শাহজাহান মোহাম্মদ ছিলেন পাবনা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেওয়া শিরিন বানু মিতিলের রাজনীতিতে যোগদান ছোটবেলাতেই। ১৯৬৯ সালে গণ-আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন শিরিন বানু মিতিল। পাবনা ও কুমিল্লা, দুই জায়গাতেই কাজ করতেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় শিরিন বানু মিতিল ছিলেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। একই সঙ্গে ছিলেন পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রী। ২৫ মার্চ রাতে পাবনাতেও হামলা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ২৭ মার্চ রাতে পাবনা পুলিশ লাইনসের যুদ্ধ শুরু হয়৷ সেই যুদ্ধ রূপ নেয় জনযুদ্ধে৷ ২৮ মার্চ পাবনা টেলিফোন এক্সচেঞ্জে হানাদারের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন শিরিন বানু মিতিল। এই যুদ্ধে মিতিলই একমাত্র নারী ছিলেন। অকুতোভয় এই মুক্তিযোদ্ধার জন্মদিন উপলক্ষে স্মৃতিচারণা করেছেন তাঁরই সন্তান তাহসিনূর রহমান।)


সেদিন ইন্টারনেটে ই-বুক খুঁজতে খুঁজতে মোবি ফরম্যাটে অনেক বাংলা বই দেখতে পেয়ে মায়ের কথা মনে হচ্ছিল। আগে মোবি ফরম্যাটে বাংলা বই বেশি পাওয়া যেত না। শুধু পিডিএফ পাওয়া যেত। ছোট স্ক্রিনে পিডিএফ পড়তে কষ্ট হয়। একটা বড় স্ক্রিনের ট্যাবে বাংলা বইয়ের যতগুলো সম্ভব পিডিএফ জোগাড় করে মাকে দেখাতে, মা চোখ বড় বড় করে বলেছিল, “এ তো পুরো লাইব্রেরি।” তারপর দেখেছি মা সেটাতে বেশ খুশিমনে বই পড়ছে। মা এত অল্পে খুশি হতো।

মা বই পড়তে ভালোবাসত, পড়তও অনেক। মায়ের কথা মনে হলেই যে ছবিটা আসে সেটা হলো, মা–হাতে বই। যেকোনো পরিস্থিতিতে। বই পেলে নাওয়াখাওয়া ভুলে যাওয়ার একটা ব্যাপার ছিল মায়ের। সেখান থেকে এক-আধটু পাওয়া এই অভ্যাসটা। আমার নানির বাপের বাড়ির দিকে বই পড়ার নেশাটা কমবেশি সবার মধ্যে আছে। বাথরুমে বই নিয়ে যাওয়া ছিল খুবই সাধারণ ব্যাপার। সেই সময় থেকে যখন হাই-কমোড ছিল না। এবং বইসহ গিয়ে ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়াটাও ছিল নৈমিত্তিক বিষয়। আমি একটা সময় ভাবতাম যে এমনটা শুধু বুঝি আমাদের বাসায়ই হয়। পরে দেখলাম নানির বাপের বাসার দিকে এটা একটা সাধারণ বিষয়। অনেক অনেক গল্প আছে। তার মধ্যে কিছু বিব্রতকরও।

মায়েরর ছোটবেলার গল্পে শুনেছি যে–মায়েদের একটা পারিবারিক লাইব্রেরি ছিল। জলছবি পারিবারিক লাইব্রেরি। নানা-নানি-মা-খালা-মামা। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট। নানা সভাপতি, নানি সদস্যসচিব। সেই লাইব্রেরি থেকে মাসে মাসে হাতে লিখে দেয়ালপত্রিকা বের হতো। শুচি খালা সম্পাদক, আর অন্যরা লেখক। বাসায় পুরোনো কিছু কিছু বইয়ের ভেতর জলছবি পারিবারিক লাইব্রেরির সিলের ছাপ এখনো আছে। 

আমার ছোটবেলার বইয়ের কথা বলতে মনে আছে যে আমরা যখন বাইরের জেলা থেকে ঢাকায় আসি, তখন দুই ট্রাকে আমাদের মালামাল এসেছিল। তার মধ্যে এক ট্রাকে ছিল শুধু বই। বড় হতে হতে যে বাসাতেই থাকা হতো না কেন, টাকাপয়সার অবস্থা যা-ই হোক না কেন, বাসার প্রধান জিনিস–বই। যেখানে সেখানে। সাজানো বই, অগোছালো বই, দাঁড় করিয়ে রাখা বই, কাত করে রাখা বই, স্তূপ করে রাখা বই, বইয়ের তাকে বই, বইয়ের তাকের ওপরে বই, টেবিলে বই, চেয়ারে বই, খাটে বই, খাটের নিচে বই। এমনকি হঠাৎ করে হাতিরপুলের বাসাটা ছেড়ে দিতে হয়েছিল দেখে পরবর্তী বছরখানেক, এলিফ্যােন্ট রোডে মল্লিকা সিনেমা হলের উল্টো দিকের গলিতে সাবলেটে যে দুটো রুম নিয়ে আমাদের থাকা হতো, সেখানে জায়গার অভাবে বই সাজিয়ে তার ওপর তোশক দিয়ে আমার ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল মা। বইয়ের খাট? খাটের বই? বই দিয়ে বানানো খাট? হবে কিছু একটা। 

সে সময়টায় মায়ের বেতন বেশি না, টানাটানিই বলা যায়। কিন্তু তার মধ্যেও দেখতাম মা প্রতি মাসে বেতন পেলেই আমাদের জন্য বই কিনে আনত। কিশোর ক্ল্যাসিকস, তিন গোয়েন্দা, ওয়েস্টার্ন, রহস্য পত্রিকা। এছাড়া নিয়মিত সানন্দা ও অন্যান্য নানান ম্যাগাজিন তো ছিলই। আরও ছিল সময়ে অসময়ে বই কেনা। শুধু যে আমাদের বই কিনে দিত, তা না। উপহারও দিত সবাইকে। ঘটনাটা ভুলে গিয়েছিলাম। বিধান রিবেরু। বিধান, আমার বন্ধু, মনে করিয়ে দিল। সেদিন ও ছিল সঙ্গে। কোথায় জানি যাচ্ছিলাম। কোথাও যাওয়ার পথে হাতে সময় থাকলে রাস্তার ধারের যেকোনো বইয়ের দোকানে কিছুক্ষণের জন্য ঢুঁ মারা ছিল মায়ের অভ্যাস। সেদিন এ রকমই ধানমন্ডির একটা বইয়ের দোকান থেকে মা, ডানা মেলার দিন বইটা ১০ কপি কিনেছিল সবাইকে উপহার দেওয়ার জন্য। লুইসা মে অলকটের লিটল্‌ উইমেন-এর অনুবাদ। আমি এই বইটার আরও তিনটা অনুবাদ পড়েছি। কিন্তু বাংলা ভাষায় করা এই বইটার এত ভালো অনুবাদ আর পড়িনি। মুশতারী খালার করা। খন্দকার মুশতারী বানু। কিন্তু সেই বইটাও এখন আর পাওয়া যায় না।

হাতিরপুলে শিপুর সঙ্গে বন্ধুত্বটা গাঢ় হয়েছিল বই পড়াকে কেন্দ্র করেই। একবার এমন হয়েছে যে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা বের হয়েছে। আমি আর শিপু গিয়ে দেখে এসেছি। দাম মনে হয় ৬০, ৭০ বা ৮০ টাকা। ১৯৯৩-৯৪ সালের কথা। তো আমরা দুজন অনেক হিসাব করছি। মাসের শেষ। এত দাম। চাওয়া কি ঠিক হবে? টাকাপয়সার সমস্যা। দুজন মিলে ঘণ্টাখানেক এসব হিসাব করে লোভ সামলাতে না পেরে মায়ের কাছে– না, মানে হ্যাঁ, মানে এই আরকি, করতে করতে বললাম যে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা বের হয়েছে। মা সোফাতে শুয়ে বই পড়ছিল। শুনেই রীতিমতো লাফিয়ে উঠে টাকা ধরিয়ে বলল- এখনি যা, কিনে আন। 

বই পড়া নিয়ে একটা কাড়াকাড়ি ব্যাপার ছিল আমাদের বাসায়। এমন হয়েছে নতুন কোনো বই কিনে এনেছি বাসায়। প্রিয় কোনো লেখকের। হয়তো পড়ছি। মা বাসায় ঢুকে দেখল আমার হাতে বই। কিছু পড়তে দেখলেই জিজ্ঞেস করত কী পড়ছি। বলামাত্র মা কি দারুণ বলে একটা খুশির চিৎকার দিয়ে ঝা করে কেড়ে নিয়ে বলত–আমি পড়ব এখন। আমি বা জয়াপু হয়তো হা করে তাকিয়ে–না…পড়ছিলাম…আ..মি… তারপর আচ্ছা ঠিক আছে। এ রকম সময় আর কী করার থাকে।

তখনো হাতিরপুল থাকি। জাহান, শিপু আর আমি মিলে তিন গোয়েন্দা হয়েছি। খাদিমুল মুশফিক জাহান। রিশাদ হোসেন শিপু। তাহসিনূর রহমান। কিশোর পাশা। রবিন মিলফোর্ড। মুসা আমান। জাহানদের বাসার ছাদের ওপর সিঁড়িঘরেরও ওপরে রেলিং দিয়ে ঘেরা একটা ছোট জায়গা ছিল। সেটার ওপর টিনের একটা চাল ফেলে যে গর্তের মতো সেটাই আমাদের হেডকোয়ার্টার। রহস্যের অভাব নিয়ে আমাদের হাহাকার শুনে মা নিজে বানিয়ে ছড়া আকারে একটা ধাঁধা লিখে দিল। গুপ্তধনের সন্ধান। আমরাও ঝাঁপিয়ে পড়েছি। গুপ্তধন ছিল নির্দিষ্ট একটা বইয়ের ভেতর লুকানো অল্প কিছু টাকা। সেটাও মায়ের রাখা। 

আরেকবার ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ি। কোনো একটা বই পড়ে মাওবাদ, নকশাল বাড়ি এসব নিয়ে মাকে প্রশ্ন করাতে মা বলল আমি তো ভালো জানি না। দাঁড়া তোকে আংটি মামার কাছে নিয়ে যাব। আমিনুল ইসলাম বাদশা। ভাষাসৈনিক। মুক্তিযোদ্ধা। সেই সপ্তাহের শুক্রবারেই মা মৌচাকের ওখানে বাদশা নানার কাছে নিয়ে গিয়েছিল। নানাও প্রায় দু-তিন ঘণ্টা ধরে বামপন্থী আন্দোলন, সোভিয়েত ইউনিয়ন-চীন বিরোধ, মাওবাদী আন্দোলন, নকশালবাড়ি আন্দোলন, খতমের লাইনসহ নানান বিষয়ে বলছিলেন। তখন মনে হয়েছিল কিচ্ছু মনে নেই। কিন্তু পরে, অনেক অনেক পরেও দেখেছি যে প্রাসঙ্গিক সময়ে আলোচনাগুলো হঠাৎ করে কোথা থেকে মনের মধ্যে জেগে ওঠে। বাদশা নানার সঙ্গে আমার আর কোনো স্মৃতি নেই। কিন্তু ওই দুই ঘণ্টা এখনো আছে। এ রকম করেই মা হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিল আরও অনেকের কাছে। রাজনীতিবিদ, ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী, সংগঠকসহ নানান মানুষ। এই দেশটা, দেশের আন্দোলনগুলো, লড়াই, ত্যাগ, সাফল্য, ব্যর্থতা, হতাশা, কষ্ট, তারপরে আবারও লড়াই, সব, সবই, পুরো অতীতটা মায়ের কারণে আমাদের কাছে এই মানুষগুলোর হাত ধরে আসে। পরিবারের একজন হয়ে আসে। সামান্য কয়েকটা প্রশ্নের উত্তরে মা কেমন করে প্রজন্মান্তরের সময়হীন বন্ধুত্ব তৈরি করে দিল। 

মা নিয়ে গিয়েছিল পয়লা বৈশাখে রমনার বটতলা, ২৫ মার্চ রাতে জগন্নাথ হলে, ১৪ ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, ১৬ ডিসেম্বর সাভারের স্মৃতিসৌধে। ঈদ তো ছিলই, কিন্তু মা নিয়ে গিয়েছিল দুর্গাপূজায় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে, পূজার দাওয়াতে মায়ের বন্ধুদের বাসায়। কতবার। বড়দিনের দাওয়াতে চার্চে। এ রকম এক দাওয়াতে, সেন্ট ইমানুয়েল ব্যাপ্টিস্ট চার্চে গিয়ে বন্ধুত্ব হয়েছিল পিয়াসের সঙ্গে। বাসায় নিয়ে এসেছিলাম ওর টিনটিনের একটা বই। দ্য সুটিং স্ট্যার। পড়ে ফেরত দেওয়ার কথা। বইটা এখনো বাসায়। ও দেশের বাইরে থাকে। কখনো দেখা হলে ক্যাক করে চেপে ধরতে পারে বইটার জন্য। 

২১ ফেব্রুয়ারি। ঢাকায় আমার শহীদ মিনারে প্রথম যাওয়া মায়ের সঙ্গে, বয়স ৪/৫/৬, ঠিক মনে নেই। মিছিল করে ফুল দিতে যাওয়া। মায়ের সঙ্গে গিয়েছি কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে। মানে মা নিয়ে গিয়েছে। পুরোনো পল্টন। তখনো বিল্ডিং ওঠেনি। সামনে অনেকটা জায়গা। একতলা বাসা। বারান্দায় অনেক চেয়ার রাখা। মা ভেতরে গিয়ে কার কার সঙ্গে যেন গল্প করছে। আমি বারান্দায় বসে অস্থির হচ্ছি। তারপর মিছিল শুরু। ওরে বাবা। হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা। পল্টন, শাহবাগ, কাঁটাবন। নীলক্ষেত মোড়ের কাছাকাছি হঠাৎ কোথা থেকে ‘মিতিল আপা’ বলে অঞ্জন মামা এসে হাজির। তারপর ‘এটা কে’ বলে ছোঁ মেরে আমাকে ঘাড়ে তুলে নিল। আমি প্রথম শহীদ মিনার দেখলাম অঞ্জন মামার ঘাড়ে চড়ে। তিন প্রজন্মের বন্ধুত্ব। কী অদ্ভুত! প্রসাদ রায় ছিলেন নানা-নানির রাজনৈতিক বন্ধু। সে সূত্রে অঞ্জন মামা, বৃত্বা মাসি মায়ের ভাইবোন, আর সে সূত্রে আমি আর ঋদ্ধ এখন ভাই। আমাদের এ রকম আরেক বোন আছে। এশা। আরমা মাসির মেয়ে। এখানেও তিন প্রজন্মের সম্পর্ক। আরমা মাসির দাদু হন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। বাংলা ভাষার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। নানা-নানি গিয়েছেন দেখা করতে, মা-ও ছিল সঙ্গে। সেখানেও বই ছিল মায়ের হাতে। প্রথম সাক্ষাতের গল্প বলতে গিয়ে মাসি বলে— “দেখে তো রাগে আমার গা জ্বলে গিয়েছে। বেড়াতে এসেছে, তা-ও ফুটানি করে হাতে বই। আমার মা এরপর বলবে, দেখ মিতিল কি লক্ষ্মী মেয়ে, কি সুন্দর পড়ালেখা করে, আর বকতে বকতে আমার জীবন শেষ করে দিবে।” পরবর্তী জীবনে দুজনে ভীষণ বন্ধু ছিল। প্রাণের বন্ধু। এ রকম করেই মায়ের কারণে পরিবার বড় হয় আমাদের। আর কিছু সম্পর্ক কীভাবে কীভাবে জানি রক্তের মতো গাঢ় হয়ে ওঠে।

এ এক অদ্ভুত ক্ষমতা মায়ের। সম্পর্ক তৈরি করার। রক্ষা করার। মা কেমন করে, কেমন করে যেন সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। নিজের যত ভাই-বোন থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন সবার সঙ্গে। মাকে হিংসে হয়। মায়ের মতো হতে ইচ্ছে করে। সবার কাছে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু যাওয়া হয় না। খুব মনে হলেও যাওয়া হয় না। আর কারও কারও কাছে যাওয়ার সুযোগও থাকে না। যেমন যাওয়া যায় না মায়ের কাছে। হায়দার নানা আর চন্দন নানি তেমন দুজন মানুষ। সম্পর্কে মায়ের ফুফু আর ফুফা। হায়দার নানার হাসিটা এত সুন্দর। সম্পর্কে ফুফু হলেও নানি মায়ের চেয়ে বয়সে খুব বড় ছিলেন না। দুজনই খুব বন্ধু। মা ওর খুব দুঃসময়ে, মন খারাপে, কষ্টে যেত ওখানে। কেমন একটা আশ্রয়ের মতো ছিল। বন্ধুর মতো ছিল। কিরণ মামা, রিয়া খালা, কেয়া খালা, কণক মামা। একবার মা খুব দুঃসময়ে চন্দন নানির কাছে গিয়েছে। আমি আর তন্বীও ছিলাম। কিরণ মামা আমাকে ছাদে নিয়ে গিটার বাজিয়ে গান শুনিয়েছিল। Take Me Home, Country Roads। আমার প্রথম শোনা। পরে যতবারই শুনেছি, কিরণ মামার কথা মনে হয়। একটা বড় দুঃসময়ে কেমন আদর করা। সরাসরি কিছু না বলেও যত্ন নেওয়া। মানুষগুলোকে এত ভালো লাগে। কিন্তু যাওয়া হয় না। 

শহীদ মিনার থেকেই তো বইমেলা। আবারও মা আর বই। শেষ বই মেলায় মায়ের সঙ্গে গিয়েছি। মা হাঁটছে, আমি মায়ের হাত ধরে ঝুলছি। ছোটবেলার মতো। শেষবারের মতো। হঠাৎ মায়ের সবচেয়ে পছন্দের বইয়ের সিরিজটার মুখোমুখি। নতুন বের করেছে। ঝকঝকে। লরা এঙ্গেলস্‌ ওয়াইল্ডারের লিটল হাউস সিরিজ। বাংলায় অনুবাদ করা। সব কটি বই মায়ের পড়া। বাংলায়। ইংরেজিতেও। কানাডায় গিয়ে দেশে ফেরার সময় পুরো সেটটা কিনে এনেছিল। তারপরও। বললাম কিনো। কিন্তু আমার কাছে টাকা ছিল না, কেন যেন আমার কাছে কখনোই থাকে না। ছিল না মায়ের ব্যাগেও। কোন বিষয় না। আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংক আছে। মায়ের জয়ন সোনা, আমার আর তন্বীর জয়াপু, জপু, জয়ন, আর যে কি কি! ওকে ফোন দিয়ে বললাম - আসো। বইমেলা। টাকা লাগবে। মা বই কিনবে। তারপর আমার স্পেশাল ব্যাংক, জলিকেও বললাম। আসো। টাকা লাগবে। মা বই কিনবে। তন্বী তখন দেশের বাইরে। জার্মানি। জয়াপু ও জলি দুজনেই বলল, আসছি। মাকে বললাম ওরা আসতে আসতে চলো আরও বই দেখি। কিন্তু আমার হাত ধরে মা দাঁড়িয়ে আছে দোকানটার সামনে। ছোট বাচ্চার মতো। নড়ছে না। বললাম কিনব তো, চলো আরও বই দেখি। জয়ন না জলি কে আগে এসেছিল মনে নেই। বইগুলো কেনা হয়েছিল। বইমেলায় যাওয়া আছে। পড়া হবে না জেনেও বই কেনা আছে। বই জমানো আছে। টাকা নষ্ট করার এই বাতিকটা আছে। মায়ের হাত ধরে ঝুলে ঝুলে ঘোরাটা থাকলেও হতো।

বইয়ের পাগলামি মনে হয় মায়ের সঙ্গে সঙ্গে বাবাও কিছুটা শেয়ার করত। দুজনে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে দেশে ফেরার সময় নিয়ে এসেছিল তাক-তাক বই। পুরো মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-স্ট্যালিন রচনাবলি তো ছিলই, সঙ্গে ছিল অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস, গল্প, উপন্যাস, কবিতা, মা-বাবার অনার্স-মাস্টার্সের বইসহ আরও কত কত বিষয়ের জানি না। এবং রাশান ভাষায়। দুজনের পরিকল্পনা ছিল বইগুলো বাংলা ভাষায় অনুবাদ করবে। হঠাৎ বাসা ছাড়ার কারণে রাখবার জায়গার অভাবে রাশান ভাষার বইগুলো মা সের দরে বিক্রি করে দিয়েছিল। মানুষের যে কত স্বপ্ন থাকে, আর জীবনের গতিতে সেগুলো যে কোথায় যায়। 

নানা-নানি-মায়ের অনেক বই। রবীন্দ্র রচনাবলী, মানিক, তারাশঙ্কর, বঙ্কিম, নজরুল, জীবনানন্দ, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সৈয়দ মুজতবা আলী এবং আরও অনেক বই। বইগুলো পুরোনো হয়ে গেছে, পাতাগুলো হলুদ। একটু জোরে ধরলে প্রায় ভেঙে হাতে চলে আসে। বইগুলোর পরবর্তী সংস্করণ কেনা হয়েছে। কিন্তু পুরোনোগুলো ফেলতে পারি না। কত গল্প। বাসার গল্প। বইয়ের গল্প। বইগুলোর গল্প। আর এত এত বইয়ের মধ্যে, বইয়ের ফাঁকে ধুলার মধ্যে, জমে যাওয়া ঝুলের মধ্যেও তো মায়ের স্মৃতি। 

 

বইগুলো তো মায়ের অস্তিত্বেরই আরেকটা অংশ। তাই না!

Link copied!