গুরু দত্ত `পিয়াসা` ছবিটা দিলীপ কুমারকে করতে বলেছিলেন। দিলীপ কুমার মানা করে দেন। তখন তার ‘দেবদাস’ করার পর মনে হয়েছিল, মাতালের রোল আর কত করবো! তারপর যখন পিয়াসা এরকম একটা দশকের সেরা ছবি ভাইব আনলো, তখন তিনি গুরু দত্তকে ধরলেন। গুরু দত্তকে বললেন, ‘আপনার চরিত্রটা যে এত অন্যরকম আগে বলেননি কেন।’ গুরু দত্ত হাসি দিয়ে নাকি জানালেন, ‘আমিও কি জানতাম ছবিটা এরকম বানাবো। জানলে তো আপনাকে বলতামই।’
ছোট বেলা থেকেই দিলীপ কুমার সাহেব সায়রা বানুর ক্রাশ। সায়রা বানু সিনেমা করতে এসে রাজেন্দ্র কুমার, সুনীল দত্ত, জয় চ্যাটার্জি—এদের সঙ্গে কাজ করতেন। শোনা যায় রাজেন্দ্র কুমারের সঙ্গে তার প্রেমও ছিল। এই প্রেম নিয়ে সায়রা বানুর মা অস্বস্তিতে ছিলেন। তখন দিলীপ কুমারকে আত্মীয়ের মাধ্যমে বিয়ের প্রস্তাব দেন। সায়রা বানুও রাজি হন। বিয়ের পরে সায়রার এক ছবিতে নায়ক চেঞ্জ হলে দিলীপ কুমার কাজটা করে দেন। সিনেমার নাম সম্ভবত, গোপী।
দিলীপ কুমার অভিনয় নিয়ে খুব ভাবতেন। সেই আমলেই তিনি দেখতে চাইতেন তার চরিত্রটা কেমন। একই ধরনের রোল তিনি কখনোই করতেন না। মেথড এক্টিংয়েই ছিল তার ভরসা। নাসিরুদ্দিন শাহের মত অভিনেতা বলতেন, ‘দিলীপ কুমারের সাকসেস পরবর্তী জেনারেশনের অনেককে মোটিভেট করতো যে, শুধু অভিনয় দিয়েও বলিউডে সুপারস্টার হওয়া যায়।’ মোঘল-এ-আজম ছবির বিপুল সাফল্যের পর এ ধরনের সিনেমা করার জন্য অনেক প্রযোজক-পরিচালক তার কাছে আসতেন টাকা নিয়ে। তিনি রাজি হতেন না। বিমল রায়ের মতো পরিচালকের মূল্য তিনি বুঝতেন। এমনকি ঋত্বিক ঘটককেও তিনি পছন্দ করতেন। কমল হাসান বলেছিল সুন্দর কথা, ‘আমার হিন্দি ছবির মুগ্ধতার জন্য দায় দিলীপ কুমারের। যদি দিলীপ কুমারের ছবি না দেখতাম কখনোই মাদ্রাজ থেকে বোম্বে আসা হতো না।’
বয়স কালেও দিলীপ কুমারের কিছু অভিনয় মনে রাখার মতো। যেমন ‘মশাল’ সিনেমায়, তার স্ত্রী মারা যাচ্ছেন, ডাক্তার নেই, উনি পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছেন; ঢিল মারছেন মানুষের জানলায়—কেউ আসুক। নিরাপদ তন্দ্রা ফেলে কেউ আসছে না। কিংবা অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে ওনার একটা ছবি আছে, নাম মনে হয় ‘শক্তি’। চিরাচরিত বাবা-ছেলের যুদ্ধ। সেখানে দিলীপ কুমারের অভিনয় অমিতাভের চেয়ে ভালো।
দিলীপ কুমারের যে গুণটা বলিউড তারকা, এমনকি বাংলাদেশের তারকারা শিখতে পারেন—তিনি খুব পরিমিতিবোধের মানুষ। মাথা ঠান্ডা রাখতেন। অযথা উত্তেজিত হওয়া, কিংবা মিডিয়া অ্যাটেনশনের জন্য কিছু বলা, এসব কখনোই করতেন না। কথা বলতেন, শান্ত ভাবে। যখন হিন্দিতে প্রশ্ন, তখন হিন্দিতে উত্তর, যখন উর্দুতে প্রশ্ন, তখন চোস্ত উর্দুতে উত্তর, ইংরেজি হলে ইংরেজি। সবাই বলতো, উনি মাই ডিয়ার এক লোক। তিনি যে সুপারস্টার, সেটা কখনোই বলতেন না কোথাও। তার বিবাহবার্ষিকীর এক ভিডিও আছে ইউটিউবে। দেখবেন এখনকার বলিউডের মত ফেইক হাসাহাসি নেই। কি ওয়েলকামিং আর আড্ডা মুখর পরিবেশ। করোনা কড়াকড়ির কারণে ওনার দেহত্যাগের খবর পেয়ে কারো আসার তেমন সুযোগ ছিল না। এক মহিলা এসেছিল, অতি সাধারণ, পুরোটা পথ হেঁটে হেঁটে কাঁদছিলেন। সে কি কান্না! এরকম ভালোবাসার জন্যই তো মানুষ সৃষ্টিশীল কাজ করে।
হুমায়ুন ফরিদী শৈশবে যেদিন প্রথম দিলীপ কুমারের সিনেমা দেখেছিলেন, তিনি মুগ্ধ। রাতে চিন্তা করেছিলেন, পর্দায় এরাই তো ঈশ্বর। কোনোদিন যে তিনি একটা দেশের শীর্ষস্থানীয় অভিনেতা হবেন, সেই স্বপ্ন বপন হয়েছিল দিলীপ কুমারকে দেখেই। জন্ম শতবর্ষে পেরিয়ে তাই আসছে শতকেও এই মহানায়ককে মনে রাখতে হবে।