রবীন্দ্রনাথ ৫৬তম জন্মদিনের কয়েক দিন বাকি থাকতে ১৯১৬ সালের মে মাসে জাপানের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তিনি বোশেখ মাসের ১৮ তারিখ অর্থাৎ ১ মে সোমবার রাতে জাপানের উদ্দেশে জাহাজে চাপেন। জাহাজের নাম ছিল, ‘তোসামারু’, এটি মূলত ছোট আকারের একটি মালবাহী জাহাজ। তবে যাত্রী বহনের জন্য কিছু ব্যবস্থা ছিল। এ যাত্রায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছিলেন উইলিয়াম পিয়র্সন, সি এফ অ্যান্ড্রুজ ও শ্রীমুকুল চন্দ্র দে। তবে ১ মে অর্থাৎ ১৮ বোশেখ রবীন্দ্রনাথ জাপান যাওয়ার উদ্দেশ্যে ‘তোসামারু’তে আরোহণ করলেও, জাহাজ সেদিন যাত্রা শুরু করেনি।
এ যাত্রায় একটি মজার ব্যাপার ঘটেছিল অর্থাৎ ১ মে ১৯১৬ তারিখে জাহাজটি জাপানের উদ্দেশে ছেড়ে না যাওয়ায় ২ মে তিনি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ফিরে আসেন। সারা দিন সেখানে অপেক্ষা করে আবার সন্ধ্যায় জাহাজে ফিরে যান। তোসামারু মূলত মালবাহী জাহাজ, নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য না আসায় জাহাজটি ছেড়ে যেতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ জাপান যাওয়ার পথে রেঙ্গুনে দুদিন যাত্রাবিরতি করেছিলেন, অবশ্য সেসবই জাহাজ কোম্পানির সৌজন্যে। ২ জ্যৈষ্ঠ, ১৫ মে সোমবার রবীন্দ্রনাথকে বহনকারী জাহাজটি সিঙ্গাপুরে পৌঁছায়।
রবীন্দ্রনাথ জাপানের পথে জাহাজ যাত্রাকালে বিচিত্র সব বর্ণনা দিয়েছিলেন। সমুদ্র, প্রকৃতি, জাহাজের নাবিক, কাপ্তান, কেবিন-বয় থেকে শুরু করে সহযাত্রীদের কেউই বাদ পড়েনি। এই পথে তাঁর সমগ্র জীবনের মধ্যেই নানা ধরনের দার্শনিক চিন্তা উদিত হয়েছে। তাঁর কাছে জগতের সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তÍ সামান্য ব্যাপর নয়, তার অভ্যর্থনার জন্য স্বর্গে-মর্ত্যে রাজকীয় সমারোহ।
কবি এর আগে চারবার সমুদ্রযাত্রা করেছিলেন, কিন্তু প্রথমবারে ইউরোপীয় জাহাজে—সেই কারণেই এই জাপানি জাহাজের বিশেষত্ব তিনি প্রতি মুহূর্তেই অনুভব কবেছেন। তাঁর মনে হয়েছে, জাহাজ থেকেই তাঁর জাপানের স্বাদ শুরু হয়েছে, যা অন্য কোনো দেশের জাহাজে গেলে হতো না। ওকাকুরার সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকেই জাপান সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ জাগ্রত হয়, তারপরে জীবনের প্রতি পর্বেই বহু জাপানি শিল্পী-কর্মী পরিব্রাজক-প-িতের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র গড়ে উঠেছিল। ১৯১৩ সালে তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন, ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথে রাশিয়া পেরিয়ে জাপানে উপস্থিত হবেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে ইউরোপের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ১৯১৫-এর গোড়া থেকেই তিনি জাপানে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। প্রথমে অর্থাভাব বাধা হয়ে এসেছিল, পরে কোরিয়া ও চীনের প্রতি জাপানের সাম্রাজ্যবাদী লোভ প্রকট হয়ে পড়ায় তিনি মানসিক বাধা অনুভব করতে থাকেন। কিন্তু এশীয় জাতি হয়েও জাপানিদের অব্যাহত অগ্রগতিকে অস্বীকার বা লঘু করে দেখাও তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই জাপানি জাহাজে ভ্রমণ করার সময়ে জাপানি কাপ্তান থেকে খালাসি পর্যন্ত সবাইকে তিনি সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন ও তাঁদেন বৈশিষ্ট্যটুকু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। অবশ্য তাঁর প্রধান কর্মতৎপরতাকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করছিল সেই দিকেই তাঁর সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছে, ভ্রমণকাহিনির প্রায় প্রতি পৃষ্ঠায় এই বিশ্লেষণই লক্ষণীয়। এই ভাবনা রবীন্দ্রনাথ বহুদিন ধরেই ভাবছিলেন, কিছুদিন পরে জাপানে ও আমেরিকায় প্রদত্ত বক্তৃতায় তা স্পষ্ট ধিক্কারের রূপ লাভ করে।
হংকং থেকে জাহাজ ছাড়ে ১১ জ্যৈষ্ঠ, জাপানের কোবে বন্দরে পৌঁছায় ১৬ জ্যৈষ্ঠ। রবীন্দ্রনাথ এই যাত্রায় ‘মালিনী’ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ও জাপানের প্রদেয় একটি বক্তৃতা লিখে ফেলেন। হংকং ছাড়বার পর কয়েক দিন বৃষ্টিবাদলের মধ্যে অগ্রসর হয়ে ১৬ জ্যৈষ্ঠ তোসামারু জাহাজ যখন জাপানের কোবে বন্দরে পৌঁছাল, তখন মেঘ কেটে গিয়ে সূর্য উঠেছে। বন্দরে রবীন্দ্রনাথকে অভ্যর্থনা করতে টোকিও থেকে এসেছিলেন তাঁর পূর্বপরিচিত দুই শিল্পী ইয়োকোহামা টাইকান ও কাটসুদা শোপকিন, বিদ্যালয়ের সাবেক ব্যায়ামশিক্ষক সারো জিন্নোসুকে ও পরিব্রাজক কাওয়াগুচি এক্কাই এবং জাপানপ্রবাসী কিছু ভারতীয়। ১৮ জ্যৈষ্ঠ বিকেলে কোবের ওরিয়ন্টাল ক্লাবে ও ওসাকার ভারতীয়রা রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধিত করেন। স্থানীয় ব্রিটিশ কনসাল জেনারেল এবং ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের কয়েকজন সদস্য আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের পরিচালক জে রহমান রবীন্দ্রনাথের মতো বিখ্যাত কবিকে নিজেদের মধ্যে পাওয়ার জন্য আনন্দ ব্যক্ত করেন এবং ফতেহ আলীকে অভিনন্দনপত্রটি পাঠ করার জন্য আমন্ত্রণ জানান।
এই অনুষ্ঠানের পর রবীন্দ্রনাথ শ্রীমতী কোজাডের বিদ্যালয়ের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ক্লাবের নারী সভ্যগণ, তাঁদের স্বামী ও কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে প্রায় দেড়শজন এই মিলনসভায় উপস্থিত ছিলেন। ক্লাবের সভানেত্রী শ্রীমতী রয় স্মিথের স্বাগত ভাষণের পর রবীন্দ্রনাথ সেই দিনই সকালে শেষ করা ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ নাট্যকাব্যটির ইংরেজি রূপান্তর পাণ্ডুলিপি থেকে পাঠ করে শোনান। তাঁর আশ্রম-বিদ্যালয় সম্পর্কে অনেকের প্রশ্নেরও তিনি উত্তর দেন। অনুষ্ঠানের শেষ রেভারেন্ড সি জে বেটস তাঁকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ আসবার আগেই ক্লাবের একটি অধিবেশনে তাঁর রচনা আলোচিত হয় ও কোবের আর একটি ক্লাব কয়েক সপ্তাহ আগে একই বিষয় সভার আয়োজন করে। ১৯ জ্যৈষ্ঠ আসাহি সিমবুন পত্রিকার আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ওসাকা যান। তাঁর সম্মানে একটি ভোজসভা আয়োজিত হয়। কাওয়াগুচির উপরোধে রবীন্দ্রনাথ রাত্রিটি ওসাকায় তাঁর বাড়িতে কাটাতে রাজি হন। কিন্তু এর পরিণতি সুখকর হয়নি। ৪ জুন রথীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠিতে পিয়র্সন এই করুণ অভিজ্ঞতার বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। সভা শেষ হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ, পিয়র্সন, মুকুল, কাওয়াগুচি, সানো সান ও একজন সাংবাদিক এই ছয়জন একটি ছোট মোটরগাড়িতে যাত্রা করেন, আশা ছিল দশটার মধ্যেই তাঁরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাবেন। কিন্তু শ খানেক গজ যাওয়ার পরেই গাড়িটির টাওয়ার বদল করতে হয়। রাত্রি দশটায় মাইল চারেক যাওয়ার পর বদলানো টায়ারটিও ফেটে যায়। বিরক্ত রবীন্দ্রনাথ হেঁটে নিকটতম স্টেশনে গিয়ে ওসাকায় বা কোবেতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মাঠের মধ্য দিয়ে পায়ে চলা পথে তাঁরা দেড় মাইল দূরবর্তী স্টেশনের উদ্দেশে রওনা হন। ২০ জ্যৈষ্ঠ সম্ভবত দুপুরে রবীন্দ্রনাথ কোবেতে ফিরে আসেন। সারেনা সানের সঙ্গে ওসাকার আসাহি সিমবুন পত্রিকার দুজন প্রতিনিধি এসে তাঁর কাছে সমস্ত ঘটনার জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করে যান। ২২ জ্যৈষ্ঠ রবীন্দ্রনাথ একটি চা-পান অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
৭ জুন রবীন্দ্রনাথ জাপানের ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করলে তিনি তাঁকে মধ্যাহ্নভোজনে আপ্যায়ন করেন। ভ্রমণ শুরুর আগে রবীন্দ্রনাথ বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেলের কাছ থেকে কয়েকটি পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেন। তিনি সাংহাই যাননি বলেই সেখানকার কনসাল জেনারেল Sir Evarard Fraser-কে লেখা কারমাইকেলের ১৭ এপ্রিলের পত্রটি তাঁর কাছে থেকে গিয়েছিল। ১০ জুন সকালে অ্যান্ডরুজ ও পিয়র্সনকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ জাপানের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। কাউন্ট ওকুমা ইন্দো-জাপানিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন, তিনি তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। বিখ্যাত বৌদ্ধপণ্ডিত আনেসাকি মাসাহারু, যিনি পনেরো বছর আগে ভারত ভ্রমণ করেছিলেন, তিনিই দোভাষীর কাজ করেন।
এরপরে তাঁরা ওকুমা-প্রতিষ্ঠিত ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে আসেন। বিকেলে তাঁরা ওকাকুরা-প্রতিষ্ঠিত নিপ্পন বিজিৎসু-ইন বা শিল্পবিদ্যালয় পরিদর্শনে যান। এরপর শিল্পবিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আমন্ত্রণে তাঁরা টোকিওর সর্বোৎকৃষ্ট রেস্তোরাঁয় সান্ধ্যভোজসভায় যোগদান করেন। পরের দিন ২৯ জ্যৈষ্ঠ রবীন্দ্রনাথ টোকিও ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটিতে দ্য মেসেজ অব ইন্ডিয়া টু জাপান ভাষণটি পাঠ করেন। বক্তৃতাটি আগেই লিখে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের হাতে দিয়েছিলেন, তাঁরা সেটি পুস্তিকাকারে মুদ্রিত করেন ও সেই মুদ্রিত কপি থেকেই তিনি প্রবন্ধটি পাঠ করেছিলেন। বক্তৃতার সময় নির্দিষ্ট ছিল বিকেল চারটা, কিন্তু দুপুর দুইটা থেকেই প্রায় দেড় হাজার লোক সভাস্থল পূর্ণ করে ফেলেন, অনেকেই স্থানাভাবে ফিরে যেতে বাধ্য হন; শ্রোতাদের মধ্যে শ খানেক ভারতীয় এবং সমসংখ্যক ইংরেজ ও আমেরিকানও ছিলেন। এই ভাষণে রবীন্দ্রনাথ বলেন, পুরোনো প্রাচ্যসংস্কৃতির উত্তরাধিকারী, মানুষকে তার আত্মার প্রকৃত ঐশ্বর্য ও শক্তির অনুসন্ধানে প্রকৃত করে ক্ষতি ও বিপত্তিতে আত্মস্থ হওয়ার শিক্ষা দেয়, লাভ-ক্ষতি গণনা না করে আত্মোৎসর্গে প্রেরণা জোগায় সামাজিক জীব হিসেবে অগণিত সামাজিক দায় স্বীকার করায়। এ সত্ত্বেও সে নির্ভয়ে আধুনিক যুগের সমস্ত সম্পদকেও দাবি করেছে। পুরোনো অভ্যাসের বন্ধন, অলস মনের অপ্রয়োজনীয় সহচর ত্যাগ করে সে বর্তমান কালের সংস্পর্শে এসেছে এবং যথাযথ আগ্রহ ও যোগ্যতার সঙ্গে আধুনিক শুভ্রতার দায়িত্বসমূহ বরণ করে নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করেন না, নিছক পাশ্চাত্যের অনুকরণ করে জাপান বড় হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ এরপর বললেন, সারা পৃথিবীর দৃষ্টি এখন জাপানের দিকে। জাপান যদি কেবল পাশ্চাত্যের প্রতিরূপ হয়ে থাকে, তাহলে যে আশা সে জাগিয়ে তুলেছে, তা সফল হবে না। পাশ্চাত্য সভ্যতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব এখনো দিতে পারেনি।
এই সভায় সমাপনী ভাষণে কাউন্ট ওকুমা এক কৌতুককর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন—রবীন্দ্রনাথের বাংলা ভাষণকে ইংরেজিতে প্রদত্ত ভেবে তিনি বলেন, যদিও তিনি ইংরেজি ভালো বোঝেন না, তা হলেও তিনি এই ভারতীয় সাধুকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন তাঁর সময়োচিত আগমন ও সতর্কবাণীর জন্য— কারণ জাপান এখন তার অন্তজীবনে একটি পরিবর্তনের পথে এসে দাঁড়িয়েছেন। যাহোক, ১৯১৬-এ জাপানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদেরই দাক্ষিণ্য-পুষ্ট বুদ্ধিজীবীরা রবীন্দ্রনাথকে পরাজিত, পরাধীন, ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি দেশের প্রতিনিধি হিসেবে দেখেছিল। ১৯০৫ সালে রাশিয়াকে যুদ্ধে পরাজিত করে এবং ১৯১০ সালে কোরিয়া ও ১৯১৫ সালে চীনের একাংশ গ্রাস করে গর্বস্ফীত জাপান তখন ইউরোপীয় মহাযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি লক্ষ করে যাচ্ছিল। এই যুদ্ধে যদি মিত্রশক্তি পরাজিত হতো, জাপান অবশ্যই ভারতের দিকে তার থাবা বাড়াত।
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে জাপানি সাংবাদিকরা নিরুৎসাহিত হয়েছিলেন। তাই এই বক্তৃতার প্রতিবেদন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি। জাপান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল। অল্পদিন এ দেশে থেকে অনেক কিছু না দেখেই তিনি কয়েকটি লক্ষণকে আদর্শায়িত করেছিলেন—তিনি যদি দীর্ঘকাল এখানে থাকতেন, তাঁর হতাশার কারণ থাকত না। রবীন্দ্রনাথ প্রথমেই এই সমালোচনার উল্লেখ করে বললেন, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা একধরনের অন্ধতাও সৃষ্টি করে, যার নমুনা তিনি নিজের দেশেও অনেক দেখেছেন। এই অন্তর্দৃষ্টির শক্তিতেই তিনি বহুবিধ বৈপরীত্যের মধ্যেও জাপানের আত্মাকে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছেন। চীন যুদ্ধে জয়ের নিদর্শন টোকিওতে সাজিয়ে রেখে জাপানি শিশুদের মন কীভাবে বিষাক্ত করা হচ্ছে, তার দৃষ্টান্ত রবীন্দ্রনাথ স্বচক্ষে দেখেছেন, তারই বিরুদ্ধে পরোক্ষ ধিক্কার উদ্ধৃতিটিতে শোনা যায়। তিনি বললেন, প্রাচ্যজাতির অভ্যুত্থান সম্পর্কে পাশ্চত্যের মনে ভয় আছে। কেননা, তার শক্তি শয়তানের শক্তি—যত দিন সে শক্তি কেবল তারই আয়ত্তে থাকবে, তত দিন সে নিরাপদে থাকবে ও পৃথিবীর বাকি অংশ ভয়ে কাঁপবে। ইউরোপের বর্তমান সভ্যতা এই শয়তানের শক্তিকে একান্ত করে রাখতে চায়। তার যত অস্ত্র ও কূটনীতি এই লক্ষ্যেই চালিত হচ্ছে। ১৮ আষাঢ় টোকিওর বক্তৃতা ও সান্ধ্যভোজের পর রবীন্দ্রনাথ ইয়োকোহামায় ফিরে আসেন। তিনি ইয়োকোহামার নিকটবর্তী সুরমিতে জেন গোষ্ঠীর সোজিজি মঠ পরিদর্শন করেন। একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণে তিনি গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমে অবস্থিত প্রয়াগ তীর্থের উল্লেখ করে তাঁর জাপানে আগমনকে তীর্থযাত্রার সঙ্গে তুলনা করেন। ইয়োকোহামায় অবস্থানকালে অনেকেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। এই ছাত্ররাই জাপানি সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী রীতিনীতি সম্পর্কে তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তাঁর চোখ খুলে দিয়েছিলেন। অবশ্য এর অনেকটাই তিনি জানতেন। আর সেই কারণেই জাপানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করতে না পেরেও পূর্ববর্তী অধ্যায়ে উদ্ধৃত পত্রটি অ্যান্ডরুজকে লিখেছিলেন। জাপানি জাতীয়তাবাদকে ধিক্কার দিয়ে যে ভাষণগুলো তিনি দিয়েছিলেন, তা আকস্মিক ছিল না—অনেক দিন ধরেই তাঁর মনে তার প্রস্তুতি চলছিল, ওই পত্রই তার প্রমাণ। তবে জাপানি ছাত্রদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপে তিনি প্রসন্ন হয়েছেন।
এরই মধ্যে রবীন্দ্রনাথ একটি রমণীয় স্থানে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেলেন। টোকিওর মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা দু-তিন সপ্তাহের জন্য পার্বত্য অঞ্চলে একটি গ্রীষ্মকালীন শিবিরে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। অধ্যাপক নারুসে রবীন্দ্রনাথকে কারুইজাওয়া পাহাড়ে এদের সঙ্গে কয়েক দিন কাটিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি সানন্দে এই অনুরোধ রক্ষা করেন। কারুইজাওয়া পাহাড়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এন্ড্ররুজ ও পিয়ার্সন সাহেবও গিয়েছিলেন। ওই পাহাড়ের ওপর ‘মীটসুচীরা’ বলে ছোট্ট হোটেলে কবির থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল। রোজ ভোর বেলা উঠে শ্রীমতী কোরা ও মেয়েরা দেখতেন কবি ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছেন পাহাড়ের কোলে গাছের ছায়ায়।...একটু বেলা হলে রবীন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে নেমে আসতেন ছাত্রীদের খাবার ঘরে। সেই ঘরে কাঠের টেবিলের ওপর পাহাড়ি বুনো ফুল সাজিয়ে মেয়েরা রোজ ওর জন্য অপেক্ষা করত। কবি ছাত্রীদের সঙ্গে সকালের জলখাবার খেতেন। খাওয়া শেষে রোজ মেয়েদের ছোট বড় কবিতা পড়ে শোনাতেন। কোনটা হয়তো সেদিনই ভোরে রচনা করেছেন। সেই কবিতাগুলো তিনি ইংরেজিতে পড়ে শোনাতেন। অধিকাংশ মেয়েই তখন ইংরেজি জানত না। সেই সময়টা অধ্যাপকরাও কেউ থাকতেন না। তখন ছাত্রীদের মধ্যে একমাত্র টোমিকোই ভালো ইংরেজি জানতেন। কারণ, তিনি আমেরিকান হোস্টেলে আমেরিকান নারীদের সঙ্গে অনেক দিন ছিলেন। তাই অন্য ছাত্রীদের কবিতা তরজমা করে বুঝিয়ে দেওয়ার ভার পড়ত শ্রীমতী কোরার ওপর। তখন থেকেই অনেক ছাত্রীর থেকেও কোরা কবির কাছে বেশি পরিচিত হয়ে ওঠেন। শ্রীমতী কোরা একটি ছোট্ট নোটবুকে কবির কবিতা ও কথা সব লিখে নিতেন। সেই লেখায় অনেক সময় ভুলত্রুটিও থাকত কারণ অল্প বয়সে ওর কবিতার গভীর ভাব অনেক সময় শ্রীমতী কোরা ঠিকমতো হয়তো বুঝতে পারতেন না।
একদিন ড. নারুসে কবিকে অনুরোধ করলেন মেয়েদের কিছু বলবার জন্য। পাহাড়ের ওপরে বিশাল একটি ওকগাছ ছিল। তার নিচে ছোট্ট কাঠের বেদির ওপর কুশন পেতে মেয়েরা কবির বসবার আসন তৈরি করেছিল। কবি তার ওপরে বসলেন। এন্ড্রু, পিয়ার্সন ও অধ্যাপকরা চেয়ারে বসেছিলেন। ৬ ভাদ্র রবীন্দ্রনাথ রথীন্দ্রনাথকে এই ভ্রমণ সম্পর্কে লেখেন: ‘তিন চার দিনের জন্যে এখানে একটি মেয়ে ইস্কুলের আতিথ্য ভোগ করে এসেচি। আমাদের সকলেরই খুব ভাল লেগেচে। জাপানী মেয়েদের উপর আমার ভক্তি বেড়ে গিয়েচে। আমি ত এদের মত এমন মেয়ে কোথাও দেখি নি।’ উক্ত অভিজ্ঞতা তাঁকে এমনই অভিভূত করেছিল যে তিনি এই চিঠিতেই লেখেন: ‘আমার ভারি ইচ্ছে এবার দেশে ফিরে গিয়ে সুরুলের বাড়ীতে খুব ভালো রকম একটি মেয়ে স্কুল খুলব। আমেরিকায় বই বিক্রি করে যদি যথেষ্ট টাকা পাই এবং যদি আবার দেশে ফিরি তাহলে এই আমার কাজ হবে।’ অনেককাল পরে রবীন্দ্রনাথ এই ঘটনার স্মৃতিচারণা করেছিলেন ‘ধ্যানী জাপান’ প্রবন্ধে। তিনি বলেছিলেন—সেবারে তোকিয়ো নারী-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা আমাকে পাহাড়ের উপর নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে গ্রীষ্মাবকাশের সময় একদল ছাত্রী প্রতিবৎসর কোনো একজন উপদেষ্টার কাছে কোনো একটি বিশেষ বিষয়ে উপদেশ গ্রহণ করে থাকেন। আমার কাছে শুনতে চাইলেন ধ্যানতত্ত্ব সম্বন্ধে। আমি তাঁদের অনুরোধ শুনে বিস্মিত হয়েছিলেম। তখনো আমি জানতাম না যে, ধ্যানের সাধনা সেখানে সবারই জানা।
১১ ভাদ্র তিনি ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথকে লেখেন: সেদিন ওকাকুরার বাড়িতে গিয়েছিলুম, সে জায়গাটা আমার খুব ভালো লেগেছে। একটা আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ওকাকুরাকে তার দেশের লোক তেমন করে চিনতেই পারে নি। সেটাতে এদের অগভীরতা প্রকাশ পায়। অনেক বড় বড় লোকের সঙ্গে কর্তাবার্তা কয়ে দেখলুম, ওকাকুরার মত কারো প্রতিভা দেখতে পাই নি। ২৩ শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথ গগনেন্দ্রনাথকে লিখেছেন, ‘ওকাকুরার বাগানবাড়িতে দুদিন ছিলুম আজ এখনি যাচ্চি টোকিয়ো হয়ে ইয়োকোহামায়। ওকাকুরা পরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এই যোগাযোগ দীর্ঘকাল অক্ষুণ্ণ ছিল।
জাপানে রবীন্দ্রনাথ একধরনের নতুন রচনায় প্রবৃত্ত হন। জাপানি ‘হাইকু’ কবিতার সঙ্গে তিনি পুর্বাবধি পরিচিত ছিলেন। এখানে স্বাক্ষর-কবিতা বা বাণী লিখে দেওয়ার অনুরোধ রক্ষা করার তাগিদে তিনি প্রধানত ইংরেজিতে ও কখনো কখনো বাংলায় এই শ্রেণির কবিতা লেখা শুরু করেন।
যখন চীনে জাপানে গিয়েছিলেম প্রায় প্রতিদিনই স্বাক্ষরলিপির দাবি মেটাতে হতো। কাগজে, রেশমের কাপড়ে, পাখায় অনেক লিখতে হয়েছে। এমনি করে যখন-তখন পথে-ঘাটে যেখানে-সেখানে দু-চার লাইন কবিতা লেখা আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। এই লেখাতে আমি আনন্দও পেতুম। দু-চারটি বাক্যের মধ্যে এক-একটি ভাবকে নিবিষ্ট করে দিয়ে তার যে একটি বাহুল্য বর্জিত রূপ প্রকাশ পেত তা আমার কাছে বড় লেখার চেয়ে অনেক সময় আরো বেশি আদর পেয়েছে। এই রকম ছোট ছোট লেখায় আমার কলম যখন রস পেতে লাগল, তখন আমি অনুরোধনিরপেক্ষ হয়েও খাতা টেনে নিয়ে আপনমনে যা-তা লিখেছি।
রুশ-জাপান যুদ্ধে জাপানের জয় ভারতবর্ষকে বিশেষ করে বাংলাদেশকে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। রবীন্দ্রনাথ এ সময় জাপানী ছন্দে তিনটি কবিতা রচনা করেছিলেন। জাপানি কবিতা সাধারণত অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। তাতে মিলেরও কোন লক্ষণ নেই। কেবল অত্যন্ত সরল মাত্রার নিয়ম আছে। রবীন্দ্রনাথের মত—এ কারণে কাব্য চর্চা জাপানের আপামর জনসাধারণের মধ্যে বিস্তার লাভ করতে পেরেছে। এ কারণেই হয়তো জাপানি কবিতার ভাষা ও ভাব আমাদের কাছে সাদাসিদে মনে হয়। কিন্তু বিদেশি কাব্যের রস ঠিকভাবে গ্রহণ করা সহজ নয়— দু-একটি তর্জমা পড়ে কোনো কথাই সহজভাবে বলা যায় না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন— ‘এদের অসমান মাত্রার তিন লাইনের কবিতাকণাগুলি দেখিলে বেদের ত্রিষ্টুপ ছন্দের শ্লোক মনে পড়ে।’
ব্যক্তিগতভাবে অনেক জাপানি রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেও সমষ্টিগতভাবে জাপানবাসী তাঁর বাণী গ্রহণ করেননি। তাই জনসাধারণ ও সাংবাদিকদের প্রাথমিক উৎসাহ পরে আর দেখা যায়নি। ফলে রবীন্দ্রনাথও চাইছিলেন জাপানের পালা শেষ করে আমেরিকায় চলে যেতে- বক্তৃতার মাধ্যমে বিদ্যালয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহের আগ্রহও ছিল। শোনা যায় কবি যে দিন জাপান ত্যাগ করলেন, সেদিন গৃহকর্তা ব্যতীত জাহাজ ঘাটে তাকে বিদায় দেওয়ার জন্য আর কেউ উপস্থিত হননি। অথচ যেদিন তিনি প্রথম এসে কোবেতে নেমেছিলেন, সেদিন সকলে রাজ-সম্মানে তাকে স্বাগত করেছিলেন। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ তার বক্তৃতায় তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে জাপানের মার-দাঙ্গা মনোভাবের সমালোচনা করেন। বিশেষ করে জাপান সে সময় চীনকে যে ভাবে কষ্ট দেয় রবীন্দ্রনাথ তার বিরোধিতা করেন। বহু শতাব্দী পরাধীন থাকার পর চীন মাত্র কয়েক বছর আগই স্বাধীন হয়েছিল—চীন তখনো অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত। তারপর জাপান আক্রমণ করে এমন সব শর্ত চাপাতে চাইল যা মানতে গেলে চীনের সার্বভৌমত্ব থাকে না। কবি কষ্ট পেয়েছিলেন এই কথা ভেবে যে ইউরোপের চেয়ে এশিয়া নৈতিক ও আধ্যাত্মিকভাবে উন্নত কিন্তু জাপানের কাজে কর্মে ইউরোপের ছায়া পড়ছে নিষ্ঠুর ও নির্দয় ভাবে। চীনের বিরুদ্ধে জাপানের এই মারমুখো মনোভাবে নিন্দা করে কবি লেখেন জাপানের পক্ষে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলোর অনুকরণে এই সাম্রাজ্যলোলুপতা আদৌ কল্যাণপ্রদ হবে না। জাপানের যুদ্ধকামী তৎকালীন রাষ্ট্রনায়কেরা কবির এই এই সমালোচনা সহজভাবে নিতে পারেননি। বিদায়ের কয়েক দিন আগে আসাহি চিমবুন পত্রিকার এক সাংবাদিকের কাছে রবীন্দ্রনাথ একটি সাক্ষাৎকার দেন। তাঁর ভাষণের যে সমালোচনা হচ্ছিল তার উত্তরে তিনি বলেন যে তাঁকে ভুল বোঝা হয়েছে। পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী সভ্যতাকে তিনি অভিশাপ দিয়েছেন বক্তব্যের অতিসরলীকরণ মাত্র।