• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইজাক আসিমভের গল্প ‍‍‘শেষ উত্তর‍‍’


তাহসিনূর রহমান
প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০২২, ০৬:০৫ পিএম
আইজাক আসিমভের গল্প ‍‍‘শেষ উত্তর‍‍’

পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে ম্যুরে টেম্পলটন পার করছিল জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়, নিখুঁতভাবে কাজ করছে সব শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, শুধুমাত্র হৃৎপিন্ডের কয়েকটা ধমনী বাদে, কিন্তু যা ঘটার তার জন্য অতটুকুই ছিল যথেষ্ট।

অসহ্য একটা ব্যাথা হঠাৎ করে শুরু হয়েই আস্তে আস্তে কমে আসতে থাকে। ম্যুরে অনুভব করলো ওর শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসছে আর পুরো শরীরে ছড়িয়ে পরেছে এক ধরণের প্রশান্তি।

ব্যথা না থাকার চেয়ে আরামদায়ক আর কিছুই হতে পারে না – বিশেষ করে ব্যথা পাবার পরপরই। ম্যুরের নিজেকে হালকা হালকা লাগছে, মনে হচ্ছে যেন বাতাসে ভেসে আছে।

চোখ খুলে কিছুটা বিস্ময়ের সাথেই লক্ষ্য করল রুমের অন্যান্যরা এখনো উদ্বিগ্ন। কোনরকম জানান না দিয়েই ব্যাথাটা যখন শুরু হয় তখন ও ল্যাবরেটরীতে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে যেতে অন্যদের চিৎকার শুনতে পেয়েছিল, তারপরই ব্যাথার চোটে সব অন্ধকার।

ব্যাথাটা চলে গেলেও, অন্যরা এখনো চিন্তিত, এখনো ভীড় করে ঝুঁকে আছে ওর শরীরের চারপাশে– 

যেটার দিকে, হঠাৎ করে খেয়াল হলো, যে সে নিজেও তাকিয়ে আছে।

হাত পা ছড়িয়ে, মাটিতে চিৎ হয়ে পরে আছে, বিকৃত মুখ। আবার শূন্যে ভেসে, শান্তি শান্তি অবস্থায়, দেখছে সবকিছু।

তাজ্জবের উপর তাজ্জব! ভাবলো ম্যুরে: পরকালের প্রলাপ তাহলে সত্যি।

যদিও নাস্তিক একজন পদার্থবিজ্ঞানীর পক্ষে এভাবে মরে গিয়ে বিষয়টা জানতে পারা অপমানজনক, কিন্তু সামান্য বিস্ময় ছাড়া ওর মানসিক শান্তিতে কোনো তারতম্য ঘটল না।

ম্যুরে মনে মনে ভাবলো: ফেরেশতা বা এরকম একটা কিছুর তো আসার কথা আমার জন্য।

ইন্দ্রিয়ের অনুভূতিগুলো হালকা হয়ে আসছে, ক্রমেই অন্ধকার হচ্ছে চারপাশ, এবং দূরে, দৃষ্টির প্রায় শেষ সীমায়, প্রায় মানুষের মতো একটা আলোকময় অবয়ব দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, যা বেশ উষ্ণতা ছড়াচ্ছে।

ম্যুরে ভাবলো: হায় কপাল। আমি তাহলে স্বর্গে যাচ্ছি।

ভাবনাটা শেষ হতে না হতেই আলোর ঔজ্জ্বল্য কমে এল, যদিও উষ্ণতার অনুভূতিটা রয়ে গেছে। ম্যুরের মানসিক শান্তিতেও কোন ভাটা পড়ল না, যদিও পুরো মহাবিশ্বে একমাত্র সেই আছে - আর আছে একটা কণ্ঠস্বর।

কণ্ঠস্বর বলে উঠলো, “এতবার করার পরও, কাজ ঠিকমতো করতে পারার আনন্দ আমি এখনো পাই।”

ম্যুরে’র মনে হলো কিছু বলে, যদিও ও জানে না যে ওর কোন মুখ, জিহ্বা বা ভোকাল কর্ড আছে কিনা। তারপরও আওয়াজ করার চেষ্টা করল। মুখহীন অবস্থায়, শব্দ উচ্চারণ করার বা নিশ্বাসের সাথে বা ঠেলে বের করার চেষ্টা করলো – বা একটা কিছু।

আর কথাগুলো বের হয়ে আসলো। সে নিজের কন্ঠস্বর শুনতে পেল, চিনতে পারা যাচ্ছে, আর শব্দগুলোর উচ্চারণও পুরোপুরি স্পষ্ট।

ম্যুরে বললো, “এটা কি স্বর্গ?”

কন্ঠস্বর বলে উঠলো: “জায়গা বলতে তোমরা যা বোঝো, এটা তেমন কিছু না।”

একটু বিব্রত বোধ করলেও, পরের প্রশ্নটা না করলেই নয়। ম্যুরে বললো- “আহাম্মকের মতো শোনালে মাপ করে দেবেন। কিন্তু, আপনি কি ঈশ্বর?”

বাচনভঙ্গি বা স্বরের কোনরূপ পরিবর্তন নেই কণ্ঠস্বরের, তবে কিছুটা আমুদে শোনাল, “এটা একটা মজার ব্যাপার, এই প্রশ্নটাই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে আমাকে নানাভাবে করা হয়। তুমি বোধগম্য কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। আমি হলাম আমি, এটাই আমি তোমাকে বলতে পারি, আর তুমি এটাকে নিজের মনমতো যে কোন শব্দ বা ধারণা দিয়ে বুঝে নিতে পারো।”

ম্যুরে বলে উঠলো: “তাহলে আমি কী? আত্মা? নাকি আমিও শুধুমাত্র আমি?” প্রশ্নটা বিদ্রুপাত্বক ভাবে না করার চেষ্টা করলেও ম্যুরের নিজেরই মনে হলো ব্যাপারটা ব্যর্থ হয়েছে। বিদ্রুপাত্বক ভাবটা কমানোর জন্য শেষে সম্মানসূচক ‘মহানুভব’ বা ‘মহাত্মা’ লাগাবে কিনা ভাবলোও, কিন্তু কোনভাবেই মুখ দিয়ে বের হলো না, যদিও জীবনে এই প্রথমবার শাস্তির ভয় লাগছিল নিজের ব্যবহার বা পাপের জন্য। – ধ্যাত্তেরি, জাহান্নামে যাক সব, যেমনই হোক জায়গাটা।

কণ্ঠস্বরের শুনে মনে হলো না যে সে বিরক্ত হয়েছে। “তোমাকে ব্যাখ্যা করা সহজ, এমনকি তোমার নিজের কাছেও। যদি ভাল লাগে তাহলে নিজেকে তুমি আত্মা বলতে পারো, কিন্তু তুমি আসলে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক শক্তির একধরনের বিন্যাস, তোমার পার্থিব অস্তিস্ত্বতে তোমার মগজ যেমন ছিলো তার প্রতিলিপি, একদম ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ পর্যন্ত। ফলে তোমার চিন্তা করার ক্ষমতা, তোমার স্মৃতি, তোমার ব্যক্তিত্ব সবই আছে। ফলে তোমার মনে হবে তুমি আসলে তুমিই।”

পুরো ব্যাপারটা ম্যুরের কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে। “আপনি বলতে চান যে আমার মগজের নির্যাসটা অক্ষয়?”

“একদম না। তোমার কোনো কিছুই স্থায়ী না, আমি যেটুকু চাই সেটুকু ছাড়া। আমি বিন্যাসটা তৈরি করেছি। তুমি যখন বস্তুগতভাবে অবস্থান করছিলে তখনই আমি এটা তৈরি করেছি আর এমন ভাবে সমন্বয় করেছি যখন তোমার বস্তুগত অস্তিত্ব শেষ হয়েছে।”

কণ্ঠস্বরকে নিজের কাজে বেশ খুশি খুশি শোনাল আর একমূহুর্ত থেমে আবার বলতে শুরু করলো। “খুবই জটিল কিন্তু পুরোপুরি নিখুঁত বিনির্মাণ। নিশ্চিতভাবেই তোমার পৃথিবীর সব মানুষের জন্যই আমি এটা করতে পারি। কিন্তু আমি খুশি তেমন না করায়। বেছে বেছে কাজ করার মধ্যে একটা আনন্দ আছে, কি বলো।”

“আপনি তাহলে অল্প কয়েকজনকেই বেছে নেন?”

“খুবই অল্প।”

“আর বাকিদের কী হয়?”

“শূন্যে মিলিয়ে যায়! – ওহ্, অবশ্যই, তুমি ভেবেছিলে নরকে যায়!”

ম্যুরে লজ্জায় লাল হয়ে যেত, যদি পারতো। বললো, “আমি ভাবিনি তো। যদিও এমনটাই বলা হয়। কিন্তু তারপরও, আমি খালি ভাবছিলাম যে আমি নিশ্চয়ই ভাগ্যবান যে নির্বাচিত হবার জন্য আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছি।”

“ভাগ্যবান? – ওহ, বুঝতে পেরেছি তুমি কি বলতে চাইছো। এটা একটা ঝামেলার ব্যাপার যে নিজের চিন্তার জগৎটাকে জোড় করে ছোট করে আনতে হয় তোমার পর্যায়ে আসতে। কিন্তু না, আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি তোমার চিন্তা করার ক্ষমতার জন্য, যেমনটা আরও লক্ষ কোটি বেছে নিয়েছি, মহাবিশ্বের সকল বুদ্ধিমান প্রজাতিদের থেকে।”

ম্যুরে কৌতুহলী হয়ে উঠল, সারা জীবনের অভ্যাস। বললো, “আপনি নিজেই সবাইকে বেছে নিয়েছেন, নাকি আপনার মতো আরও কেউ আছে?”

মূহুর্তের জন্য ম্যুরের মনে হলো এই প্রশ্নটাতে কণ্ঠস্বর একটু অধৈর্য্য হলো, কিন্তু কথা শুনে কোন পার্থক্য করা গেল না। “আমার মতো আর কেউ আছে কি না তা জানা তোমার জন্য অপ্রাসঙ্গিক। এই মহাবিশ্ব আমার এবং একমাত্র আমার। এটা আমার ভাবনা, আমার তৈরি করা এবং শুধুমাত্র আমার ইচ্ছেতেই সব হবে।

“কিন্তু আপনার তৈরি করা লক্ষ কোটি বিন্যাসের মধ্যে আপনি যে আমার সাথে সময় ব্যায় করছেন? আমি কি এতই গুরুত্বপূর্ণ?

কণ্ঠস্বর বললো: “তুমি একদমই গুরুত্বপূর্ণ না। আমি অন্যদের সাথেও আছি, তোমার ধারণা অনুযায়ী মনে হবে একই সাথে।”

“তারপরও বলবেন আপনি একা?”

আমুদেভাবে কণ্ঠস্বর বলে উঠল, “তুমি আমাকে কথার অসঙ্গতির ফাঁদে আটকাবার চেষ্টা করছো। যদি তুমি একটা অ্যামিবা হতে, আর একটি মাত্র কোষের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র বুঝতে এবং একটা স্পার্ম তিমিকে প্রশ্ন করতে, যা ত্রিশ কোয়াড্রিলিয়ন কোষের তৈরি, যে সে কি এক না বহু, স্পার্ম তিমি সেক্ষেত্রে কি বললে অ্যামিবার পক্ষে বোঝা সম্ভব হবে ব্যাপারটা?”

ম্যুরে শুকনো গলায় বললো, “আমি এটা নিয়ে ভাববো। বুঝে উঠতেও পারি।”

“ঠিক তাই। এটাই তোমার কাজ। তুমি চিন্তা করবে।”

“কোন কাজে? আমার তো ধারণা, আপনি সবই জানেন।”

কণ্ঠস্বর বলে উঠলো, “আমি যদি সবকিছু জানিও, তাহলেও আমি জানি না যে, আমি সবকিছু জানি।”

ম্যুরে বলে উঠলো, “মনে হচ্ছে প্রাচ্যের কোন দার্শনিক প্রলাপ, শুনলে মনে হয় গভীর জ্ঞানের কথা, আসলে অর্থহীন।”

কণ্ঠস্বর বলে উঠলো, “তোমাকে দিয়ে হবে। তুমি আমার ধাঁধার জবাব ধাঁধা দিয়ে দিচ্ছ, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে বিষয়টা ধাঁধা না। ভেবে দেখ। আমি অনন্তকাল ধরে আছি, কিন্তু এর মানে কী? এর মানে আমি মনে করতে পারি না আমি কখন থেকে আছি। যদি আমি পারতাম তাহলে আমি অনন্তকাল ধরে থাকতাম না। আর যেহেতু আমি মনে করতে পারি না আমার অস্তিত্বের শুরু কোথায়, সেক্ষেত্রে অন্তত একটা বিষয় আছে - আমার অস্তিত্ব লাভের প্রকৃতি, যেটা আমি জানি না।

“এখন আমি যা জানি তা অসীম, আবার এটাও ঠিক যে জানার যত বিষয় আছে তাও অসীম, তার ফলে আমি কিভাবে নিশ্চিত হবো যে দুটো অসীমই সমান? আমার অসীম জ্ঞানের তুলনায় সম্ভাব্য জ্ঞানের অসীমতা অসীমগুণ বেশি হতে পারে। একটা সহজ উদাহরণ দেই: যদি আমি সকল জোড় সংখ্যাকেই জানি তাহলে আমি অসীম সংখ্যা জানতে পারি, কিন্তু তারপরও আমি একটাও বেজোড় সংখ্যা না জানতে পারি।”

ম্যুরে বলল, “কিন্তু বেজোড় সংখ্যা তো বের করা যায়। আপনি যদি জোড় সংখ্যার অসীম সিরিজকে দুই দিয়ে ভাগ করেন তাহলে আরেকটা অসীম সিরিজ পাওয়া যাবে, যার মধ্যে থাকবে বেজোড় সংখ্যার অসীম সিরিজ।”

কণ্ঠস্বর বললো, “তুমি বিষয়টা ধরতে পেরেছো। আমি সন্তুষ্ট। তোমার কাজ হবে এরকম আরো উপায় খুঁজে বের করা, অনেক জটিল জটিল উপায়, যা জানা তা থেকে যা এখনো জানা হয়নি, তা বের করা। তোমার পুরো স্মৃতিই রয়েছে। সকল তথ্য যা তুমি সংগ্রহ করেছিলে বা শিখেছিলে, এবং তা থেকে বিশ্লেষণ করে বের করেছিলে বা করবে সবই তুমি মনে করতে পারবে। যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে যে সমস্যার সমাধান করবে বলে তুমি ঠিক করবে, তার প্রাসঙ্গিক তথ্য শেখার সুযোগ তুমি পাবে।”

“এগুলো কি আপনি নিজেই করতে পারেন না?”

কণ্ঠস্বর বললো, “পারি, কিন্তু এভাবেই বেশি আনন্দদায়ক। আমি মহাবিশ্বটা তৈরি করেছি অনেক অনেক তথ্য নিয়ে কাজ করার জন্য। এর মধ্যে আমি যুক্ত করেছি আনসারটেনিটি প্রিন্সিপাল, এনট্রপি এবং অন্যান্য র‌্যানডমাইজেশন ফ্যাক্টর, যেন পুরো বিষয়টা খুব সহজেই বোঝা না যায়। বিষয়টা ভালোই কাজে দিয়েছে, কারণ মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পুরো সময়ই এটা আমাকে আনন্দ দিয়েছে।”

“এরপর আমি এমন জটিলতা তৈরি করেছি যেখান থেকে সৃষ্টি হয়েছিল প্রথম প্রাণ এবং তারপর বুদ্ধিমত্তা, যা আবার ব্যবহার করেছি গবেষণার জন্য, বিষয়টা এমন না যে আমার কোন সাহায্য দরকার, কিন্তু এর ফলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আরো একটা উপায় যুক্ত হয়। যার ফলে আমি আর আগে থেকে অনুমান করতে পারছি না যে এর পরের মজাদার তথ্যটা কখন কিভাবে, কোন পদ্ধতিতে পাবো।”

ম্যুরে বললো, “এমনটা কখনো হয়েছে?”

“অবশ্যই। এমন কোন শতাব্দী নেই, যেটাতে কোনে না কোনে মজার বিষয় পাওয়া যায়নি।”

“যেটা আপনি নিজেই ভেবে বের করতে পারতেন, কিন্তু করেননি?”

“হ্যাঁ।”

ম্যুরে বললো, “আপনি কি বাস্তবেই ভাবছেন যে আপনাকে আমি এভাবে খুশি করতে চাইবো?”

“পরবর্তী একশ বছরের মধ্যে? কোন সম্ভবনাই নেই। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে বিবেচনা করলে তোমার সাফল্য নিশ্চিত, কারণ তুমি অনন্তকাল ধরে এই কাজ করবে।”

ম্যুরে বলে উঠলো, “আমি অনন্তকাল ধরে এই চিন্তা করবো? যতদিন ইচ্ছা ততদিন?”

“হ্যাঁ।”

“কোন লক্ষ্যে?”

“তোমাকে তো এরমধ্যেই জানিয়েছি। নতুন নতুন জ্ঞান আবিষ্কার করার জন্য।”

“তা ঠিক আছে। কিন্তু আমার নতুন জ্ঞান আবিষ্কারের কারণ কী হবে?”

“যখন এই একই কাজ তোমার নশ্বর শরীর নিয়ে করতে, তখন এর কারণ কী ছিলো?”

ম্যুরে বললো, “নতুন জ্ঞান খুঁজে বের করা, যেটা শুধু আমিই পারব। সতীর্থদের প্রশংসা পাওয়া। সাফল্যে খুশি হওয়া, কারণ আমি জানি এর জন্য আমার সময় অল্প। এখন আমি যাই খুঁজে পাই আপনিও সেটা পারতেন যদি একটু কষ্ট করতেন। আপনি আমার কাজের প্রশংসা করতে পারবেন না, খালি আমোদ পেতে পারেন বড়জোড়। অনন্তকাল বরাদ্দ থাকলে কোন কাজের সাফল্যে কৃতিত্ব বা আনন্দ থাকে না।”

কণ্ঠ জানতে চাইল, “চিন্তা এবং আবিষ্কার করাটাই আনন্দ এমন তুমি মনে করো না? তুমি মনে করো না যে এটাই যথেষ্ট?”

“সীমিত সময়ের জন্য, হ্যাঁ। কিন্তু অনন্তকালের জন্য না।”

“তোমার কথা বুঝতে পারলাম। কিন্তু তোমার আর কিছু করার নেই।”

“আপনি বলেছেন আমাকে চিন্তা করতে। কিন্তু আপনি আমাকে বাধ্য করতে পারবেন না।”

কণ্ঠস্বর বললো, “সরাসরি কোন জবরদস্তি করার ইচ্ছে আমার নেই। দরকারও নেই। যেহেতু চিন্তা করা ছাড়া আর কোন কাজ করার নেই, ফলে চিন্তা তুমি করবেই। তুমি জানোই না কিভাবে চিন্তা না করতে হয়।”

“তাহলে আমি নিজেই নিজের জন্য লক্ষ্য স্থির করবো। উদ্দেশ্য খুঁজে বের করবো।”

কণ্ঠস্বর মেনে নেবার ভঙ্গিতে বললো, “এটা তুমি অবশ্যই করতে পারো।”

“আমি একটা উদ্দেশ্য পেয়েও গিয়েছি।”

“আমি কি জানতে পারি?”

“আপনি এরইমধ্যে জানেন। আমি জানি আমরা সাধারণভাবে আলাপ করছি না। আপনি আমার বিন্যাসটা এমনভাবে সাজিয়েছেন যে আমি মনে করছি আমি আপনার কথা শুনছি এবং আমি বলছি, কিন্তু আপনি সরাসরি আমার মধ্যে আপনার চিন্তা দিয়ে দিচ্ছেন এবং আমার থেকে চিন্তা নিয়ে নিচ্ছেন। এবং যখনই আমার চিন্তার ফলে আমার বিন্যাস পরিবর্তিত হচ্ছে আপনি তৎক্ষনাৎ তা ধরতে পারছেন, ফলে স্বেচ্ছায় আমার চিন্তা জানানোর কোন বিষয় নেই।”

কণ্ঠস্বর বললো, “তুমি আশ্চর্যজনকভাবে ঠিক বলেছ। আমি খুশি, কিন্তু তুমি তোমার চিন্তা স্বেচ্ছায় জানালে আমি খুশি হবো।

“আমি আপনাকে বলছি। আমার চিন্তার উদ্দেশ্যে হবে আমার যে বিন্যাস আপনি তৈরি করেছেন তা নষ্ট করার উপায় খুঁজে বের করা। আমি আপনার খেয়াল মেটানোর জন্য চিন্তা করতে চাই না। আমি চিরকাল আপনার খায়েশ পূরণের জন্য ভাবতে রাজি না। আমি আপনার পুতুল হিসেবে অনন্তকাল থাকতে চাই না। আমার সব চিন্তা হবে এই বিন্যাস নষ্ট করার উদ্দেশ্যে। এটা আমাকে শান্তি দিবে।

কণ্ঠস্বর বললো, “এতে আমার কোন আপত্তি নেই। এমনকি তোমার নিজের অস্তিত্ব ধ্বংস করার তীব্র বাসনা, তুমি না চাইলেও হয়তো নতুন, আরও কৌতুহলউদ্দীপক কিছু নিয়ে আসতে পারে। এবং অবশ্যই তুমি যদি তোমার আত্মহত্যার প্রচেষ্টায় সফল হতে পারও তাহলেও তুমি কিছুই অর্জন করতে পারবে না, কেননা আমি তোমাকে সাথে সাথে এমনভাবে আবার তৈরি করে নেবো, যেন তোমার আত্মহত্যার প্রচেষ্টা আর কাজ না করে। তুমি যদি আবারও নতুন কোনো পদ্ধতি খুঁজে বের করতে পারো নিজেকে ধ্বংস করার, আমি আবারো তোমাকে তৈরি করবো, পদ্ধতিটা অকার্যকর করে, এভাবেই চলবে। এটা মজার হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু তুমি অনন্তকাল ধরেই থাকবে। এটাই আমার ইচ্ছা।”

রাগে গা জ্বলে গেলেও ম্যুরে’র গলার স্বর শান্তই শোনাল। “শেষ পর্যন্ত আমি তাহলে নরকেই এসেছি? আপনি বলেছিলেন যে নরক বলে কিছু নেই, এটা যদি নরকই হয় তাহলে অবশ্য নরকের চালাকির অংশ হিসেবেই আপনি মিথ্যা বলবেন।”

কণ্ঠস্বর বললো, “এক্ষেত্রে তোমাকে নিশ্চিত করে কি লাভ যে তুমি নরকে নেই? যাই হোক, আমি তোমাকে নিশ্চিত করছি। স্বর্গ বা নরক বলে কিছু নেই। কেবল মাত্র আমিই আছি।”

ম্যুরে বললো, “ভেবে দেখুন তাহলে, আমার চিন্তা আপনার কোন কাজেই হয় তো লাগবে না। যদি আমি কোনো কাজেই না লাগি, তাহলে এটাই কি আপনার জন্য সুবিধাজনক না, যে আমাকে শেষ করে দেয়া এবং ভবিষ্যতে আমাকে নিয়ে আর কোন ঝামেলা না করা?”

“পুরষ্কার হিসেবে? তুমি নির্বাণ লাভ করতে চাও ব্যর্থতার পুরষ্কার হিসেবে এবং তুমি আমার ব্যর্থতাও নিশ্চিত করতে চাও? এটা কোনো চুক্তিই হলো না। তুমি অবশ্যই ব্যর্থ হবে না। অনন্তকাল যখন তোমার সামনে পরে রয়েছে তখন অন্তত একটা না একটা চিত্তাকর্ষক চিন্তা তুমি করবেই করবে, না চাইলেও করবে।”

“তাহলে আমি আমার জন্য অন্য আরেকটা উদ্দেশ্য ঠিক করবো। আমি নিজেকে ধ্বংস করার চেষ্টা করবো না। আমি আপনাকে ধ্বংস করার চেষ্টাকেই আমার লক্ষ্য হিসেবে ঠিক করবো। আমি এমন কিছু ভেবে বের করবো যেটা আপনি কোনদিন ভাবতে পারেননি শুধু না, কোনদিন ভাবতেও পারবেন না। আমি শেষ উত্তরটা বের করবো, যার পরে আর কোন জ্ঞান নেই।”

কণ্ঠস্বর বলে উঠলো, ‘অনন্ত সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই। এমন অনেক কিছু থাকতে পারে যেটা এখন পর্যন্ত আমার জানতে ইচ্ছে হয়নি, কিন্তু এমন কোন কিছুই থাকতে পারে না যা আমি জানতে পারবো না।”

ম্যুরে একটু ভেবে বললো, “আপনি আপনার সূচনা জানেন না। আপনি নিজেই বলেছেন। ফলে আপনি নিজের সমাপ্তিও জানেন না। ঠিক আছে তাহলে। এটাই হবে আমার লক্ষ্য এবং এটাই হবে সব প্রশ্নের উত্তর। আমি নিজেকে ধ্বংস করবো না। আমি আপনাকে শেষ করে ছাড়ব– যদি না আপনি আগেই আমাকে শেষ করেন।”

কণ্ঠস্বর বলে উঠলো, “বাহ! তুমি তো সাধারণের চেয়ে তাড়াতাড়ি ভেবে ফেললে। আমি ভেবেছিলাম তোমার আরো অনেকক্ষণ লাগবে এই পর্যন্ত ভাবতে। এই নিখুঁত এবং চিরন্তন চিন্তার জগতে এমন কেউ নেই যে আমাকে ধ্বংস করতে না চায়। কিন্তু এটা সম্ভব না।”

ম্যুরে বললো, “আমার সামনে অনন্তকাল রয়েছে আপনাকে ধ্বংস করার কোন না কোন উপায় খুঁজে বের করার।”

কোন উত্তেজনা ছাড়াই “করো তাহলে” বলে কণ্ঠস্বর চলে গেল।

কিন্তু ম্যুরে তার উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছে এবং তাতেই সে খুশি।

কোনো সচেতন সত্ত্বা, যা অনন্তকাল ধরে টিকে আছে, সে আর কি চাইতে পারে, শেষ ছাড়া?

কণ্ঠস্বর অন্য কী কোটি কোটি বছর ধরে খুঁজছে? অন্য আর কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে, যার জন্য বুদ্ধিমত্তা তৈরি করা হয়েছে এবং তাদের মধ্যে থেকে খুজেঁ খুজেঁ কাজে লাগনো হচ্ছে, এই অনুসন্ধানে সহায়তা করার জন্য? ম্যুরের বিশ্বাস যে ও-ই একমাত্র এই উত্তর পাওয়ার ক্ষেত্রে সফল হবে।

সাবধানে, লক্ষ্য অর্জনের উত্তেজনা নিয়ে, ম্যুরে চিন্তা করতে শুরু করল।

ওর হাতে অনন্তকাল রয়েছে।

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগের আরো খবর

Link copied!