• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
ষষ্ঠ কিস্তি

সে ও নিমবিরিক্ষি যে গুপ্তকথা জানে


আকিমুন রহমান
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৫, ২০২৪, ০৩:১৪ পিএম
সে ও নিমবিরিক্ষি যে গুপ্তকথা জানে

নারীটির চক্ষের চাহনিটা মনে আসে।

 

চলন্ত চতুর্চক্রযানের আসনটিতে আমি একেবারে গোড়া থেকে আসীন ছিলাম। আমার সবই তো ইচ্ছাধীন। ইচ্ছা করি তো দৃশ্যমান হই, ইচ্ছা হয় তো অদৃশ্য থাকি। তবে ইদানীং আমি অমন যা-ইচ্ছে-তাই করার অস্থির-দশায় থাকি না। ইচ্ছা করে না অমন অস্থির হতে আর। এখন আমি দীর্ঘ দীর্ঘ দিন ধরে শুধু একটি ইচ্ছা নিয়েই রয়ে যাই।

হয় আমি অদৃশ্য থেকে যাই আগাগোড়া; নয়তো থাকি দৃশ্যমান হয়ে, থাকি লোকদের একেবারে চক্ষের সামনে। থাকি একদম মনুষ্য-সকলেরই মতো দেহকাঠামো ধরে। তবে এই সন্ধ্যায়, এই যে এবার; আমার কী হয়- আমার কিনা নিজের সঙ্গে নিজেরই এলেবেলে খেলাখেলিতে থাকার সাধ হতে থাকে। চতুর্চক্রযানের আসনটিতে বসে, আমি একবার অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকি, একবার স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকি। একবার নিজেকে অন্য সকলের কাছে দৃশ্যমান করে রেখে, পাশের আসনের নারীটির কাছে নিজেকে আদ্যোপান্ত অদৃশ্য রেখে যেতে থাকি।

নারীটি যখন তার পাশের আসনটিকে ফাঁকা দেখতে পাচ্ছিল; বাসের অন্য সকলজন তখন দেখতে পাচ্ছিল যে ওটি ফাঁকা নয়। ওটিতে যাত্রী বসা। কেন সকলের সামনে নিজেকে প্রকাশ করে রেখে নারীটির কাছে নিজেকে অদৃশ্য রাখছিলাম? নাহ! বিশেষ কোনো কারণবশত নয় মোটেও। ওটা করছিলাম কৌতুকবশে, স্রেফ কৌতুকবশে।

মনে হচ্ছিল, এই তো এইজন, এই নগরীর এক অতি সামান্য নারী, খুব যে পরিশ্রান্ত আর আশাধুকন্ত আর নিতান্তই ক্লিষ্ট একজনা সে, সেটা তো তার দিকে তাকানো মাত্রই যেকোনো লোকই বুঝে উঠতে পারবে। অমন এক নারী আমার এই দৃশ্যমান হয়ে ওঠা ও অদৃশ্য থেকে-যাওয়াটার ধাক্কা পেয়ে কী করে! কেমন ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া দেখাবে এমন নারী- ঠিক এমনটা হলে! দেখা যাক তো!

 

চলাচলের জন্য অবশ্য চতুর্চক্রযানের আমার কী প্রয়োজন! চাইলেই আমি নিজেকে ছোটাতে পারি, যেকোনো গতিতে। যদি ধীরে চলতে চাই আমি, তাহলে বয়ে যেতেই পারি ঝোড়ো-বাতাসের গতিতে। সেভাবে যেতেই তো পারি। জোর ছুট দিতে চাই যদি, আলোর গতিতে যাওয়াটা কি কোনো ব্যাপার, আমার জন্য! বা ইচ্ছা হলে কদম কদম হাঁটলেই-বা সমস্যা কী আমার জন্য। কিছুই কি আদপে ক্লান্তিকর, আমার জন্য? তা তো নয়।

কিন্তু এই নগরে এসে পৌঁছানোর পর, আমি আমার চলাফেরা করার একান্ত নিজস্ব রীতি-প্রক্রিয়াগুলো একেবারে বন্ধ করে রেখেছি। চলাফেরা করা শুরু করেছি একেবারে সামান্য সাধারণ লোকসকলের রীতিতে। এইখানে অনেক অনেক ত্রিচক্রযান আছে, আমি লক্ষ করেছি। মনুষ্যচালিত ওই সব বাহনও আমি এখানে সহজে ব্যবহার করছি না। করছিই না। ওই ত্রিচক্রযান আমাকে খানিকটা আরাম দেবে হয়তো গতায়াতের ক্ষেত্রে, কিন্তু আমার আবার আরামের কোন দরকার? আমি কি এই অঞ্চলের দ্বিপদ মনুষ্যগোত্রের কেউ? না তো!

এইখানে আমাকে কোন জিনিসটা পেতে হবে? আমার এখানে কী পাওয়া দরকার?

এই লোকালয়ের মনুষ্যসকলের অন্তরটাকে পাঠ করে ওঠার পরিস্থিতিটা পেতে হবে। ওটা পড়ে ওঠার জন্য একটা অবাধ পরিস্থিতি আমাকে পেতে হবে। একদম সামান্য মনুষ্য যারা, তাদের অন্তকরণের আলো ও কালোকে জেনে উঠতে হবেই আমাকে। ওটাই বিষম দরকার আমার।

সেই জন্যই এই যে আমি, একটার পর আরেকটা ঝিক্কুর-টিক্কুর ঝিক্কুর টিক্কুর টক্কুর করে করে পথ-চলতে-থাকা চতুর্চক্রযানে উঠে যাচ্ছি যখন-তখন। আর চলছি। নগরী একমাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত যাচ্ছি-আসছি। লোকসকলের ভিড়ে ভিড়ে থাকছি। তাদের হৃৎদুনিয়ার হাবিজাবি পড়ছি, দেখছি, গন্ধ নিচ্ছি, সেই হাবিজাবির শব্দ শুনছি। শুনতে শুনতে পথ পেরিয়ে যাচ্ছি। এভাবেই চলছে এইখানে আমার কর্মসর্ম। তবে এত দিন কিন্তু আমি কেবল আসন নিয়েছি পুরুষলোকেরই পাশে।

নারীযাত্রীদের পাশেও যে যাওয়া দরকার, ওই গোত্রের চিৎবিবরণও যে আমার বুঝে ওঠা দরকার, সেটা একটুও হিসাবে আসেনি। একদমই না। নারীগণের দিকে আরও চেয়ে দেখব আমি? আরও? সাদোমের সেই রাতে, এই মর্ত্য-বিপন্নাগণকে রক্ষা করতে গিয়েই না আমি হয়ে উঠেছি অভিশম্পাতগ্রস্ত? এই যে আমি, এক দেবভৃত্য যদিও, তা-ও আমার নিজ ভূখণ্ডটা তো দেবলোক, তাই না? সেইখানে আমি কি কোনো দিন পা রাখতে পেরেছি আর? পারলাম? পারলাম না।

এত সহস্রকাল ধরে এই যে পরবাসে এই মর্ত্যভূমিতে, নির্বাসন দণ্ড ভোগ করে চলছি চলছি চলছি, তার জন্য আদতে কি মর্ত্যমানবীগণই দায়ী নয়? তারাই দায়ী। সেই প্রলয়ের রাতে, আমি যদি সাদোমের রুগ্না বিপন্না নারী কয়টাকে বাঁচাবার জন্য না ছুটতাম, তাহলে আমার প্রভু-দুজন তো ক্ষিপ্ত হতেন না। যদি আমি স্বপ্রণোদিত হয়ে ওই নারী কয়জনকে অগ্নিতাণ্ডব থেকে রক্ষা করতে না-যেতাম, তাহলে কি আমাকে এই জীবন পেতে হতো? হতো না। আমি এখন থাকতাম দেবলোকে, অন্য সকল দেবভৃত্যের সাথে। থাকতাম মসৃণ আলোয়। থাকতাম নব নব কর্তব্যকর্মে। আহ! এই মর্ত্য-মানুষীগণের জন্যই না আমার এই সর্বনাশ! তাহলে আর কোনো দিন কি আমি এই গোত্রের দিকে চোখ মেলে তাকাব নাকি? কোনো দিন তো তাকাব না। সাদোমের পরে আর কোনো যুগের কোনো মানবীর দিকে আমি আর তো একটা ঝিটিক-ঝিলিকি চাউনিও ছটকে দিইনি। কোনোকালেই না।

আহ! আর কতকাল আমাকে এই নির্বাসন-দণ্ড ভোগ করে যেতে হবে? কেনো আমি পাচ্ছি না, কোনো যুগেও কেন পাচ্ছি না সেই পাপ-গিটগিটে ক্লেদ-জিবজিবে লোকালয়টার খোঁজ! মর্ত্য-নারীর খোঁজে তো আমার কোনো প্রয়োজনের কোনো সিদ্ধি নেই।

তারপর কী হলো, এই প্রথম এটা কী হলো! এই নগরীতে আসার পরে এই্-ই প্রথম, আমি সহযাত্রী হিসেবে কিনা পেয়ে গেছি এক নারীকে। পেয়েছি কিনা অতি মলিন অমনোহর এই নারীকে। সে যখন এসে আমার পাশের আসনে আসীন হয়, আমার মনে হতে থাকে যে, এর দিকে আর মনোযোগ দেবার বিশেষ কোনো দরকার পড়বেই না আমার। অমন মলিন-ধাঁচের এন্তার পুরুষকেই তো পাঠ করা সারা আমার, একে আর আলাদা করে পাঠ করা লাগবেই না। এসে গেছে যখন একটা নারী পাশের আসনটাতে আসীন হতে, থাকুকগে সে। আমি বরং দণ্ডায়মান পুরুষগুলোর চিত্ত নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকি। এই মলিনা থাকুকগে তার মতো।

এবার আমি কিন্তু নিজের কাছে নিজে গভীর এক শপথে আবদ্ধ আছি। আমি সুগাঢ়রকমে শপথ করেছি যে, আগের আগের কালের অন্য অন্য জনপদগুলোর মতো, এই নগরটাকেও আমি, পলকের মধ্যে ধ্বংস করব না। কিছুতেই করব না।

অতীতে অতীতে; যত বিনাশ ও প্রলয় আমি নিমেষে ঘনিয়ে দিয়েছি একেকটা নগরীর জীবনে, তাতে কী ফল ফলেছে? তাতে শুধু প্রলয়ই সাধন করা গেছে। শুধু ভুল প্রলয় এনেছি আমি। ধ্বংস করেছি প্রাণ ও চরাচর। শুধু অহেতুক বিনাশ। আমার মুক্তি তো আসেনি! আমি তো দণ্ডমুক্ত হয়ে দেবলোকে প্রত্যাবর্তনের পথ পাইনি। বরং মর্ত্যলোকেই পড়ে থাকতে দেখেছি নিজেকে। ভূলোকে; দণ্ডিত একাকী যে জীবনে ছিলাম আমি গোড়া থেকে; সেই জীবন থেকে মুক্তি আসেনি তো আমার!

তাই এবার আমার তীব্র পণ এই যে, এই নগরীর প্রতি ধূলিকণায় আমি আমার পদচিহ্ন রাখব। লোকালয়ে লোকালয়ে পরিব্রাজন চালাব দীর্ঘ দীর্ঘ কাল। লোকসকলের পায়ে পায়ে থেকে থেকে, জেনে-বুঝে-দেখে নেব-কতটা পাপ ও কলুষ বসত করে তাদের অন্তরে বাইরে, গৃহে ও নগরে, ধর্মশালায় ও বাণিজ্য সদনে। তারপরেই ধ্বংস ঘনিয়ে আনব এইখানে। তার আগে নয়, কিছুতেই নয়।

কিছুতেই আর কোনো হঠকারী ও অন্ধ ও মূঢ় কর্মসাধন নয়। কিছুতেই আর অকারণ বিনাশের গ্লানিভার নেওয়া নয়। এইবার আমার সকল কর্মই, সবটাই, সুবিবেচনাপ্রসূত হওয়া চাই। সেটা করার জন্য যা যা করা জরুরি আমার জন্য; আমি সেসব করতে প্রস্তুত। আমি ক্রমে বুঝে উঠেছি, আমার অধৈর্য হওয়া চলবে না। সত্যকার পাপকলুষময় নগরটিকে এইবার পেতে হবেই আমাকে। তারপর বিনাশ। তারপর আমার মুক্তি আমার দেবজগৎ!

এখানে আমি ক্রমে বুঝে উঠেছি এখানকার লোক-সন্নিধানে যাওয়ার প্রকৃষ্ট পন্থাগুলোর একটা হচ্ছে এটা। এই যে লোকসাধারণের যানবাহনে আসীন হওয়াটা। এই বাহনে চেপে আমি সহজেই লোকবেষ্টিত অনামা-একজন হয়ে থাকতে পারব। আর, এভাবেই, অনায়াসেই লোকচিত্ত পাঠ করে চলা সম্ভব হবে।

 

সেই প্রতিজ্ঞামাফিকই আমি সদ্য শুরু করেছি এই চতুর্চক্রযান আসীন হওয়ার কর্মখানা। অবশ্য এই নগরীতে পৌঁছুনোর পরপরই এমন ক্রিয়াকর্ম আরম্ভের কোনো তাগাদা বোধ করেনি আমার শরীর। যেকোনো নগরীকে, প্রথমে পদব্রজে, শ্লথ মন্থর একটা পাঁক দেওয়াটাই আমার পছন্দ বরাবর। এই নগরীর বেলায়ও তা-ই করে নিয়েছি। তারপর নগরীর উত্তরের প্রবেশপথের ধূলিতে আসন গেড়ে বসেছি, থির।

 

আমি অতি থির না হলে, লোকসকলের ছুট, ঝাঁপ, ছোটাছুটি নিবিড় চক্ষে দেখে উঠব কোনপ্রকারে। উত্তর সীমানায় বসে থেকেছি আমি। বসে থেকেছি অন্তত মনুষ্য-হিসাবের এক যুগ সময়। বসে থেকে থেকে দেখে চলেছি লোকগণের কর্মতাড়া ও জীবনপদ্ধতি। দেখেছি, আর থেকে থেকে শিউরে উঠেছি! কী বিপুল পঙ্ক ও কদর্যতালোলুপ এই নগরীর মনুষ্যগণ! সর্বনাশগ্রস্ত হওয়ার জন্য, কদর্যতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ায়ে নেওয়ার জন্য কী উন্মত্তরকম ব্যগ্র তাদের রক্ত! আরে, মজা তো!

বাহ! আমার জন্য কী চমৎকার গুছিয়ে রাখছে নগরীকে, তার লোকসকল! প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। একই রকম করে করে। কত কত কলুষ, কত গুম খুন, কতো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকরণ, কত কত বিশ্বাসহনন, কত ক্লেদ, কত চতুরালি! তখন আমার বাহুদ্বয় বড় উতলা হয়ে যেতে থেকেছে। খুব বেচণ্ডা অস্থির। আরে, এই যে আমি এই লোকালয়ের উত্তর কিনারার ধুলোয় বসা; এইখানে বসে থেকেই তো প্রলয় ঘনিয়ে আনা যায়! আনি তবে! দেই তবে প্রলয়। আনি ধ্বংস ও বিনাশ। এনে ফেলি তাহলে! এমত কত তাড়া ও চাপ যে পেতে থাকে আমার চিত্ত ও অন্তকরণ!

কিন্তু তারপরেও আমার কী যে হয়! এই অযুত নিযুত বর্ষ পরে, এইবার কী যে হয়! আমার চিত্ত আর অটল, অকম্প্র থাকতে পারে না। বিনাশ ঘনানোর প্রশ্নে নির্দ্বন্দ্ব থাকতে পারে না। আমার অন্তর্লোক অকারণেই যেন বিচলিত হতে থাকে। যেন সে কেঁপে ওঠে, সামান্য এক ঝলকই কেঁপে ওঠে। মনে হতে থাকে, আবারও ভুল হয়ে যায় যদি আমার! যদি এটাও সেই পাপ-নগরী না হয়ে থাকে! তাহলে! তাহলে! তবে তো আমার মুক্তি আবার সুদূর হয়ে যাবে। আবারও তো আমার অন্তরাত্মা ফালা ফালা হতে থাকবে গ্লানি ও ঘৃণায়।

না না! স্থির প্রাণে, আরও গহন-গভীর-পর্যবেক্ষণ ছাড়া একটা কোনো পদক্ষেপই আর গ্রহণ করব না আমি। তেমনটা করা কিছুমাত্র সমীচীন হবে না আমার জন্য। যত দিন যায় যাক, যত সময় লাগে লাগুক; আমি তো আগে সম্পন্ন করি গূঢ়, ঘন পর্যবেক্ষণ! সেটাই করব আমি। তারপর ধ্বংস নামাতে কতক্ষণ!

 

সেই পর্যবেক্ষণ-প্রক্রিয়ারই একটি অংশ এটি। এই যে নিজেকে নানা চতুর্চক্রযান-আরোহীগণের অংশ করে তোলা। জনপদের এক পথ থেকে আরেক পথে-এক চতুর্চক্রযান থেকে অন্য যানে- এক রকম ভিড় থেকে অন্য রকম জটলায়, নিজেকে ফেলে রাখা-চলছে আমার। অবিরাম চলছে। লোকসকলকে দেখে ওঠা ও পাঠ করে ওঠা-চলছে।

 

চলতে চলতে এই পথে কিনা শেষে এই বৃত্তান্ত! কৌতুকবশে বহুক্ষণ নারীটির কাছে অদৃশ্য থেকে হঠাৎ দৃশ্যমান হয়ে ওঠার ব্যাপারটা ঘটালাম আমি। প্রথম প্রথম স্রেফ কৌতুকবশেই অমনটা করা। তবে ক্রমে আমি বুঝে উঠতে পারি যে আমাকে এই নারীর সামনে অতি অবশ্যই দৃশ্যমান হতে হবে।

 

কেননা যখন অদৃশ্য হয়ে, তার পাশের আসনে আমি আসীন ছিলাম আমি; তখন আমি এই মলিনা-সামান্যার ভেতরে এমন কিছু তথ্য-উপাত্ত ও বিশেষত্ব আমি পেয়ে উঠতে থাকি; যেগুলো ছিল বড় অভাবিত। ভারী বিস্ময়কর রকমের অদ্ভুত! এর আগে কত কত নগরবাসী-পুরুষকেই না পাঠ করা হলো আমার এইখানে; তাদের ভেতরে তো অমন কিছুর কোনো লক্ষণ, কদাপি পাইনি আমি।

 

এই যে এই সমস্তটা চতুর্চক্রযান, এটি তো বোঝাই হয়েই আছে এখন নগরবাসী সাধারণ নারীতে ও পুরুষে। আমি নিয়মমাফিক এই সন্ধ্যায়ও কী করি? প্রথমেই তাদের সকলের অভ্যন্তরকে এক ঝটকা দেখে নিই। এই লোকালয়ের অন্য লোকগণেরই মতোই; এরাও ধুকন্ত, আধিগ্রস্ত, ব্যাধি জর জর, দিশেহারা কিছু দেহমাত্র। এদেরও নাসিকায় রক্তস্রাব, এদেরও ত্বকে ত্বকে রক্তিম স্ফোটক।

সেই সব স্ফোটক থেকে এই সব দেহেও, বিদ্যুৎ ঝিলিকের মতো যন্ত্রণা থেকে থেকে দেখা দিয়ে যাচ্ছে। এই চতুর্চক্রযানেও বহুমূত্র রোগগ্রস্তরা মূত্র-স্খলন-ভাবনায় একই রকম দিশেহারা। সর্বত্র, এই নগরীর সকল দেহেই; একই রকম উপাত্ত - দফায় দফায় পেতে পেতে আমি ক্লান্ত। একই উপাত্ত একই পরিস্থিতি-সর্বত্র, সকল দেহে, সকল সময়।

এই যানেও তো তাই-ই আছে, তাই না? তাহলে আর নতুন করে যাচাই করার কী আছে! কিচ্ছু নেই। বরং এখন আমি খানিকটা বিরাম দিই আমার কর্মে। একটু বিরতি আসুক এখন। আমি অমনটা ভেবে, আমার দেহটাকে খানিকটা এলিয়ে দেই চতুর্চক্রযানের আসনে। ও! পাশে তো আবার এখন আসীন আছে এক নারী! এমন সহযাত্রী পাওয়া তো আবার আমার জন্য এখানে এই প্রথম। যাক! আছে নারী থাকুক সে! এ রকমটা ভেবে আমার বাঁ দিকে ঘাড় ফেরাই। এই তো যানের জানালা-ঘেঁষে, আমার পাশেই আসীন নারীটি। আধিব্যাধি উদ্‌ভ্রান্তি তো এই শরীরেও একই রকম আছে? তাই তো? আছে তো থাক।

 

আমার চোখেরা একটা তিতিবিরক্ত ঝাপটা-দৃষ্টি ছিটকে দেয় নারীটির দিকে। একে অত নিবিড় মনোযোগ দেওয়ার কিচ্ছু নেই। কিন্তু ওই এক ঝটকায় নারীটির অভ্যন্তরকে দেখে-নেওয়া ও পড়ে-ওঠার কর্মখানা করে উঠতে গিয়ে- আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়সকল যেন বজ্রাহত হয়ে পড়ে। আমি স্তব্ধ হয়ে যেতে থাকি। কেমন একরকম হতবিহ্বলতা আমাকে অসাড়-অচল করে দিতে থাকে, পলকের মধ্যে।

কী? কী বৃত্তান্ত!

এই নারীদেহ তো তার দেশের অন কোনো দেহের মতো নয়। কিছুমাত্র নয়। নারীটি আদ্যোপান্ত ব্যাধিমুক্ত, আধি জড়তাশূন্য। সুস্থ সে। উচ্চ-রকমের আলোদীপ্ত সুস্থ! অসম্ভব! এটা অসম্ভব! সমস্তটা ব্যাধি-ক্লিন্নতা জরজর নগরীতে; অমন সরল সুস্থতা কী করে থাকে! এটা অসম্ভব। নিশ্চয়ই, ভুল পাঠ পাচ্ছি আমি এইখানে।

সর্বত্র সকলখানে ব্যাধিগ্রস্ততা দেখে দেখে দেখে নির্ঘাত ক্লিষ্ট ও পরিশ্রান্ত ও অনেকখানি বিকল হয়ে উঠেছে আমার ইন্দ্রিয়সকল! নির্ঘাত সেটাই হয়েছে। তখন আমার নিজের ওপর ক্রোধ জন্মাতে থাকে। দেবদেহধারী আমি। আমাকে কীভাবে দূষণগ্রস্ত করে তুলতে সমর্থ হয়, এই মর্ত্যরে ধূলি বা বালাই!

ক্রুদ্ধ অন্তর নিয়ে আমি নারীটির দিকে তাকাই। আরও গাঢ় পাঠ দিতে ব্যাপৃত হই আমি, নারীদেহটিকে। কী বিস্ময় দেখো কী বিস্ময়! নারীটির অন্তর্লোককে পাঠ করি, সেই সামর্থ্য আমার নেই! আমি পরিষ্কার বুঝে উঠতে পারি, একে সম্পূর্ণ পড়ে ওঠা আর তন্নতন্ন দেখে ওঠা- আমার তীব্রতম ও অপ্রতিরোধ্য দর্শনেন্দ্রিয়ের পক্ষেও সম্ভব নয়। কিছুতেই সম্ভব নয়।

আমি তখন আমার অন্য সকল ইন্দ্রিয়কেও ব্যাপৃত করি। তারপর মুহূর্তেই আমার সত্তা সংশয়মুক্ত হয়। না! সে অগম্য, সুদূরা। নিশ্চয়ই এটি মানবী। মানবী সে এই নগরীরই। কিন্তু অন্য কারও মতো সে নয়। সে তবে নিজ লোকলয়বাসীদের থেকে এমত পৃথক হয় কী করে! কীভাবে সম্ভব সেটা!

আমি তখন আমার সমস্তটা সত্তাকে, নিমেষে, আমার একটিমাত্র ইন্দ্রিয়ে পরিণত করে নিই। নিজেকে আমি পরিণত করি দর্শন ইন্দ্রিয়ে। দেখতে চাই আমি। এই নারীর অন্তর্লোককে দেখে উঠতে চাই। কিন্তু এ কী! এই নারীকে পড়ে-ওঠা, আমার পক্ষে অসম্ভব।

আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠতে থাকে, ক্রোধে ও অক্ষমতার যাতনায়। আমি তো আমিত শক্তিধর। আমি তো অটল, জরাশূন্য, মৃত্যুহীন, চির যৌবনগ্রস্ত। রোগআকীর্ণ, ক্লেদক্লিন্ন এক নগরের নগণ্য এক নারীর অন্তর্লোককে পাঠ করে নিতে কিনা অসমর্থ আমি আজ! শোচনীয় দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে উঠেছে তবে আমার শক্তি এখন! দেবদেহের অপার পরাক্রমশীলতা আজ তবে ভেঙে কণা কণা যাচ্ছে জরাগ্রস্ত লৌহের মতো! হায়! এসব কী! কী! আমার সন্তাপদীর্ণ দর্শনেন্দ্রিয়, পুনর্বার নারীটির অভ্যন্তরের পরিচয় অন্বেষণ করতে যায়, আবারও বাধাগ্রস্ত হয় তুমুলরকম।

কী! কেন ওই নারী অন্তরবিশ্ব এমত দুষ্প্রবেশ্য আমার জন্য! কী কারণে!

হবে না কেন! ওই তো নারীটিকে আদ্যোপান্ত বেষ্টন করে আছে এক বৃক্ষ। বিপুল শাখা-পল্লবময় এক সে বৃক্ষ! সেসকল শাখা ও পত্রগুচ্ছ সরিয়ে, এই নারীর অন্তর্লোকে প্রবেশের সাধ্য আমার নেই।

বৃক্ষ, বৃক্ষ! তোমার সঙ্গে আমার মিত্রতা নেই অমিত্রতাও নেই। আমার পথে বিঘ্ন হয়ো না। আমার কর্ম নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হতে দাও। বৃক্ষ, পথ ছাড়ো।

“যে তুমি অচিনজনা”, বৃক্ষ উত্তর দেয়; “তোমার সঙ্গেও আমার মিত্রতা নেই-অমিত্রতা নেই। আমার পথে আমি দণ্ডায়মান- সে পথে তুমি প্রবেশের কে! যাও। সরো।”

আমি বুঝে উঠি, এ-বৃক্ষ পরোয়াহীন, দুর্মর গোঁয়ার এক। এই নগরীর বিনাশের কাল ঘনিয়ে আনার আগে, এমত তুচ্ছ এক বৃক্ষের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হওয়া, আমার জন্য গৌরবের হবে না। এখন আমাকে থাকতে হবে সর্বকিছুর সঙ্গেই বিবাদশূন্য, নির্বিকার। বেশ, তাই হোক। এই বৃক্ষের ত্যাদড়ামোরই জয় থাকুক তবে এখন।

তবে মনে মনে আমি নিজেকে শুনিয়ে রাখি; প্রলয়ের কালে একে দিতে হবে কঠিনরকম দণ্ড-যন্ত্রণা। দিতেই হবে। এখন শুধু এই বৃক্ষের নামপরিচয় জেনে রাখাটাই জরুরি। আমার জন্য তো এটি এক অচিনবৃক্ষ। এমনই এক ঠ্যাঁটা একগুয়ে বৃক্ষ, যেমনটার সাথে গত কয়েক সহস্র বছরে আমার কখনোই কথা হয় নাই। ‘আমাকে নাম পরিচয় প্রকাশ করার ইচ্ছা রাখো, বৃক্ষ?’ কিঞ্চিৎ ধন্দ নিয়েই আমি জিজ্ঞেস করি।

“ধুলামাটির লোকসকলে আমারে ডাকে নিমবিরিক্ষি নামে।” খুব তেরিয়া শোনায় বৃক্ষটির কণ্ঠ।

 

নিমবিরিক্ষি-আচ্ছাদিতা নারীটিকে পাঠ করা হয় না আমার। এখন একে আমি উপেক্ষা করলেও পারি। এক নগরীর একটি মাত্র দেহ পাঠবহির্ভূত রইলে, কী আর এমন ক্ষতি হতে পারে! আমি কী অরোধ্য নই! চির অপ্রতিরোধ্য নই কি আমি? তবে অস্বস্তি কিসে! কোনো অস্বস্তি-অশান্তি-শঙ্কা-ভীতি কিচ্ছু নেই। আমার জন্য ওসব কিচ্ছু নেই।

শুধু একটু কৌহূহল, টলেদুলে উঠছে আমার মধ্যে। এই নারীটি, এতক্ষণ যার জন্য আমি নিজেকে অদৃশ্য করে রেখেছিলাম, আচমকাই সে যখন তার পাশের আসনে আমাকে দেখে উঠবে; তখন সে কী করবে! এই এতক্ষণ ধরে অদৃশ্য থাকা একজন আচমকা দৃশ্যমান হয়ে উঠলে-কী করতে পারে এই নারী! আতঙ্কে মহাচিৎকার দিয়ে উঠবে কী! যান থেকে লাফিয়ে নেমে যাওয়ার জন্য দৌড়াবে? সংজ্ঞা হারাবে? এটা জানার জন্য কেন যে আমার ইচ্ছা হতে থাকে, প্রবল ইচ্ছা, সেটা আমার বোধগম্য হয় না।

আমি বুঝতে পারি, আমাকে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে হবে। অবশ্যই তেমন একটা চমকের ঝাপটা বইয়ে দিতে হবে। এই নারীটিকে চিনে ওঠার জন্য, অই একটাই পথ আছে শুধু। না না! খুব ঝাঁকালো রূপ নিয়ে দেখা দেওয়ার দরকার নেই আমার। এই নগরীর সকল পুরুষ যেমন নিঃসাড়, জবুথবু; তেমন শরীর-কাঠামো নিয়ে দেখা দিলেই চলবে। শুধু খানিকটা চমকে দিতে হবে তাকে। ব্যস ওই-ই।

 

নিজেকে যতটা ভাঙাচোরা ও নজরে না-পড়ার মতো করা সম্ভব, করে নিয়ে আমি; দেখা দিই তাকে। বসে থাকি আলগোছে, তার পাশের আসনে। তার ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য সর্বদাই চোখ তোলার কী কোনো দরকার আছে আমার! নেই তো। ইচ্ছে হলে চোখের ব্যবহার করি আমি, মনুষ্যগণের মতো। ইচ্ছে হলে আমি ব্যবহার করতে পারি আমার অন্য অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গ। তাতেই সবকিছু দেখে উঠতে পারি আমি। সবকিছু বুঝে উঠতে পারি।

নারীটির পাশের আসনে বসা আমি তখন আমার অঙুলিদের বলে দিই, ‘দেখে ওঠো সবটা তোমরা। বুঝেও ওঠো অতি ভালোরকমে, এই নারীর ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া!’ পলকে আমার অঙুলিরা, উতলা এক ঝলক অগ্নির রূপ ধরে নেয়। সেই অদৃশ্য অগ্নি-আরশিতে পার্শ্ববর্তিনীর সকল ক্রিয়াকর্মের ছবি ঝটকে উঠতে থাকে। সে নারী আমাকে এক ঝলক দেখে- কী-দেখে না, মুহূর্তের মধ্যেই চতুর্চক্রযানের ভেতরে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। সে-ও মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

আমাকে দেখে সে শুধু এক ঝলক; সেইটুকু দেখাতেই, তার চোখে যে বিস্ময় ও বিহ্বলতা জাগনা দেয়, সেটি বিপুল। সেটাকে আমার মনে হতে থাকে, যেন যোজন যোজন বিস্তৃত ওই হতবিহ্বলতা। আরে! মনুষ্যগণের অক্ষির অত ক্ষুদ্র মণি অমন দূরবিস্তৃত ধন্ধ-সংশয় ধারণ করতে পারে! আমি তো তা কখনো জানিনি!

তবে কীভাবেই বা সেটা জানা সম্ভব হবে! মনুষ্যগণের সাথে অত-নিকট- হয়ে ওঠার পরিস্থিতি তো কদাপি তৈরি করিনি আমি! যানটির ভেতরে অন্ধকার নেমে এলে, নারীটি থেকে থেকে আমাকে দেখে যাওয়া চালাতে থাকে। খুব সন্দেহ-বিস্ময়ভরা তার দৃষ্টি! আমাকে এমত সন্দেহের চোখে দেখার কী আছে!

 

আমি এখন এই দেশের অন্য সকল পুরুষের মতোই তো বেশবাসধারী আছি। শরীর তো আমি তাদের মতোই বাঁকাচোরা করে আছি। একদম তাদের রকমেই মাপসই খাপসই করে রাখা আছে আমাকে আমার! তবু এ নারীর প্রাণ এমন সন্দেহঘোরালো কেন! অমন তাজ্জব হয়ে যাওয়া চোখ এবং বাক্যহারা হয়ে যাওয়া চিত্ত নিয়ে -এ নারী আমাতে কী অন্বেষণ করে? আমাকে সহজভাবে নিচ্ছে না কেন সে? আমি বুঝতে পারি, ভুল হয়ে গেছে আমার। অমন আচমকা দেখা দেওয়া উচিত হয়নি আমার।

 

উপরন্তু, এই নারীটিকেও তার দেশের অন্যসকলের মতোই, ধুকধুকন্ত ও নাজেহাল একজন বলে ধরে নেওয়াও হয়েছে এক ভুলকর্ম। খুবই ভুলকর্ম। বিশদ যাচাই-বাছাই না করে, শেষে কিনা আমি হয়ে উঠছি কেবলই আন্দাজ- অনুমাননির্ভর একটা ফালতু প্রাণী! এটা তো চরম বিপর্যয়কর আমার জন্য!

ধূলির দুনিয়া কী আমাকেও নষ্ট করে তুলছে! তাই কি ধসে যাচ্ছে আমার ইচ্ছাশক্তির দৃঢ়তা ও তেজ! অনুতাপ ও আশঙ্কা ও অনুশোচনা বোধ করার জন্য নিজেকে ঠেলতে থাকি আমি; কিন্তু কী বিস্ময়! এত অযুত নিযুত বছরের মধ্যে, এই প্রথম, অনুশোচনাবিদ্ধ হতে আর অনুতাপিত বোধ করতে, কিছুমাত্র ইচ্ছা হয় না আমার!

গোল্লায় যাক তবে এখন ওই নিয়মবাঁধা অনুশোচনা-অনুতাপের আহাউহু কর্মাবলী! এখন আমি বরং নারীটির বিমূঢ় হয়ে ওঠা চাহনিটার কথা ভাবি! খুব করে ভাবি বরং সেটাই। তার সেই মৌন দৃষ্টি; এতখানি বাক্সময় কী করে হয়! সংশয়-বিস্ময় যদি এইভাবে দূরবিস্তৃত হয়ে যেতে পারে, যদি এইমতে তা মনুষ্যচক্ষুকে কম্পমান করে তুলতে পারে; তাহলে উল্লাসের কালে এই চোখ কতটা উথলে উঠতে পারে? কেমন উথলে ওঠে তখন? কেমন?

এবংবিধ ভাবনায় আমি কিঞ্চিৎ আলোড়িত হয়েও সারি না, দেখি যে পথ আচমকাই ফুরিয়ে এসেছে। চতুর্চক্রযান পৌঁছে গেছে তার শেষ গন্তব্যে। যানটি থামে-কি-থামে-না, সকল পুরুষযাত্রীই সবার আগে নেমে যাওয়ার জন্য ধুস্তাধুস্তি শুরু করে।

অন্য সময় এসব ক্ষেত্রে আমি অদৃশ্য হয়ে গিয়ে, নিজেকে উড়িয়ে নিয়ে আসি বাইরে। অদৃশ্য থেকে থেকে দেখতে থাকি, নামার জন্য লোকসকলের উৎকণ্ঠ হুড়ানাড়াকে। কে আগে নামবে- তাই নিয়ে তারা একে অন্যকে কেবলই গুঁতা-ধাক্কা ও তেরিয়া চাপ দিয়ে চলেছে। সেটা দেখে দেখে আমি আবার নতুন রকমে উল্লাসে ফেটে পড়তে থাকি। মৃত্তিকা যেদিন অগ্নি উদগীরণ করবে এদের গ্রাস করার জন্য, অর্থাৎ আমি যেদিন সেটা চাইব সেদিন-আতঙ্কের ছুট তো দিতে হবে এই লোকসকলকে। সেটার আগাম অনুশীলন ভালোই তো চালাচ্ছে ওরা! বেশ ভালো তো!

 

কিন্তু আজ আবার আচমকা অদৃশ্য হওয়া সমীচীন হবে না আমার। নারীটি এই তো আমার পাশেই বসা। তার শ্লথ, আনমনা চোখ চেয়ে আছে, নামার জন্য বেতলা হয়ে-যাওয়া লোকগুলোর দিকে। আবার একটু পরপর তার চোখেরা চেয়ে থাকছে আমার দিকেও। এখন, তার চোখে সংশয়কর মনে হয়, এমন আচরণ করে ওঠাটা-খুব ভুল হবে আমার জন্য। আমার উদ্দেশ্য-সিদ্ধির পথ, এখন রাখা চাই সরল, বিঘ্নহীন, একদম নিস্তরঙ্গ।

আমি তখন করি কী অন্য পুরুষের মতোই, যথাবিধি অন্য যাত্রীদের, ঠেলে-গুঁতিয়ে এবং নিজে বিপুল ভারী সব ঠেলা-গুঁতা খেতে খেতে চতুর্চক্রযানটা থেকে নামি। তারপর আউলা-মাউলা করে করে হাঁটাও চালাই। হেঁটে অনেকটা এগিয়ে যাবার প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করি আমি অন্য পুরুষযাত্রীর মতোই। তারপর নিমিষে নিজেকে অদৃশ্য করে নিয়ে, পলকে এসে দাঁড়াই যানটির সামনে। নারীটি তখনো আসীন, যানের অভ্যন্তরে। আনমনা দেখায় কেন তাকে! আফসোস! তার অভ্যন্তরে দৃষ্টিপাত করার সাধ্য আমার নেই। কেমন এক বৃক্ষবেষ্টনে ঘোর অবরুদ্ধ তার অন্তর্লোক, দুষ্প্রবেশ্য সে- আমার জন্য।

 

নারীটি আমার জন্য ভীতিকর কিম্বা ঝামেলা-উদ্রেককর কিছু হয়ে উঠতে পারে কী? প্রভূত যাচাই-বিশ্লেষণ করেও আমি কেন উত্তর পাই না। তবে বোধ করতে থাকি যে, একে উপেক্ষা করার অসমীচীন হবে। চূড়ান্ত হঠকারী কর্ম হবে সেটা। এই মনুষ্য-কন্যাকে আমি পাঠ করে উঠতে না-ই পারি, কিন্তু তাকে অনুসরণ করে যেতে হবেই আমাকে। কে সে, তার বসত কোথায়-এই সব জানা যাক তো প্রথমে, পরে ধীরে ধীরে না হয় অন্য সবকিছু জেনে ওঠা যাবে।

অতি ধীরে অবশেষে সেই নারী যানটি থেকে নেমে আসে। নেমে সে কোনো দিকে হাঁটা শুরু করে না, বরং তাকাতে থাকে এদিকে-ওদিকে। সেটা দেখে হাস্য সংবরণ করা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে আমার পক্ষে। সে কী অকাজে তাকাচ্ছে? নাহ! সে আসলে আমার সন্ধান করছে। আর দেখো দেখো, সে কিনা মনে মনে হাওয়াকে শোনাচ্ছে, আমার চোখের কথা। সবুজ চোখ-সবুজ চোখ- সেই লোকের ওটা কেমন চোখ!

আমার চোখের রং বদলে নেয়ার জন্য সহস্র রকম উদ্যোগ নিতে পারি আমি এখন নতুন করে; আগে যেমন নিয়েছি তেমন করে।

কিন্তু তাতে তো কোনো ফলই ফলবে না। ঊর্ধ্বলোকের বিধিই এই যে, আমার চোখের রং তো কোনো অবস্থায়ই বদলাবে না, এমনই রয়ে যাবে বরাবর। দেবদেহের এই-ই বৈশিষ্ট্য যে। দেখো তো কী ভুল আমার! কী বিষম ভুল! আমার অক্ষির মণির বরন যে ঘোর সবুজ, সেই কথার বিস্মরণ আসে কী করে আমার মধ্যে! তার সঙ্গে চাহনি বিনিময় করার কী প্রয়োজন ছিল! আমি যে শক্তিমান, তা তো জানি আমি। কিন্তু অভীষ্ট সিদ্ধির পথে নিজেকে বিঘ্নহীন রাখতে হবে না? রাখছি আমি? না না না!

ওই যে নারীটি হাঁটে! হেঁটে হেঁটে যায়, শিথিল পায়ে। পায়ে পায়ে পেছনে পেছনে আমিও তার সঙ্গে এগোই। এগোই। যেতে যেতে যেতে শেষে সে ঢোকে, সামান্য আলো ও অনেক অন্ধকার জাবড়ে থাকা ঘুপসি এক গলিতে। সরু সে-গলির দুপাশে কোঠাঘর, কেবলই কোঠাঘর। বিবর্ণ এবং ভাঙা-জেরাবেরা। তেমন একটা কোঠাঘরের সামনে এসে দাঁড়ায় নারীটি। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সে খুঁজে নেয় দরজার কড়ায় লাগানো তালাটিকে।

অন্ধকারে এবড়ে-মেবড়ে অনেক অনেকবার সে চেষ্টা চালায়, চাবিটা যথাস্থানে ঢোকাবার জন্য। একটা বাতিও কেন থাকে না তার সঙ্গে! আশপাশেও একটা কোনো বাতি থাকতে নেই কী এখানে? অদ্ভুত তো। আমি আলো হয়ে জ্বলে উঠলে, হবে? না, হবে না।

নারীটি হেঁচড়ে-পেচড়ে তালাটা খোলে অবশেষে। তারপর কপাট ঠেলে ভেতরে পা রেখে, একটা বাতি জ্বেলে নেয়।

ঘোলা ঘোলা আধানেভা আধাজ্বলা সেই বাতিটা; কোঠাবাড়িটার বাহির ও ভেতরটাকে আচমকাই জাগনা পাইয়ে দেয়। এই যে প্রধান দরজাখানা, সেটা নারীটির পরনের বস্ত্রের মতোই মলিন-ফ্যাকাশে ও জোড়াতালি দেওয়া। ওই তো ভেতরে একফালি আঙিনা, সেইখানে ওই দেখা যায় এক ঝাপটা সবুজ। অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়ায়ে থাকা, ঋজু একটু সবুজ।

কী ওটা?

গাছ। গাছ।

আমি ভেতরে ঢোকার জন্য আগানো শুরু করি। কিন্তু আমি দেখতে পাই, ভেতরে ঢোকার পথ নেই, আমার জন্য। ওই তো নারীটি ঢুকে গেল ভেতরে, কিন্তু আমি এক কদমও ঢুকতে পাই না। কেন! কী কারণ!

ওই যে সবুজ- ওই যে গাছখানা-সে আমার পথ রোধ করে দণ্ডায়মান হয়ে আছে।

গাছ-গাছ-তোমাকে যেন চিনি চিনি লাগে!

লোকে আমাকে ডাকে নিমবিরিক্ষি নামে।

 

(চলবে)

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগের আরো খবর

Link copied!