করোনা এবং বার্ধক্যজনিত নানান রোগে ভুগে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, কামাল লোহানী চলে গিয়েছিলেন আজকের এই দিনে, ২০২০ সালে। দীর্ঘদিন তিনি এ পৃথিবীর আলো হাওয়ায় ছিলেন। ৮৬ বছর তো কম সময় নয়। বার্ধক্যজনিত জড়তা তার আসেনি। স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর, কথা বলতে পারতেন, হাঁটাচলাও করতেন, নানান অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতেন, সভা পরিচালনা করতেন। কিন্তু এভাবে তিনি চলে যাবেন, তা কেউ ভাবেনি। তখন সিএমএইচের একটা ব্যবস্থা করা গেলে হয়তো তিনি বেঁচে যেতেন। করোনা দুর্যোগে সবকিছুই ছিল এত কঠিন।
তিনি ছিলেন এ অঞ্চলের বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তি। কী করেননি তিনি এক জীবনে—সাংবাদিকতা, রাজনীতি, নৃত্যশিল্পী, সংগঠনের নেতৃত্ব সবকিছুই। অন্তত দুটো বড় বড় সংগঠন তার হাতে গড়া। ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী ও ছায়ানট। তিনি ছিলেন ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক। যখন রবীন্দ্রনাথের গান পাকিস্তানের খড়গে পড়ল তিনি তখন জেলায় জেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তুলে ধরলেন। গণসংগীত আর গণনাট্য ছিল তার আরও দুটো প্রিয় কাজের জায়গা। তিনি বক্তব্য দিতেন, অনুষ্ঠানে ধারাভাষ্য দিতেন, আবৃত্তি করতেন। জীবনের শেষ দিকে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকও হয়েছিলেন।
তার সব কর্মকাণ্ড একটা কাজের তুলনায় কিছুই না, সে কাজটা হলো তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে বার্তা সম্পাদক। তার কণ্ঠেই এই জাতি শোনে, বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন ও আমরা বিজয়ী। স্বাধীন বাংলা বেতারে তিনি রাত-দিন কাজ করতেন। থাকার জায়গা ছিল না, অফিসেই শুয়ে থাকতেন। স্বাধীন বাংলা বেতারের এত উৎকর্ষ সম্ভব হয়েছিল তাদের মতো মানুষদের অংশগ্রহণে। তিনি ছিলেন ভাষাসংগ্রামীও। ট্রেড ইউনিয়ন, সাংবাদিক ইউনিয়ন ও গ্রুপ থিয়েটারেও তার ছিল সক্রিয় নেতৃত্ব। কামাল লোহানী কেন কামাল লোহানী হয়েছেন? কারণ, তিনি কলেজ জীবনে নুরুল আমিনের মতো দোর্দণ্ড প্রতাপের মুখ্যমন্ত্রীকে জেলায় ঢুকতে দেননি, সভা পণ্ড করেছেন।
প্রতিটা আন্দোলনে ছিল তার অংশগ্রহণ। পাকিস্তান আমলে কয়েকবার তিনি কারাবরণ করেন। ভাষা আন্দোলন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা আদায় সংগ্রাম, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান সবকিছুতেই তিনি ছিলেন অগ্রগামী। দৈনিক মিল্লাত দিয়ে তার সাংবাদিকতা শুরু। পূর্বদেশ, সংবাদ, বাংলার বাণী অসংখ্য সংবাদপত্রে ছিলেন নির্ভীক সাংবাদিক। নিজে ন্যাপ করলেও তিনি আওয়ামী লীগের অনেক কাজে জড়িত হতে দ্বিধাবোধ করতেন না। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বিকশিত হয় তার হাত থেকেই। এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিতেও ছিলেন নেতৃত্বে। তিনি ভাবতেন, রাজনৈতিক সচেতনতা ছাড়া সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রাণ পায় না। সারাটা জীবন এর সাধনায় ব্যয় করেছেন। গণমানুষ যেন সাংস্কৃতিকচর্চার মাধ্যমে উন্নত ও মননশীল হয় এর জন্য এক জীবনে যা করতে পারে মানুষ, এর থেকেও বেশি কাজ করেছেন। যত দিন থাকবে এই বাংলাদেশ, তত দিন তিনি স্মরণের টানে ফিরে ফিরে আসবেন আমাদের মাঝে।