ডেভিড বোওয়ির গান আছে, উই ক্যান বি হিরোজ জাস্ট ফর ওয়ানডে। পুরো অতিকথনে ভরা গান। আমরা কখনোই হিরো হতে পারবো না। হিরো ছিলেন আমজাদ হোসেন, থাকার জায়গা নেই। প্রখ্যাত লেখক শওকত আলীর হলের সিটে গেস্ট হয়ে বসে লিখে ফেললেন, ‘ধারাপাত’ নামে একটা গল্প। ভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের দিয়েই তা মঞ্চস্থ করান। সৈয়দ শামসুল হক ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউটে মঞ্চ নাটকটা দেখে বিখ্যাত ‘চিত্রালী’র পাতায় দুই পাতা সমালোচনা লেখেন। তিন দিন পরেই এক প্রযোজক এসে বলেন, আমরা আপনার ধারাপাত নিয়ে সিনেমা বানাবো। আমজাদ হোসেন বলেন, আমার নাটক তো আপনারা দেখেননি। প্রযোজক বলেন, হক ভাই লিখছে, তাই যথেষ্ট। আর আমার পরিচালক তো আপনার সঙ্গে বসবেনই চিত্রনাট্য নিয়ে।
আমজাদ হোসেন ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভার আরেক নাম। তিনি একজন অসামান্য লেখক। বেহুলা ছবিতে তিনি যখন জহির রায়হানের সহকারী ছিলেন, তখন দেখা গিয়েছিল চিত্রনাট্য মোটামুটি তিনি প্রস্তুত করেছেন। এমন কি জীবন থেকে নেয়ারও চিত্রনাট্যের উল্লেখযোগ্য অংশ তার রচিত। কিন্তু যেহেতু তিনি নবীন, আর তখনকার পরিচালকরা সব ক্রেডিট নিজের কাছেই রাখতে ভালোবাসতেন। আমজাদ হোসেন সিনেমার সব কিছুতেই অংশগ্রহণ করতেন। এটা পরে যখন তিনি নিজে সিনেমা বানিয়েছেন কাজে লেগেছে। লাইট ক্যামেরা থেকে অভিনয়ের পরিমিতিবোধ, সবকিছুতেই তিনি ছিলেন পারদর্শী। অনেকেই নিজেকে শেকড় সন্ধানী দাবী করেন। বাংলাদেশের সিনেমায় আমজাদ হোসেনের মতো গ্রামীণ মানুষদের দুঃখ সুখের গল্প আর কেউ বলেননি। গ্রামীণ প্রেম, কূটনীতি, অবক্ষয়, ভালোবাসা, পরাজয়, লড়াই এসবই তার সিনেমার গল্প।
আমজাদ হোসেন জন্মেছিলেন জামালপুরের এক গ্রামে। এক নিভৃত পল্লীতে তিনি কাটিয়েছেন শৈশব। তার চারপাশে ছিল দারুণ প্রকৃতি ও অনাহারী আর অভাবী মানুষের ভিড়। এই মানুষরাই পরে তার সিনেমার চরিত্র হয়। স্কুলে থাকতেই তিনি একবার পালিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন, বাড়ির চাল বিক্রি করে। কয়েকদিন ছিলেনও ঢাকায়। মায়ের জন্য খুব মন খারাপ হয়, এ জন্য আবার ফিরে যান। এই ভাইবোন স্নেহ ও মায়ের প্রতি আবেগ এসব তার সিনেমাতে থাকবেই।
এখন বিখ্যাত নায়ক কমল হাসান বলেন, ‘যে সিনেমায় মৌলিক ইমোশন থাকতে হবে, যা দর্শক কানেক্ট করতে পারে। দর্শক কানেক্টেড হলে সিনেমা চলবেই।’ আমজাদ হোসেন এসব কাজ কত আগেই করে ফেলেছেন। ওনারা নিজের মধ্য মেধাকে জনরুচি বলে চালিয়ে দিতেন না। বরং জনরুচিকে কীভাবে উন্নত করা যায়, সাধারণ ব্যাপার দিয়েই সেটাই ছিল লক্ষ্য।
আমজাদ হোসেন সিনেমা বানিয়েছেন দুডজনের কাছাকাছি। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন নয়টা। এত বিপুল অর্জনের পরেও এসব ছাপিয়ে আমি তার গীতিকবি ভূমিকাটাকে বড় করে দেখবো। তিনি এত ভালো গান কীভাবে লিখতেন, এটা আমার মাথায় এখনো আসে না। কী দারুণ সব গান, ‘হায় রে কপাল মন্দ’, ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসতো’, ‘আমি আছি থাকবো’, ‘এমন তো প্রেম হয়’। এত অসাধারণ সব গান। তিনি কিন্তু গীতিকার ছিলেন না। সিনেমা করতে গিয়ে বুঝলেন, যেমন গান চান তেমন হচ্ছে না সবসময়। তাই নিজেই লিখতে বসেন। এমন কি তিনি গান লিখতেন সিনেমা দৃশ্য ধারণের অবসরে। সবাই ঘুমোচ্ছে, তিনি রাত জেগে সিগারেট খেতে খেতে গান লিখছেন। গান সেখান থেকেই চলে যেত আলাউদ্দিন আলীর কাছে। আলাউদ্দিন আলী যত মেলোডি জানতেন সব উজাড় করে দিয়েছেন আমজাদ হোসেনের জন্য। এত ভালো সুর আর সংগীত আয়োজনে এত মিনিমালিস্টিক এপ্রোচ ভাবা যায় না। ববিতা যখন লিপে আনেন সুন্দরী ছবিতে, ‘আমি আছি থাকবো ভালোবেসে মরবো’, কি যে অসাধারণ লাগে, সাদা কালোতেই।
তার ছবিতে কি সব গান থাকতো যেগুলো কেউ হয়তো মন দিয়েও শোনেনি। এর ফিলোসোফিকাল ডেপথ নিয়েও ভাবেনি। যেমন ‘নয়ন মনি’ ছবিতে, ‘এত সুন্দর হেরেম বাদশা/ কত তোমার গুন/ আইতে না আইতে ঘরে লাগাইলা আগুন’। এই সিনেমাটা আমজাদ হোসেনের ‘নিরক্ষর স্বর্গে’ উপন্যাস থেকে নেওয়া। এই অভাবের দেশে আমরা তো সবাই এমনি, জন্ম থেকেই জ্বলছি ও না চাইতেই সব তছনছ করে দিচ্ছি। আমজাদ হোসেন তার সিনেমায় গানের পক্ষে মানুষকে টানতেন। দেখবেন তার ছবিতেই আছে গান, ‘কোন কেতাবে লেখা আছে গো হারাম বাজনা গান’ কিংবা আমাদের সবার প্রিয় গান আমজাদ হোসেনের লেখা, ‘বাবা বলে গেল আর কোনোদিন গান করো না।’ গানটায় আছে সলিল চৌধুরীর প্রভাব, কিন্তু ছোটবেলায় কি আর এত বুঝতাম। মনে হতো এর চেয়ে আলোকিত কথা সুর আর কী হতে পারে?
এই মুসলমান বাঙালি সমাজে গান বাজনা নিয়ে যে প্যারাডক্স, তার বিরুদ্ধে ওনারাই কাজ করেছেন। আর আমরা কী করেছি, এই গানের জীবিত শিল্পীকে মৃত বানিয়েছি। অথচ শিল্পী শামীমা ইয়াসমিন দিবা বেশ ভালো আছেন যুক্তরাষ্ট্রের এক শহরে। খালি তার ফেসবুক নেই বলে আমাদের কাছে হারিয়ে যাওয়া মানুষ। তাই আমজাদ হোসেনের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে এত বড় লেখা লিখতে হলো। কারণ সামষ্টিক স্মৃতিভ্রষ্টতার বিপক্ষে আমি কিছুটা হলেও তো লড়েছিলাম।