বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব সম্পর্কে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মত হচ্ছে, বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য যদি কিছু থেকে থাকে, তবে সেটা হচ্ছে সমাজে পরিবর্তন আনা। আমাদের সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেনি। ইতোমধ্যে রাষ্ট্র ও সমাজে পুঁজির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাতে জনগণের কোনো উপকার হয়নি। প্রয়োজন পরিবর্তন এনে সমাজকে মানবিক করা। এটা করতে গেলে রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের দ্বন্দ্ব দেখা দেবে। দেখা দিক। সেটা ভালো কথা। কিন্তু লক্ষ্য থাকবে রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে নয়, তাকে সঙ্গে নিয়েই সমাজকে বৈষম্যহীনতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এ কাজ বুদ্ধিজীবীরা করবেন জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে। কারও একা পক্ষে একা করা সম্ভব নয়। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে করতে হবে। আর যারা করবেন তাদেরই বলা হবে সৃষ্টিশীল বুদ্ধিজীবী। প্রথাগত বুদ্ধিজীবী থেকে আলাদা।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সামাজিক-মানুষের উত্থান চান, তিনি জানেন মানুষের মাঝে আছে—‘স্বাধীনতার স্পৃহা, সাম্যের জয়’। দায়বদ্ধ বুদ্ধিজীবী হিসেবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মানুষের মনোজাগতিক উন্নতির মাধ্যমে মানবিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে তার দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এটা তিনি নিরন্তরভাবে করে যাচ্ছেন। নিয়মিত লিখছেন তিনি, সামাজিক মালিকানার কথা বলছেন।
গত দুই দশক বিরতিহীনভাবে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়ে চলছে সাহিত্য-সংস্কৃতির ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত। পত্রিকা সম্পাদনা তার নেশা—এ কথা তিনি তার আত্মজীবনীতে বলেছেন। সম্পাদনার কাজের মধ্যে খুঁজে পান ভালো লাগার অপার্থিব আনন্দ। পরিক্রমা, সাহিত্যপত্র, সচিত্র সময়, সাপ্তাহিক সময়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা ইত্যাদি পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করেছেন। লেখার টেবিল থেকে মিছিলের রাজপথ—সব জায়গায় তিনি ছিলেন এবং আছেন। বাংলা বানানে অন্যায় হস্তক্ষেপ কিংবা নির্বিচার বৃক্ষ নিধনের বিরুদ্ধে তিনি সবসময় সোচ্চার একজন।
দুই.
রাষ্ট্র কিংবা সমাজে ভাঁড় ও বুদ্ধিজীবীদের আনাগোনা সব সময়। তারা এতটা বুভুক্ষু, যা পায় তাই খায়। এরা বর্জ্য ও হালুয়ার তফাৎ বোঝেন না—এরা বর্জ্য খেয়ে হালুয়ার ঢেঁকুর তোলেন। এসব দলদাসরা যখন সংঘবদ্ধ—পাল্লায় ভারী, তখন নিতান্ত হাতে গোনা কজন যতটা সম্ভব ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করেন—এরা আঁধারকে আঁধার এবং আলোকে আলোই বলেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাদেরই একজন। আমরা তাকে ‘সিক* স্যার’ হিসেবেই বেশি চিনি।
সক্রেটিস দার্শনিক ছিলেন। তাকে আমরা আদর্শ বুদ্ধিজীবী বলতে পারি। তিনি ব্যাখ্যা করতেন এবং তরুণদের মধ্যে সেই ব্যাখ্যা পৌঁছে দিতে চাইতেন। তার লক্ষ্য ছিল, সেই সময়ের বিদ্যমান ব্যবস্থাটাকে বদলাবেন। এভাবেই সিক স্যারকেও সক্রেটিসের ছায়া আদর্শ বুদ্ধিজীবী হিসেবে দেখি।
২৩ জুন তিনি ৮৮ ছুঁয়েছেন। ১৯৩৬ সালের এই দিনে তিনি তৎকালীন ঢাকার (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ) বিক্রমপুর উপজেলায় বাড়ৈখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। বাক্স্বাধীনতা, মানবিক অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচার বিষয়ক আন্দোলনে পুরোধা তিনি। মার্কসবাদী চিন্তাচেতনায় উদ্বুদ্ধ, প্রগতিশীল ও মুক্তমনা এই লেখক। সমাজতন্ত্রের প্রতি তার দুর্বলতা অপার, পক্ষপাত প্রশ্নহীন। বার্ধক্যের উপস্থিতি অনেক আগে ঘটলেও চেতনায়-বুদ্ধিজীবীতার প্রশ্নে এখনো তিনি টগবগে যুবক—জ্ঞানচর্চায় যার ব্যাপ্ত জীবনের লক্ষ্য-মহত্তম এক উদ্দেশ্য। কেবল লেখালেখি নয়, বা তাতে কর্তব্য শেষ করেননি, যাপন করেছেন সমাজতন্ত্রের প্রতি উৎসর্গিত এক জীবন।
তিন.
গত শতকের ৯০ দশকে শীর্ষ কলামলেখকদের মধ্যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একজন। সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থেকে বিবেকর তাড়নায় তিনি কলাম লেখা শুরু করেন। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ‘উপর কাঠামোর ভেতরই’ নামে সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে নিয়মিত কলাম লিখতেন। যিনি ‘গাছপাথর’ ছদ্মনামে ‘সময় বহিয়া যায়’ শিরোনামে সেই সময়ের বহুল প্রচারিত সংবাদ পত্রিকায় একটানা কয়েক বছর লিখেছিলেন। তাঁর লেখা আমার আগের প্রজন্ম কিংবা আমাদের প্রজন্মের মননগঠনে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। অনেকেই হয়তো তার আরাধ্য সমাজতন্ত্র জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেনি, কিন্তু শ্রেয়বোধ, কল্যাণচেতনা ও সমন্বিত জীবনচেতনা প্রথিত করেছে তার লেখা।
গান্ধী বলেছিলেন, ‘বি দ্য চেঞ্জ দ্যাট ইউ উইশ টু সি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গান্ধীবাদী নন, কিন্তু গান্ধীর এই উক্তির এমন অনুশীলন সারাটা জীবন করে গেছেন। সমাজতন্ত্রের আদর্শকে সারা জীবন হৃদয়ে ধারণ করেছেন, চর্চা করেছেন ও প্রচার করেছেন। কোনো দিন এতটুকু বিচ্যুত হননি। তার লেখার মধ্যে ঘুরেফিরে পুঁজিবাদের অশুভ ও সর্বগ্রাসী চরিত্র এবং সমাজতন্ত্রের কল্যাণকর দিকগুলো বারবার আসে, কিন্তু তা পাঠকের মধ্যে একঘেয়েমি সৃষ্টি করে না। যেসব ঘটনা সাধারণ মানুষের জীবনকে স্পর্শ করে, তিনি সুকৌশলে সেসব ঘটনার অবতারণা করেন এবং তা ব্যাখ্যা করেন তত্ত্বের আলোকে, উপমার মাধ্যমে। তার লেখার আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো গদ্যের মধ্যেও একটা ছন্দ আছে, যা পাঠককে কাছে টানে।
সিক স্যারের সাহিত্য সমালোচনা আর দশজনের চেয়ে আলাদা, কেননা এই কঠিন কাজটি তিনি করেছেন ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের আলোকে। ইতিহাস চেতনার ও সমাজতত্ত্বের জ্ঞান ছাড়া যে সাহিত্য সমালোচনা, তা সঠিক সাহিত্য সমালোচনা নয়।
বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে শতাধিক বই তিনি লিখেছেন। গল্প-উপন্যাসও লিখেছেন। তবে প্রধানত গবেষণামূলক কাজের প্রতি তার আগ্রহ বেশি। তার শিক্ষকতা, লেখালেখি, সম্পাদনা ও সাংগঠনিক কাজে যে মূল তাগিদ বা লক্ষ্য তার ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি। তার সব তৎপরতার মৌলিক তাগিদ পুঁজিবাদী সমাজের অমানবিক নিষ্ঠুর বৈষম্যমূলক সহিংস যে চরিত্র, সেগুলোকে উন্মোচিত করে মানবিক মুক্তির পথ সন্ধান করা। তিনি বিশ্বজুড়ে মানুষের চিন্তা ও সংগঠিত লড়াই থেকে নিজে অনুপ্রাণিত হয়েছেন, অন্যদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং লক্ষ্যকে সুনির্দিষ্ট করার চেষ্টা করেছন। তিনি সব কাজের মধ্যে, চিন্তার মধ্যে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্যে সমাজকে বদলে দেওয়া বা সমাজে বিপ্লবী রূপান্তরের লক্ষ্য স্থির করেছেন, সমাজতন্ত্রের অপরিহার্যতা তুলে ধরেছেন। তার লেখার সবচেয়ে বড় ব্যাপার, তার সমাজচেতনা। তার প্রতিটি লেখাই দেশ, মাটি ও মানুষকে নিয়ে। মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসার কারণে তিনি শ্রেণিহীন-শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি অবিরাম লিখে চলেছেন।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রথমত ও প্রধানত বাংলাদেশের লড়াকু বুদ্ধিজীবী বলেই বাংলাদেশের মেহনতি মানুষের সমস্যা ও সংগ্রাম তার অসংখ্য রচনার প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে। পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও পিতৃতন্ত্র ছাড়াও তার প্রিয় বিষয় হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। এখানে তার জাতীয়তাবাদ-সংক্রান্ত ধ্যানধারণার বিশদ মূল্যায়ন পরিসরের স্বল্পতার কারণে সম্ভব নয়। তবে অবশ্যই বলা যাবে যে তিনি আমাদের সময়ে জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক। তিনি যেমন ঐতিহাসিক কারণে জাতীয়তাবাদের ভেতরে ক্ষেত্রবিশেষে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও উপনিবেশবাদবিরোধী উপাদান শনাক্ত করেছেন, তেমনি তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদের সমালোচনাও করেছেন, এই বুঝিয়ে যেসব জাতীয়তাবাদ এক ধরনের নয়।
কিন্তু সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আন্তর্জাতিকতাবাদীও। ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, চীনা বিপ্লব, কিউবার বিপ্লব, ভিয়েতনামের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মুক্তির লড়াইসহ তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন উপনিবেশবাদবিরোধী লড়াই নিয়েও লিখেছেন তিনি। প্রমাণ করেছেন যে বিপ্লব ও সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা ব্যতিরেকে বিপ্লবী রাজনীতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পথ শনাক্ত ও প্রশস্ত করা সম্ভব নয়। তবে শুধু এ ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও তার আন্তর্জাতিকতাবাদ স্পষ্ট হয়ে থাকে, যেমন তা থাকে ইংরেজি সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্য নিয়ে তার বিস্তর আলোচনায়। এ ক্ষেত্রে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন বটে।
চার.
এটা আমাদের জন্য বড় বিস্ময়কর এবং আনন্দের ব্যাপার, একই সঙ্গে সূবর্ণ সময়; সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এই ৮৮ বছর বয়সেও তার লক্ষ্যে কাজ করতে গিয়ে সামান্য ক্লান্ত হননি।। এখনো তিনি অক্লান্তভাবে কাজ করে চলেছেন। আমরা আশা করি আরও বহু বছর তিনি সুস্থ ও সক্রিয় থাকবেন এবং বৈষম্য ও নিপীড়নবিরোধী মানুষের চলমান লড়াইয়ে তার কাজগুলো অনুপ্রেরণা দেবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পথ দেখাবে।
মানুষের স্বাধীনতায় তিনি বিশ্বাসী। তার মতে শ্রেণিবিভক্ত সমাজে মানুষ প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ করতে পারে না। রাষ্ট্রযন্ত্রের সাহায্যে মুষ্টিমেয় কিছু লোক সমাজের ব্যাপক অংশের ওপর তাদের কর্তৃত্ব বজায় রেখে শোষণ করছে—তার লেখার মাধ্যমে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এই দিকটিই বারবার তুলে ধরছেন। তার এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তিনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শ বিশ্বাসী। এ বিশ্বাসে তিনি অটল। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পতনের অনেকই মনে করেন সমাজতন্ত্রের আর ভবিষ্যৎ নেই। কিন্তু এক তিনি জায়গায় লিখেছেন, “বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কোনো ভবিষ্যত নেই। কেননা, বুর্জোয়াদের এমনকি বুর্জোয়া চরিত্রও নেই। তারা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে জনগণকে শোষণ করবে, কিংবা দলবদ্ধভাবে ডাকাতদের মতো মিলেমিশে ডাকাতি করবে। অতটুকু পারস্পরিক ‘মৈত্রী’ স্থাপন করতে অপারগ।” তবে যে সমাজে কিছুসংখ্যক মানুষ বিত্তের পাহাড় গড়বে আর বেশির ভাগ মানুষের জীবনের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করতে নাভিশ্বাস উঠবে, রৌদ্রবৃষ্টির ঝড়ে কঠোর পরিশ্রম করেও কৃষক তার ফসলের ন্যায্য দাম পাবে না, একজন শ্রমিক সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও তার ছোট্ট মেয়ের একটি লাল জামার বায়না পূরণ করতে পারে না—সে সমাজ একদিন ভেঙে পড়বে।
সমাজ পরিবর্তনের একজন আস্থাশীল মানুষ হিসেবে তিনি তার চিন্তাচেতনা ও সংকল্পকে যেভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন, একদিন নিশ্চয়ই এর সফলতা আসবে, তরুণরা সেই সুবিধা পাবে। সিক স্যারের স্বপ্ন একদিন পূরণ হবেই। তিনি নিজেই বলেছেন, সত্যকে অস্পষ্ট করার চেষ্টার কোনো কমতি নেই; কিন্তু সত্যটিকে আনা চাই সামনে। আলোর পরিস্ফুটন জোরদার হলে তবে কুয়াশা কাটবে। এখনো যেসব মানুষের ওপর আমরা ভরসা রাখি, আশাবাদী হই, তাদের একজন কিংবা পঞ্চাশ-ষাট দশকের প্রতিনিধি হিসেবে শেষতম মানুষ হিসেবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বহুধাবিভক্ত বাম রাজনীতিতে ঘনীভূত অন্ধকার আরও গ্রাস করার সংশয়পথকে আলোকিত করবেন তিনি।
লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
*SIC (Sirajul Islam Chowdhury)