এক.
যদিও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) নিজে কখনো উল্লেখ করেননি যে মার্ক টোয়েন ( ১৮৩৫-১৯১০) তাঁর প্রিয় লেখকদের একজন। বা কখনো তিনি নির্দেশ করেননি, টোয়েনের দুই কিশোর নায়ক টম স্যয়ার ও হাকলবেরী ফিনের দুরন্তপনার আখ্যানগুলোর সাথে কদাপি তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তাঁর শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথ চরিত্র দুটির ওপর, লক্ষ করা যায়, মার্ক টোয়েনের ওই দুই নায়কের ব্যাপক প্রভাব। এ-প্রভাব কি নিতান্তই কাকতালীয়, নাকি শরৎচন্দ্রের প্রত্যক্ষ পাঠ-অভিজ্ঞতার ফল! এই বিষয়ে শরৎচন্দ্র যেমন মোটেও কিছু নির্দেশ করেননি; তেমনি যে দু-একজন সমালোচক ও জীবনীকার শরৎচন্দ্রের পঠন-অভিজ্ঞতার ইতিকথা তুলে ধরতে আগ্রহী থেকেছেন, তাঁরাও সেটি জ্ঞাপন করতে সমর্থ হননি।
এখানে আমরা প্রথমেই জেনে নিতে পারি যে শরৎচন্দ্র বিদেশি সাহিত্যের সাথে কতটা পরিচিত ছিলেন; জেনে নিতে পারি, ওই সাহিত্যের প্রতি তাঁর কতটা আগ্রহ ছিল, তিনি কতটা অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিলেন, বা আদৌ তিনি ওই সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ বোধ করেছিলেন কি না!
এই বিষয়ে তথ্যপ্রাপ্তির প্রধান উৎস বিষ্ণু প্রভাকরের ‘ছন্নছাড়া মহাপ্রাণ’ গ্রন্থটি। বিষ্ণু প্রভাকর জানান, শিক্ষাজীবনের গোড়া থেকেই শরৎচন্দ্র পাশ্চাত্য সাহিত্য সম্পর্কে বেশ গভীরই আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কলেজে পড়াকালীন, সেই ১৯৯৮-এর দিকে, ইংরেজি ‘উপন্যাস ছাড়াও বহু বিজ্ঞান বিষয়ক বই তাঁর পড়া’ হয়ে যায়। এ-সময় ‘ডিকেন্স, থ্যাকারে ও শ্রীমতি হেনরি উড’ হয়ে ওঠে ‘তার প্রিয় লেখক।’ ওই সময়েই নানা ইংরেজি আখ্যানের বাংলা ভাবানুবাদ করে তোলার ঝোঁক জেগে ওঠে তাঁর মধ্যে। শরৎচন্দ্র ‘ মিসেস হেনরি উডের ইস্টলীনের ছায়ানুবাদ’ করে ওঠেন। ওটির নাম দেন ‘অভিমান’। আবার ‘ ঠিক এই সময়েই শরৎ মেরী কোরেলির উপন্যাস ‘মাইটি এ্যাটমে’র অনুবাদ শুরু করেন। এবং ওই অনুবাদকর্মের নাম রাখেন ‘পাষাণ’। (ছন্নছাড়া মহাপ্রাণ: পৃষ্ঠা ৪০ -৪২)
এই সময়টাতে শরৎচন্দ্র বাস করছেন বীভৎস দারিদ্র্যের মধ্যে। পিতা মতিলাল সংসার-উদাসীন, কর্মনিস্পৃহ। রোজকার সংসারব্যয় কীভাবে নির্বাহ হবে, সংসারপ্রধান হয়েও সেটা নিয়ে ‘বাপের কোনো উদ্বেগ বা ভাবনা ছিলো না।’ শরৎ নিজেও তখন যেকোনো প্রকারে মুদ্রা আয়ের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেবার কথাও ভাবনায় আনতে পারেনি। শুধু নিরুপায় বসে বসে নিরুদ্ধার ধুঁকতে থাকা তখন। অমন অন্ধকার ক্ষুধাদীর্ণ সময়েও শরৎচন্দ্রের পড়ার টেবিলে ‘তার প্রিয় লেখক হেনরি উড, মেরী কোরেলি, লিটন ও ডিকেন্সের বই সাজানো থাকতো।’ ( পৃষ্ঠা : ৪৭) সাজানো থাকত তাঁর আত্মার আশ্রয় হয়ে। তিনি বারবার সেই সব গ্রন্থ পাঠ করে চলেছেন, এই সব বইয়ের বোধ ও ভাবনা দিয়ে বারবার তাঁর মন আন্দোলিত হয়েছে। দারিদ্র্যের কামড়ের ব্যথা ভুলিয়ে রেখেছে।
ভাগ্যান্বেষণে শরৎচন্দ্র বার্মা যান ১৯০৩ সালের জানুয়ারি মাসে। সেখানে বিস্তর অনিশ্চিত ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে তাঁর দিন অতিবাহিত হতে থাকে। একের পর এক অস্থায়ী কাজ খুঁইয়ে ফেলতে থাকার তীব্র যাতনাও সইতে হতে থাকে তাঁকে। অমন দুর্গতির কালে ওই পাশ্চাত্য সাহিত্যের পৃথিবীই শরৎচন্দ্রের জন্য হয়ে থেকেছে ‘পরম অভয় আশ্রম’। এ সময়েও তাঁর ‘পড়াশুনোর ঝোঁক’ বরাবরের মতো ‘প্রবল’ই থাকে। তিনি বাছবিচারহীনভাবে পড়তে থাকেন‘ সমাজশাস্ত্র, যৌনবিজ্ঞান, ভৌতিকশাস্ত্র, দর্শনশাস্ত্র, সব বিষয়ই।’ সবই তিনি পড়ে চলেন ‘সমান অনুরাগের সঙ্গে।’ রেঙ্গুনে থাকাকালীন তিনি যেমন বাছবিচারহীনভাবে গ্রন্থ পাঠ করে চলতেন, তেমনি বাছবিচারহীনভাবে তিনি মেলামেশা করতেন সমাজের চোখে যারা ‘হেয়,নিচু’, তাদের সাথে। তবে তাদের সাথে মেলামেশা করতেন শরৎ, মাঝেমধ্যে। কিন্তু নিত্যনিয়মিত তিনি নিজেকে নিয়ে যেতেন তাঁর একান্ত আশ্রয়-তাঁর জন্য বই জোগানোর পরম যেই ঠাঁই ছিল, সেইখানে।
রেঙ্গুনে শরৎচন্দ্রকে অত বিচিত্র সকল বইয়ের জোগানদাতা কে ছিল? ছিল বার্নার্ড লাইব্রেরি! বিষ্ণু প্রভাকরের বিবরণ থেকে আমরা জানতে পারি; শরৎচন্দ্র নিত্য তাঁর ‘অফিসের পর সোজা স্থানীয় নামকরা বার্নার্ড লাইব্রেরিতে গিয়ে চুপচাপ পড়াশোনা’ শুরু করতেন। ‘লাইব্রেরিতে তার কোনোরকম বিধিনিষেধ ছিল না। কোন আলমারির কোন তাকে কোন বই আছে, সব তার নখদর্পণে ছিল। প্রত্যেকটি বই-ই তার পড়া হয়ে গিয়েছিল। বইগুলোকে নিজের অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতোই ভালোবাসত’ শরৎ। (পৃষ্ঠা ৬৫)
রেঙ্গুন ত্যাগের সময় যখন আসে, তখন শরৎ তাঁর বন্ধুস্বজনকে ছেড়ে যাবার জন্য শোকতাপ পেতে থাকেন না; বা খোদ রেঙ্গুন শহরকে হারাবার কথা মনে করে করে কষ্ট পান না। বাঁধা আয়ের সুস্থিরতাকে খোয়ানোর যাতনায়ও কাতরে ওঠেন না। বরং তিনি পুড়তে থাকেন তাঁর প্রিয় বার্নার্ড লাইব্রেরিকে হারানোর বেদনায়। তাঁর মনে হতে থাকে: ‘এই বার্নার্ড লাইব্রেরির জন্য রেঙ্গুন ছেড়ে যেতে আমার ইচ্ছে হয় না, কলকাতার ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরিতে এত স্বাধীনতা আমি কোথায় পাব?’ (পৃষ্ঠা ৬৪)
ওই সময়ে কার কার বই পড়তে বেশি ভালোবাসতেন শরৎচন্দ্র? আমরা জানতে পারি: ‘প্রিয় লেখক টলস্টয়ের “আনা কারেনিনা” ও “রেজারেকশন” বই দুখানি তাঁর বড় প্রিয় ছিল। “আনা কারেনিনা” প্রায় বারবার-পঞ্চাশেক পড়ে উঠেছিলেন শরৎচন্দ্র।’ (পৃষ্ঠা ৬৫) ডিকেন্স তো একেবারে প্রথম তারুণ্যবেলা থেকে শরৎচন্দ্রের প্রিয় ঔপন্যাসিক ছিলই, রেঙ্গুনবাসের সময় থেকে টলস্টয়ও তাঁর প্রিয়তম কথাকার হয়ে ওঠে। এ সময় ডিকেন্স ও টলস্টয় ছাড়াও ‘জোলা’ আর ‘অস্টিন’ও তাঁর চিত্তহর হয়ে ওঠেন। তবে এই সময়ে শরৎচন্দ্র অন্য একরকমের অনুসন্ধিৎসা দিয়েও তাড়িত হতে থাকেন। পাশ্চাত্যেও নানা আখ্যানে আখ্যানে তিনি এক মহানায়কের সন্ধান করতে থাকেন। যেই নায়কের কর্ম ও চরিত্রমহিমাগুণে পুরো জাতি তার অনুরক্ত আর অনুসারী হয়ে উঠেছে। বিষ্ণু প্রভাকর জানান, ওই সময়ে ‘আমেরিকা ও রাশিয়ার মানুষকে যা এক করে তোলে, শরৎ এমন চরিত্রের খোঁজেও’ ছিলেন।
এই সকল তথ্যই আমাদের কাছে শরৎচন্দ্রের পাশ্চাত্য সাহিত্য ও দর্শনপ্রীতির কথাটি কাছে অতি স্পষ্ট করে তোলে। যদিও এ-থেকে আমরা মোটেও জানতে পারি না যে, শরৎচন্দ্র আদৌ তখন মার্ক টোয়েনের সন্ধান পেয়েছিলেন কি না! বা, মার্কিন কথাসাহিত্যের সাথে ওই সময়ে তাঁর আদৌ অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছিল কি না।
রেঙ্গুন বাসের সময়পর্বে শরৎচন্দ্রের সাহিত্যসৃষ্টির প্রবণতা যে কেমন ছিল, সে সম্পর্কে ড. সুকুমার সেনের দেওয়া একটি তথ্য আমাদের ধন্দকে মীমাংসিত হতে বেশ খানিকটা সাহায্য করে। শরৎসাহিত্যসমগ্র ১-এর ভূমিকা অংশে সুকুমার সেন জানান: ‘বর্মাতে থাকতে শেষের দিকে তিনি ইংরাজী উপন্যাস থেকে কিছু কথাবস্তু নিয়ে উপন্যাস রচনা করেছিলেন। সেসব উপন্যাস, যেমন ‘দত্তা’ ও ‘দেনাপাওনা’ প্রকাশিত হয়ে জনসমাদর লাভ করলো।’ আমরা আরো জানতে পারি যে, ‘বর্মায় থাকতে তিনি বিশেষভাবে আত্মজীবনীমূলক একটি উপন্যাসের পত্তন করেছিলেন।’ ১৯১৬-তে কলকাতায় স্থায়ীভাবে ফিরে আসার পরে শরৎচন্দ্র তখন ‘সেটি বাড়িয়ে চললেন (১৩২২ থেকে ১৩৩৯পর্যন্ত)। “ভারতবর্ষে” প্রথমে ‘শ্রীকান্তের ভ্রমণকাহিনী’ নামে ও পরে ‘শ্রীকান্ত’ নামে ওটি বেরোতে থাকে।
‘ইংরাজী উপন্যাস’ থেকে ‘কথাবস্তু’ নিয়ে সাহিত্যসৃজনের ওই সময়টিতেই যখন শরৎচন্দ্র তাঁর “শ্রীকান্ত” প্রথম পর্বটিকে গড়ে তুলছেন,তখন তিনি কী কোনো “ইংরাজী উপন্যাস” দিয়েই কিছুমাত্র দুলে ওঠেননি? শুধুই কি নিজস্ব একান্ত অভিজ্ঞতা আর কল্পনা-প্রতিভা যোগেই রচনা করেছেন এই আখ্যান? নাকি মার্ক টোয়েনের সাথেও ওই সময়ে তাঁর ব্যাপক পঠন-অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছিল, যেমন গড়ে উঠেছিল টলস্টয় ও তাঁর আনা কারেনিনার সাথে! ওই নিবিড় অন্তরঙ্গতার প্রভাবজাতই কী নয় গৃহদাহ আখ্যানটি? সুরেশ-এর দ্বিধা-দোদুল্যমানতা-ব্যক্তিত্বের টলোমলোত্ব আর দুর্বলতার মধ্যে আমরা কি আনা কারেনিনার ভ্রুনস্কির ছায়াকে মাথা-উঁচোতে দেখি না?
শরৎচন্দ্র বা তাঁর জীবনীকারগণ বা তাঁর সমালোচকদের কেউই কখনো জানাননি যে তিনি কখনো মার্ক টোয়েনকে দিয়ে প্রভাবিত হয়েছেন। কিন্তু কাহিনি ও চরিত্রসৃজনের নানা প্রবণতাকে তন্ন তন্ন বিশ্লেষণ করা গেলে এই সত্য অনুদ্ঘাটিত থাকে না যে শ্রীকান্ত প্রথম ভাগের ওপর মার্ক টোয়েনের দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ টম স্যয়ার এবং দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ হাকলবেরি ফিন-এর এক গভীর প্রভাব রয়েছে। শরৎ অনেকখানিই প্রভাবিত হয়েছেন টোয়েনকে দিয়ে; কাহিনি নির্মাণে আর পাত্রপাত্রী সৃজনে।
আমরা প্রথমে মার্ক টোয়েনের কাহিনির সাথে পরিচয় ঘটিয়ে নিতে পারি।
(চলবে)