বেলা তখন বারোটা। থেমে থেমেই বৃষ্টি হচ্ছিল। শ্রাবণ মাস। এই বৃষ্টি তো এই রোদ। হালুয়াঘাটে আসতেই বৃষ্টিও যায় বেড়ে। পাহাড়ের পাদদেশের শহর বলেই হয়তো আবহাওয়ার এ হাল।
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের একপাশে মেঘালয়। আকাশছোঁয়া শত শত পাহাড় রয়েছে সেখানে। দূর থেকে তা দেখতে বেশ লাগে। বর্ষায় মেঘগুলোকে যেন ছুঁয়ে দেয় মেঘালয়ের পাহাড়গুলো। আর অমনি বৃষ্টি হয়ে তা ঝরে পড়ে হালুয়াঘাটের বুকে।
চাষং অপেক্ষায় ছিল মোটরবাইক নিয়ে। মোটরবাইক ছাড়া এ অঞ্চলে ঘুরে বেড়ানো প্রায় অসম্ভব। বাসস্ট্যান্ডে পা দিতেই হাসিমুখে স্বাগত জানাল সে। এই মান্দি বা গারো যুবকটিই আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে এখানকার আদিবাসী পাড়াগুলোতে।
হালুয়াঘাট থেকে ১০ কিলোমিটার ভেতরে আচকিপাড়া। সেখানে দুপুরের খাবার সেরে নিই সুমনা চিসিমদের বাড়িতে। সুমনা আমার বিশেষ পরিচিত। তার উৎসাহেই এসেছি হালুয়াঘাটে।
আমরা যাব ডালু পাড়ায়। কিন্তু ডালুদের কোন সন্ধান জানা নেই সুমনা চিসিমের। শুধু বললেন, ’৬৪-এর রায়টের সময় ঘরবাড়ি ফেলে অধিকাংশ ডালুই চলে গেছে মেঘালয়ে।’
সুমনাদের পাশেই বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রংয়ের বাড়ি। সেখানে পা রেখেই ডালুদের সন্ধান জানতে চাই। সঞ্জীব দ্রংয়ের গড়া সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, হালুয়াঘাট বাজারে রয়েছে একটি ডালু পরিবার। চাষং জেনে নেয় ঠিকানাটি।
গ্রিলের দোকানে কাজ করেন আনন্দ ডালু। কিন্তু তিনি নিজেকে এখন আর ডালু বলে পরিচয় দেন না। হিন্দু পরিবারে বিয়ে করে তার নামটিও পাল্টে ফেলেছেন বহু আগেই। তার নাম এখন দিগেন চন্দ্র রায়। ডালু আদিবাসীদের না পেয়ে খানিকটা হতাশ হই। কিন্তু হাল ছাড়ি না।
বাজারের পাশেই খুঁজে পাওয়া গেল এক ডালু পরিবারকে। গৃহকর্ত্রী জয়া ডালুর সঙ্গে আলাপ হতেই জানলাম তাদের গ্রামের বাড়ি জয়রামকুড়ায়। সেখানে এখনো ডালুদের একটি আদিবাসী পাড়া রয়েছে। সবকিছু জেনে রওনা হই সেদিকে।
আবারও ঝিরঝির বৃষ্টি। আঠালো কাদামাটির পথ পেরিয়ে এগোতে থাকি। চলার পথে চাষং জানাল, ডালুরা মিশে যাচ্ছে অন্য জাতির মাঝে। অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে গারো, হাজং আর সনাতন হিন্দু সংস্কৃতিতে। ফলে এখন আর তাদেরকে আলাদাভাবে চেনা যায় না।
রাস্তার ঠিক পাশেই মিলল এক ডালু বাড়ি। মাটি আর ছনে ছাওয়া ছোট ছোট তিনটি ঘর। ঘরগুলোতে নেই কোনো জানালা। রান্নাঘর আর গোয়ালঘর লাগোয়া। উঠোনের একপাশে তুলসীগাছ। পাশেই মাটির তৈরি ছোট্ট একটি প্রার্থনা ঘর। গোটা বাড়িটিতে দারিদ্র্যের ছাপ বেশ স্পষ্ট।
আমাদের পায়ের শব্দ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন এক বৃদ্ধ। নাম শুকনা ডালু। বয়স জানালেন আশি। লাঠিতে ভর দিয়ে চলেন তিনি। এখানকার ডালুদের মধ্যে তিনিই বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি। বাড়ির ছোট্ট বারান্দাতে বসে তার সঙ্গে চলে কথোপকথন।
ডালুরা ইন্দো-মঙ্গোলয়েড গোষ্ঠীর একটি শাখা। নৃবিজ্ঞানীদের মত তেমনটাই। কিন্তু এ আদিবাসীরা মনে করে তারা মহাভারতে বর্ণিত অর্জুনের পুত্র বভ্রুবাহনের বংশধর। বভ্রুবাহনেরই অধঃনস্ত ছিলেন সুবলা সিং মতান্তরে ডালজী। একসময় তাকে তার স্বদেশভূমি মনিপুর থেকে বিতাড়িত করা হয়। তিনি তখন দলবলসহ আসামের পুরো মধ্যাঞ্চল ও দুর্গম গারো পাহাড় পার হয়ে ভোগাই নদের তীরে বারেঙ্গাপাড়া নামক স্থানে এসে প্রথম বসতি গড়ে তোলেন। ডালজী প্রথম বসতি গড়েছিল বলেই তার নামানুসারে ওই স্থানের নামকরণ করা হয় ডালুকিল্লা। বর্তমানে যা ডালুবাজার বা ডালুগাঁও নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে এ ডালুগাঁও থেকে উত্তরে হাড়িগাঁও, দক্ষিণে হাতিপাগাড়, কুমারগাতি, সংড়া, জুগলী প্রভৃতি স্থানসহ কংশ নদের পাড় পর্যন্ত ডালুরা বসতি বিস্তৃত করে।
বাংলাদেশে ডালুদের সংখ্যা মাত্র দেড় হাজারের মতো। সেটিও ১৯৯৭ সালের আদমশুমারির সময়ের তথ্য। জয়রামকুড়া ছাড়াও হালুয়াঘাটের সংড়া, মনিকুড়া এবং শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলায় এদের বাস। এ দেশে ডালু আদিবাসীদের সংখ্যা কম হলেও ভারতের আসাম রাজ্যের নওগাঁ, দরং, গোয়ালবাড়ি এবং মেঘালায় রাজ্যের ফুলবাড়ি, গারোবাদা, তুরা প্রভৃতি জেলায় বিপুলসংখ্যক ডালু আদিবাসী রয়েছে।
ডালুদের গোত্র নিয়ে আলাপ উঠতেই শুকনা ডালু জানালেন, তাদের প্রধান গোত্র তিনটি—চিকাং, পিড়া এবং মাশী। ডালু ভাষায় এটি ‘দপফা’। এ ছাড়া রয়েছে আরও সাতটি উপগোত্র। হরহর করে তিনি বলে যান সাতটি নাম- দরুং, নেংমা, কাড়া, মাইবাড়া, বাপার, কনা এবং গান্ধী। ডালু সমাজে সন্তানেরা মায়ের গোত্রনাম লাভ করে। এদের একই গোত্রে বিয়েও নিষিদ্ধ থাকে।
হঠাৎ ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে এক নারী। কপালে তার ভরাট সিঁদুর। পরনে ডালুদের পোষাক ‘পাথানি’। হাতে সাদা শাখা। বাঁশের ডালাতে করে মুড়ি এনেছেন তিনি। শুকনা ডালু পরিচয় করিয়ে দেন তার ছেলে লিটন ডালুর স্ত্রী পুতুলী ডালুকে।
মুড়ি খেতে খেতে পুতুলীর কাছে শুনি ডালু নারীদের অলংকারের গল্প। একসময় ডালু মেয়েরা গলায় হাঁসুলী, মিক্কিছড়া, কানে-কানখিরি, বাহুতে- কাটাবাজু, নাকে- নাকঠাঁসা, নোলক, পায়ে-বেকীখাঁড়ু, ঠ্যাংপাতা প্রভৃতি পরত। কিন্তু এখন হিন্দু নারীদের মতো শুধুই শাঁখা, চুরি আর মালা পরে তারা।
ডালুদের প্রিয় খাবার কী? উত্তরে পুতুলী বলেন, খাবাররীতি অনেকটাই গারোদের মতো। ক্ষারের জল বা বিলাতি সোডা দিয়ে রান্না করা তরকারি তাদের কাছে উপাদেয়। হিঁদল শুঁটকি তাদের তরকারি রান্নায় অন্যতম উপকরণ। কচি বাঁশ ও কলার মোচা তাদের কাছে অতি প্রিয়। তবে গরু ও মহিষের মাংস একেবারেই নিষিদ্ধ। এ আদিবাসীদেরও প্রিয় পানীয় ‘পঁচুই মদ’। ডালু নারীরা এই মদ তৈরিতে পটু।
শুকনা ডালুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে খানিকটা এগোই। বড় একটি দিঘির পেছনটাতে সন্ধান পাই ডালুদের পাড়াটির।
ছয়-সাতটি বাড়ি মাত্র। মধ্যখানে উঠোন। বেশ পরিষ্কার ও পরিপাটি। কোদাল নিয়ে বৃষ্টির পানি সরাচ্ছিলেন এক বৃদ্ধা। নাম আলেফা ডালু। এ পাড়ার প্রধান কে? এমন প্রশ্নে তিনি নীরব থাকেন। ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন বৃদ্ধার ছেলে নিতায় ডালু। তিনি বলেন, ‘এ পাড়ায় কোনো প্রধান নেই। শুকনা ডালুকেই আমরা মোড়ল বলে মানি।’
একসময় ডালুদের এক একটি গ্রাম পরিচালিত হতো একেকজন মোড়ল বা সরকারের মাধ্যমে। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যাদি নিরসনে ডালুরা তার ওপরই নির্ভর করত। পুরো সমাজ মোড়লের একক নিয়ন্ত্রণে থাকত। শিক্ষা ও আর্থিক বিবেচনায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচন করা হতো মোড়ল বা সরকারকে।
ব্রিটিশরা ডালুদের মোড়ল বা সরকারের পরিবর্তে গাঁওবুড়ার পদ প্রবর্তন করে। এরাই ডালুদের মাঝে সমাজনেতা হিসেবে দায়িত্বপালন, ছোটখাটো বিচার সমাধা, অর্থ দণ্ডে দণ্ডিত করা ও সামাজিক বা পরিবারিক বিবাদে মধ্যস্থতা করত। সময়ের হাওয়ায় ডালু সমাজে আজ লুপ্ত হয়েছে সে নেতৃত্বও।
নিতায় পড়াশোনা করেছে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। তার মতে, ডালুরা অন্য জাতির আদিবাসীদের মতো ততটা সচ্ছল নয়। ফলে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর চেয়ে কাজে নিয়ে যাওয়াকেই তারা উত্তম বলে মনে করে।
তাঁদের পেশা কী? এমন প্রশ্নের উত্তর মিলে আলেফা ডালুর মুখ থেকে। তিনি বলেন, গারো ও হাজংদের মতো এ আদিবাসীরাও কৃষির উপর নির্ভরশীল। একসময় এক একটি ডালু পরিবারের প্রচুর ভূসম্পদ ছিল। বসত বাড়ির আশপাশে মৌসুমি সবজি ফলাতে এরা ছিল পারদর্শী। কিন্তু বর্তমানে জমি হারিয়ে অধিকাংশ পরিবারই হয়েছেন ভূমিহীন। ফলে অন্যের জমিতে কাজ করে জীবিকা চালাচ্ছেন তারা। আবার অনেক ডালুই হাতের কাজ, কুটির শিল্প, ছুতের মিস্ত্রি, কর্মকার প্রভৃতি পেশায় যুক্ত হয়েছেন। এভাবে তারা হারিয়ে ফেলেছে তাদের পূর্বপুরুষদের পেশাটা।
সন্ধ্যা তখন হয় হয়। উঠোনের একপাশে তুলসী থানে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালিয়ে ভক্তি দেওয়ার প্রস্তুতি নেয় নিতায়ের স্ত্রী কবিতা ডালু। বাড়ি বাড়ি তুলসী ঠাকুর ছাড়াও এ পাড়ায় বাস্তুদেবতা ‘থান’ রয়েছে। এ আদিবাসীদের বিশ্বাস বাস্তুদেবতার সন্তষ্টি ছাড়া সমাজে কারোই মঙ্গল হয় না। তাই তারা নিয়মিত পুজোর আয়োজন করে। পুজোর কথা উঠতেই নিতায় বলেন, ‘শক্তির দেবী শ্যামাকে আমরা পুজি। এছাড়া গৌরি, নিতাই ও মনসা আমাদের প্রধান দেবদেবী।’
হঠাৎ উলুধ্বনি দেয় কবিতা। আমরা নীরব থাকি। ডালুরা স্মরণ করে তাদের বিশ্বাসের দেবতাদের।
এ অঞ্চলের গারো ও হাজংরা ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান হলেও ডালুরা হন সনাতন হিন্দু। ধর্মান্তরিত হয়ে গারো ও হাজংরা হারিয়ে ফেলেছে তাদের আদি সংস্কৃতিগুলোকে। কিন্তু পেয়েছে চিকিৎসাসেবা, ছেলেমেয়েদের শিক্ষা আর উন্নত ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা। কিন্তু ডালুদের ক্ষেত্রে তা-ও ঘটেনি। মূলধারার সনাতন হিন্দুরা যেভাবে পূজার্চনা করে, তারাও সেভাবেই তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। কিন্তু তবু সনাতনপন্থি বর্ণহিন্দরা তাদের আজও গ্রহণ করেনি।
শুধু তা-ই নয়, এরা কোন উৎসবে ডালুদের সঙ্গে একত্রে ভোজন পর্যন্ত করে না। ফলে বুকের ভেতর বৈষম্য আর কষ্টের বোঝা সব সময় বয়ে বেড়াচ্ছে এ দেশের ডালু আদিবাসীরা। তাই ফেরার পথে নিতায়ের কাছে প্রশ্ন ছিল- ডালুরা কি হিন্দু? দীর্ঘশ্বাস ফেলে দৃঢ় কণ্ঠে নিতা শুধু বললেন, ‘না বাবু, আমরা সব সময়ই আদিবাস’।