• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অন্য জীবনের খোঁজে মিলান কুন্দেরা


আলম খোরশেদ
প্রকাশিত: জুলাই ১৩, ২০২৩, ০২:৪২ পিএম
অন্য জীবনের খোঁজে মিলান কুন্দেরা

মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাসের শিরোনাম তিনি রেখেছিলেন Life is Elsewhere (1969) তথা ‘জীবন অন্যত্র’। সেই অন্য জীবনের সন্ধান পেয়ে তার উদ্দেশ্যে অগস্ত্যযাত্রার সূচনা করলেন তিনি, মিলান কুন্দেরা, এই মাত্র দুদিন আগে, চুরানব্বই বছর বয়সে। অবশ্য এর আগেও, ১৯৭৫ সালে, তাঁকে আরও একবার, রাষ্ট্রযন্ত্রের রক্তচক্ষুর কোপানলে পড়ে স্বদেশের মাটি ফেলে পাড়ি জমাতে হয়েছিল পারি অভিমুখে অন্য এক লেখকজীবনের সন্ধানে। 

 

সেইখানে প্রথমে ‘হাসি ও বিস্মরণের বই’ (The Book of Laughter and Forgetting, 1979) লিখে ভেবেছিলেন অতীতের সমস্ত বেদনা ও বিষাদের প্রশমন ঘটাবেন, কিন্তু হল তার উল্টো। তিনি ক্রমে অস্তিত্বের এমন এক অসহ্য লঘুত্ব, আক্ষরিক ও বাচনিক উভয়ার্থেই, অনুভব করতে লাগলেন যে তাঁকে এক পর্যায়ে আস্ত একটি উপন্যাস The Unbearable Lightness of Being (1984) লিখেই নিষ্কৃতি পেতে হয়েছিল সেই তুমুল ওজনহীনতার অনুভব থেকে। পরবর্তীকালে এর একটি দুর্দান্ত চলচ্চিত্ররূপও দেখেছি আমরা ফিলিপ কাউফম্যানের কুশলী পরিচালনায়। কালক্রমে এই বহুল আলোচিত গ্রন্থটির নাম ও পরিণামের সঙ্গে প্রায় সমার্থক হয়ে গিয়েছিল কুন্দেরার গোটা সাহিত্যিক অস্তিত্ব, যিনি এই বইয়েই উচ্চারণ করেছিলেন তাঁর সেই স্মরণীয় অমোঘ বাক্যখানি: The struggle of man against power is the struggle of memory against forgetting।
 

একাধারে কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক কুন্দেরা তাঁর এই নবতিপর জীবনে খুব বেশি যে লিখে যেতে পেরেছেন সেটা নয়: সাকুল্যে দশটি উপন্যাস, দশটি প্রবন্ধগ্রন্থ, পাঁচটি নাটক, তিনটি কবিতার বই ও দুটো গল্পগ্রন্থ, এই হল তাঁর সমগ্র রচনাবলির পরিমাণ। স্বভাবের দিক থেকেও তিনি ছিলেন প্রচারবিমুখ, নিভৃতচারী ও আত্মনিমগ্ন। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে কিংবা প্রচার মাধ্যমে মুখ দেখাতে উৎসাহী ছিলেন না আদৌ। কিন্তু তা সত্ত্বেও কী এক আশ্চর্য রসায়নে যেন বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত তাঁর বিশাল পাঠকসমাজ! তাঁর এই বিপুল জনপ্রিয়তা এবং তাঁর রচনার প্রতি পাঠকের নিঃশর্ত আনুগত্য সত্যি বিস্ময়কর। প্রতিবছর নোবেল পুরস্কার ঘোষণার সময় এলেই তাঁর সেই অনুগত পাঠকসমাজ যেভাবে এই একটি নাম উচ্চারিত হবার আশায় উৎকর্ণ হয়ে থাকে তা আসলেই তুলনারহিত। Slowness (1995) উপন্যাসখ্যাত মিলান কুন্দেরার এই ধীর জীবনের অবসানের সঙ্গে তাদের সেই অপেক্ষারও অবসান হবে ঠিক, কিন্তু তাদের হৃদমাঝারে তাঁর জন্য যে রাজ-আসন পাতা রয়েছে, সেটি নোবেলকমিটির যাবতীয় Ignorance (২০০০ সালে রচিত কুন্দেরার অপর একটি আলোচিত উপন্যাস ) কে উপেক্ষা করে আরও পাকাপোক্ত ও প্রতাপশালী হয়ে উঠবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আজ আপাতত এইটুকু বলেই, ত্রিশ বছর আগে নিউ ইয়র্কে বসে আমার লেখা তাঁর সুবিখ্যাত গদ্যগ্রন্থ The Art of Novel (1986) এর একটি তাৎক্ষণিক পাঠপ্রতিক্রিয়াকে পুনরুদ্ধৃত করে আমার এই সংক্ষিপ্ত মিলান কুন্দেরা শ্রদ্ধালেখর ইতি টানছি এখানে।
 

“চেক কথাসাহিত্যিক মিলান কুন্দেরার প্রবন্ধসংগ্রহ The Art of Novel বইখানি পড়া হল সম্প্রতি। এ যাবৎ কুন্দেরার মাত্র দুখানি উপন্যাস, The Unbearable Lightness of Being এবং Life is Elsewhere পড়ে উঠতে পেরেছি, তাঁর কোনো প্রবন্ধ পড়ার সুযোগ হয়নি অদ্যাবধি। উপন্যাস-বিষয়ে এ যুগের অন্যতম প্রধান একজন ঔপন্যাসিক কী ভাবেন সেটা জানার আগ্রহ ছিল তাই প্রবল।
 

প্রায় এক বৈঠকেই বইখানা পড়ে ওঠা গেছে। গ্রন্থে মোট রচনার সংখ্যা সাতটি। এর মধ্যে দুখানা দীর্ঘ কথোপকথন ও একটি অভিভাষণ। এছাড়া Sixty Three Words নামে একটি অভিনব রচনা রয়েছে যেখানে কুন্দেরা তাঁর রচনাবলিতে বহুল-ব্যবহৃত তেষট্টিটি শব্দ বেছে নিয়ে, তিনি তাদের যে-অর্থে ব্যবহার করেছেন তার সংজ্ঞা দেন। যেমন, Beauty, Betrayal, Being, Comic, Imagination, Lightness, Laughter, Value ও Vulgarity জাতীয় শব্দসমূহ সম্পর্কে কয়েক লাইনে কুন্দেরার নিজস্ব চিন্তার সন্ধান মেলে তাতে। বাকি তিনটি রচনা উপন্যাস-বিষয়ে তাঁর বিশ্বাস ও ভাবনার নির্যাস, শিরোনাম যথাক্রমে, The Depreciated Legacy of Cervantes; Notes Inspired by The Sleep Walkers এবং Somewhere Behind। প্রথম লেখাটি ইউরোপীয় উপন্যাস-বিষয়ে কুন্দেরার নিজস্ব মূল্যায়ন, যার মানদণ্ড হিসেবে তিনি ব্যবহার করেন দন কিহোতের জনক স্প্যানিশ লেখক সেরভান্তেসকে। দ্বিতীয় রচনাটি কুন্দেরার অন্যতম প্রিয় লেখক অস্ট্রিয়ার Herman Broch ও তাঁর মাস্টারপিস উপন্যাস The Sleep Walkers বিষয়ে, যার প্রভাব ও প্রেরণা তাঁর উপর প্রচণ্ড বলে তিনি নিজেই স্বীকার করেন। Somewhere Behind প্রবন্ধটির বিষয় তাঁর অপর এক শ্রদ্ধেয় লেখক স্বদেশী ফ্রানৎস কাফকা, যাকে তিনি আধুনিক ইউরোপীয় উপন্যাসের অন্যতম পথিকৃৎ বলে মনে করেন।
 

কুন্দেরার মতে, আধুনিক যুগের শুরু কেবল দেকার্ত থেকেই নয়, সেরভান্তেসও তার সমান অংশভাক্। হুসার্ল বা হাইডেগাররা যে Being এর বিশ্লেষণ করে গেছেন তাঁদের রচনাবলিতে এবং আধুনিক বিজ্ঞানে এই মানবমুখিতার ক্রমঅনুপস্থিতিতে যে-আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন, সেরভান্তেসের উপন্যাসে তারই বীজমন্ত্র যেন খুঁজে পান কুন্দেরা। আর Herman Broch এর মধ্যে তিনি দেখতে পান বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে সূচিত তথাকথিত ‘মডার্নিজম’ এর বিপরীতে আরেক শুদ্ধ আধুনিকতাকে, যা কেবল ভাঙচুরে বিশ্বাস করে না, বরং এক সামগ্রিকতায় জীবনকে ছুঁতে চায়, ইতিহাসের সব জটিলতা ও বিপন্নতাকে স্বীকার করে নিয়েও তাকে অতিক্রম করে যেতে চায়। আর কাফকাকে তো তিনি তার নিজের ঐতিহ্য বলেই মনে করেন। কারণ তাঁর মতে, কাফকাই প্রথম পরিবার, প্রতিষ্ঠান ও সমাজের নিজস্ব এক অনতিক্রম্য বিধানের দিকে আমাদের দৃষ্টি ফেরান, যাকে এড়ানোর কোনো উপায় থাকে না আধুনিক মানুষের। সেই যুক্তিহীন, ভিত্তিহীন নিয়ম কিংবা নিয়মহীনতার নির্মম জগতেই কুন্দেরা আবিষ্কার করেন আজকের বহুল আলোচিত ম্যাজিকাল রিয়েলিজমের প্রথম উদ্ভাস। কুন্দেরা নিজেকেও সেই কাফকা ঘরানার ম্যাজিক রিয়ালিস্ট বলেই দেখেন।
 

প্যারিস রিভিউ পত্রিকায় ক্রিস্টিয়ান সালমনকে দেওয়া সাক্ষাৎকার দুটোতে কুন্দেরা উপন্যাস বিষয়ে তাঁর এইসব মৌলিক পর্যবেক্ষণ ও ব্যাখ্যাকেই আরো বেশি বিশদ করে বর্ণনা করেন। বিশেষত তাঁর উপন্যাসের সংগঠন ও নির্মাণরীতি নিয়ে অনেক বিস্ময়কর তথ্য জানতে পারা যায় তাতে। ইউরোপীয় ধ্রুপদী সংগীতের কাঠামোকে আত্মস্থ করে তাঁর উপন্যাসের শরীর সংস্থানের কথা তিনি সোৎসাহে জানান। এছাড়া দর্শনশাস্ত্র ও মার্কসবাদ বিষয়ে তাঁর প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য ও মৌলিক ব্যাখ্যান কুন্দেরার মনোজগতকে বুঝতে সাহায্য করে অনেকখানি। এই বইয়ে আরো পাওয়া যায় ইউরোপীয় আধুনিক অনেক ঔপন্যাসিক যেমন হাসেক, ম্যুসিল, গম্ব্রোভিচ, জয়েস, টমাসমান, দস্তয়েভস্কি সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব মূল্যায়ন এবং রাবেলে, দিদেরো, লরেন্স স্টার্ন, প্রুস্ত, বালজাক, তলস্তয়ের মতো আদিগুরুদের নিয়ে তাঁর মৌলিক উচ্চারণসমূহ। গ্রন্থটি পাঠ করে বোঝা যায় কুন্দেরা উপন্যাস রচনাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সামাজিক কর্মকাণ্ড হিসেবেই গ্রহণ করেন। সে-কারণে তাঁর রচনার সংখ্যা হয়তো বেশি নয়, কিন্তু গুরুত্ব ও অভিঘাতের দিক থেকে সেগুলোর মূল্য অপরিসীম। বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ঔপন্যাসিক মিলান কুন্দেরার মনোবিশ্বের সন্ধান পাবার জন্য এই বইটি পাঠ তাই জরুরি বলে প্রতীয়মান হয়।” (১৯৯৩)
 

অন্তিম অভিবাদন লেখকদের লেখক, মহান মিলান কুন্দেরা আপনাকে। আপনার এই নতুন জীবনের ভার কিংবা ভারহীনতাটুকু সহনীয় হয়ে উঠুক, এমন প্রার্থনা ও প্রত্যাশা আমাদের সকলের।

 

Link copied!