পথে পথে দিলাম ছড়াইয়ারে
সেই দুঃখে চোখের পানি।
ও-ও আমার চক্ষু নাই...
‘সূর্যস্নান’ ছবির এই প্লেব্যাক কণ্ঠটি যিনি একবার শুনেছেন, তার পক্ষে ভুলে যাওয়া কঠিন। এম এ তাহের সম্পাদিত ‘কলিম শরাফীর অ্যালবাম’-এর জন্য তাঁর “প্রিয় বান্ধব” শিরোনামের এক মন্তব্যে লিখেছেন-
‘কলিমের সাথে আমার বহু দিনের পরিচয়।... কলিম ছিল শুভদার স্কুল দক্ষিণীর ছাত্র এবং শুভদার অত্যন্ত প্রিয় পাত্র। ওর সুন্দর স্বভাব ও ব্যবহার, এত ভালো গলা এবং ও এত ভালো গাইত যে সব মিলিয়ে আমাদের সবার কাছেই সে খুব প্রিয় ছিল।’
শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ১৯৫৮-৫৯ এর একটা অনুষ্ঠানের স্মৃতিচারণায় কলিম শরাফীর গায়ন প্রসঙ্গে লিখেছেন : ‘যতক্ষণ তিনি গাইলেন আমরা মোহাবিষ্টের মতো বসে রইলাম।’
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী লিখেছেন—
‘প্রথম থেকেই আমি কলিম শরাফীকে চিনেছি এক ঈশ্বরদত্ত কণ্ঠের অনন্য শিল্পী পরিচয়ে, যে কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের অমর সৃষ্টি গানের কথা এক অনির্বচনীয় দ্যোতনা নিয়ে আমার কানের ভিতর দিয়ে মর্মে প্রবেশ করে। আমি জানি এই অভিজ্ঞতা আমার একার নয়, আমার মতো অসংখ্য শ্রোতার।’
এমন সুবর্ণ কণ্ঠের শিল্পীর পক্ষে যেটি স্বাভাবিক ছিল—‘গানে ভুবন ভরিয়ে’ দেওয়া। সেটি তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। সম্ভব হয়নি বললে ভুল হবে; সেটি তাঁকে করতে দেওয়া হয়নি। কেন দেওয়া হয়নি, সে ইতিহাসে যাওয়ার আগে একটু পেছন দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক।
বর্ণাঢ্য অথচ ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবনের পথিক কলিম শরাফী জন্মেছিলেন ১৯২৪ সালের ৮ মে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার খয়রাদিহি গ্রামে। পীর বংশের সন্তান কলিম শরাফীর পুরো নাম মুখদুমজাদা শাহ সৈয়দ কলিম আহমেদ শরাফী। পিতা মুখদুমজাদা শাহ সৈয়দ সামি আহমেদ শরাফী। মায়ের নাম বেগম আলিয়া।
মাত্র চার কি পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারিয়ে কলিম শরাফী নানির কাছে প্রতিপালিত হন। মায়ের স্মৃতি ভুলতে পারেননি বলেই হয়তো পরবর্তীকালে আপন কন্যার নাম রেখেছেন আলেয়া শরাফী।
শৈশব থেকেই কলিম শরাফীর গানের গলা অসম্ভব সুন্দর। শ্রোতারা মুগ্ধ হতো তাঁর গান শুনে। গান শিখতেন রেডিও আর গ্রামোফোন থেকে। গাইতেন স্বদেশি গান, নজরুলের গান, রবীন্দ্রনাথের গান।
১৯৪০ সালের ৩ জুলাই কলকাতায় নেতাজি সুভাষ বসুর নেতৃত্বে হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের জন্য আন্দোলন শুরু হয়। কলিম শরাফী তখন ১৬ বছরের স্কুলছাত্র। সেই আন্দোলনের এক মিছিলে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি পুলিশের হাতে নিগৃহীত হন। লড়াই-সংগ্রামের সঙ্গে তাঁর সেটাই প্রথম পরিচয়।
১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন শুরু হয়। কলিম শরাফী তখন স্পর্ধিত আঠারোয়। নিজ এলাকায় আন্দোলনের পক্ষে এক সভায় সভাপতিত্ব করার কয়েক দিন পর ‘ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট’-এর বলে তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। কারাগারেই তাঁর পরিচয় ঘটে কারাবন্দী বামপন্থী নেতাদের সঙ্গে। সেখানেই তাঁর মার্ক্সবাদের প্রথম হাতেখড়ি। আর পরিচয় হয় সমবয়সী প্রণব গুহঠাকুরতার সঙ্গে। তার কাছেই প্রথম রবীন্দ্রসংগীত শেখা।
১৯৪৩-এ কারামুক্তির পর কলিম শরাফী বীরভূম জেলা ছাত্র ফেডারেশনের সেক্রেটারির দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। সে সময়ই ব্রিটিশদের চক্রান্তে বাংলায় মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষ হয় যা ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫০) নামে খ্যাত। এ সময় কলকাতার প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী ও রাজনৈতিক কর্মী বিনয় রায়ের নেতৃত্বে গড়ে উঠে “বেঙ্গল কালচারাল স্কোয়াড”। উদ্দেশ্য গান-নাটক ইত্যাদির মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা এবং দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে সহায়তা করা। কলিম শরাফীর ভাষায়, “জমায়েত হয়ে গেল সব বড়ো বড়ো শিল্পীদের। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, বিনয় রায় এঁরা সব ছিলেন। বাইরে থেকে জর্জদা (দেবব্রত বিশ্বাস), হেমন্তদা, এরা সব আসতেন। দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে গান গাওয়া, ভিক্ষা চাওয়া, নাটক করা, লঙ্গরখানা এসব করতাম।”
(সূত্র: কুররাতুল-আইন-তাহমিনা: কলিম শরাফীর গান, গানের কলিম শরাফী)
১৯৪৩-এর মে মাসে CPI এর সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট হিসেবে মুম্বাইয়ে IPTA i জন্ম হয়। এর পরপরই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আইপিটিএর শাখা গঠিত হয়। ১৯৪৪ সালে কলিম শরাফী আইপিটিতে যোগ দেন এবং কলকাতার হাজারা পার্কে হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতার সামনে তিনি প্রথম গণসংগীত পরিবেশন করেন। এরপর আত্মীয়স্বজনের অনুরোধে ভর্তি হলেন ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুলে। কিন্তু বছর না ঘুরতেই সেটা ছেড়ে দিলেন রাজনীতির টানে।
১৯৪৬ সালে কলকাতায় স্মরণকালের ভয়াবহতম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়, যা ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’নামে পরিচিত। এ বিষয়ে কলিম শরাফীর স্মৃতিচারণা: “... ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় একটি কলঙ্কিত অধ্যায় হচ্ছে সোহরাওয়ার্দীর ১৬ আগস্ট ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’। আগের দিন সন্ধ্যায় রামরাজতলা গেলাম বীণাদির বাসায়। উদ্দেশ্য ছিল পরদিন গড়ের মাঠে যাব ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র বক্তৃতা শুনতে। কিন্তু সেখান থেকে আর বের হওয়া হলো না। খবর এলো, হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। অসংখ্য লোক মারা গেছে। দিদি আমার কথা ভেবে আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। সন্ধ্যায় বন্ধুরা খোঁজ করতে এলেও দিদি তাদের বলে দিলেন কলিম চলে গেছে। পরদিন ভোরেই ধুতি পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে পড়লাম। ভাবলাম সুচিত্রাদির বাসায় যাব। কিন্তু পথে সমরেশ রায় যে খবর দিল তাতে করে সেখান থেকে সোজা জর্জদা মানে দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। দেখি শম্ভুদা, বৌদি (তৃপ্তি মিত্র) ও জর্জদা। আমাকে দেখেই জর্জদা চিৎকার করে উঠলেন—‘শালা বাইচা আছে।’ তাড়াতাড়ি একটা খাটের নিচে আমাকে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। এভাবেই বন্ধ ঘরের খাটের নিচে লুকিয়ে কেটে গেল সপ্তাহখানেক। তারপর একদিন জর্জদা মুসলিম এলাকা পার্ক সার্কাস পর্যন্ত আমাকে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল।”
আইপিটিএর গণসংগীতচর্চা ও অন্যান্য কাজকর্মের পাশাপাশি কলিম শরফী রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষার জন্য ১৯৪৭ সালে শুভ গুহঠাকুরতা প্রতিষ্ঠিত সংগীত শিক্ষায়তন ‘দক্ষিণী’তে যোগ দেন।
২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সিপিআইয়ের দ্বিতীয় কংগ্রেসে সাধারণ সম্পাদক ‘বি টি রনদীভে’ তাঁর নতুন থিসিসে রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া কবি আখ্যায়িত করে তাঁকে বর্জনের আহ্বান জানান। সে অনুযায়ী আপিটিএ-তেও রবীন্দ্র বর্জনের হাওয়া এসে লাগে। এর প্রতিবাদে মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, কলিম শরাফী, অশোক মজুমদার প্রমুখ আইপিটিএ থেকে বের হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন নাট্য সংস্থা ‘বহুরূপী।’ নাটকের গতানুগতিক ধারাকে ভেঙে আইপিটিএর হাত ধরে নবান্ন নাটকের মাধ্যমে যে নবনাট্য আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই বহুরূপীর জন্ম।
১৯৫০-এ কলিম শরাফী ঢাকায় চলে আসেন। গণসংগীতের শিল্পী কলিম শরাফী ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা এবং সলিল চৌধুরীর সুর করা “অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি” গানটি পরিবেশন করেন। তারপরই গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তার বাসায় এসে তাকে জেরা করতে শুরু করে। গানটি কেন গাইলেন। উদ্দেশ্য কী ইত্যাদি। যাওয়ার সময় শাসিয়ে গেলেন, এ ধরনের গান যেন তিনি ভবিষ্যতে আর না করেন।
ঢাকায় গোয়েন্দা সংস্থার হয়রানি এড়াতে কলিম শরাফী চট্টগ্রাম চলে যান। এর আগে কলকাতা থেকে গণনাট্য সংঘের দলের সঙ্গে কলিম শরাফী চট্টগ্রাম এসেছিলেন ১৯৪৭-এর আগেই ‘শহীদের ডাক’ নাটক নিয়ে। তাছাড়া ১৯৫০-এ চট্টগ্রামে ভয়াবহ বন্যার পর বন্যার্তদের সাহায্যার্থে অনুষ্ঠিত চ্যারিটি শোতে গান গাওয়ার জন্য চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। সেই সুবাদে পুরোনো পরিচিতজনদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। যোগাযোগ হয় গোপাল বিশ্বাস, সুচরিত চৌধুরী, মাহবুব উল আলম চৌধুরী, সুনীল চক্রবর্তী, চিরঞ্জীব দাশশর্মা এবং আরও কয়েকজনের সঙ্গে।
১৯৫১-তে সায়েদুল হাসান (মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ) এবং আবুল ফজলের প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম হরিখোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হয় দেশের প্রথম সাংস্কৃতিক সম্মেলন। সেখানে রমেশ শীল, মাহবুব উল আলম চৌধুরী, চিরঞ্জীব দাশশর্মা, গোপাল বিশ্বাস, সুচরিত চৌধুরী ও ফণী বড়–য়াসহ আরও অনেকের সমাবেশ ঘটেছিল। এই সম্মেলনে কলকাতা থেকে সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, সাংবাদিক সত্যেন মজুমদারসহ আরও অনেকে এসেছিলেন। সেই সম্মেলনে প্রতিক্রিয়াশীল মহল থেকে অনেক বাধা এসেছিল। কলিম শরাফীকে তাড়ানোর জন্য তিনি জামাল খান রোডের যে বাড়িতে থাকতেন, তা রিকুইজিশন করে নেওয়া হয়। তারপর সবাই সংঘবদ্ধ হয়ে ঠিক করলেন একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন করা দরকার। এভাবেই ‘প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ’ গঠিত হলো। এর সভাপতি ছিলেন শওকত ওসমান এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবু মোহাম্মদ সাহাবউদ্দিন।
প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নতুন ধারার নাট্য আন্দোলন শুরু করে। বিশেষ করে একটি দিক দিয়ে কালিম শরাফীর প্রচেষ্টা স্মরণ করার মতো। এ দেশে প্রথম ঘরের মেয়ে-বউদের দিয়ে নাটক করানোর সূচনা প্রান্তিক থেকেই হয়েছিল। কলিম শরাফী চেয়েছিলেন, এ দেশের নাট্যজগৎ প্রচলিত ধারার পরিবর্তে সামাজিকভাবে সম্মানজনক স্থানে উন্নীত হোক। সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তাঁর স্ত্রী কামেলা শরাফী, কাজী আলী ইমামের স্ত্রী সনি ইমাম এবং এম এ সামাদের স্ত্রী ফওজিয়া সামাদ নিয়মিত নাট্যাভিনয়ে অংশ নিতেন। এটি পাকিস্তানের মতো একটি ধর্মান্ধ দেশে বিপ্লবের মতো। পরবর্তীকালেও এ দেশে উচ্চ শিক্ষিত নাট্যশিল্পী সমাজ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা কলিম শরাফী অব্যাহত রাখেন। এ ব্যাপারে রামেন্দু মজুমদারের ভাষ্য—
১৯৬৪ সালে জাপানের এনইসি কোম্পানির উদ্যোগে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্র চালু হয়। প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ পেলেন জামিল চৌধুরী আর অনুষ্ঠান পরিচালক কলিম শরাফী।...কলিম ভাই মুনীর চৌধুরীকে অনুরোধ করলেন একটি নাটক লিখে দেওয়ার জন্য। আর এ-ও বললেন, বিশ্ববিদ্যালয় মহল থেকেই যেন অভিনেতা-অভিনেত্রী বেছে দেন। কারণ, তখনো টেলিভিশনে অংশ নেওয়া সম্পর্কে কিছুটা সামাজিক সংস্কার ছিল। প্রথমেই যদি চলচ্চিত্র জগতের লোকেরা টিভি নাটকে আসে, তবে বাইরের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের এখানে যুক্ত করা কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি চেয়েছিলেন টিভিকে কেন্দ্র করে আলাদা একটি শিল্পীমহল গড়ে উঠুক। ফলে আমাদের সুযোগ হয়ে গেল ঢাকা টেলিভিশনের প্রথম নাটক ‘একতলা দোতলা’তে অভিনয় করার। কলিম ভাই না থাকলে আমরা সে সুযোগ পেতাম না।
১৯৫২ সালে ২২ থেকে ২৪ আগস্ট কুমিল্লার ঈশ্বর পাঠশালায় অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলন। কলিম শরাফীর পরিচালনায় ‘প্রান্তিক’ এ সম্মেলনে ‘আজ হরতাল, আজ চাকা বন্ধ’ এবং বন্দীদের মুক্তি চেয়ে গণসংগীত পরিবেশন করে।
১৯৫৪ সালের ২৩ থেকে ২৬ এপ্রিল ঢাকা কার্জন হলে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কলিম শরাফী তার ‘প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ’ নিয়ে সেই সম্মেলনে যোগদান করেন এবং গণসংগীত ও নাটক ‘বিভাব’ পরিবেশন করেন। কলিম শরাফীর পরিচালনায় রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশিত হয়। পরবর্তীকালের অনেক নবীন প্রবীণ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সেদিন তাঁর পরিচালনায় রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেছিলেন।
১৯৫৬-তে পাকিস্তান সরকার কুখ্যাত ৫২ (ক) ধারা জারি করার পর তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে থাকতে হয়। ১৯৫০ থেকেই তাঁর ওপর গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত ছিল। ১৯৫৮-তে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির পর রেডিওতে তাঁর গান প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়। একসময় জীবিকার প্রয়োজনে কলিম শরাফী বেশ কিছু বাণিজ্যিক প্রচারণামূলক তথ্যচিত্র পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৫৮-তে সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে জহির রায়হানের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালনা করেন ‘সোনার কাজল’ নামে একটি চলচ্চিত্র। গল্পটি তার নিজের লেখা।
১৯৬৪ সালে ঢাকা টেলিভিশন প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি তার অনুষ্ঠান প্রধানের দায়িত্বপালন করেন। টেলিভিশনে তিনি ‘ঘরোয়া’ নামে একটা নিয়মিত অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। নায়করাজ রাজ্জাক সেই ঘরোয়া অনুষ্ঠানের দু-একটি এপিসোডে অভিনয় করেছিলেন।
১৯৬৭ সাল পর্যন্ত কলিম শরাফী ঢাকা টেলিভিশনে চাকরিরত ছিলেন। তারপর রামেন্দু মজুমদারের ভাষায় :
কিন্তু পাকিস্তান টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের অধীনে তাঁর মতো মানুষের বেশি দিন চাকরি করা আর হয়ে উঠল না।
১৯৬৮ সালে কলিম শরাফী ব্রিটিশ রেকর্ডিং কোম্পানির পূর্ব পাকিস্তান ম্যানেজার ও পরে ডাইরেক্টর কাম জেনারেল ম্যানেজার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। রেকর্ডিং কোম্পানিতে থাকাকালীন তাঁর প্রচেষ্টা, প্রশিক্ষণ ও পরিচালনায় এ দেশের নবীন-প্রবীণ শিল্পীদের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড বের হয়। সম্ভবত এটাই ছিল সেই শিল্পীদের প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড। ১৯৬৯ সালে কলিম শরাফী সত্যেন সেন প্রতিষ্ঠিত উদীচীর উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত হন এবং ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত প্রায় ১০ বছর উদীচীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের জেনারেল ম্যানেজার ও জনসংযোগ কর্মকর্তা পদে যোগ দেন। পাশাপাশি উদীচীসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকেন।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার নৃশংসভাবে হত্যার পর সামরিক জান্তা দেশের ক্ষমতা দখল করে। এরপর তারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিপরীত দিকে দেশকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলিম শরাফী দেশবাসীকে যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান একুশে পালনের জন্য আহ্বানসংবলিত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করায় তৎকালীন সামরিক সরকার প্রধান জিয়াউর রহমান তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন।
এ সময়ই উদীচী স্বাধীনতার ইতিহাসভিত্তিক গীতি-আলেখ্য ‘ইতিহাস কথা কও’ রচনা করে সর্বপ্রথম উদীচীর কার্যালয়ে তাঁর সামনে উপস্থাপন করলে তিনি এটিকে সর্বত্র মঞ্চস্থ করার নির্দেশ দেন। সেই থেকে ‘ইতিহাস কথা কও’ ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে।
১৯৮৩ সালে প্রাতিষ্ঠানিক সংগীত শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে তিনি শান্তিনিকেতন থেকে সদ্য-প্রত্যাগত শিল্পীদের সঙ্গে মিলে ‘সংগীত ভবন’ নামে একটি গান ও নাচের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি অধ্যক্ষ এবং সভাপতি, সম্প্রতি প্রয়াত বাবু রহমান সাধারণ সম্পাদক (পরবর্তীকালে আমিনুর রহমান নিঝু এর সাধারণ সম্পাদক হন), শিক্ষক হিসেবে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, সাদি মহম্মদ, আমিনুর রহমান নিঝু, শামীমা পারভীন, হাসি বিশ্বাস, শিবলি মহম্মদ প্রমুখ। কর্মকর্তা ও সংগঠক হিসেবে যুক্ত হন মোস্তফা ওয়াহিদ খান (প্রয়াত) এবং মো. তমিজ উদ্দিন ।
শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৫ সালে তাঁকে ‘একুশে পদক’ ও ১৯৯৯ সালে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-এ ভূষিত করা হয়।
ঘটনাচক্রে কলিম শরাফীকে নানা বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের সেই বিখ্যাত গান ‘কোন এক গাঁয়ের বধূর কথা’ প্রথমে কলিম শরাফীরই গাওয়ার কথা ছিল। সলিল চৌধুরী গানটি তৈরি করে তাঁকেই দিয়েছিলেন এবং কলিম শরাফী কয়েক দিন অনুশীলনও করেছিলেন। এরপর একদিন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গানটি শুনে বন্ধুত্বের দাবিতে বললেন, ‘কলিম আমি গানটি নিলুম।’
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসার পরে ‘অবাক পৃথিবী’ গানটি করে সেই যে গোয়েন্দা বাহিনীর নজরে পড়ে গেলেন সেটি আর তাঁকে ছাড়েনি। ১৯৫৮-তে তাঁর গান প্রচারও নিষিদ্ধ হয়ে গেল। সেই সরকারি নিষেধাজ্ঞা তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তুলে নেওয়া হয়নি। আর একটি ঘটনা শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর নিজস্ব ভাষ্যেই উল্লেখ করছি, ‘‘...এরই মাঝে আমাদের সংগীত প্রীতির ফল হিসেবে শ্রোতার আসর নামে একটি অবাণিজ্যিক সংগঠনের জন্ম হয়। যার পেছনে প্রধান পুরুষ ছিলেন জামিল চৌধুরী। প্রতিভাবান কণ্ঠশিল্পীদের কণ্ঠ ধরে রাখার প্রচেষ্টা হিসেবে কিছু লং প্লে রেকর্ড বের করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। জামিল চৌধুরী এই লং প্লের বাংলা করেছিলেন দীর্ঘবাদন। সম্পৃক্ত ছিলেন শ্রোতার আসরের সঙ্গে সন্জীদা খাতুন, সাবিয়া মুহিত প্রমুখ। আমিও কিছুটা জড়িত ছিলাম রেকর্ড কভার করার সুবাদে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ নামে একটি দেশাত্মবোধক গানের রেকর্ড বেরিয়েছিল, যা খুব সুনাম বয়ে এনেছিল দেশে-বিদেশে। সোহরাব হোসেনের নজরুলগীতি, ‘বাঁশরি ও নির্মাল্য’ বলে একগুচ্ছ রবীন্দ্রসংগীত। ‘গীতমালিকা’ নামে সেলিনা মালেক ও ইফ্ফাত আরা খানের রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড বেরোল। আরও বেরোল সন্জীদা খাতুন ও ফাহমিদা খাতুনের রবীন্দ্রসংগীত ও ফরিদা পারভীনের লালনগীতির রেকর্ড। আমার খুব ইচ্ছে কলিম ভাইয়ের একটি লং প্লে রেকর্ডের কভার করি। জামিল ভাইকে বললামও। কী কারণে যেন শ্রোতার আসর থেকে কলিম ভাইয়ের রেকর্ড আর বের হয়নি।” অথচ উদার হৃদয় কলিম শরাফীই এ দেশের রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের নিয়ে তাদের জীবনের প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ডটি করিয়েছিলেন। প্রশিক্ষণও দিয়েছিলেন।
১৯৭৮ সালে প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী জাহিদুর রহিমের অকালপ্রয়াণের পর তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে শিল্পী কলিম শরাফীকে সভাপতি করে গঠন করা হয় ‘জাহিদুর রহিম স্মৃতি পরিষদ’। কলিম শরাফী তখন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীরও সভাপতি। ১৯৭৯-এ শিল্পী জাহিদুর রহিমের প্রয়াণ দিবসে ‘জাহিদুর রহিম স্মৃতি পরিষদ’-এর আয়োজনে রবীন্দ্রসংগীত প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮১-তে কলিম শরাফী আর উদীচীর দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা শাখাসমূহের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় জেলাভিত্তিক রবীন্দ্রসংগীত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রথম রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলনও ‘জাহিদুর রহিম স্মৃতি পরিষদ’-এর আয়োজনেই অনুষ্ঠিত হয়। বছরখানেক পর ২৯ নভেম্বর ১৯৮২-এর নাম পরিবর্তন করে “রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষৎ” রাখার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৮৩ সালের ৩০ জানুয়ারি তৃতীয় জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনে “রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষৎ” আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয়, কিন্তু কলিম শরাফী সেখানে আর থাকেননি। কী এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল সেখানে, কে জানে?
জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী তাঁর সম্পর্কে কবিতার মতো করে লিখেছেন—
“কথা বেশি বলেন না কখনো
লিখার ক্ষেত্রেও তেমন মুক্তহস্ত নন
মন্তব্য প্রদানে অবশ্য সতত সুস্পষ্ট।
শর্ষের মধ্যে ভূত সহজেই চোখে পড়ে তাঁর
রাতে বা দিনে যখনই যেখানে দেখেন
ফীলহাল ধরে ফেলেন চোখের নিমেষে।”
কিন্তু সংগ্রামী কলিম শরাফী তো থেমে থাকার মানুষ নন। আজীবন দৃঢ়চেতা অথচ উদার কলিম শরাফী জীবনের বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়েছেন, কিন্তু কখনোই ধৈর্য হারাননি। রবীন্দ্রনাথের গানকে অমোঘ অস্ত্র হিসেবে তুলে নিয়েছিলেন সেই তরুণ বয়সেই। তাই তিনি তরুণতর শিল্পী তপন মাহমুদসহ দেশের প্রথিতযশা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের নিয়ে গঠন করলেন “রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থা”।
এই তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত, দৃঢ়চেতা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অথচ শান্ত অচঞ্চল মানুষটির কাছে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছে দীর্ঘদিন। উদীচী আর সংগীত ভবনের সুবাদে। ২০১০ সালের ২ নভেম্বর তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
মৃত্যুর পূর্বে কিছুদিন তিনি সম্পূর্ণ স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। সে সময় তমিজউদ্দিনই তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। এমনি এক দিনে তজিউদ্দিন কলিম ভাইকে প্রশ্ন করলেন, “আমাকে চিনতে পারছেন?” কলিম ভাই বললেন, “কে, সেলিম?” কথাটা বন্ধু তমিজের মুখে শুনে একটা প্রবল ধাক্কা খেলাম। স্মৃতিশক্তিহীন অবস্থায়ও যিনি আমার নামটা মনে রাখেন, তিনি আমাকে কতটা ভালোবাসেন! অথচ আমি এমনই অকৃতজ্ঞ, আমার অফিসের কাছে থাকা সত্ত্বেও নিয়মিত দেখতে যেতে পারিনি।
কলিম ভাই। আমাকে ক্ষমা করুন। আপনার চলে যাওয়াকে আমরা কেউ স্বীকার করি না। আপনি আছেন, থাকবেন। আমাদের স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে। আজীবন লড়াই-সংগ্রামের প্রতীক হয়ে।
তথ্যসূত্র:
১) মাহমুদ সেলিম সংগৃহীত কলিম শরাফীর সাক্ষাৎকার নিয়ে ১৯৮৫-তে প্রকাশিত সংবর্ধনা সংকলন।
২) এম এ তাহের সম্পাদিত ‘কলিম শরাফীর অ্যালবাম।’ (বেশিরভাগ তথ্য)
৩) ব্যক্তিগত স্মৃতি।