বিখ্যাত আব্বাসউদ্দীন যখন ছোট ছিলেন, তিনি এক লোকের বাসায় দেখেন গ্রামোফোন। খুবই অবাক ভেতরে কে গান গায়। বাসার কর্তাকে বারবার প্রশ্ন, ভেতরে কে গান গায় তাকে দেখা যাবে। রসিক কর্তার বাজারে যাওয়ার দরকার ছিল হয়তো। বললেন, তোমার ঘর থেকে পাঁচ সের চাল এনে দাও দেখাচ্ছি। পড়িমড়ি করে দৌড়ে বাড়িতে গেলেন, মাকে বোনকে দেখছেন না। তাড়াতাড়ি চাল এক গামলায় ঢুকিয়ে দৌড়ে যাচ্ছেন, মনে বিশ্বজয়ের খুশি। কর্তা চালটাল ঢুকিয়ে বললেন কেউ নেই গ্রামোফোনের ভেতরে, একটা প্লেট তাতে বাজতেছে।
তাঁকে বুঝতে আমাদের ফিরে যেতে হবে নব্বই বছর আগের গ্রামোফোন যুগে। ফিরে যেতে কাজী নজরুল ইসলামের গান লেখা ও সুরারোপের শ্রেষ্ঠ সময় যখন। স্মরণ করতে হবে বিখ্যাত শিল্পী আব্বাসউদ্দীনকে। আব্বাসউদ্দীন প্রথম শিল্পী, যিনি মুসলমানদের ভেতর স্বনামে রেকর্ড বের করেছেন। মুন্সী মুহম্মদ কাশেমও বড় শিল্পী ছিলেন। তিনি কে মল্লিক নামে রেকর্ড বের করতেন। কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। কেউ ভাবতেই পারেনি এত ভালো শ্যামাসংগীত-নজরুলগীতি একজন মুসলমান শিল্পী গায়। সমসাময়িক বেশির ভাগ শিল্পী তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ ছিলেন। এত সাফল্যের পর তিনি কলকাতা ছেড়ে দিয়ে বর্ধমানে শেষ জীবন কাটিয়েছেন। আব্বাসউদ্দীনকে বলা যায় একজন নিজে নিজে তৈরি হওয়া শিল্পী। তাঁর আত্মজীবনী পড়লে জানা যায়, তিনি কলের গান শুনে শুনে গাইতেন। কোচবিহারের সেই শুষ্ক সমতলে লোকজনের পল্লী সুর তিনি সহজেই অন্তরে ধারণ করতেন। চাকরি করতেন সরকারি। মুসলমান আর দশটা ছেলের মতোই গান গাওয়াকে তিনি পেশা হিসেবে নিতে পারেননি প্রথম জীবনে। নজরুলের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তিনি তাঁকে দিয়ে গাওয়ান দুটো গান। তাঁর রেকর্ড জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তখন তিনি আধুনিক গান গাইতেন। কবির পরামর্শে তিনি লোকগীতি ও ভাওয়াইয়া শুরু করেন, রেকর্ড বের করেন। সেখানেও তিনি অত্যন্ত সফল। তবু সৃষ্টির নেশা ছিল তাঁর। তিনি চিন্তা করে দেখলেন অবাঙালি মুসলমানরা এত কাওয়ালি শুনলে, হিন্দুরা এত শ্যামাসংগীত, রামপ্রসাদী ও ভক্তিমূলক গান শুনলে, মুসলমানরা কেন বাংলায় ইসলামি গান শুনবে না।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম তেমন সায় দেননি ব্যাপারটায়। শত শত শ্যামাসংগীত লিখে তুমুল ব্যস্ত কবির ধারণা ছিল, মুসলমানরা গান গাওয়াকে গুনাহের কাজ ভাবে এমনিতেই। টাকা দিয়ে রেকর্ড কারা কিনবে? আব্বাসউদ্দীন না থাকলে বাংলায় গজল হামদ নাত ইসলামি গান কিছুই হতো না।
চীনের প্রেসিডেন্ট একবার এলেন ঢাকা। গুলিস্তান হলে কালচারাল প্রোগ্রাম, সেখানে তিনি প্রধান অতিথি। সারা দিন অসহ্য গরম ছিল, অনুষ্ঠানের শেষ গান গাইলেন আব্বাসউদ্দীন আহমেদ, আল্লাহ মেঘ দে পানি দে। অনুষ্ঠান শেষে বের হওয়ার সময় দেখা গেল তুমুল বৃষ্টি চারদিকে। বিদায়ের সময়ে এয়ারপোর্টে জানালেন চায়নিজ ভিভিআইপি, অনেক কারণে তোমাদের দেশের কথা মনে থাকবে, সবচেয়ে বেশি মনে থাকবে তোমাদের এক শিল্পী গান গেয়ে বৃষ্টি নামাতে পারে।
আহমদ ছফার একটা চমৎকার ব্যাখ্যা আছে। কেন অবিভক্ত ভারতে আব্বাসউদ্দীনরা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে শিল্পী হতে পেরেছেন আর পাকিস্তান আমলে নতুন কিছু তেমন দিতে পারেননি। কারণ, পাকিস্তানের শুরু থেকেই আমাদের অধিকতর মুসলমান হওয়ার লোভ ও পাঞ্জাবিদের সবকিছুকে নস্যাৎ করার কালচার সঙ্গে আছে নিজের চেনা পরিবেশ থেকে এসে ঢাকার অন্ধকারে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। এর কারণে আব্বাসউদ্দীন সাতচল্লিশের পর নিজের গৌরবান্বিত অতীতের চর্বিত চর্বন ছাড়া আর কিছুই থাকল না। জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিয়ে স্মরণ করি এই মহান শিল্লীর কথা।