নদীমাতৃক বাংলাদেশে সঙ্গীত প্রবাহিত হয় ঢেউয়ের ভাঁজে ভাঁজে। এখানকার প্রত্যেকটি অঞ্চল একেক ধরনের গানের খনি। মোটা দাগে যদি বলি, ঢাকা ও এর আশপাশের অঞ্চলে পাওয়া যাবে জারি গান, চাঁপাইনবাবগঞ্জে গম্ভীরা গান, রংপুরে ভাওয়াইয়া গান, ময়নসিংহে ভাটিয়ালি গান প্রভৃতি। এমন দেশের চলচ্চিত্রে গানের প্রভাব থাকাটাই স্বাভাবিক। সেজন্য বাংলাদেশের অধিকাংশ চলচ্চিত্র এখনও পর্যন্ত মিউজিকাল ফিল্ম। তো এই বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রেও প্রতিফলিত হয়েছে বেশ ভালোভাবে। আমরা এই ছোট নিবন্ধে দেখানোর চেষ্টা করবো কেমন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্রে পরিচালকরা সঙ্গীতকে ব্যবহার করেছেন শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষের ভেতরকার মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে তুলতে ও দেশপ্রেমকে ফুটিয়ে তুলতে।
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বোঝা প্রয়োজন এবং সেজন্য আমাদের একটু ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরাতে হবে। ১৭৫৭ সালে ভারত উপমহাদেশের শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় হয় ব্রিটিশদের হাতে। তখন থেকেই বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা পরাধীন হয়ে যায়। দীর্ঘ প্রায় দুশো বছর ইংরেজ শাসনের পর, ১৯৪৭ সালে, ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভেঙে তিন টুকরো হলো: পশ্চিম পাকিস্তান, ভারত ও পূর্ব পাকিস্তান। ভারতভাগের পরপরই পশ্চিম পাকিস্তান অনেকটা সাম্রাজ্যবাদী কায়দায় শাসন করছিল বলে পূর্ব পাকিস্তান নিজেদের অধিকারের কথা বলতে শুরু করে। যেমন ভাষার ক্ষেত্রে, দুই পাকিস্তান মিলিয়ে বাংলা ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা বেশি হলেও বাংলাকে সরকারি ভাষা করা হয়নি। তাই ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় এবং সেটি দমাতে পাকিস্তানি পুলিশ গুলি চালায়। মারা যায় ছাত্রজনতা। সেই অসন্তোষ ধীরে ধীরে জাতীয় আন্দোলনে রূপ নিতে শুরু করে। ১৯৬৯ সালে হয় গণঅভ্যুত্থান।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়ী হলেও, পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হয়নি। শুরু হয় স্বাধীকারের আন্দোলন। একে দমাতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ নিরস্ত্র মানুষের উপর রাতের অন্ধকারে নৃশংস গণহত্যা চালায় পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। শুরু হয় বাংলাদেশের মানুষের সশস্ত্র সংগ্রাম। যাকে আমরা বলি মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এটাই হলো মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ জন্মের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নিয়ে আজকের আলাপে আমরা মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সকল চলচ্চিত্রের সঙ্গীত নিয়ে আলাপ করতে পারবো না। তাই আমরা বেছে নিচ্ছি চারটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রকে। দুটি প্রামাণ্যচিত্র ও দুটি কাহিনিচিত্র। চলচ্চিত্রের সকল প্রকার শব্দ নিয়েও আমরা আলাপ এগুতে পারবো না, তাই আমরা লক্ষস্থির করছি সঙ্গীতের উপর।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নির্মিত উল্লেখযোগ্য প্রামাণ্যচিত্রের নাম ‘স্টপ জেনোসাইড’। প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়ে থাকার সময়, ছবিটি খুব অল্প অর্থে নির্মাণ করেন জহির রায়হান। জহির রায়হান বাংলাদেশের একজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র নির্মাতা। ১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া তার ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রটি মুক্তিযুদ্ধের আগে গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে নির্মিত হয়েছিল। যুদ্ধ শুরুর পর তিনি অনেকটা লাতিন আমেরিকার গেরিলা ফিল্মমেকারদের মতো করে বানালেন ‘স্টপ জেনোসাইড’। যা বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের এক সিনেম্যাটিক দলিল হয়ে ওঠে। এই চলচ্চিত্রের শুরুতেই ব্যবহার হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিস্ট এন্থেম। অর্থাৎ মানুষে মানুষে বৈষম্যের অবসান চেয়ে যে মুক্তির লড়াই হচ্ছে, জুলুমের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ হচ্ছে, সেটিকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন জহির রায়হান। বলতে চাইলেন এই গণহত্যা বন্ধ হোক, প্রতিষ্ঠা হোক মানবিক মর্যাদা, সাম্য ও ন্যায় বিচার।
১৯৭১ সালের দেশ স্বাধীনের পর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র হিসেবে মুক্তি পেল চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১ জন’। এই ছবিটিও কিন্তু শুরু হয় সঙ্গীত দিয়ে এবং সেটি একটি দেশাত্মবোধক গান। গানটি এমন: “ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা / তোমাতে বিশ্বময়ী, তোমাতে বিশ্ব মায়ের আঁচল পাতা”। গ্রামবাংলাকে বাংলাদেশের মানুষ সম্বোধন করে ‘সোনার বাংলা’ বলে। দেশপ্রেমের এই প্রকাশ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতেও রয়েছে। তো সেই সোনার বাংলা, যেখানে প্রকৃতির সাথে মানুষ মিলেমিশে থাকে, সদা শান্তি বিরাজমান, সেখানে অশান্তি বয়ে নিয়ে আসে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ। মায়ের মতো আগলে রাখে যে দেশমাতৃকা, তাকে রক্ষা করতেই এদেশের মানুষ অস্ত্র ধরেছিল, যুদ্ধ করেছিল। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ না হলে দেশমাতৃকার জন্য কেউ অস্ত্র হাতে নেয় না। বলা যায় এধরনের গান ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এটাই প্রতিয়মান হয়, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়েই এই ভূখণ্ডের মানুষ জান বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিল ও দেশ স্বাধীন করেছিল।
এরপর যে ছবিটি নিয়ে আলাপ করবো, সেটির মুক্তি ১৯৯৪ সালে, নাম ‘আগুনের পরশমণি’।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন বাংলাদেশের বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। এটি তার নিজের লেখা ‘আগুনের পরশমণি’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এবং এটিই তার পরিচালিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। ছবিটির টাইটেল নেওয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গান থেকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নোবেলজয়ী বাঙালি বিশ্বকবি, তার লেখা গানই বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। ‘সোনার বাংলা’র কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তো রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে এই গানটি নেওয়ার কারণ, ষাটের দশকে, মুক্তিযুদ্ধের আগে এদেশের মানুষ রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আন্দোলনের অনুপ্রেরণা নিয়েছে। আর এখানে আগুনের পরশমণি বলতে স্বাধীনতার কথা বোঝানো হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ গানটিকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। গানের প্রথম দুটি লাইন এমন: “আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।/ এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে”।
চলচ্চিত্রের শেষ অংশ, যেখানে একজন আহত মুক্তিযোদ্ধা মারা যাচ্ছেন, অথচ নতুন সূর্য উদিত হচ্ছে, স্বাধীনতার সূর্য। একদিকে আত্ম উৎসর্গ, অন্যদিকে, সম্মিলিত অর্জন। এই দৃশ্যের পেছনে বাজছে ওই গানটি। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভেতর দিয়ে অর্জিত পবিত্র স্বাধীনতা, এই বোধকে ফুটিয়ে তুলতে, দেখানো হলো একজন যোদ্ধা স্পর্শ করছে ভোরের সূর্যালোক, যেন আগুনের পরশমণি। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকা রবীন্দ্রনাথের গানটি পুরো ঘটনাটিকে নিয়ে যায় অন্য মাত্রায়।
এরপরের আলোচ্য ছবিটির নাম ‘মুক্তির গান’, প্রামাণ্যচিত্র, ১৯৯৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ চলচ্চিত্রটির পরিচালক। মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা লিয়ার লেভিন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণের অভিপ্রায়ে এদেশের একদল সাংস্কৃতিক কর্মীকে অনুসরণ করতে শুরু করেন। বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা নামের দলের এই সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের দেশাত্মবোধক ও সংগ্রামী গান শুনিয়ে উজ্জীবিত করতেন। এই শিল্পীদের সাথে থেকে লেভিন প্রায় ২০ ঘণ্টার ফুটেজ সংগ্রহ করেন। যুদ্ধের শেষ দিকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। আর্থিক কারণে তিনি প্রামাণ্যচিত্রটি শেষ করতে পারেননি।
মুক্তিযুদ্ধের দুই দশক পর, ১৯৯০ সালে তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ নিউইয়র্কে লেভিনের সংগৃহীত ফুটেজের সন্ধান পান। সেখান থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য তারা আরো বিভিন্ন উৎস থেকে মুক্তিযুদ্ধের নানা সংরক্ষিত উপাদান সংগ্রহ করেন, বিশ বছর আগের সেই শিল্পীদের সাথে যোগাযোগ করেন। লেভিনের কাছ থেকে প্রাপ্ত ফুটেজের সাথে সংগৃহীত অন্যান্য উপাদান যোগ করে নির্মাণ করেন ‘মুক্তির গান’।
এই প্রামাণ্যচিত্রে অনেকগুলো গান ব্যবহৃত হয়েছে, তবে উল্লেখযোগ্য গানটি হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আমার সোনার বাংলা’, এই গানটি পরে সর্বজনের মতের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়। গানটিতে বাংলাদেশকে মায়ের সাথে তুলনা করে বলছে: মায়ের মুখটা যদি মলিন হয়, তাহলে তার সন্তানের মনও আকুল হয়ে ওঠে। এদেশের মানুষ তার দেশকে মায়ের মতোই ভালোবাসে। বিভিন্ন রূপকের মধ্য দিয়ে দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসাই ফুটে উঠেছে এই গানে। আমরা তো জানি যে কোনো জাতীয়তাবাদী চেতনায় দেশ, মায়ের রূপ নিয়ে উপস্থিত হয়। মাকে রক্ষার প্রত্যয়ে সন্তানরা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে কুণ্ঠিত হয় না। এই প্রামাণ্যচিত্রেও তাই দেখানো হয়েছে, যখন ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া হচ্ছিল তখন মুক্তিযোদ্ধাদের চোখ জলে ভরে উঠছিল। কিন্তু সেই নয়নভরা জলে জ্বলছিল মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, জ্বলছিল প্রতিশোধের বহ্নি।
এই চলচ্চিত্রের বড় বৈশিষ্ট্য হলো, আমরা এখানে ১৯৭১ সালে ধারণকৃত ছবি দেখতে পাই। এই চলচ্চিত্রে শব্দ ধারণ করা হয়েছে ভিন্ন একটি যন্ত্রে, আর ছবি ধারণ করা হয়েছিল ১৬মি.মি. ক্যামেরায়। সেসময় আশ্রয় শিবির থেকে যুদ্ধের ময়দান পর্যন্ত যেভাবে সঙ্গীত প্রেরণা জোগাচ্ছিল, ঠিক একইভাবে যুদ্ধপরবর্তী সময়েও সঙ্গীত সমান অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য চলচ্চিত্রগুলোতে।
বাংলাদেশের জনগণের জন্য ইতিহাসের দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও ঐতিহ্যের দিক থেকে সঙ্গীত দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে এই দুই উপাদানের শৈল্পিক সংমিশ্রণ ঘটিয়ে দর্শকের মনকে উজ্জীবিত ও দেশপ্রেম দ্রবীভূত করার কাজটাই করেছেন চলচ্চিত্র নির্মাতারা।
(এই নিবন্ধটি সৌদি আরবের রিয়াদে ফিল্ম ক্রিটিসিজম কনফারেন্সের দ্বিতীয় আসরে উপস্থাপিত বক্তৃতার লিখিত রূপ। বক্তৃতাটি দেওয়া হয় ৯ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে।)