সাম্য, অসাম্প্রদায়িকতা, দ্রোহ আর প্রেমের অপূর্ব সংমিশ্রণের কবি কাজী নজরুল। যার এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আরেক হাতে রণতুর্য। নজরুল মহাবিদ্রোহী, ‘প্রলয়োল্লাস’ তার রক্তে। তাই তিনি হুংকার ছাড়েন এভাবে- আমি ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা সঞ্চারি ভূমিকম্প।/ ধরি বাসুকির ফণা জাপটি,/ ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা শাপটি!/ আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,/ আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্বমায়ের অঞ্চল...।
চিরবিদ্রোহের এই হুংকারেই তিনি আখ্যা পান বিদ্রোহী কবি হিসেবে। তবে তার ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় অন্যরূপে ধরা দেন কবি- ‘গাহি সাম্যের গান—/ যেখানে আসিয়া এক হ’য়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,/ যেখানে মিশেছে হিন্দু-মুসলিম-ক্রীশ্চান!’
মানুষের পক্ষে, মানবতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়া বিরল কবি নজরুল। ধর্মের নামে অধর্ম, জাতের নামে বজ্জাতির প্রতিবাদ করেছেন নির্ভয়ে। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিপ্লবী বীর। তার কবিতায় তাই লেখা হয়, আরতির থালা/ তসবীর মালা/ আসিবে না কোনো কাজে/মানুষ করিবে মানুষের সেবা/ আর যত সব বাজে...।
বহুকাল আগে নিজের রচনায় এমন প্রত্যাশার কথা জানিয়ে গেছেন কবি। কবি নজরুল যেন বাঙালি জাতীয়তাবোধের শিকড় ধরে টান দিয়েছেন। তাই তো তিনি আমাদের জাতীয় কবি।
মানবতায়, প্রেমে, সাম্যে বাঙালির সমূহ আবেগ, অনুভূতিতে জড়িয়ে থাকা চির বিদ্রোহী কবির আজ শনিবার ১১ জ্যেষ্ঠ ১২৫তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৯৯ সালের এইদিনে কবি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
নজরুল ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বাঙালি কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ ও দার্শনিক। বাংলা সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই ছিলেন বেশি পরিচিত। তবে বড্ড পরাধীন সময়ে ঝড়ের মতো আবির্ভাব ঘটেছিল নজরুলের। অথচ আজও বিস্ময়কর আলো হয়ে পথ দেখিয়ে চলেছেন বাঙালিকে।
নজরুলের সাহিত্য চর্চার শুরুটা হয়েছিল বালক বয়সে লেটো দলে যোগ দেয়ার মধ্য দিয়ে। তার কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিপুল সমৃদ্ধি। কবি বিশেষ আলোড়ন তোলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে। তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা।’ ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়াজাগানো কবিতা সঙ্কলন ‘অগ্নিবীণা।’
‘বিদ্রোহী ছাড়াও ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’ কবিতাগুলো তুমুল হৈচৈ ফেলে দেয় সর্বত্র। গদ্য রচনার বেলায়ও নজরুল ছিলেন স্বতন্ত্র চিন্তার। তাঁর প্রথম গদ্য ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ ১৯১৯ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেনানিবাসেই তিনি লিখেছেন ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’ ও ‘ঘুমের ঘোরে’ গল্পগুলো। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের গল্প সঙ্কলন ‘ব্যথার দান।’ একই বছর প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘যুগবাণী।’
তবে নজরুলের সৃষ্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে আছে সঙ্গীত। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গান রচনা করেন তিনি। সুর বৈচিত্র্যে ভরপুর এসব গান বাংলা সঙ্গীতকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। তাঁর সৃষ্ট রাগগুলোও দারুণ বিস্ময় জাগায়।
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কবি তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কারণে অসংখ্যবার জেল খেটেছেন। জেলে বসেই তিনি লিখেছেন বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী।’ ১৯৪২ সালে চির বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল বাকশক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে শিশুর মতো হয়ে যান।
এ অবস্থায় ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে। দীর্ঘ রোগ ভোগের পর এখানেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট পৃথিবীকে চিরবিদায় জানান। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।
বাণী
বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে আজ সারাদেশে উদযাপন হবে জাতীয় কবির জন্মদিন। দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাণীতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কবি নজরুল তাঁর প্রত্যয়ী ও বলিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তি সংগ্রামে অনুপ্রাণিত ও উদ্দীপ্ত করেছেন। নজরুল সাহিত্যের বিচিত্রমুখী সৃষ্টিশীলতা আমাদের জাতীয় জীবনে এখনও প্রাসঙ্গিক।
কর্মসূচি
শনিবার (২৫ মে) সকালে ঢাকায় কবির মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে দিনের কর্মসূচি। এর পর দিনভর চলবে আলোচনা স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান।
এবারও জাতীয় পর্যায়ে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং নজরুল’ প্রতিপাদ্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে তিন দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন জাতীয় সংসদের সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী।
ছায়ানটের আয়োজনে তিনদিনব্যাপী নজরুল উৎসব উদ্বোধন করা হয়েছে শুক্রবার (২৪ মে)। কথন, গান, পাঠ, আবৃত্তি ও নৃত্যানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করা হয়। আজও রয়েছে নানা আয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন জাতীয় কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে বাংলা একাডেমি।
‘আমি সেইদিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাসে ধ্বণিবে না’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে শিল্পকলা একাডেমি। এতে প্রধান আলোচক থাকবেন শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক রফিকুল্লাহ খান। প্রধান অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি সচিব খলিল আহমদ।
চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হয়েছে নজরুল মেলা। উদ্বোধনী পর্বে অংশ নেবেন- সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাহিত্যিক, নজরুল বিশেষজ্ঞ ও নজরুল সঙ্গীতশিল্পী এবং চ্যানেল আইয়ের পরিচালকবৃন্দ। মেলায় থাকবে ক্ষুদ্র ও কুঠিরশিল্পের স্টল ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টল।