• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কথার জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ


সাধন সরকার
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৩, ২০২২, ১২:১৫ পিএম
কথার জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ

বাংলাসাহিত্যের নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্রকার, গীতিকার, গল্পকার, চিত্রকর, নাট্যকারসহ আরও অনেক কিছু। কলাম লেখক হিসেবে ও কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যেও তার খ্যাতি ছিল। ১৯৭২ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হলে তার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি বাংলার পাঠক সমাজকে কথার জাদুতে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিলেন। পাঠক তৈরির কারিগর ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। সব বয়সী পাঠকরাই তার লেখার ভীষণ ভক্ত। আশির দশকে জনপ্রিয় কলাম লেখকদের একজন ছিলেন তিনি। সাপ্তাহিক ঢাকা পত্রিকায় তিনি তখন কলাম লিখতেন। যদিও এই লেখাসমূহ অগ্রন্থিত রয়ে গেছে।

বৈচিত্র্যময় লেখার মাধ্যমে লেখক হুমায়ূন আহমেদ সহজ-সরল রচনা আর রসবোধ দিয়ে পাঠককে অনায়াসে কাছে টেনেছেন। মাটি ও মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসতে পেরেছিলেন বলেই তিনি পাঠকসমাজকে এত বৈচিত্র্যময় সৃষ্টি উপহার দিতে পেরেছিলেন। কী চলচ্চিত্রে, কী নাটকে, কী উপন্যাসে, কী গল্পে— সৃজনশীল লেখার মাধ্যমে সবখানেই ছিল তার ধারাবাহিক সাফল্য। তিনি অনেক কঠিন কথা সহজভাবে ও সহজ কথা কঠিনভাবে গল্পে তুলে আনতেন। কত কৌশলী ও হৃদয়গ্রাহী করে যে তিনি গল্প বলতে পারতেন, তা অতুলনীয়। তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প ও ছোটগল্পসমূহ পাঠককূলে ব্যাপক প্রশংসা পায়।

চরিত্র রূপায়ণে অতি দক্ষ শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। তার চরিত্রগুলো পাঠক মহলে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। হিমু, মিসির আলী, বাকের ভাই, রূপা ও শুভ্র চরিত্রগুলো এখনো ব্যাপক জনপ্রিয়। কোনো যুক্তি ও বিচার-বুদ্ধির তোয়াক্কা না করে উদ্ভট সব কর্মকাণ্ডই ‘হিমু’ চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। অপরদিকে হিমুর বিপরীত চরিত্র ‘মিসির আলী’। যুক্তিবাদী মিসির আলী যুক্তির বাইরে এক পাও হাঁটেন না। মোটা ফ্রেমের চশমা পরিহিত মিসির আলী অতি প্রাকৃত ঘটনা তো বিশ্বাসই করেন না! ‘শুভ্র’ চরিত্রটি একজন পরিপূর্ণ মানবের প্রতিচ্ছবি হিসেবে খ্যাতি পায়।

হুমায়ূন আহমেদের নাটকে সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘বাকের ভাই’। অন্যদিকে তার অসম্ভব রূপবতী মেয়ে চরিত্র ‘রূপা’। এমন সব ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্রায়নের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ পাঠক ও টেলিভিশন দর্শকদের আনন্দে ভাসিয়েছেন। টিভি নাটকেও হুমায়ূন আহমেদের আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা ছিল। ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘আজ রবিবার’, ‘কোথাও কেউ নেই’ ও ‘বহুব্রীহি’ ব্যাপক দর্শকনন্দিত নাটক। চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যাপক মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন সবার প্রিয় এই লেখক। তিনি মোট আটটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এসব চলচ্চিত্রের কাহিনি তৈরি, চিত্রনাট্য, পরিচালনা ও প্রযোজনাও তিনি করেছেন। চলচ্চিত্রগুলোর বেশিরভাগ গান তারই লেখা। তার প্রথম সিনেমা ‘আগুনের পরশমণি’ মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। তার আটটি চলচ্চিত্রই সে সময় ব্যবসা সফল ও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তার জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ‘আমার ভাঙা ঘরে ভাঙা চালা’, ‘এক যে ছিল সোনার কন্যা’, ‘যদি মন কাঁদে’, ‘বরষার প্রথম দিনে’, ‘আমার আছে জল’ ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে তিনি দর্শকের মনে নতুন আঙ্গিকে জায়গা করে নিয়েছেন। ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’ চলচ্চিত্র দর্শকদের মন থেকে কখনো মুছে যাবে না। 

হুমায়ূন আহমেদের লেখায় অসংখ্য জনপ্রিয় কথা বা উক্তি আছে, যা পাঠকদের কাছে প্রবাদতুল্য। এমন শত শত উক্তির মধ্যে জনপ্রিয় একটি উক্তি হলো— ‘ভালোবাসা একটা পাখি। যখন খাঁচায় থাকে তখন মানুষ তাকে মুক্ত করে দিতে চায়। আর যখন খোলা আকাশে তাকে ডানা ঝাপটাতে দেখে, তখন খাঁচায় বন্দি করতে চায়।’ ঢাকার অদূরে হুমায়ূন আহমেদ গড়ে তোলেন ‘নুহাশ পল্লী’। প্রতি বছরই এই নুহাশ পল্লীতে প্রিয় লেখকের জন্ম ও মৃতু্যবার্ষিকী উপলক্ষে তাকে স্মরণ করে হুমায়ূন ভক্তরা। হুমায়ূন আহমেদ তার লেখনীর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে যে লাখো-কোটি পাঠক তৈরি করে গেছেন তা সমগ্র বাংলাসাহিত্যেই বিরল। সব মিলিয়ে বাংলাসাহিত্যে এক আধুনিক ধারা তৈরি করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ।

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “লোকজন আগ্রহ নিয়ে আমার বই পড়ছে, এটাই আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি।” এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, লাখ লাখ তরুণ তার লেখা পড়ে বইপড়ায় আগ্রহী হয়েছে। সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি হিসেবে জনপ্রিয় এ লেখক পেয়েছেন দেশি-বিদেশি অসংখ্য পুরস্কার। এসব পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (একাধিকবার), শিশু একাডেমি পুরস্কার ইত্যাদি। 

২০১২ সালে এই জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও তার লেখনীর মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

Link copied!