• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
রম্যগল্প

অগ্রহায়ণের শীত মাঘের গায়ে


শফিক হাসান
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৬, ২০২৩, ১১:৪৪ এএম
অগ্রহায়ণের শীত মাঘের গায়ে

এক মাঘে শীত যায় না!

তাহলে কত মাঘে যায়?

মনজুর আলম সেই শৈশব থেকে প্রবাদটার মর্মার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করে আসছে; পারেনি অদ্যাবধি। ১২ মাসে যদি এক বছর হয়, তাহলে বছরে মাঘ মাস তো পড়বে একটাই। এর সঙ্গে যুক্ত হবে অগ্রহায়ণ ও পৌষ। অগ্রহায়ণ গায়ের হিমের সুই ঢুকিয়ে শীতকালের জন্য মানুষকে প্রস্তুত করতে থাকে। পৌষ ও মাঘ শেষ বাড়িটা মেরে কাঁপিয়ে দেয়, নাড়িয়ে দেয়। তাই বলে এক মাঘে শীত যায় না, এমন উক্তিকে সমর্থন করা যায় না। তবে এটা ঠিক, একবারে, মানে প্রথমবারে তেমন কিছুই হয় না। এ জন্যই বলা হয়, দান দান তিন দান। এই তিনটা দান থাকার কারণেই শেষবারে টেনেটুনে এসএসসি পাস করতে পেরেছে মনজুর। যদি প্রথম দফাতেই সব শেষ হয়ে যেত, তাহলে তার মতো অনেকেরই জীবন থমকে পড়ত। এইচএসসি পাস করেছে দুই দফায়; এরপর ভেবেছে তৃতীয় সার্টিফিকেট ডিগ্রি পাস করে ফেলবে প্রথম দফাতেই। 

হিসাবটা সহজ—তিন দুই এক। কিন্তু একের ঘরেই পৌঁছানোর আগেই ছিটকে পড়তে হলো কর্মজীবনে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী হিসেবে চাকরি শুরু করল।

এই অফিসের বসের আবার ছত্রিশ মাসে বছর। সেটাও বড় কোনো সমস্যা ছিল না, যদি না সেটা মনজুরদের ঘাড়ে না চাপত। ক্লায়েন্টদের সঙ্গে বসের সম্পর্ক ভালো না। সবার কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নেন, কিন্তু কাজ করেন না। এই তো সেদিন অফিস থেকে একজন ক্লায়েন্ট তাকে কল করলে বললেন, ‘অল্প একটু অপেক্ষা করুন। আমি তিনতলায় আছি।’

তিনতলা থেকে পাঁচতলায় উঠতে আর কতক্ষণ লাগে? বড়জোর তিন মিনিট! বস ফিরলেন টানা তিন ঘণ্টা পরে। এটা নিয়ে রাগারাগির পর জানা গেল, বস ছিলেন নিজ বাসার তিনতলায়। তারপর যানজট পেরিয়ে আসতে বাড়তি সময় লাগবেই! বসের নাম ‘উপায় নেই’! অবশ্য এটা কর্মীদের আবিষ্কৃত নাম। এরা অনেকেই শুনেছে ‘উপায় নেই গোলাম হোসেন’ প্রবাদটি। তাই বসের মূল নাম ছেঁটে ফেলে শুধু ‘উপায় নেই’ বলেই সম্বোধন করে আড়ালে-আবডালে।

উপায় যে নেই, এটা সত্য। উপায় থাকলে কি আর কর্মীরা এত কম বেতনে এই প্রতিষ্ঠানে পড়ে থাকত! ভাগ্য ভালো হলে তিন মাসে একবার বেতন হবে, তাও পুরোটা না। চাকরি পাল্টানোর চেষ্টা কম করেনি মনজুর; সর্বশেষ তার এক এলাকাতো ভাই বলেছেন, তিন লাখ টাকা ঘুষ দিতে পারলে সে একটি সরকারি অফিসে পিয়নের চাকরি ম্যানেজ করে দিতে পারবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনজুর তখন বলেছে, তিন লাখ টাকা থাকলে এর সঙ্গে আরও কয়েক লাখ টাকার কিস্তিঋণ নিয়ে সে মধ্যপ্রাচ্যেই চলে যেতে পারত। ওখানে দোকানে চাকরি করলে, হোটেলে থালা-বাসন মাজলে বা পেট্রোল পাম্পে তেল দিলেও মাসে মাসে বেতন পাওয়া যাবে। বেতন যদিও দেশ থেকে খুব একটা বেশি নয়, তবুও ভালো; বিদেশের মাটিতে থাকলে মাস শেষে অন্তত নিশ্চিন্তে বেতনটা মেলে।

মনজুরের মনিব বাবুল মিয়া তিনটি বিয়ে করেছেন। তিন বউয়ের সঙ্গে খিটিমিটি লেগেই থাকে। এর প্রভাব পৌঁছায় অফিস অবধি। কোনোদিন যদি বউদের সঙ্গে বেশি মনোমালিন্য হয়, সেদিন অফিসের প্রত্যেক কর্মীর খবর করে ছাড়েন। এজন্য কর্মীরা সবসময় প্রার্থনা করে, বউদের সঙ্গে যেন মনিবের ঝগড়া-বিবাদ না হয়। ম্যাডামরা যেন মাথা ঠান্ডা রাখেন!

কথায় আছে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়। আর মনজুর করে ফেলেছে রাত! একে তো সেদিন অফিসে আসতে দেরি হয়েছে, উপরন্তু এসে দেখে তার চেয়ারে বসে আছেন বসের ছোট বউ সাবিহা। মনজুরকে দেখেই সাবিহা ম্যাডাম রাগলেন, ‘এই তোমার অফিসে আসার সময় হলো? কী অজুহাত দেবে, যানজট ছিল!’

মনজুর জানে এরা ঠুঁটো জগন্নাথ, শুধু মুখেই চোটপাট। তাই নির্বিকারভাবে বলল, ‘না, ম্যাডাম। আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। তাই সকালে মামার বাসায় যেতে হয়েছে।’

‘তুমি বিয়ে করবে? খুব ভালো, খুব ভালো! পরিচিত ভালো মেয়ে আছে। আমার ছোট বোন। আশা করি তোমার পছন্দ হবে।’

‘আমার বিয়ে মোটামুটি ঠিক হয়ে গেছে।’

‘তাতে কী, আরেকটা করবে! তোমার স্যার তিনটা বিয়ে করেননি?’

মনজুর ধারণা করল, বস এখনো অফিসে আসেননি। এলে সাবিহা ম্যাডাম তার রুমে বসেই চেঁচামেচি করতেন। প্রত্যুত্তরে বলল, ‘জি। বাবাকে বলে দেখি। আপনি স্যারের চেয়ারেই বসতে পারেন।’

‘সেটা পারলে কি তোমার এখানে আসি? ওখানে বড় বউ বসে আছেন সকাল থেকেই। তোমার স্যার কোথায়?’

‘সেটা কীভাবে বলব? দেখতেই পাচ্ছেন, আমি এখন এলাম!’

স্বগতোক্তি করলেন সাবিহা, ‘বিদেশে পালায়নি তো আবার!’

সাহস করে মনজুর বলল, ‘মেজ ম্যাডাম আসেননি?’

‘সেও এসেছে। ওই দেখ।’

সামনে তাকিয়ে মনজুর লক্ষ্য করল অসহায় রুদ্ররোষে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন মেজ ম্যাডাম। তার দাঁতের কিড়মিড় শব্দই বলে দিচ্ছে, স্যারকে সামনে পেলে জ্যান্ত খেয়ে ফেলবেন আজ। ছোট ম্যাডাম যেহেতু আত্মীয়তার সম্পর্কের কথা বলেছেন, বিয়েটা হয়ে গেলে তখন তার সঙ্গে ঠাট্টা-মশকরার সম্পর্ক সৃষ্টি হতে পারে। তাই সাহস করে মনজুর বলে বসল, ‘স্যার কি আজও গুরুতর কোনো অন্যায় করেছেন?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাবিহা বললেন, ‘বাকি দুই বউয়ের কথা জানি না। আমার সঙ্গে কোনো ঝামেলা হয়নি।’

‘তাহলে আপনিও এভাবে অফিসে চলে এলেন কেন?’

‘কম দুঃখে আসিনি রে, ভাই। অগ্রহায়ণ মাস চলে এসেছে। আমার আবার ঠান্ডার সমস্যা। শীতকাল ঝগড়াঝাঁটি, গালমন্দ করতে পারি না। গলা বসে যায়। তাই আগেভাগেই সব সেরে নিচ্ছি। আসুক আজ মিনসে!’

সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলল মনজুর। ম্যাডামের বোনেরও যদি শীতজনিত সমস্যা থাকে, তাহলে স্বামী হিসেবে সে বছরে অন্তত তিন মাস শান্তিতে থাকতে পারবে!

Link copied!