দেশভাগের পর বাঙালির স্বাধীনতা-স্বাধিকার সংগ্রামের সূচনা হয় ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এর প্রথম পর্যায় ১৯৪৮ সাল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বাংলা ভাষার দাবির আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে রফিক, জব্বার ও বরকতরা শহীদ হওয়ার ঘটনা ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। এই আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলেও এর উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে জেলা ও মহকুমায়। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র হত্যার ঘটনায় ভাষার দাবিতে পূর্ব বাংলার মানুষের গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। এ ঘটনা ন্যায্য অধিকার আদায়ে বাঙালির মধ্যে ধর্ম, পেশা, বর্ণনির্বিশেষে জাতীয় ঐক্য তৈরি করে। ভাষা আন্দোলনের চেতনা ও সুদূরপ্রসারী প্রভাবে পরবর্তী ধারাবাহিকতা হলো, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা এবং উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। সবশেষ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সফল পরিণতি পায় বাঙালি জাতি, অর্জিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
বাঙালির স্বাধীনতাসংগ্রামের দীর্ঘ পথপরিক্রমার সূচনা ও মূলে রয়েছে একুশের আত্মদান। যার প্রতীক শহীদ মিনার। এটি বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের সব সংগ্রামের অনুপ্রেরণা অসীম উৎস। এ কারণেই শহীদ মিনার শত্রুপক্ষ তথা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছে বারবার।
‘৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে নিহত শহীদদের লাশ তাঁদের আত্মীয়স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। লাশগুলো দ্রুত সরিয়ে ফেলে এবং গভীর রাতে গোপনীয়তার সঙ্গে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করে পুলিশ। শহীদের লাশকে কেন্দ্র করে যেন আন্দোলন আরও তীব্রতা না পায় এবং রক্তাক্ত অধ্যায়ের প্রামাণ্য (ঊারফবহপব) দ্রুত আড়াল করাই ছিল এর লক্ষ্য। তখন বাংলা ভাষার দাবির আন্দোলনকারীদের মধ্যে আওয়াজ ওঠে “শহীদ স্মৃতি অমর হোক” স্লোগান। এই আওয়াজ ও প্রাণ বিসর্জনের শোককে আরও নির্দিষ্ট করা এবং শহীদের প্রতি বিনম্র কৃতজ্ঞাকে মূর্ত রূপ দিতে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ১২ নম্বর ব্যারাকসংলগ্ন ছাত্রদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থানটিতে একটি শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা করেন মেডিকেলের ছাত্ররা। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, রাতের মধ্যেই সেই পরিকল্পনা দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা হয়। শহীদ মিনারের প্রথম নকশাটি করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র বদরুল আলম। এই তথ্যের ভিন্নমতও পাওয়া যায়। বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ ৩য় খণ্ড এবং বশীর আল্হেলালের ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, প্রথম শহীদ মিনারের নকশা করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র সাঈদ হায়দার। অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের ‘শহীদ মিনার’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, সাঈদ হায়দারের নকশায় ও বদরুল আলমের রেখায় করা হয় শহীদ মিনার। ৩টি গ্রন্থেই সাঈদ হায়দারের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে। সাঈদ হায়দার বলেন :
‘...দলমত নির্বিশেষে সকল ছাত্র শহীদ মিনার তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করে।...২৩ তারিখ বিকেল থেকে শুরু করে সারা রাত সেখানে কাজ হয় (কারফিউ থাকা সত্ত্বেও)। মেডিকেল কলেজ সম্প্রসারণের জন্য প্রচুর ইট বালি ছিল। ছাত্ররাই ইট বয়ে এনেছে। বালির সঙ্গে মিশিয়েছে। দুজন রাজমিস্ত্রী ছিল।...আমাদের মেডিকেল কলেজে তিনশ ছাত্র ছিল। তাদের সকলেই সেদিন কোনো কোনো কাজ করেছিল। আর শহীদ মিনারের নকশা করেছিলাম আমি।...এছাড়া আমাদের বয়-বেয়ারা। এরাই ছিল সেদিনকার বড় কর্মী।...বদরুল আলমও মিনার নির্মাণে সাহায্য করেছিল, তার হাতের লেখা সুন্দর ছিল।...’ (রফিকুল ইসলাম, শহীদ মিনার, পৃ. ৪৩-৪৪)
এখানে ভাষাসংগ্রামী সাঈদ হায়দার নিজেকে নকশাকারক হিসেবে দাবি করেছেন। পাশাপাশি এটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং বদরুল আলমের সাহায্যের কথাও উল্লেখ করেছেন। ভাষাসংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের লেখায় দেখা যায়, মেডিকেলের ছাত্ররা শহীদ মিনারের নকশা করার জন্য দায়িত্ব দেন তখনকার ছাত্র ডা. বদরুল আলমকে। কারণ, বদরুল আলম ভালো আঁকতে পারতেন। বদরুল আলম ২২ ফেব্রুয়ারি একটি নকশা করেন। ওই নকশা বাস্তবায়ন করা ছিল সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ওই মুহূর্তে অত সময় নিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের পরিবেশ ছিল না। তাই নকশাটি সংশোধন করার জন্য নেতৃত্বস্থানীয় ছাত্র গোলাম মাওলা, শরফুদ্দিন আহমদ, আলীম চৌধুরী ও সাঈদ হায়দার বদরুল আলমকে পরামর্শ দেন। তখন বদরুল আলম ও সাঈদ হায়দার মিলে আরেকটি নকশা তৈরি করেন। দ্বিতীয় নকশাটি সবার অনুমোদন লাভ করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি এটি নির্মাণ করা হয়। (আনিসুজ্জামান, ভাঙাগড়ার শহীদ মিনার, প্রথম আলো, ২১.০২.২০১২)
১৯৯০ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতার বহুল প্রচারিত ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘শহীদ মিনারের ইতিকথা’ শীর্ষক এম আর আখতার মুকুলের লেখায়ও একই মত পাওয়া যায়। সেখানে তিনি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদ মিনার নির্মাণকাজে অংশগ্রহণকারী মেডিকেল ছাত্রদের সাক্ষ্য উপস্থাপন করেছেন। তাই দেখা যাচ্ছে, প্রথম শহীদ মিনারের নকশাটি বদরুল আলম এবং সাঈদ হায়দারের যৌথ শ্রমের ফসল। এই তথ্যের অনুরূপ বক্তব্য পাওয়া যায় সাঈদ হায়দারের লেখায়ও। তাঁর লেখায় জানা যায়, কাজের দক্ষতা ও সক্ষমতা থাকার কারণে শহীদ মিনারের নকশা আঁকার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বদরুল আলমকে। তাঁর আঁকা নকশাটি ছিল শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় অত্যন্ত সুন্দর। কিন্তু সেটি এক রাতে নির্মাণ সম্ভব ছিল না। পরে সাঈদ হায়দার সহজ করে আরেকটি পরিকল্পনা দেন। সেটিতে বদরুল আলম সহমত দেন। পরে সাঈদ হায়দার ও বদরুল আলম যৌথভাবে চূড়ান্ত ড্রয়িং সম্পন্ন করেন। এটি মেডিকেলের ছাত্র ইউনিয়নের নেতারাসহ সব আন্দোলন কর্মীরা পছন্দ করেন। (সাঈদ হায়দার, প্রথম শহীদ মিনার, প্রথম আলো, ২১.০২. ২০১৭)
ঢাকা মেডিকেল কলেজে তখন নির্মাণকাজ চলছিল। এ কাজের ঠিকাদার ছিলেন মোত্তালেব ও পিয়ারু সরদার। কলেজের অভ্যন্তরেই গুদামঘরে নির্মাণসামগ্রী রাখা ছিল। ছাত্রদের দাবিতে গুদামঘরের চাবি দিয়ে দেন ঠিকাদার। ছাত্ররা তখন গুদামঘরের বালু, সিমেন্ট ও পাশ থেকে ইট নিয়ে আসেন। গুদাম থেকে ছাত্ররা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে একজনের হাত থেকে আরেকজনের হাত করে ইট আনা হয় ১২ নম্বর ব্যারাকের সামনে। একইভাবে বালতি করে পানি আনা হয়। রোগীর স্ট্রেচারে করে আনা হয় বালু ও সিমেন্ট। কাজে লাগানো হয় দুটো রিকশা। (অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, প্রাগুক্ত) এভাবেই মেডিকেল ছাত্রদের একটি ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় রাতের আঁধারে নির্মিত হয় শহীদ মিনার।
প্রথম শহীদ মিনারের নকশায় এর উচ্চতা ছিল সাড়ে ৯ ফুট। তবে নির্মিত হয়েছিল ১১ ফুট। নির্মাণের পর শহীদ মিনারের নিচের অংশ লাল কাপড়ে ঢাকা হয়। ওপরের অংশের দুই জায়গায় “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” ও “শহীদ স্মৃতি অমর হোক” শীর্ষক দুটি পোস্টার লাগানো হয়। শহীদ মিনারটি দুবার উদ্বোধন করা হয়। শহীদ শফিউর রহমানের বাবা পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের বাসিন্দা মৌলভী মাহবুবুর রহমানকে এনে ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম শহীদ মিনারটি উদ্বোধন করা হয়। এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে তৎকালীন আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীনকে দিয়ে শহীদ মিনারকে আরেকবার উদ্বোধন করানো হয়। বদরুদ্দীন উমরের মতে, শহীদ মিনারে একটি সমাবেশ করার প্রয়োজনীয়তার কারণেই খুব সম্ভবত দ্বিতীয় অনুষ্ঠানটি করা হয়। এম আর আখতার মুকুলের মতে, আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ প্রাদেশিক পরিষদ থেকে পদত্যাগ করার ঘটনায় ছাত্রসমাজ খুব উৎসাহিত হয়। এ কারণে তাঁকে দিয়ে দ্বিতীয়বার শহীদ মিনার উদ্বোধন করা হয়।
ঢাকায় ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনারের নিয়ে ভারতে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদপত্র দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ‘রাতারাতি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত’ শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল গেটে যে স্থানে পুলিশের গুলিবর্ষণের ফলে কয়েকজন ছাত্র নিহত হইয়াছে, সে স্থানে রাতারাতি ১০ ফুট উচ্চ এক শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হইয়াছে। আজ ছাত্রদের একা শোভাযাত্রা সলিমুল্লাহ হল হইতে বাহির হইয়া নীরবে প্রায় অর্ধমাইল পথ অতিক্রম করিয়া শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের পাদদেশে উপস্থিত হয়।’
২৪-২৬ ফেব্রয়ারি নবনির্মিত শহীদ মিনার হয়ে উঠে বাঙালির আত্ম-অধিকার এবং সাংস্কৃতিক তীর্থকেন্দ্র। শিশু-কিশোর, তরুণ ও বয়স্ক—সব বয়সের বাঙালি ছুটে আসেন, মিনারের ভিত্তিমূলে ফুল দিয়ে অমর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। শহীদ মিনার বারবার ফুলে ফুলে ঢেকে যায়। মিনারের পাদদেশে অনেকে অর্থ দেন, বিশেষ করে নারীরা। স্বর্ণালংকার দেওয়ারও তথ্য পাওয়া যায়।
২৩ ফেব্রুয়ারি নির্মিত শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন তখনকার দর্শন বিভাগের ছাত্রী রওশন আরা বাচ্চু। তাঁর সাক্ষাৎকারে জানা যায়, সে সময় শহীদ মিনারে ফুলের পাশাপাশি টাকাও দিয়েছেন অনেকে। প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মা গলার চেইন খুলে মিনারের পাদদেশে প্রদান করেন। রওশান আরা বাচ্চু বলেন, ‘ফুল, টাকা আর গয়নায় শহীদ মিনারের পাদদেশ ভরে যায়।’
অনুরূপ তথ্য পাওয়া যায় লেখক কর্তৃক গৃহীত ভাষাসংগ্রামী শরীফা খাতুনের স্মৃতিভাষ্যে। তিনি ইডেন কলেজের ছাত্রী ছিলেন তখন। কলেজের ছাত্রীদের নিয়ে শহীদ মিনারে আসেন। সেখানে ছাত্রীরা ফুল দেওয়ার পাশাপাশি ছাত্রীরাও অর্থ প্রদান করে। এই অর্থ ও গয়না আহতদের চিকিৎসা এবং আন্দোলন চালিয়ে নিতে ব্যয় করার জন্য দেওয়া হয়।নির্মাণের মাত্র তিন-চার দিনেই প্রথম শহীদ মিনার হয়ে ওঠে বাঙালি চেতনার মিনার। বাংলা ভাষাপ্রেমী মানুষের শ্রদ্ধার স্রোত বয়ে চলে স্মৃতির মিনারে। তবে পাকিস্তানি প্রশাসন এ নিয়ে ভীত ছিল, যা প্রমাণ মেলে পরবর্তী ত্বরিত হস্তক্ষেপে। শহীদ মিনারে নিক্ষেপিত হয় শাসকচক্রের রক্তচক্ষু। ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যেই তৎকালীন নাজিমুদ্দীন-নুরুল আমীন মুসলিম লীগ সরকারের সশস্ত্র পুলিশের আক্রমণের লক্ষ্য হয় শহীদ মিনার এবং এটি নিশ্চিহ্ন করা হয়।
প্রথম শহীদ মিনার ভেঙে ফেলার ঘটনায় কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ লেখেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা। ‘স্মৃতির মিনার ভেঙ্গেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু/আমরা এখনো চার কোটি পরিবার খাড়া রয়েছি তো/... ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক। একটি মিনার গড়েছি আমরা চার কোটি কারিগর... রাঙ্গা হৃদয়ের বর্ণলেখায়।’
লেখক : গবেষক ও সাংবাদিক