ভারতের বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা অতনু ঘোষ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি সিনেমার গল্পের ভার দর্শকের হাতে ছেড়ে দেন। দর্শক যেভাবে ভাবতে চায়, সেটাই গল্প! মাহরীন ফেরদৌস তার এবার প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘হয়তো বলে কিছু আছে’ সেই ভাবনাতেই উৎসারিত হয়তো। আমরা খালি চোখে যা দেখি, সাধারণ ভাবে যা ভাবি, তার বাইরেও অনেক কিছু হতে পারে, সেই হতে পারতো থেকেই এই গল্প গুলোর ভিত্তি।
দীপেশ চক্রবর্তী সেদিন বললেন ঢাকায় এসে, ‘হতে পারতো ইতিহাসও একটা গবেষণার ব্যাপার। যা হয়েছে তা তো হয়েছেই। দীপেশ চক্রবর্তী ধারণা করেছেন, দেশভাগ না হলে বাংলাটা হয়তো আরেক রকম হতো। পরস্পরকে জানা বোঝার আরও কিছু ক্ষেত্র তৈরি হতো।’ মাহরীন ফেরদৌস হতে পারতো ইতিহাসকে দেখেছেন, ব্যক্তি বিশেষের পার্সপেক্টিভে। তার গল্পের চরিত্রগুলো কেমন যেন ঘোরগ্রস্ত। জীবনে যেমন হচ্ছে সেটার সঙ্গে মানিয়ে চলতে গিয়ে আরেকটা অপরবাস্তবে নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করছে ক্রমাগত।
মাহরীন ফেরদৌসের নির্মিত গল্পগুলো আধুনিক, সেখানে স্বতঃস্ফূর্ত ভাষা শক্তিতে পূর্ণ। গল্পগুলোর ভেতরে একই সঙ্গে বসবাস করছে ভয়, দ্বিধা, অপরাধ, প্রেম ভুল ও প্রায়শ্চিত্ত। যেন মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে যাওয়া পৃথিবীর দমকা বাতাস এসে বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে একদল মানুষকে। এই বিভ্রম ও বিভ্রান্তি নিয়েই লড়াইটা করতে হচ্ছে সবার। মাহরীন ফেরদৌসের গল্পগুলোর যে ব্যাপারটা আমার প্রিয়, সেটা হলো হঠাৎই চেনা মানুষদের বদলে যাওয়ার পরিণতি। কীভাবে সব ছেড়েছুড়ে মানুষ না চাইতেই বিপন্নতায় আশ্রয় নেয় সেই বয়ানগুলো অসাধারণ। বিপন্নতা থেকে বিস্মৃতির ভেতরে আবারও স্মৃতিতে ফেরা মানুষের যে মুন্সীয়ানা সেটা তার গল্পে প্রতীয়মান বারবার।
বারোটা গল্পে ঋদ্ধ বইটি। কিছু কিছু গল্প এত অসাধারণ। যেমন, ‘তাহের ফিরে এসেছিল’, ‘স্মৃতিচিহ্ন’, ‘অবিকল’, ‘চৈতালি সন্ধ্যায় সামরিন’। কয়েকটা গল্প আবার হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যায়। মনে হচ্ছিল আরেকটু পড়ি। কিন্তু গল্প নিয়ে সিদ্ধান্তের ভার পাঠকের হাতেই তুলে দেওয়া। মাহরীন ফেরদৌসের গদ্য স্বচ্ছ জলের মতোই। কোনো ভণিতা ছাড়াই তিনি কঠিন সম্পর্কের টানাপোড়নকে সহজভাবে ঢেলে সাজান। পাঠককে তিনি পরীক্ষায় ফেলতে চান না কিন্তু ঘটনার পরম্পরায় নাড়া দেন দক্ষ হাতেই। এক যুগের বেশী সময় ধরে লিখতে লিখতে তিনি বুঝে গিয়েছেন, কিভাবে পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধের মত টেনে নিয়ে যেতে হয়। অনেক লোকই বলে, যদির কথা নদীতে ফেল। কিন্তু সেই হতে পারতো/ যদি কিন্তুকে মাথায় রেখে তার চরিত্রগুলো এক চোখে দেখে অতীত তো অন্য চোখে দেখে ভবিষ্যৎ। জড়বস্তুরও যে প্রাণ আছে সে কথা লেখা থাকে দেওয়ালে দেওয়ালে। আর সেই ‘হয়তো’ তেই ভর করেই অনেক মিলনাত্মক গল্প পরিণতি পায় শ্যাওলা ও শূন্যতার আঁশটে গন্ধে।
বইয়ের নাম : হয়তো বলে কিছু আছে
লেখক : মাহরীন ফেরদৌস
প্রকাশনার নাম : কথা
মূল্য : ২৫০ টাকা