মুখবন্ধ
শার্ল বোদলেয়ারের মৃত্যুর দুই বছর পর—অর্থাৎ ১৮৬৯ সালে—গ্রন্থাকারে প্রকাশিত পঞ্চাশটি গদ্য-কবিতার সংগ্রহ ‘পারির পিত্ত’ অনেক ভাষায় অনূদিত হইয়াছে। বাংলা ভাষায়ও অন্তত একটি চমৎকার অনুবাদ পাওয়া যায়। গত বছর কবির জন্মের দুইশত বৎসর উপলক্ষে এই নতুন অনুবাদে হস্তক্ষেপ করিয়াছিলাম। আমার গুণী বন্ধু বিধান রিবেরুর আগ্রহে এ বছর এইগুলি সংবাদ প্রকাশ পত্রিকায় ছাপা হইতেছে। বলা বাহুল্য, এই অনুবাদ নিতান্তই খসড়া।
আজ প্রকাশিত হইতেছে চতুর্থ গুচ্ছ। পূর্বের মতো এই গুচ্ছেও ছয়টি পদ্য (১৯-২৪) রহিল। গদ্যে লেখা এই পদ্যগুলি যুগপদ গীতিধর্মী, নীতিপরায়ণ, নৈরাশ্যকবলিত অথবা বিদ্রোহমণ্ডিত। কোন কোনটি যোগায় স্মিতহাসি, কোন কোনটি বা সেই হাসিকে আকর্ণবিস্তৃত করে। উদাহরণ হিসাবে ‘গরিবের খেলনা’ লওয়া যায়। ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্য এই পদ্যের একমাত্র বিবেচ্য নয়। একাধারে তিনি চোখে আঙুল দিয়া দেখাইতেছেন: “বিলাস-ব্যসন, বেপরোয়া ভাবসাব আর নিত্য ধনদৌলত প্রদর্শনীর দৌলতে দারুণ সুদর্শন এই শিশুদের মধ্যবিত্ত কিংবা বিত্তহীন শিশুর তুলনায় ভিন্ন ধাতুতে গড়া বলিয়া বিশ্বাস হয়।” পরিশেষে কবির চোখ এড়ায় নাই এই সত্যটিও: “আর শিশু দুইটি ভাই ভাই ভাব জমাইয়া সমানে সমানে শাদা দাঁত কেলাইয়া হাসিতেছিল।”
ফরাশি সভ্যতার অন্তস্তলে যে অন্তঃসারশূন্যতা তাহা— ‘ভাঁড়’ নামক পদ্যটির মতন— ‘পরীজাতির উপহার’ পদ্যেও প্রকটিত করিয়াছেন বোদলেয়ার। সদাশয় পরীমণি যখন ঘটনাচক্রে ফরাশি দোকানদারের পুত্রকে উপহার দিলেন “খুশি করিবার ক্ষমতা”, সংকীর্ণমনা দোকানদার ভদ্রলোক তাহার মর্ম বুঝিতে পারিলেন না। কবি লিখিলেন: “আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় ইনি সেই অতিসাধারণ চিন্তাবিদদের অন্যতম যিনি অসাধ্যসাধনের যুক্তিটা বুঝিতে মন যে উচ্চতায় উঠাইতে হয় সে উচ্চতায় উঠাইতে অক্ষম।”
‘প্রলোভন: অথবা রতি, ধনসম্পত্তি, ও খ্যাতি’ নামক পদ্যেও একই শ্লেষ আমাদের স্মিতহাসি সরবরাহ করে। এই পৃথিবীতে যাঁহারা রতিবাজ, সম্পত্তিবান, আর খ্যাতিমান তাঁহাদের ক্ষমতার সত্যকার উৎস শয়তান—এই রূপকান্ত উচ্চারণ বোদলেয়ারের স্বাক্ষর। এই তিন রিপুর অধীশ্বরদের তিনি প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন, তবে শুদ্ধমাত্র স্বপ্নে। জাগরণের পর যে আক্ষেপ তিনি আমাদের সামনে নিক্ষেপ করিলেন তাহা বড়ই হৃদয়বিদারক। কবি লিখিলেন: “তখন আমি উঁচুগলায় ডাকিলাম তাহাদের, মাথা নত করিয়া ক্ষমাপ্রার্থনা করিলাম, প্রতিশ্রুতি দিলাম তাহাদের অনুগ্রহ পাইতে যতবার আত্মাবমাননা করিতে হয় ততবারই করিব; মনে হইল, নিশ্চয়ই তাহাদের মনে খুব গভীরেই আঘাত দিয়াছি, কেননা তাহারা কোনদিন ফিরিয়া আসে নাই।”
যথাক্রমে ‘সন্ধ্যার গোধূলি,’ ‘নির্জনতা’, এবং ‘প্রকল্প’ নামা পদ্য তিনটিতেও গীতিধর্মের সঙ্গে নীতিনিষ্ঠার যুগলবন্দী প্রকটিত, প্রকৃতি যে সংস্কৃতির অনুকরণ করিতে পারদর্শী তাহার নিদর্শন ‘সন্ধ্যার গোধূলি’ পদ্যের এই কথায় মিলিবে: “গোধূলি, কি মিষ্টি আর মোলায়েম আপনি! রাত্রির বিজয়ীসুলভ নিবর্তনে পিষ্ট দিবাভাগের যাতনাতুল্য দিগন্তের শেষ গোলাপি কিরণমালার ছটা, অস্তায়মান গৌরবের মাথায় ঝাড়বাতির আলোতে পড়া আবছা আবছা লাল দাগ, অদৃশ্য হাতে নামাইয়া দেওয়া প্রাচ্যের গহন হইতে লইয়া আসা ভারি কাপড়ের পর্দা, জীবন-সায়াহ্নের পবিত্র ক্ষণে মানব-হৃদয়ে জটিল বেদনাবোধের যে সংগ্রাম চলে তাহার অনুকরণ করে।”
‘নির্জনতা’ এবং ‘প্রকল্প’— দুই পদ্যেই বুর্জোয়া সমাজের কপট মানবিকতা বোদলেয়ারের ব্যঙ্গ হইতে ছাড়া পায় নাই। ফরাশি বিপ্লবের তৃতীয় রণধ্বনি ‘ভ্রাতৃত্ব’ কিভাবে শেষ পর্যন্ত মানুষে মানুষে বিভেদকে স্থায়ী করিয়া লইয়াছে তাহা তীব্র, তীক্ষ্ণ, তমোহর ভাষায় ধরা পড়িয়াছে ‘ভ্রাতৃত্ব-ব্যবসায়’ পদবন্ধে। মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় যাহা ভ্রাতৃত্ব বা জাতীয় ঐক্য, ধনতন্ত্রের মধ্যযুগে তাহা স্রেফ ‘ভ্রাতৃত্ব-ব্যবসায়’ বৈ নয়। বোদলেয়ার এই ব্যবসায়কে অনস্বীকার্য ন্যায্যতার সঙ্গেই তুলনা করিয়াছেন সচরাচর কথিত ‘পতিতাবৃত্তির’ সঙ্গে।
‘প্রকল্প’ কবিতায় যথাক্রমে রাজপ্রাসাদ, পরদেশ ব্যবসায় আর বুর্জোয়া-ঔপনিবেশিক সরাইখানার পাশাপাশি তুলনা মিলিবে। আধুনিক নগর জীবনের নৈতিক দুর্বৃত্তপনার সঙ্গে ঔপনিবেশিক পরধনতন্ত্রের সাক্ষাত বন্ধুত্ব উৎকল্পনার আকারে বন্দী হইয়াছে এই পদ্যে। বুর্জোয়া যুগের সংক্ষিপ্তসার বোদলেয়ার সংকলন করিয়াছেন এই অবকাশে: “আনন্দ আর সুখ দেখি, জীবনানন্দে টইটম্বুর, প্রথম দর্শন করা সরাইখানায়, পড়িয়া পাওয়া সরাইখানায়। বড় একটা অগ্নিকুণ্ড, দৃষ্টিনন্দন বাসনকোসন, চলনসই নৈশভোজ, গ্রামীণ দ্রাক্ষারস, আর খানিক খসখসে অথচ ঝকঝকে চাদরমোড়া খুব বড় একটা বিছানা; আর কি চাই?”
পূর্বের মতো এই কবিতাগুলিও ক্লদ পিশোয়া সম্পাদিত বোদলেয়ার রচনাবলীর প্রথম খণ্ডে মুদ্রিত পাঠ অবলম্বন করিয়া অনূদিত হইয়াছে।
১৫ এপ্রিল ২০২২
দোহাই
Charles Baudelaire, Oeuvres complètes, I, texte établi, présenté et annoté par Claude Pichois (Paris: Éditions Gallimard, 1975), pp. 304-315.
১৯
গরিবের খেলনা
নির্দোষ বিনোদন কি জিনিশ সে বিষয়ে আমি আপনাদের একটা ধারণা দিতে চাই। এই দুনিয়ায় দুষিত নয় এমন আমোদের জিনিশ বড় অল্পই পাওয়া যায়।
সকালবেলা যখন সত্যই মনস্থির করিয়াছেন বাহির হইয়া বড় রাস্তা কয়টা একটু ঘুরিয়া আসিবেন পকেট দুইটা এক পয়সা দামের ছোট ছোট কতক খেলনা—যথা একসুতার চ্যাপ্টা পুতুল, নেহাই পেটানো কামার, ঘোড়সওয়ারসহ লেজে বাঁশি লাগানো ঘোড়া—দিয়া ঠাসিয়া লইবেন আর হোটেল-মোটেলের আশপাশে, গাছতলায় চেনেন না জানেন না এমন যত গরিব ছেলেপিলে সামনে পড়িবে হাতে তুলিয়া দিবেন। দেখিবেন, তাহাদের চক্ষু ছানাবড়া হইতে হইতে সীমানা ছাড়াইয়া যাইতেছে। প্রথম প্রথম তাহারা লইতেই সাহস করিবে না; নিজেদের সুখে সন্দেহ হইবে তাহাদের। তারপর আকুল প্রাণে দুই হাতে উপহারটা চাপিয়া ধরিবে আর—মানুষে বিশ্বাস হারাইয়া বিড়াল যেমন উপহারস্বরূপ পাওয়া খাদ্যের স্বাদটা অনেক দূরে গিয়াই মাত্র লইতে চাহে তেমন—একটা দৌড় দিয়া অনেক দূর চলিয়া যাইবে।
বড় রাস্তার উপর লোহার শিকঘেরা বিশাল একটা বাগানবাড়ির একেবারে শেষ মাথায় চোখে পড়িতেছিল সুন্দর বড় এক ভবন; ভবনটির শাদা দেওয়ালে সূর্যকিরণ পড়িয়া ঝকমক করিতেছিল; সেখানে ফুটফুটে আর আনকোরা একটি শিশু, তাহার গায়ে চাপানো গ্রাম্য আদিখ্যেতাপূর্ণ কেতাদুরস্ত যত জামাকাপড়।
বিলাস-ব্যসন, বেপরোয়া ভাবসাব আর নিত্য ধনদৌলত প্রদর্শনীর দৌলতে দারুণ সুদর্শন এই শিশুদের মধ্যবিত্ত কিংবা বিত্তহীন শিশুর তুলনায় ভিন্ন ধাতুতে গড়া বলিয়া বিশ্বাস হয়।
তাহার পাশে ঘাসের উপর পড়িয়াছিল স্বয়ং মালিকের মতোই আনকোরা, চকচকে, সোনারঙের রাংতামোড়া, গাঢ় লাল জামা গায়ে, পালক আর কাঁচের দানায় ঢাকা চমৎকার একটা খেলনা। শিশুটির মন কিন্তু আপনকার সাধের খেলনায় মজিয়া ছিল না, আর দেখুন না সে কোনদিকে তাকাইয়া রহিয়াছিল:
লোহার ঘেরের অন্য পারে, বড় রাস্তাটার উপর, কাঁটাগুল্মের ঝোপঝাড় আর বিছুটির মাঝখানটায় ছিল আরেকটি শিশু, অপরিচ্ছন্ন, রোগাটে, ঝুলমাখা, ঐ যে গরিব-মিসকিন তাহাদের কাহারও ঘরের; সমজদার যেমন গাড়িতে নতুন লেপা রঙের তলায় অনুপম চিত্রকর্ম দেখিতে পান, দারিদ্র্যের অসহনীয় ছাপটা সরাইয়া দিলে নিরপেক্ষ দৃষ্টিও তেমন তাহার নিহিত সৌন্দর্য আবিষ্কার করিবেন।
এই দুই দুনিয়ার—সর্বসাধারণের চলার পথের আর ব্যক্তি-মালিকানাধীন বাড়ির—প্রতীকপ্রতিম পার্থক্য ভেদ করিয়া গরিব শিশুটি ধনী শিশুকে নিজের খেলনা দেখাইতেছিল আর ধনীটিও নিবিষ্ট মনে দুর্লভ আর মহার্ঘ্য দ্রব্যের মতো তাহা দেখিতেছিল।
এক্ষণে পুচকে ছোড়াটি শিকের খাঁচার মধ্যে যে খেলনাটিকে গুঁতা দিতেছিল, নাড়াচাড়া করিতেছিল আর করিতেছিল ঝাঁকাঝাঁকি তাহা জীবন্ত এক ইঁদুর! শিশুটির মা-বাবা, সন্দেহ নাই, টাকা-পয়সার কারণে খোদ জীবন হইতেই এই খেলনাটা লইয়াছিলেন।
আর শিশু দুইটি ভাই ভাই ভাব জমাইয়া সমানে সমানে শাদা দাঁত কেলাইয়া হাসিতেছিল।
২০
পরীজাতির উপহার
পরীজাতির মহাসম্মেলন চলিতেছিল, উদ্দেশ্য নবজাতকদের—বিগত চব্বিশ ঘণ্টায় যাহারা ভূমিষ্ঠ হইয়াছে তাহাদের—মধ্যে উপহার সামগ্রী বণ্টন করা।
নিয়তির এই সকল প্রাচীন আর হুজুগপ্রিয়া ভগিনী, আনন্দ আর বেদনার এই সকল উজবুক জননী ছিলেন সাংঘাতিক বিচিত্রস্বভাবা: কাহারও কাহারও স্বভাব ভারিক্কি গোছের আর বিষাদাচ্ছন্ন, অন্যদের স্বভাব দিলখোলা আর খোঁচামারা গোছের; কেহ কেহ—যুবারা—চিরকালই যুবা; অন্যরা—বৃদ্ধারা—চিরকালই বৃদ্ধা।
পরীজাতিতে অটুট আস্থাশীল পিতারা সকলেই স্ব স্ব নবজাতক কোলে আসিয়াছিলেন। পুরস্কার বিতরণী সভায় মঞ্চের উপর বিচারকমণ্ডলীর আসনের পাশে পুরস্কার সামগ্রী যেভাবে সাজাইয়া রাখা হয় সেভাবে পুরস্কারাদি—প্রতিভা, সৌভাগ্য, দুর্জয় পরিস্থিতি মোকাবেলা প্রভৃতি—স্তূপ করিয়া রাখা হইয়াছিল। এই জায়গার বিশেষ কৃতকর্মের স্বীকৃতি নয় বরং একেবারেই বিপরীত জিনিশ, জীবন যাহারা শুরুই করে নাই তাহাদের আশীর্বাদস্বরূপ, যে আশীর্বাদে তাহাদের নিয়তি নির্ধারিত হইবে আর জানা যাইবে তাহাদের অসুখের আর সুখের উৎসস্থলটা কোথায়।
বেচারি পরীর দল শশব্যস্ত হইয়া উঠিলেন; কারণ উপহার প্রার্থীদের ভিড়টা বড়ই বাড়িয়া গিয়াছিল; তদুপরি মানবসন্তান আর দেবতাদের মধ্যখানে যে জগত সে জগতও আমাদের মতন কালের—আর তাহার অগুণতি সন্তান-সন্ততির—দিন, ঘণ্টা, পল, অনুপলের নির্মম বিধির কাছে মাথা নত করিয়াছে।
সত্য বলিতে, সর্বসাধারণের সহিত সাক্ষাত করিবার দিন মন্ত্রীরা, কিংবা কোন জাতীয় উৎসবোপলক্ষে বিনাসুদে বন্ধকী ছাড়াইবার দিন মোঁ-দো-পিয়েতের কর্মীসাধারণ যেমন রুদ্ধশ্বাস হইয়া পড়েন তাহাদেরও হইল সেই দশা। আমার ধারণা, বিচারাসনে আসকাল উপবিষ্ট বিচারকের দল যেমন নৈশভোজ, পরিবার-পরিজন আর আদরের চটিজোড়ার টানে অধীর হইয়া সময় কত দেখিবার জন্য ঘন ঘন ঘড়ির কাঁটায় চোখ রাখেন তাহারাও তেমন করিতেছিলেন। অতিপ্রাকৃত জগতের বিচারক্ষেত্রে যদি এক-আধটু তাড়াহুড়ার আর কপালদোষের ব্যাপার-স্যাপার থাকিয়া থাকে তো মানবিক বিচারক্ষেত্রেও মাঝেমধ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটিতে দেখিলে আমাদের হতবাক হওয়া উচিত নয়। হইলে আমরাও কার্যত হই অন্যায় বিচারক।
ফলে সেদিনও কিছু মারাত্মক ভুলচুক হইয়াছিল; খাপছাড়া চিন্তা নয়, প্রজ্ঞাই পরীজাতির বিশেষ, চিরন্তন চরিত্র-বৈশিষ্ট্য—একথা যদি সত্য হইয়া থাকে তো এই সব ভুলচুক খানিক বেমানান বলিয়াই আমরা ধরিয়া লইতে পারি।
এভাবে ধনদৌলত নিজের গদীতে টানিয়া লইবার চুম্বকসদৃশ ক্ষমতাটা দেওয়া হইয়াছিল এক ধনী ঘরের একমাত্র উত্তরাধিকারীকে যে কিনা দানদক্ষিণা জিনিশটা কি আদৌ জানিত না; তাহা ছাড়া জীবনের যে ধন দশের সামনে জাঁকের সহিত রাখা থাকে তাহা অর্জনের আকুলতাও তাহার মধ্যে দেখা যায় নাই; ফলে অনেক পরে কোটি কোটি টাকার মালিক হইয়া তাহাকে ভয়ানক বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়াইতে হইয়াছিল।
এভাবে সুন্দরে আসক্তি আর কাব্যরচনার শক্তি দেওয়া হইয়াছিল এক বেরসিক বুড়া বদমায়েশের, পেশায় খনিশ্রমিকের, ছেলেকে যে না পারিয়াছিল পৈতৃক বৃত্তির কোন কাজে লাগিতে, না পারিয়াছিল আপনকার শোচনীয় সন্তান-সন্ততির দুঃখমোচন করিতে।
বলিতে ভুলিয়াছিলাম, এই পবিত্র কয়েকদিনের বিতরণ প্রক্রিয়ায় বণ্টিত উপহারাদি পুনর্বিবেচনার কোন বিধান ছিল না, আর খোলা ছিল না প্রাপ্ত উপহার সামগ্রী ফেরত দেওয়ার পথও।
পরীমণিরা সকলেই উঠিলেন, ভাবিলেন এই একঘেয়েমির শেষ হইয়াছে; কারণ অধিক কোন উপহার সামগ্রী, মনুষ্যের জটলার সামনে তুলিয়া ধরিবার মতন তবারকের টুকরা-টাকরাও আর পড়িয়া ছিল না; ঠিক ঐ মুহূর্তে সাহসী একটি লোক—মনে হইল লোকটা ছোটখাটো ব্যবসায়ী হইবেন—উঠিয়া দাঁড়াইলেন আর হাতের নাগালে যাহাকে পাইলেন নানারঙের বাষ্পে বোনা কামিজ পরিহিতা সেই পরীমণিকে ধরিয়া বড় গলায় বলিলেন:
“আহা! আপামণি! আপনারা আমাদের কথাটা ভুলিয়াই গেলেন! আমার ছোট্টটি তো কিছুই পাইল না! কিছুই না পাইয়া ফিরিয়া যাইব বলিয়া তো আমি এতদূর ছুটিয়া আসি নাই!”
পরীমণি নিশ্চয়ই খুব একটা অসহায় অবস্থায় পড়িয়া থাকিবেন, কারণ সেখানে আর কিছুই ছিল না। ঠিক তখন তখনই তাহার মনে পড়িয়াছিল এক বিধির কথা—যাহা অতিপ্রাকৃত জগতের বাসিন্দা, মানবজাতির বন্ধু আর তাহাদের আবেগ-অনুভূতির সহিত খাপ খাওয়াইয়া চলা দেবদেবী, আকাশের পরী, মাটির যক্ষ, আগুনের পরী, বায়ুর পরী (পুরুষ), বায়ুর পরী (নারী), পানির পরী (পুরুষ), আর পানির পরী (নারী) সকলেই জানিতেন কিন্তু ক্বচিৎ-কদাচিত কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ হইত—সেই বিধি অনুসারে এইবার যেমনটা হইল তেমন কখনও যদি উপহার সামগ্রীতে টান পড়িত সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরীমণির হাতে একটা ক্ষমতা ন্যস্ত হইত যে ক্ষমতাবলে তিনি—অতিরিক্ত আর ব্যতিক্রমী—একটি উপহার সৃষ্টি করিতে পারিতেন, এই শর্তে যে উপহারটা সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভাবন করিবার মতন বুদ্ধি তাহার ঘটে থাকা চাই।
সদাশয় পরীমণি আপন মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতি রাখিয়া আত্মসমাহিত অবস্থায় উত্তর দিলেন: “আপনার পুত্রকে দিলাম... তাহাকে দিলাম... খুশি করিবার ক্ষমতা!”
“কিন্তু খুশি করিবে কিভাবে? খুশি করা...? খুশি করিবে কেন?”—ক্ষুদে দোকানদারটি জেদ দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় ইনি সেই অতিসাধারণ চিন্তাবিদদের অন্যতম যিনি অসাধ্যসাধনের যুক্তিটা বুঝিতে মন যে উচ্চতায় উঠাইতে হয় সে উচ্চতায় উঠাইতে অক্ষম।
“কারণ! কারণ!” বিরক্ত পরীমণি পিঠ দেখাইয়া উত্তর দিলেন আর আপন জাতির শোভাযাত্রায় পুনশ্চ সামিল হইয়া সঙ্গীদের বলিলেন: “এই অহংপুষ্ট ক্ষুদে যে ফরাশি-সন্তানটি সকলই বুঝিয়া লইতে চাহেন, আর আপন পুত্রের ভাগ্যে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ পুরস্কারটি জুটিবার পরও যাহা সকল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে তাহাকে প্রশ্নবিদ্ধ করিতে চাহেন আর যাহা সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে তাহাকেও বিতর্কিত করিতে চাহেন, তাহাকে আপনারা কি বলিবেন?”
২১
প্রলোভন
অথবা রতি, ধনসম্পত্তি, ও খ্যাতি
যে রহস্যঘেরা সিঁড়ি ব্যবহার করিয়া নরক ঘুমন্ত মানুষের অসহায়ত্বের উপর হামলা চালায় আর তাহার সহিত গোপন সম্পর্ক স্থাপন করে গতরাতে দুই দুইটি চমৎকার শয়তান আর—কোনক্রমেই কম যায় না এমন—এক নারী শয়তান সেই সিঁড়িতে আরোহন করিয়াছিল। তাহারা আমার সামনে আসিয়া, সগৌরবে, মঞ্চের উপরে দাঁড়াইবার ভঙ্গিতে সটান দাঁড়াইয়াছিল। এই তিন ব্যক্তির গা হইতে গন্ধকতুল্য একটা ঝলক বাহির হইতেছিল বলিয়া রাত্রির ঘন অন্ধকারের পটভূমিতে তাহাদিগকে আলাদা দেখা যাইতেছিল। চালচলন তাহাদের এমনই গর্বদৃপ্ত আর কর্তৃত্বে ভরপুর দেখাইতেছিল যে প্রথম প্রথম তিনজনকেই আমি সত্যকারের দেবতা ভাবিয়াছিলাম।
প্রথম শয়তানটার চেহারা দেখিয়া বোঝার উপায় ছিল না সে নারী না পুরুষ। আর তাহার শরীরের বহিঃসীমা বিচারে সে ছিল পুরাকালের দেবতা বাখোসের মতো গোলগাল। তাহার কালো আর অমীমাংসেয় রঙের মনোরম আলস্যভারাতুর চোখগুলি ছিল ঝড়ের পর ভারি বৃষ্টির ফোঁটায় বেগুনি ফুলের মতন ভরা এবং তাহার আধফোটা উষ্ণ আতরদানের ন্যায় ঠোঁট হইতে সুন্দর আম্বরখানার গন্ধ বাহির হইতেছিল; আর যতবার সে নিঃশ্বাস ছাড়িতেছিল ততবারই কস্তুরীগন্ধা পোকামাকড় জ্বলিয়া উঠিতেছিল, আর উড়িয়া বেড়াইতেছিল নিঃশ্বাসের উত্তাপে।
তাহার গোলাপরঙা তহবন্দের চারিপাশে দরমেয়ানের মতো জড়ানো একটি সাপ মাথা তুলিয়া অগ্নিগর্ভ চোখে তাহার দিকে অলসভাবে তাকাইয়া ছিল। এই জীবন্ত দরমেয়ান হইতে পালাক্রমে ঝুলিতেছিল কালো তরলভর্তি কিছু শিশি, কয়েক প্রস্ত চকচকে ছুরি আর কিছু শল্যচিকিৎসার সরঞ্জাম। তাহার ডানহাতে ধরা অন্য একটা শিশির গায়ে—ভিতরে টকটকে লাল একটা পদার্থ—পরিচয়স্বরূপ উৎকীর্ণ ছিল এই অদ্ভ‚ত কয়টি শব্দ: “পান করুন, এ আমার রক্ত, প্রীতির অব্যর্থ নিদর্শন”। বামপাশে একটি বীণা যাহা নিঃসন্দেহে তাহার একান্ত আনন্দের আর একান্ত বেদনার গান গাওয়ার কাজে লাগিত আর লাগিত সপ্তাহের শেষরাতে আপন উন্মার্গগামিতার সংক্রমণ আরো ছড়াইয়া দেওয়ার কাজে।
তাহার মোলায়েম হাঁটু হইতে সোনার শেকলের কয়েকটা ভাঙাচোরা আংটা ঝুলিতেছিল, আর ফলস্বরূপ সৃষ্ট কষ্টের কারণে যখন সে চোখ নামাইয়া মাটির দিকে তাকাইতে বাধ্য হইল তখন তাহার জ্বলজ্বলে—আর বহুদিনের শ্রমে মাজিয়া-ঘষিয়া পালিশ করা মসৃণ—পায়ের নখের দিকে তাকাইয়া অভিমানভরা ভাবনায় সে মগ্ন হইয়াছিল।
তাহার চোখ হইতে একটা কপট মাতলামির ভাব বিকীর্ণ হইতেছিল আর সেই চোখে সান্ত্বনাতীত সকাতর দৃষ্টিতে সে আমার দিকে তাকাইতেছিল; অধিক কি, গুনগুন গলায় সে আমাকে বলিতেছিল: “যদি তুমি চাও, যদি তুমি চাও, তোমাকে আমি তাবত আত্মার অধীশ্বর বানাইয়া দিব, আর তুমি হইবে যাবত জীবজগতের অধিপতি যেমন অধিপতি কোন ভাস্করও হয় না তাহার হাতের মাটির; আর যতক্ষণ না তোমার আত্মাটা আর আর আত্মার মধ্যে হারাইয়া না ফেলিতেছ ততক্ষণ তুমি নিজের আত্মা হইতে বাহির হইয়া অন্যান্য আত্মার সহিত সংযুক্ত হইয়া নব নব যে জন্মানন্দ লাভ করা যায় তাহার স্বাদ পাইবে।”
আর উত্তরে আমি তাহাকে বলিয়াছিলাম: “হাজার শুকরিয়া। এতসব ফালতু জীব যাহাদের মূল্য নিশ্চয়ই আমার মতন অধমের অধিক নয় তাহাদের লইয়া আমার কিছুই করিবার নাই। কোন কোন ক্ষেত্রে স্মৃতিশক্তিটা একটু দুর্বল বলিয়া লজ্জাবোধ করি বটে, তবে কোন কিছুই আমি ভুলিতে রাজি নই; আর তোমার সঙ্গে আমার যদি পরিচয় নাও থাকিত, বুড়া দানব, তোমার এই রহস্যঘেরা ছুরিকাঁচি, তোমার শাঁখের করাত এইসব শিশি, তোমার পায়ের এই শিকল—এই সমস্ত প্রতীক দেখিলেই তো পরিষ্কার ধরা পড়ে তোমার সঙ্গে খাতির রাখার দায়টা কত। রাখিয়া দাও তোমার উপহার সামগ্রী।”
দ্বিতীয় শয়তানটার না ছিল সেই যুগপদ বিয়োগান্ত আর হাসি হাসি ভাব, না ছিল সেই শোভন খোশামুদে ব্যবহার, না ছিল সেই মোলায়েম আর সুবাসমাখা সৌন্দর্য। সে এক বিশালবপু লোক, চক্ষুবিহীন কদর্য তাহার অবয়ব, ভারি ভুঁড়িটা নিতম্বের নীচে নামিয়া, আর তাহার সারা দেহে সোনারঙে রাঙানো চামড়া জুড়িয়া উল্কির মতো আঁকা দুনিয়াজোড়া দারিদ্রের অগণিত নিদর্শনের প্রতিনিধিত্বশীল ক্ষুদে ক্ষুদে সঞ্চরণরত অনেক পুতুলের ভিড়। সেখানে ছোট্ট ছোট্ট হাড্ডিসার অনেক মানুষ একটা পেরেক হইতে স্বেচ্ছায় ঝুলিতেছে; সেখানে ভিক্ষাকাতর চক্ষু কাঁপনরত হাতের তুলনায় ভিক্ষার কাজে ঢের কার্যকর এমন ছোট্ট ছোট্ট অনেক বিকলাঙ্গ, লিকলিকে যক্ষ আর পিছু পিছু বিশীর্ণ স্তন ধরিয়া ঝুলিয়া থাকা সন্তানকোলে বয়স্কা মায়েরা। ইহার বাহিরে আরো অনেকে।
মোটা শয়তানটা আপনার বিশাল ভুঁড়ির উপর আঙুলের চাট মারিতেছিল, যাহা হইতে বাহির হইতেছিল একটা দীর্ঘায়ত, ঝনঝন, ধাতব আওয়াজ, যাহার শেষ অনেক মনুষ্যকণ্ঠের সমবেত ধ্বনিপুষ্ট ভোঁতা একটা গোঙানিতে; আর সে ভাঙা ভাঙা দাঁত বেয়াদবের মতন কেলাইয়া—দুনিয়ার সবদেশেই কিছু কিছু লোক অতিভোজন করার পর যেমন হাসে তেমন— একটা বিশাল নাদানের হাসি হাসিল।
অতঃপর সে আমাকে বলে কি: “আমি তোমাকে এমন জিনিশ দিব যাহা দিয়া যে কোন কিছু হাত করা যায়, যাহার মূল্য যে কোন কিছুর সমান, যাহা অন্য যে কোন জিনিশের স্থান দখল করিতে পারে!” বলিয়াই নিজের দানবীয় উদরের উপর একটা চাট মারিল যাহার প্রতিধ্বনি তাহার অশোভন কথাবার্তার যোগ্য সমালোচনাই ধ্বনিত করিল।
আমি বিরাগের সহিত মুখ ঘুরাইলাম আর বলিলাম: “আমার আপন আনন্দের স্বার্থে অন্য কাহারও দুর্গতিসাধন করিয়া কাজ নাই; আর একটা দেওয়ালরঞ্জিকা কাগজের মতন তোমার চামড়ার উপর আঁকা নিখিল দুঃখের বিনিময়ে অর্জিত এ জাতীয় শোকাবহ ধনসম্পদ মোটেও কাম্য নয় আমার”।
নারী শয়তানের কথা বলিতে যদি না বলি প্রথম দর্শনেই তাহাকে আমার আশ্চর্য চিত্তাকর্ষক মনে হইয়াছিল তো মিছা বলা হইবে। এই চিত্তাকর্ষণ জিনিশটা কি বস্তু স্থির করিতে গিয়া যে সুন্দরী নারীরা ভরাযৌবন অতিক্রম করিয়াও বয়সে আর বাড়িতেছেন না আর আপনাপন সৌন্দর্যের ধ্বংসস্তূপতুল্য রসায়নটি আজও ধরিয়া রাখিয়াছেন তাহাদের বাহিরে আর কিছুর তুলনা দিবার কথা ভাবিতে পারি নাই। তাহাকে সঙ্গে সঙ্গে মনে হইল প্রতাপশালী এবং উজবুক; আর চোখ দুইটি, ঝিমাইতেছে যদিও, আজও সম্মোহনশক্তি হারায় নাই। সবকিছুর ঊর্ধ্বে যাহা আমার মনে দাগ কাটিয়াছিল তাহা কণ্ঠস্বরের সেই যাদু যাহা নিয়মিত মদ্যপানের কারণে গলায় সঞ্চারিত খসখসে ভাবটার সহিত খাদে নামিয়া যাওয়া সুন্দর অতি নীচু পঞ্চম স্বরের কথা মনে করাইয়া দেয়।
খাপছাড়া মনভোলানো গলায় এই নকল দেবী আমাকে বলিল: “তুমি কি জানিতে চাও আমার ক্ষমতা কতখানি?” “তবে শোন”।
এই বলিয়া সে দুনিয়ার তাবত সংবাদপত্রের শিরোনাম মুদ্রিত ফিতায় মোড়া সুবিশাল একটা শিঙায় ঠোঁট দুইটা ঠেকাইল আর শিঙাযোগে আমার নামটা ফুকারিল যাহা কয়েক লক্ষ বিস্ফোরণের ন্যায় সশব্দে মহাশূন্য পার হইয়া অন্য কোন সুদূর গ্রহফেরত প্রতিধ্বনির মতন কানে বিদ্ধ হইল আমার।
“শয়তান!” আধা-হতভম্ব দশায় আমি বলিয়া ফেলিলাম, “কি সাংঘাতিক চিজ!” তবে এই মনভোলানো খান্ডারণীকে রীতিমতো পরখ করিয়া দেখিবার পর মনে হইল উহাকে আগে কোথায়ও যেন পূর্ব-পরিচিত কয়েকটি বদমায়েশের সঙ্গে মদ্যপান করিতে দেখিয়াছিলাম; আর কাঁসার ফাটা আওয়াজটা কানে পশিতেই আমার মনে পড়িল একটা দেহপসারিণী-বৈ-নয় শিঙার আবছা আবছা স্মৃতি।
প্রাণের গভীর হইতে ঘৃণা জানাইয়া বলিলাম, “দূর হ এখান হইতে! যাহাদের নাম পর্যন্ত মুখে আনিতে আমার ইচ্ছা হয় না তাহাদের প্রেমিকা ভাগাইয়া বিবাহ করিবার কোন খায়েশ নাই আমার।”
সৎসাহসের সহিত এহেন প্রত্যাখ্যান করিতে পারিয়াছি বলিয়া গৌরববোধ করিবার একটা অধিকার আমার অর্জিত হইয়াছিল সন্দেহ নাই। কিন্তু দুঃখের কথা, আমি জাগিয়া গিয়াছিলাম আর সকল তাকত আমাকে ছাড়িয়া গিয়াছিল। মনে মনে বলিলাম, “আমি নিশ্চিত গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিলাম, না হইলে এমন নীতিনিষ্ঠার পরিচয় দিলাম কি করিয়া! আহা, এক্ষণে তো জাগিয়া আছি, এখন তাহারা ফিরিয়া আসে তো অত অশিষ্ট আচরণ করিতাম না!”
তখন আমি উঁচুগলায় ডাকিলাম তাহাদের, মাথা নত করিয়া ক্ষমাপ্রার্থনা করিলাম, প্রতিশ্রুতি দিলাম তাহাদের অনুগ্রহ পাইতে যতবার আত্মাবমাননা করিতে হয় ততবারই করিব; মনে হইল, নিশ্চয়ই তাহাদের মনে খুব গভীরেই আঘাত দিয়াছি, কেননা তাহারা কোনদিন ফিরিয়া আসে নাই।
২২
সন্ধ্যার গোধূলি
বেলা পড়িয়া আসে। সারাদিনের কর্মক্লান্ত দরিদ্র প্রাণে নামিয়া আসে মহাশান্তি; এখন তাহাদের ভাবনাচিন্তা গোধুলির কোমল আর অমীমাংসিত আলোর রঙ ধারণ করে।
এই ফাঁকে সন্ধ্যার স্বচ্ছ আকাশ ভেদ করিয়া পাহাড়চূড়া হইতে নামিয়া আসা বিচিত্র চিৎকার-চেঁচামেচির এক মহাকোলাহল আমার ঝুলবারান্দায় পৌঁছে, স্থানমাহাত্ম্যে তাহা ভরা জোয়ারের কিংবা ঘুমভাঙা ঝড়ের আওয়াজের মতো একটা কাঁদো কাঁদো সুরের লহরীতে রূপান্তরিত হয়।
সন্ধ্যা যাহাদের শান্তি যোগায় না তাহারা কি যে দুর্ভাগা; আর যাহারা রাত্রির আগমনকে, পেঁচার ন্যায়, হৈ-হুল্লোড়ের সংকেত ধরিয়া লয় তাহারাও! ভয়ানক এই চেঁচামেচিটা এদিকে আসিতেছে পাহাড়চ‚ড়ায় স্থাপিত ঐ দরিদ্র নিবাস হইতে; আর এদিকে ফি ঘরের জানালা ঘোষণা করিতেছে: “এখন এখানে শান্তি; এখন এখানে সংসারসুখ”! আর আমি ঊর্ধ্বলোকে হাওয়া দম ছাড়িলে, ধোঁয়ায় টান দিয়া, এই বিশাল পাদদেশে অবকাশ চিন্তায় মগ্ন হই আর এই নারকীয় লহরীর সুরে সুর মিলাইয়া আমার ভাবনাচিন্তা একপাশে সরাইয়া রাখি।
গোধূলি উন্মাদের উন্মাদনায় ইন্ধন যোগ করে।—মনে পড়ে আমার দুই বন্ধুর কথা, গোধূলি যাহাদের পুরাদস্তুর অসুস্থ করিয়া তুলিত। একজন বন্ধুবান্ধুবের সম্পর্ক আর সাধারণ ভদ্রতার সম্পর্কও নষ্ট করিত এবং প্রথমে যে সামনে পড়িত তাহার সহিত—অসভ্যের মতন—দুর্ব্যবহার করিত। একবার দেখিয়াছিলাম, সে এক হোটেলে বড় খানসামার গায়ে একটা আস্ত মুরগি ছুঁড়িয়া মারিয়াছিল, জানি না ওটার গায়ে গোপন ভাষায় কোন অপমানের কথা লেখা বলিয়া সে বিশ্বাস করিয়াছিল। গভীর ইন্দ্রিয়সুখের বার্তাবহ সন্ধ্যা দুনিয়ায় যত সেরা মজা তাহার কাছে তাহাদেরও নষ্ট করিয়া দিত।
অন্যজন, এক অতৃপ্ত উচ্চাভিলাষী, বেলা পড়িয়া আসিবার সাথে মিলাইয়া বেশি বেশি তিক্তপ্রাণ, বেশি বেশি বিষাদাচ্ছন্ন, বেশি বেশি বদমেজাজী হইয়া উঠিত। যতক্ষণ দিন ততক্ষণ সহনশীল আর মিশুক থাকিলেও যখনই সন্ধ্যা নামিত হইয়া উঠিত ক্ষমাহীন; অধিক কি, শুদ্ধমাত্র অন্যের ঘাড়ে নয়, মায় নিজের উপরও সে হিংস্র কায়দায় আপনকার গোধূলি উন্মাদনার চোটপাট চালাইত।
প্রথমজন উন্মাদ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, আপনার স্ত্রী আর শিশু-সন্তানকেও চিনিতে অক্ষম হইয়া গিয়াছিল সে। দ্বিতীয়জন একটা চিরস্থায়ী অসুস্থতার অস্বস্তি বহিবার বন্দোবস্ত কায়েম করিয়াছে; এদিকে প্রজাতন্ত্র আর রাজা-রাজড়া যত পদক-পদবী দিতে পারেন সব ঢালিয়া দিলেও, আমার বিশ্বাস, গোধূলি তাহার মনে কল্পলোকের সমস্ত পুরস্কার লাভের জাজ্বল্যমান বাসনা জ্বালাইয়া দিবে। যে রাত্রি লোকের মনের উপর কালো আবরণ টানিয়া দেয়, আমার মনে তাহা জ্বালায় আলোকশিখা; আর এক যাত্রায় দুই বিপরীত ফল যদিও মোটেই দুর্লভ নয়, আমি বরাবরই এক ধরনের অস্বস্তি আর আশংকায় ভুগিতে থাকি।
হে রাত্রি! হে শান্তিদায়িনী ছায়া! আপনি আমার অন্তরের অন্তস্তলে উৎসবের বার্তা, আপনি আমার উদ্বেগমুক্তি! প্রান্তরের নির্জনভূমিতে, রাজধানীর শানবাঁধা পাথুরে গলিতে গ্রহনক্ষত্রের ঝিকিমিকি, লণ্ঠনের বিস্ফোরণ, আপনি আমার স্বাধীনতাদেবীর আতশবাজি!
গোধূলি, কি মিষ্টি আর মোলায়েম আপনি! রাত্রির বিজয়ীসুলভ নিবর্তনে পিষ্ট দিবাভাগের যাতনাতুল্য দিগন্তের শেষ গোলাপি কিরণমালার ছটা, অস্তায়মান গৌরবের মাথায় ঝাড়বাতির আলোতে পড়া আবছা আবছা লাল দাগ, অদৃশ্য হাতে নামাইয়া দেওয়া প্রাচ্যের গহন হইতে লইয়া আসা ভারি কাপড়ের পর্দা, জীবন-সায়াহ্নের পবিত্র ক্ষণে মানব-হৃদয়ে জটিল বেদনাবোধের যে সংগ্রাম চলে তাহার অনুকরণ করে।
আরো একটু বলা যাইতে পারে, নৃত্যশিল্পীরা যে ধরনের অদ্ভ‚ত সব পোশাক পরিয়া থাকেন তাহাদের কোনটায় মর্মভেদী আর গম্ভীর চোখ—দুঃখী বর্তমানের ফাঁকফোকর দিয়া সুখী অতীতের আভাস দেখার মতো—চাকচিক্যময় ঘাগরার তলায় তলায় পরলোকগত জাঁকজমকের রূপরেখা দেখিতে পায়; আর সর্বাঙ্গে ছড়ানো-ছিটানো কল্পলোকজাত সোনা-রূপার তারকারাজি কল্পলৌকিক অগ্নিশিখার প্রতিনিধি সাজে, যে কল্পনা রাত্রির সুগভীর বেদনার কথা ভুলিয়া গেলে কখনোই জ্বলিয়া ওঠে না।
২৩
নির্জনতা
জনৈক মানবদরদী সাংবাদিক আমাকে বলেন, নির্জনতা মনুষ্যের পক্ষে ক্ষতিকর আর আপন প্রস্তাবের সপক্ষে দুনিয়ার তাবত অবিশ্বাসীর মতো তিনিও গির্জার পিতাদের উদ্ধৃতি পেশ করিলেন।
দৈত্য-দানব যে হামেশা উষর জায়গা-জমিনে স্বেচ্ছায় ঘোরাফেরা করে আমি তাহা জানি, আরও জানি খুনখারাবি আর লুচ্চামির প্রতিভা নির্জনতার আড়ালে ভালো জ্বলিয়া ওঠে। তবে ইহাও সম্ভব যে যাহারা নিজ নিজ অযৌক্তিক আবেগ আর নিজ নিজ দৈত্য-দানবে ভরাইয়া ফেলেন সেই অলস আর অস্থিরমতি লোকদের কথা ছাড়িয়া দিলে নির্জনতা অন্য কাহারও বিপদের কারণ হয় না।
একথা একপ্রকার নিশ্চিত যে রবিনসনের দ্বীপে বদ্ধ উন্মাদ হইয়া পড়িবার বিষম ঝুঁকি আছে মাত্র সেই বাচালের যাহার চরম পুলক কোন আসনে আসীন হইয়া কিংবা আদালতে দাঁড়াইয়া উঁচু গলায় বক্তৃতা ঝাড়ার মধ্যে। আমার সাংবাদিকটিকে বলিব না ক্রুসোর মতো সাহসী গুণাবলীর অধিকারী হইতে হইবে; তবে আমি চাহিব যাহারা নির্জনতার আর ধ্যানমগ্নতার প্রেমে পড়িয়াছেন অভিযোগের আঙুল তুলিয়া তাহাদের যেন হেয় না করা হয়।
আমাদের জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে এমন কিছু বাগ্মী আছেন যাহাদিগকে—সঁতেরের ঢোল পিটাইয়া বক্তৃতাটা অসময়ে বন্ধ করা হইবে না এমন নিশ্চয়তাসহ—ফাঁসির মঞ্চের বেদিতে দাঁড়াইয়া বাগাড়ম্বরপূর্ণ একটা বক্তৃতা ঝাড়িবার সুযোগ দেওয়া হয় তো সর্বোচ্চ দণ্ড দিলেও প্রায় বিনা ওজরে কবুল করিবেন।
আমি তাহাদের করুণা করি না, কেননা আন্দাজ করি অন্যরা নৈঃশব্দ্যে আর ধ্যানমগ্ন অবস্থায় যে ধরনের শিহরণ অনুভব করে তাহারাও তাহাদের বাগ্মিতার স্ফূরণ হইতে সমান শিহরণ আহরণ করেন; তবে আমি তাহাদের নিকুচি করি।
সবকিছুর উপরে আমি কামনা করি আমার অভিশপ্ত সাংবাদিকটি আমাকে আমার মতো করিয়া আনন্দযাপনের সুযোগ দিবেন। অনেকটা অতি-পয়গম্বরী চালে নাসিক্যধ্বনি যোগ করিয়া তিনি আমাকে বলিলেন, “আপনি তাহা হইলে কদাচ আপনার আনন্দে অন্যদের ভাগ দিবার প্রয়োজন বোধ করেন না?” এই অতিচালাক ঈর্ষাপরায়ণটা দেখিয়া রাখুন! তিনি জানেন আমি তাহারটা ঘৃণা করি, আর তিনি আসিয়াছেন আমারটায় হাত দিতে, বাড়াভাতে ছাই দেওয়া নচ্ছার কোথাকার!
“একা হইতে না পারার পরম দুর্ভাগ্য!...” এই কথাটা কোথায়ও না কোথায়ও বা বলিয়া থাকিবেন লা ব্রুয়িয়ের, যে সব লোক নিজেকে ভুলিয়া থাকিবার মতলবে, নিঃসন্দেহে নিজেকে নিজে সহ্য করিতে না পারার ভয়ে, একদৌড়ে জনতার ভিড়ে গিয়া মিশেন তাহাদের লজ্জা দিবার উদ্দেশ্যে।
“আমাদের প্রায় সকল দুঃখের আবির্ভাব নিজ নিজ ঘরে কিভাবে যে থাকিতে হয় তাহা না জানিবার কারণে,” কথাটা বলিয়াছিলেন আরেক মহাত্মা, পাসকাল, যে উন্মাদের দল এদিক-ওদিক ছোটাছুটির মধ্যে কিংবা—ইচ্ছা হইলে যাহার নাম আমার শতাব্দীর সুন্দর ভাষায় রাখিতে পারিতাম ‘ভ্রাতৃত্ব ব্যবসায়’ সেই—পতিতাবৃত্তির মধ্যে সুখের সন্ধান করিয়া বেড়ান তাহাদিগকে আপনকার ধ্যানমগ্ন হইবার মতো ছোট্ট ছোট্ট ঘরে ফিরাইবার উদ্দেশ্যে।
২৪
প্রকল্প
বিশাল এক জাতীয় উদ্যানে একাকী হাঁটিতে হাঁটিতে সে মনে মনে বলিল, “সূক্ষ্ম কারুকার্যখচিত একপ্রস্ত দরবারী কামিজ পরিয়া সামনে বড় বড় ঘাসের উঠান আর পুকুর-দীঘিসহ কোন প্রাসাদের মার্বেল পাথর বিছানো সিঁড়ি ভাঙ্গিয়া—বৈকালিক হাওয়ার বিপরীত দিক হইতে—নামিতে তাহাকে কি সুন্দরই না দেখাইবে। কেননা স্বভাবগুণে তাহার চালচলন রাজকুমারীর মতো।”
অনেকক্ষণ পরে একটা রাস্তা ধরিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে সে একটা ছাপচিত্রের দোকানের সামনে থামিল, আর, সেখানে এক বাক্সের মধ্যে বিষুবাঞ্চলীয় নিসর্গের ছাপমারা একটা ছবি দেখিয়া, সে মনে মনে বলে: “নাহ্! তাহার আদরের জীবনটা আমি কোন প্রাসাদে আটকাইয়া রাখিতে চাই না। ঐ জায়গাটা আমাদের আপন মনে হইবে না। তাহা ছাড়া সোনার জালে ছাইয়া রাখা দেওয়ালে তাহার ছবি টাঙাইবার মতন জায়গাও মিলিবে না; এই সব গুরুগম্ভীর দর্শকশালার কোথায়ও ঘনিষ্ঠ হইবার মতো একটা কোণও রাখা নাই। এই তো সেই স্থান যেখানে বাস করিলে আমার জীবনস্বপ্ন বাস্তবায়িত হইবে—একথা প্রশ্নাতীত।”
আর, ছাপচিত্রের খুঁটিনাটি দুই চোখে বিশ্লেষণ করিতে করিতে, সে মনে মনে বলিয়া চলিল: “সমুদ্রের ধারে, আমি নাম ভুলিয়া বসিয়াছি এমন সব আজব আর আলোকোজ্জ্বল গাছপালাঘেরা এক মনোরম কাঠের কুটির..., বাতাসে একটা মাতাল করা, অমীমাংসেয় সুগন্ধ..., কুটিরের মধ্যে গোলাপ আর মৃগনাভির কড়া আতর..., ঢের দূরে, আমাদের ক্ষুদে বাসস্থানটার পিছনে, মৃদু মৃদু ঢেউয়ে দোদুল্যমান মাস্তুলের মাথা..., আমাদের চারিপাশে, দুর্লভ জাতের আবলুস কাঠ দিয়া পর্তুগিস কায়দায় বানানো দোলনা কেদারাসহ জানালার আঁধারিতে পরিশ্রুত গোলাপি আভায় আলোকিত ঘরটা বিনুনি করা মাদুর আর মাতাল করা ফুলের সাজি-সজ্জিত (যেখানে সে শান্ত-সমাহিত মনে, পাখার বাতাস খাইতে খাইতে, হালকা আফিম দেওয়া তামাক টানিবে!), বারান্দা ছাড়াইয়া আলোর নেশায় মাতাল পাখিদের কিচিরমিচির আর ক্ষুদ্রকায় নিগ্রো নারীদের হৈচৈ..., এবং, রাতের বেলা, আমার স্বপ্নে সঙ্গত করার স্বার্থে সঙ্গীতবৃক্ষের, বিষণ্ণ ফিলাও গাছের করুণ গান! আজ্ঞে, সত্য বলিতে, এই সেই সজ্জা যাহার সন্ধানে আমি ঘুরিয়া বেড়াই। প্রাসাদ লইয়া কি করিব আমি?”
আর অনেক দূরে, একটা মস্ত সদর রাস্তা ধরিয়া চলিতে চলিতে, সে দেখিল ছিমছাম একটা সরাইখানা, যেখানে সস্তা ভারতীয় কাপড়ের পর্দা ঝোলানোর ফলে ভারি ঝলমলে হইয়া ওঠা জানালায় দুইটা হাস্যোজ্জ্বল মুখ বাহিরে আসিয়াছে। আর সঙ্গে সঙ্গে সে মনে মনে বলিল: “যাহা আমার এতটা কাছে তাহা খুঁজিতে এত দূরে দূরে ঘুরিয়া বুঝিলাম আমার চিন্তাভাবনা বড়ই ভবঘুরে হইয়া গিয়াছে। আনন্দ আর সুখ দেখি, জীবনানন্দে টইটম্বুর, প্রথম দর্শন করা সরাইখানায়, পড়িয়া পাওয়া সরাইখানায়। বড় একটা অগ্নিকুণ্ড, দৃষ্টিনন্দন বাসনকোসন, চলনসই নৈশভোজ, গ্রামীণ দ্রাক্ষারস, আর খানিক খসখসে অথচ ঝকঝকে চাদরমোড়া খুব বড় একটা বিছানা; আর কি চাই?”
আর একা একা বাড়ি ফিরিতে ফিরিতে, যে মুহূর্তে প্রজ্ঞার উপদেশ ছাপাইয়া পার্থিব স্বার্থের গুঞ্জনটা বড় হইয়া ওঠে, সে মনে মনে বলিল: “আজ আমি, কল্পনালোকে, তিনটা বাড়ি পাইয়াছিলাম, তিনটা বাড়িই আমাকে সমান আনন্দ দিয়াছে। আমার প্রাণ যেখানে এত স্বচ্ছন্দে সফর করিতে সক্ষম, সেখানে দেহকে স্থান পরিবর্তনে বাধ্য করিব কোন দুঃখে? আর আমার প্রকল্পগুলি বাস্তবে রূপান্তরিত করিবার কষ্টটা স্বীকার করিব কি কারণে যখন স্বয়ং প্রকল্প প্রণয়ন করিয়াই আমি পরিপূর্ণ আনন্দ লাভ করি?”
তর্জমা: সলিমুল্লাহ খান