লতা মঙ্গেশকর নিয়ে সব চেয়ে সুন্দর কথাটা শুনেছিলাম বিখ্যাত গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার জাভেদ আখতারের মুখে। জাভেদ আখতার বলেছিলেন, ‘মাইকেল এঞ্জেলো মানেই যেমন চিত্রকলা, শেক্সপিয়র মানেই যেমন ইংরেজি সাহিত্য, তেমনি ভারতীয় সিনেমার গান মানেই লতা মঙ্গেশকর।’ লতা মঙ্গেশকরের জন্য আমার বারবার মনে পড়ে কবীর সুমনের গান, ‘তোমার তুলনা আমি খুঁজি না কখনো, বহু ব্যবহার করা কোনো উপমায়।’ আসলেই তো, লতা মঙ্গেশকরকে আপনি কোন উপমায় ডাকলে তাকে সফল ভাবে চিত্রায়ন করা যাবে। ভারতের লোকজন তার নাম দিয়েছেন, “নাইটএঙ্গেল অফ ইন্ডিয়া’। সেটাও মনে হয় না যথেষ্ট।
পিতা দীনানাথ মঙ্গেশকর পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। মারাঠি থিয়েটারের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি ও ক্লাসিক্যাল গাইতেন। গান শেখাতেন। তো একদিন দেখেন তার বাচ্চা মেয়েই এক গানের শিক্ষার্থীর ভুল ধরিয়ে দিচ্ছেন। তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে শুনে অবাক। লতা মঙ্গেশকরের বাবা তার মাকে বলেছিলেন, ‘ঘরে আলো ফেলে আমি অন্যের ঘরে বাতি দিচ্ছি।’ পরের দিন থেকেই লতাকে গান শেখানো শুরু করেন। শৈশবে বাড়িতে থাকাকালীন কে এল সায়গল ছাড়া আর কিছু গাইবার অনুমতি ছিল না তাঁর। বাবা চাইতেন, ‘ও শুধু ধ্রপদি গান নিয়েই থাকুক।’
জীবনে প্রথম রেডিও কেনার সামর্থ্য যখন হলো, তখন তার বয়স আঠারো। কিন্তু রেডিওটা কেনার পর নব ঘোরাতেই প্রথম যে খবরটি তাকে শুনতে হয় তা হচ্ছে, কে এল সায়গল আর বেঁচে নেই। সঙ্গে সঙ্গেই রেডিওটা ফেরত দিয়ে দেন তিনি। লতা মঙ্গেশকরের নাম ছিল হেমা। কিন্তু মৃত বড়বোনের নাম লতিকা হওয়ায় তার নাম হয়ে যায় লতা। মাত্র বারো তেরো বছর বয়সেই বাবাকে হারান। তিনি গান শেখা ছাড়েননি। এক নাটকের কোম্পানিতে গাইতেন। ‘কিটি হাসাল’ নামের এক মারাঠি সিনেমায় তার প্লেব্যাক ক্যারিয়ার শুরু। ওস্তাদ আমান আলী খানের কাছে ক্লাসিক্যাল শিখতেন। সেই এতটুকু বয়সেই তার স্কুল ছেড়ে দিতে হয়েছে। কারণ বোন আশাকে নিয়ে বের হতে হয়। স্কুল প্রশাসন এ অনুরোধ মানতে নারাজ। সেই সময়টা কে এল সায়গল, শামশাদ বেগম ও নুরজাহানদের যুগ। তাই প্রাথমিকভাবে লতা মঙ্গেশকরকে শুনতে হয়েছিল, যে তার কণ্ঠস্বর একটু বেশিই পাতলা। তাকে প্রথম সুযোগ দেন মাস্টার গুলাম হায়দার। তার পরেই আসে ‘মহল’-এর সেই বিখ্যাত গান ‘আয়েগা আনেওয়ালা’। ওই ছবিটি ১৬ বছরের মধুবালা ও ২০ বছরের লতা, দুজনের কাছেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। নায়িকা ও গায়িকার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে ওই ছবি থেকে। যে কণ্ঠস্বরকে একদিন যথেষ্ট ভারী নয় বলে অভিহিত করেছিল বলিউড, পরবর্তীকালে সেই কণ্ঠস্বরই হয়ে ওঠে বলিউডের গোল্ডেন ভয়েস।
যতীন মিশ্রর বই ‘লতা সুর গাথা’তে লতাজি বলেছেন, “প্রায়ই রেকর্ডিং করতে করতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। ভীষণ খিদে পেত। তখন রেকর্ডিং স্টুডিওতে ক্যান্টিন থাকতো, তবে নানা রকম খাবার পাওয়া যেত কি না? সে বিষয়ে আমার মনে নেই। তবে চা-বিস্কুট খুঁজে পাওয়া যেত তা বেশ মনে আছে। সারাদিনে এক কাপ চা আর দু চারটে বিস্কুট খেয়েই কেটে যেত। এমনও দিন গেছে যে দিন শুধু জল খেয়ে সারাদিন রেকর্ডিং করছি, কাজের ফাঁকে মনেই আসেনি যে ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খাবার খেয়ে আসতে পারি। সারাক্ষণ মাথায় এটাই ঘুরতো যেভাবে হোক নিজের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে আমাকে।”
বলিউডে লতা মঙ্গেশকরকে নিজের ছোট বোনের মত দেখতেন নায়ক দিলীপ কুমার। আবার লতাও দিলীপ কুমারকে সব থেকে কাছের মানুষ মনে করতেন ইন্ডাস্ট্রিতে। একবার দিলীপ কুমার লতার ওপর খুব রেগে গিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে লন্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে লতা নিজের প্রথম প্রোগ্রাম করছিলেন, যেখানে অনুষ্ঠান শুরু করার জন্য দিলীপ কুমারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। দিলীপ কুমার নিজের কাজ ভীষণ মন দিয়ে করতেন এবং ছোট ছোট বিষয়ে খুব গুরুত্ব দিতেন। পাকিজা ছবির ‘ইনহি লোগো নে লে লি দুপাট্টা মেরা’ গানটি দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করতে নিমরাজি ছিলেন দিলীপ কুমার। লতাজিকে দিলীপ কুমার প্রশ্ন করেছিলেন, “অনুষ্ঠানের শুরুতেই এই গানটি কেন করতে চাইছেন আপনি?” লতা তখন দিলীপ কুমারকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন যে, এই গানটি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি গান এবং মানুষ এটি শুনতে চাইছেন। কিন্তু তখন দিলীপ কুমারকে কোনভাবেই বোঝানো যায়নি। তিনি ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন।
যতীন্দ্র মিশ্রর বইয়ে লতা আরও বলেছেন, তাকে ভেবে ‘সত্যম শিবম সুন্দরমের’ চিত্রনাট্য লিখেছিলেন রাজ কাপুর। ‘অনেক আগে উনি চেয়েছিলেন মুখ্য ভূমিকায় আমি অভিনয় করি। ইচ্ছে না থাকায় আমি না করে দিয়েছিলাম ওই প্রস্তাবে। যদি ছবি তৈরিতে কোনো বাধা হয়নি। অনেক পরে ৮০’র দশকে যখন আবার ছবিটি বানাবার কথা ভাবেন তখন জিনাত আমানকে নেন ছবিতে।”
দশকের পর দশক টানা সিনেমায় প্লেব্যাক করা কতটা ডিসিপ্লিন আর পরিশ্রমের ব্যাপার সেটা এ যুগের লোকজন কল্পনাই করতে পারবে না। এর ভেতরেই তিনি পড়াশোনাও করতেন। যখন শরৎচন্দ্রের উপন্যাস থেকে সিনেমা হবে তিনি হিন্দি অনুবাদ পড়ে নিতেন। বলিউডের সে সময় দিকে উর্দু হিন্দির শুদ্ধ উচ্চারণের ব্যাপার ছিল। কারণ সব বড় বড় উর্দু হিন্দি কবিরা সিনেমায় গান লিখতেন। কিছুটা মারাঠি টান হিন্দিতে থাকার জন্য কেউ কেউ ওনার সমালোচনা করতেন। এইজন্য তিনি গৃহশিক্ষক রেখে হিন্দি আর উর্দু পাকাপাকি ভাবে শিখে ফেলেন। লতা মঙ্গেশকরের এসব নিষ্ঠার গল্প অনেক। তিনটা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার পেয়েছেন। দ্বিতীয় সংগীত শিল্পী হিসেবে ভারতরত্ন পেয়েছেন। যেসব পুরষ্কার লোকজন পায় দেরিতে, উনি পেয়ে গেছেন আগেভাগেই।
ভারত সরকার ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ তারিখে তাকে ‘ডটার অব দ্য নেশন’ খেতাবে ভূষিত করেন। সব চেয়ে বড় পুরষ্কার তো জনগণের অকুণ্ঠ ভালোবাসা। ভারতের বিভিন্ন প্রজন্মের পার্থক্য থাকবে কিন্তু মিল একটাই সব প্রজন্মের প্রিয় শিল্প লতা মঙ্গেশকর।
তবুও লতা মঙ্গেশকর আমাদের দূরের মানুষই থাকতেন যদি না তিনি বাংলা গান গাইতেন। তিনি ৩৬ ভাষাতে গান গেয়েছেন বলে শোনা যায়। তার ভেতরে বাংলার স্থান নিঃসন্দেহে শীর্ষে। আমাদের মা খালাদের কণ্ঠে যেসব গান শুনে আমরা বড় হয়েছি, এর ভেতরে বেশির ভাগ গানই সন্ধ্যা আর লতার। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাওয়ান কি দুর্দান্ত সেই গান, ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’। এরপর ভূপেন হাজারিকা তাকে দিয়ে গাওয়ান, ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে’। যে গান শুনলে এতদিন পর এখনও মন ভরে ওঠে। এরপর সলিল চৌধুরী, সুধীন দাশগুপ্ত হেমন্তের সুরে গান অগণিত হিট গান। স্বীকৃতি হিসেবে ১৫ বার বেঙ্গল ফিল্ম সাংবাদিক অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। ‘নিঝুম সন্ধ্যায়’, ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘যা রে উড়ে যারে পাখি’, ‘বলছি তোমার কানে’ আরও অজস্র যে গান এসব ছাড়া বাংলা ছবির গান কল্পনা করা যায় না।
এত কথা বলার কারণ আজ তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। নব্বই পার হয়ে তিরানব্বইতে তিনি চলে গেলেন। বিখ্যাত ক্রিকেটার টেন্ডুলকার বলেছিলেন, “লতা মঙ্গেশকর আমাকে অনুপ্রাণিত করে সবসময়, একটা মানুষ সাফল্যের চূড়ায় বসেও কিভাবে এত বিনয়ী হয় এটা আমি শিখেছি লতাজির থেকে। কাজের প্রতি যে আত্মনিবেদন এটা বিশ্বের যে কেউ শিখতে পারে ওনার থেকে।”
প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। লতা মঙ্গেশকর থেকে যাবেন প্রাসঙ্গিক আরও অনেকদিন।