• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথ

কতটা মৌলিক সৃজন তারা, কতটা প্রভাবিত


আকিমুন রহমান
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২০, ২০২৩, ০৩:০৫ পিএম
কতটা মৌলিক সৃজন তারা, কতটা প্রভাবিত

মার্ক টোয়েন ও শরৎচন্দ্রের আখ্যানগুলোর মধ্যেকার অন্য সাদৃশ্যসমূহ 
 

১) দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব টম সয়্যার, এবং দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন রচনা দুটির সাথে  শ্রীকান্ত (প্রথম পর্ব) উপন্যাসের ঘটনাগত ও পাত্রপাত্রীদের আচরণগত আরও বহু সাম্য আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়ে ওঠে। যেমন: আমরা দেখতে পাই, হাকলবেরি ফিন আগাগোড়াই হচ্ছে এক বিধিভঙ্গকারী ও স্বেচ্ছাচারী বালক।  তার সমস্তকিছু নিয়েই সে আছে এক যথেচ্ছচারী বিশৃঙ্খল জীবনে। পোশাক-আশাক পরার ব্যাপারে যেমন সে কোনো নিয়ম মানার তোয়াক্কা করে না, তেমনি অন্যদের সাথে আচরণ করার ক্ষেত্রেও রীতিনিয়ম মান্য করার ব্যাপারে সে নির্বিকার। দায়িত্বহীন মদ্যপ পিতার কিম্ভূত শাসানীর ঘেরে থাকতে থাকতেই সে নিজের জন্য গড়ে নিয়েছে এক তোয়াক্কাহীন নিজস্ব জীবন-যাপন-বিধি। আর, ওগুলোই সে পালন করে চলে। এবং এসবের মধ্য দিয়ে , হাক, সামাজিক বিধান-নিয়ম-পালনকারীদের সুরুচিকে একটা জোর ধাক্কা দিয়ে যেতে থাকে ফলে সু-বিধি-মান্যবাদী সুশীল সমাজের কাছে সে গণ্য হতে থাকে দুষ্ট ও বেয়াদব ও মন্দ ছেলে বলে । ভদ্রসমাজের সভ্যগণ, হাককে, তাদের সুশীল সন্তানদের জন্য সমূহ- ক্ষতিকর বলে বিবেচনা করতে থাকে।  
 

হাকলবেরি ফিন নেশাসক্ত। ওই কিশোর-বয়সেই সে অতি ধূমপায়ী। যখন যেখানে যে অবস্থায়ই তাকে থাকতে হোক না কেন, ধূমপান তাকে করতে হয়ই। প্রতিকূল হোক বা অনুকূল থাকুক—সকল পরিস্থিতিতেই-পাইপে তামাক ভরে, তাতে আগুন ধরানোর ব্যবস্থা, তাকে করে নিতে হয়ই। 
কিশোর হাক,  নিজের কিশোর মনের স্বাভাবিক আবেগে , টম সয়্যার বা জো হারপার-এর সাথে জলদস্যু হয়ে ওঠার খেলায় মেতে ওঠে বটে, কিন্তু বেশিক্ষণ সে আর তার কিশোর সত্তার মধ্যে থাকতে পারে না। অচিরেই  সেই কিশোরটির ভেতরে মাথা উঁচিয়ে ফেলে- এক অদমনীয় নেশাআকুল সত্তা। তখন তাকে, নিজের পাইপটাতে, তামাক ধরানো লাগেই। স্বস্তির সময়ে যেমন তাকে ধূমপান করতে হয়, তেমনি সংকটের কালেও তাকে ধূমপানেরই আশ্রয় নিতে হয়। সে যখন বাবা প্যাপের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাবার জন্য, ভেলায় চড়ে একাকী পালাতে থাকে; তখনো নিজের পাইপের তামাকের ধোঁয়াই তাকে সাহস জোগাতে থাকে।
আমরা দেখতে পাই, জলদস্যু হওয়ার জন্য বাড়ি থেকে পালানোর আগে টম সয়্যার নিজের সঙ্গে নেয় দরকারি নানা জিনিস। নেয় খাবারদাবার ইত্যাদি। কিন্তু ওই সব জিনিসপত্রের দিকে হাকলবেরি ফিনের মনোযোগ থাকে অতি সামান্য। বরং নিজের তামাকের পুঁটুলিটাকে স্ফীত করে তোলার জন্যই সে অতি তৎপর থাকে। সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য যখন অনেকখানি তামাক সে জোগাড় করে উঠতে পারে, তখনই সে পায় অনেক স্বস্তি। 
 

দ্বীপে পালিয়ে গিয়ে, টম সয়্যারের মতোই, নিজের জন্য একটা জলদস্যু-নাম গ্রহণ করে হাকলবেরি ফিন। তারপরই সে তার সবচেয়ে জরুরি কর্মটি সম্পন্ন করার কাজে ব্যাপৃত হয়ে ওঠে। পাইপে তামাক ধরায় সে। তারপর তুমুলরকমে টানতে শুরু করে। হাকলবেরি ফিনের ওই তেজালো নেশাসক্তি ও ধূম্রসেবনের এমন বর্ণনা দেয় টম সয়্যার:  
 

Finn the Red-Handed had stolen a skillet and a quantity of half-cured leaf     tobacco, and had also brought a corn-cobs to make pipes with. But none of the pirates smoked or “ chewed” but himself. … … … …
The Red-Handed made no response, being better employed. He had finished gouging out a cob, and now he fitted a weed stem to it, loaded it with tobacco, and was pressing a coal to the charge and blowing a cloud of fragrant smoke- he was in the full bloom of luxurious contentment. The other pirates envied him this majestic vice, and secretly resolved to acquire it shortly. … … … 
Gradually their talk died out and drowsiness began to steal upon the eyelids of the little waifs. The pipe dropped from the fingers of the Red-Handed, and he slept the sleep of the conscience-free and the weary.
 

অবিকল একই রকম নেশাপ্রবণ ইন্দ্রনাথও। যেকোনো পরিস্থিতিতে, তারও, ধূম্রপান করা চাইই। তবে সে হাকলবেরি ফিনের চেয়ে আরও অনেক বেশি বেপরোয়া ও নির্বিকার। ইন্দ্রনাথ শুধু তার যা ইচ্ছে তা-ই করে না; তার-বয়সী একজনের জন্য যে-সকল কর্ম করাকে অসিদ্ধ ও অগ্রহণযোগ্য বলে বিধি জারি করে রেখেছে এই সমাজ, সেই সব সমাজ-নিষিদ্ধ কর্মগুলোকে সে দাপটের সাথে, সর্বসমক্ষে করে চলতে থাকে। 
আমরা দেখতে পাই, হাক মূলত তার পাইপটা ধরায় অনেকখানি বিজনে; শুধু টম সয়্যার বা অন্য দু-একজন বন্ধুর সামনে। অন্যদিকে,ইচ্ছে হলে ইন্দ্র,সর্ব-বয়স্ক-সামাজিকগণের সম্মুখেই তার সিগারেটে  আগুন ধরায়। কঠিন টান দিয়ে দিয়ে তুমুল ধূম্র উদ্‌গিরণ করে। লোকগণের কঠোর তিরস্কারমিশ্রিত দৃষ্টির তোয়াক্কা সে করে না। নিন্দা-দুর্নামের ভয় তাকে টলায় না। 
অন্যদিকে.হাকলবেরি ফিনকে আমরা শুধু তামাকই সেবন করতে দেখি। কিন্তু ইন্দ্রকে শুধু তামাক সেবন করলেই চলে না; অন্য অন্য নেশাদ্রব্যও তাকে গ্রহণ করতে হয়। হাক এবং ইন্দ্রের এই নেশাসক্তিকে বয়োজ্যেষ্ঠ সামাজিকগণ কতটা দুষ্কর্ম বলে মনে করছে, তাদের কতটা বেয়াদব ও বাজে ও দুষ্ট ছেলে বলে তারা গণ্য করছে, সেটা হাক ও ইন্দ্রের কাছে বিবেচনার কোনো বিষয়ই নয়। এমনকি তাদের ওই ধূম্রাসক্তি-  তাদের সমবয়স্ক ও নিকট বন্ধুদের মনেই বা কোনো ভাবনা-বিকারের জন্ম দিচ্ছে, তা-ও ভেবে দেখে না তারা। হাক ভাবে না, ইন্দ্র তো একেবারেই নয়।
বিধিভঙ্গকারী, দুর্বিনীত ইন্দ্রনাথের সাথে সেই প্রথম সাক্ষাতের সন্ধ্যায়; শ্রীকান্ত বিষম অস্বস্তি ও কুণ্ঠায়, কুঁকড়ে যেতে থাকে। কেননা, লোকচক্ষুর তোয়াক্কাশূন্য ইন্দ্র তখন, সর্বসমক্ষেই,পরোয়াহীন ধূম্রপানে মেতে উঠেছিল:
 

“এতক্ষণ যেন যেন কিছুই হয় নাই- মারে নাই,মার খায় নাই,ছুটিয়া আসে নাই- না, কিছুই নয়; এমনিভাবে জিজ্ঞাসা করিল, তোর নাম কি রে?
শ্রী- কা - ন্ত -
শ্রীকান্ত? আচ্ছা। বলিয়া সে তাহার জামার পকেট হইতে একমুঠা শুকনা পাতা বাহির করিয়া কতকটা নিজের মুখে পুরিয়া দিয়া কতকটা আমার হাতে দিয়া বলিল, ব্যাটাদের খুব ঠুকেছি- চিবো।
কি এ?
সিদ্ধি।
আমি অত্যন্ত বিস্মিত হইয়া কহিলাম, সিদ্ধি? এ আমি খাইনে।
সে ততোধিক বিস্মিত হইয়া কহিল, খাসনে? কোথাতার গাধা রে! বেশ নেশা হবে- চিবো! চিবিয়ে গিলে ফ্যাল্ ।
নেশা জিনিসটার মাধুর্য তখন তো আর জানি নাই। তাই ঘাড় নাড়িয়া ফিরাইয়া দিলাম। সে তাহাও নিজের মুখে দিয়া চিবাইয়া গিলিয়া ফেলিল।
আচ্ছা তাহলে সিগরেট খা। বলিয়া আর একটা পকেট হইতে গোটা-দুই সিগরেট ও দেশলাই বাহির করিয়া,একটি আমার হাতে দিয়া অপরটা নিজে ধরাইয়া ফেলিল। তারপওে  দুই করতল বিচিত্র উপায়ে জড়ো করিয়া সেই সিগরেটটাকে কলিকার মত করিয়া টানিতে লাগিল। বাপ রে, সে কি টান! এক টানে সিগরেটের আগুন মাথা হইতে তলায় নামিয়া আসিল। চারিদিকে লোক-আমি অত্যন্ত ভয় পাইয়া গেলাম। সভয়ে প্রশ্ন করিলাম,চুরুট খাওয়া কেউ যদি দেখে ফ্যালে?
ফেললেই বা! সবাই জানে। বলিয়া স্বচ্ছন্দে সে টানিতে টানিতে রাস্তার মোড় ফিরিয়া আমার মনের ওপর একটা প্রগাঢ় ছাপ মারিয়া দিয়া আর একদিকে চলিয়া গেল।” 
 

২) আবার আমরা লক্ষ করি যে,  লৌকিক সমাজচক্ষুকে উপেক্ষা করার তেজ ও দাপট হাক এবং ইন্দ্রের মধ্যে যতোটা, ঠিক ততখানিই অশক্ত ও ভয়গ্রস্ত তারা দুজনে- ভূত-প্রেত দিয়ে। অশৈলী-অলৌকিকের বিষয়-বৃত্তান্ত যখন আসে, তখন তারা দুইজনই বেশ ত্রস্ত বোধ করতে তাকে। হাক এবং ইন্দ্র- দুজনের বিশ্বাস করে, জগতে ভূতপ্রেত আছেই। আর, তারা হচ্ছে অতি শক্তিশালী  এক প্রপঞ্চ। তাদের সাথে যুঝে ওঠার কোনো সামর্থ্য মানুষের নেই। তাদের সাথে পেরে ওঠার সাধ্য তো কারো নেই-ই। কাজেই তাদের সাথে যুঝতে যাওয়ার স্পর্ধা যেনো কোনো মনুষ্য দেখাতে না যায়। বরং বিবিধ কৌশল ও মন্ত্র-তন্ত্রসহযোগে যদি চেষ্টা করা যায়,তাহলে হয়তো ওই প্রেতভূতকে, খানিকটা দমন করা সম্ভব। এর বেশি আর কিছু করার উপায় নেই। 
ভূত-পেত্নী ছাড়াও জগতে আরও অন্য বহু কিছুও আছে। আছে নানারকম জাদুটোনা, তুকতাক, বানমারা তাবিজ-কবজ করাকরি ইত্যাদি। হাকলবেরি ফিন এবং ইন্দ্রনাথ- দুজনেই মানে যে, যাদুটোনা দিয়ে ও নানা তুকতাক করে করি, নানা আপদ-বালাই থেকে চমৎকার রকমে নিস্তার পাওয়া সম্ভব। সেই বিশ্বাস অনুসারে, তারা, নিজেদের নানা ঠেকা-আপদের সময়ে নানা ক্রিয়া-আনুষ্ঠানিকতাও পালন করে চলে। কীভাবে কোন তুক করলে শরীরের আঁচিল দূর করে দেয়া যায়, হাক সেটা জানে। এবং জানে যে; সেই তুকতাক করার জন্য, রাতের ঠিক কোন সময়টাতে, কবরখানায় যাওয়ার দরকার। এবং অন্য আরো কী কী করলে- ওই তুকতাকের অব্যর্থ ফললাভ সম্ভব, সেটাও জানা আছে তার। দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব টম সয়্যার আখ্যানে হাকের সাথে টমের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে সেই গূঢ় রহস্যবার্তা এভাবে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে:
Tom hailed the romantic outcast.
“ Hello,Huckleberry!”
“ Hello yourself, and see how you like it.”
“ what’s that you got?”
“ Dead cat.”
“Lemme see him, Huck. My, he’s pretty stiff.” … … …
“ Say – what is dead cats good for, Huck?”
“ Good for? Cure warts with.” … … …
“… ..  But say- how do you cure them with dead cats?”
“ Why, you take your cat and go and get in the grave-yard long about midnight when somebody that was wicked has been buried; and when it’s midnight a devil will come, or maybe two or three, but you can’t see’em, you can only hear something like the wind, or maybe hear ‘em talk; and when they’re taking that feller away, you heave your cat after them and say,` Devil follow corpse, cat follow devil, warts follow cat, I’m done with ye!’ That’’ll fetch any wart.”… … …
“ Say, Hucky, when you going to try the cat?”
“To-night. I reckon they ‘ll come after old Hoss Williams to-night.”
“ But they buried him Saturday. Didn’t they get him Saturday night?”
“ Why, how you talk! How could their charms work till nidnight? – and then it’s Sunday. Devils don’t slosh around much of a Sunday… …” 
 

ঠিক অমন গভীরভাবেই, ইন্দ্রনাথও, ভূত তাড়াবার কায়দা-কৌশল আত্মস্থ করে নিয়েছে।  ইন্দ্র জানে, মধ্যরাতের অন্ধকারের পৃথিবীটা হচ্ছে ভূত-পেত্নীদের পৃথিবী। দিনের এই পৃথিবীটা মানুষের বটে, কিন্তু সেই মধ্যরাতের জগৎটা আর কোনো অবস্থাতেই মানুষের জগৎ থাকে না। ওটা তখন একান্তই ভূতপ্রেতের নিজস্ব দুনিয়া হয়ে যায়। সেই সময়, নিজের ভালাইয়ের জন্যই, মানুষকে থাকতে হবে গৃহের ভেতরে। তা নইলে ঘটবে বিষম উৎপাত। ভূত-প্রেতদের চলাচলতিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে ফেললে, তারাও মনুষ্যদের দেওয়া শুরু করবে কঠিন দণ্ড। তারা মানুষকে তখন বিশ্রীরকমে নাজেহাল করতে শুরু করবে। তবে সেই  হিংস্র অশৈলীদের ঢিঁট করার কোনো উপায় কী মনুষ্যের হাতে নেই?। আছে তো। ইন্দ্র জানে সেই বিধি-পদ্ধতি। প্রেত ঢিঁট করার কায়দা-কৌশল সঠিক-রকমেই জানে ইন্দ্রনাথ।
ইন্দ্র এ-ও জানে, দুস্থ লোককে অর্থ সাহায্য দেওয়ার জন্য ঘুরঘুট্টি অন্ধকার রাতে; নির্বিঘ্নে জেলেদের জাল থেকে মাছ চুরি করে আনাটা যতটা সহজ, মধ্যরাতের ওই প্রেতদের সামাল দেওয়াটা তত সহজ নয়। কারণ তারা তখন মানুষকে বিবিধ বিঘ্ন-বিপত্তি দিয়ে নাস্তানাবুদ করার জন্য একেবারে একাট্টা আর মরিয়া হয়ে থাকে। 
 

অলৌকিক অশেলীরা কোন প্রক্রিয়ায় মৎস্যচোর কিশোরদুটিকে বিপন্ন করতে পারে? তার সেই মাঝরাতের অন্ধকারের ভেতরে, নৌকার সামনে এসে, মাছ চাইতে পারে। কেবল মাছ চেয়ে চেয়ে নাজেহাল করে যেতে পারে। তখন তাদের সামলাতে পারার হিম্মত যেমন থাকতে হয় মনুষ্য-পুত্রের অন্তরে; তেমনই জানা থাকতে হয় তাদের রুদ্ধ করার তুকতাকগুলো। সে-সবের সমস্তই ইন্দ্রের জানা আছে।  
চুরি করা মাছ নৌকার রেখে, রাত্রি গহিনে, অচেনা গাঁয়ে যায় ইন্দ্র- মাছের ক্রেতা খুঁজতে। মাছ তো তখন থাকে নৌকায়, একলা অই শ্রীকান্তের জিম্মায়। সে সময় সেই অশৈলীগণ যদি এসে হানা দেয়, শ্রীকান্ত তাদের মোকাবেলা কীভাবে করবে? তখন কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবে শ্রীকান্ত! তাদের মোকাবেলা করার সেই তুকতাকের যে- কৌশলগুলো ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্তকে শিক্ষা দিতে থাকে, তা এমন:
“উপরে, মাথার উপর আবার সেই আলো-আঁধারের লুকোচুরি খেলা এবং পশ্চাতে বহুদূরাগত সেই অবিশ্রান্ত তর্জন। আর সুমুখে বালির পাড়। এটা কোন জায়গা,তাই ভাবিতেছি, দেখি ইন্দ্র ছুটিয়া আসিয়া উপস্থিত হহইল। কহিল, শ্রীকান্ত,তোকে একটা কথা বলতে ফিরে এলুম। কেউ যদি মাছ চাইতে আসে,খবরদার দিসনে - খবরদার বলে দিচ্ছি । ঠিক আমার মত হয়ে যদি কেউ আসে,তবু দিবিনে – বলবি,মুখে তোর ছাই দেব - ইচ্ছে হয়, নিজে তুলে নিয়ে যা। খবরদার হাতে করে দিতে যাসনে যেন, ঠিক আমি হলেও না, - খবরদার!”
এই অশৈলীবিষয়ক ভয়-উৎকণ্ঠা থেকে উদ্ধার পাওয়ার কী কোনো পথ আছে? কীভাবে রক্ষা পাওয়া সম্ভব! হাকের মতোই ইন্দ্রও জানে সেই রক্ষা পাওয়ার উপায়টা। তন্নতন্ন করেই জানে সেই নিদানের সন্ধান। এবং সেইসবের খোঁজ সে শ্রীকান্তকে দিতে থাকে:
“ জিজ্ঞাসা করিলাম, আচ্ছা ইন্দ্র,তুমি কখনো ঐ সব দেখেচো?
কি সব?
ঐ যারা মাছ চাইতে আসে?
না ভাই দেখিনি- লোকে বলে,তাই শুনেচি।
আচ্ছা,তুমি এখানে একলা আসতে পারো?
ইন্দ্র হাসিল। কহিল, আমি ত একলাই আসি।
ভয় করে না?
 

না। রামনাম করি। কিছুতেই তারা আসতে পারে না। একটু থামিয়া কহিল, রামনাম কি সোজা রে? তুই যদি রামনাম করতে করতে সাপের মুখ দিয়ে চ’লে যাস, তবু তেতার কিছু হবে না। সব দেখবি ভয়ে ভয়ে পথ ছেড়ে দিয়ে পালাবে। কিন্তু ভয় করলে হবে না। তা হ’লেই তারা টের পাবে,এ শুধু চালাকি করছে- তারা সব অর্ন্তযামী কিনা! ... ভয় কি শ্রীকান্ত? কত রাত্তিরে একা একা আমি এই পথে যাই-আসি- তিনবার রামনাম করলে কার সাধ্যি কাছে আসে?”
হাক বা ইন্দ্রের জগতে দিন তেমন দীপ্তিশালী নয়। এইখানে রাত্রি হচ্ছে প্রবল অনুকূল এক সময়। এইখানে যা কিছু ঘটায় তারা, অথবা যা কিছু তাদের ঘিরে ঘটে, তার সবটাই ঘটে প্রধানত রাত্রিকালে। টম ও হাক রাতের বেলায়ই অভিযানে বেরোয়। রাত্রির অন্ধকারেই হাকলবেরি ফিন তার ক্রুদ্ধ হিংস্র পিতার হাত থেকে নিস্তারের পথ খুঁজে পায়। ইন্দ্রনাথও শ্রীকান্তকে নিয়ে প্রধানত রাতের অভিযানেই বেরোয়; আর বিচিত্র অভাবনীয় সব বাস্তবতার মুখোমুখি হয়।

 

৩)  এই আখ্যান তিনটিকে আমরা সমাজ-বহিরিস্থিতদের আখ্যান বলেও গণ্য করতে পারি। টম সয়্যার ওইখানে, সুস্থ সামাজিক জীবনবাসী হওয়ার জন্য গৃহীত হয়,সুবোধ সামাজিক হয়ে ওঠার প্রশিক্ষণও নিতে থাকে, কিন্তু বারংবার সে এই সব কিছু থেকে পালিয়ে যেতে থাকে। বারংবার পালিয়ে যেতে সে কিছুমাত্র পরোয়া করে না। অন্যদিকে, হাকলবেরি ফিন হচ্ছে আদ্যোপান্ত এক সমাজ-বহিরিস্থিত কিশোর,তাকে যতোই দয়ালু ধনী বিধবা দত্তক নিয়ে সুশীল বানানোর উদ্যোগ নিক, কিন্তু ওই সব বিধি-শোভনতা শিখে ওঠার চাপটাকে তার অসহ্য লাগতে থাকে। এবং সে ওইসব কিছু থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে ওঠে। তাই তার বাবা প্যাপ যখন তাকে ছিনতাই করে, দুর্গম প্রত্যন্ত এলাকায় নিয়ে, বন্দী করে রাখে; তখন হাক প্রবল উল্লাসই বোধ করতে থাকে। তার কোনোধরণের অশান্তি বা অস্বস্তি হয় না। হাক তখন এমনটাই বোধ করতে থাকে:

 “It was kind of lazy and jolly, laying off comfortable all day, smoking and fishing, and no books nor study. Two months or more run along, and my clothes got to be all rags and dirt, and I didn’t see how I’d ever got to like so well at the widow’s, where you had to wash, and eat on a plate, and comb up, and go to bed and get up regular, and be forever bothering over a book, and have old Miss Watson pecking at you all the time. I didn’t want to go back no more.”
 

ইন্দ্রনাথকে আপাতদৃষ্টিতে গৃহ ও সমাজবাসী বলে মনে হতে থাকলেও, আদতে সেখানে সে থাকে অতি আলগোছে। সে সেখানে বাস করে,প্রথাগত জীবনের কোনাকিছুতেই লগ্ন না হয়ে। দিনের পর দিন বরং সে থাকে জলের কাছে,থাকে সমাজের অনাদৃত নিম্নতলের লোকের নিকটবর্তী হয়ে। সে স্বস্তি ও নির্ভার বোধ করতে থাকে রসাতলের লোকের সান্নিধ্যে। যেতে থাকে বিজন শ্মশানঘাটায়, সেখানকার এক পরিত্যক্ত ভিটায় বসবাসরত সাপুড়ে আর তার স্ত্রী অন্নদাকে তার মনে হতে থাকে নিতান্ত আপনার জন বলে।  
শ্রীকান্তের বিবরণ থেকে আমরা এভাবে ইন্দ্রনাথের বহিরিস্থিততার বিষয়ে অবহিত হতে থাকি: “শ্মশানের সেই সঙ্কীর্ণ ঘাটের পাশে বটবৃক্ষমূলে ডিঙি বাঁধিয়া যখন দুজনে রওনা হইলাম,তখনও অনেক বেলা ছিল। কিছু দূরে গিয়া ডানদিকে বনের ভিতর ঠাহর করিয়া দেখায়, একটা পথের মতও দেখা গেল। ইন্দ্র তাহাই ধরিয়া ভিতওে প্রবেশ করিল। প্রায় দশ মিনিট চলিবার পর একটা পর্ণকুটীর দেখা গেল। কাছে আসিয়া দেখিলাম,ভিতরে ঢুকিবার পথ আগড় দিয়া আবদ্ধ। ইন্দ্র সাবধানে তাহার বাঁধন খুলিয়া ঠেলা দিয়া প্রবেশ করিল এবং আমাকে টানিয়া লইয়া পুনরায় তেমনি করিয়া বাঁধিয়া দিল। আমি তেমন বাসস্থান কখনো জীবনে দেখি নাই। একে ত চতুর্দিকেই নিবিড় জঙ্গল,তাহাতে মাথার উপরে একটা প্রকাণ্ড তেঁতুল গাছ এবং পাকুড়গাছে সমস্ত জায়গাটা যেন অন্ধকার করিয়া রাখিয়াছে।”
 

শ্রীকান্ত প্রথম পর্বের সাপুড়ে শাহজী হচ্ছে এক ঘোরতর সমাজ-বহিরিস্থিত জন। হাকলবেরি ফিনের মদ্যপ, উদ্ধত, বন্য পিতা প্যাপের মতো শাহজীও অসভ্য, বেপরোয়া, হিংস্র , হিতাহিতজ্ঞানশূন্য ও আত্মসর্বস্ব এক মাতাল। শাহজী চরিত্রটির সঙ্গে প্যাপ চরিত্রটির বিপুল সাদৃশ্য আমরা লক্ষ্য করে থাকি।
যে-কোনো রকমের অপরাধ করতেই প্যাপ-এর অন্তরে কোনো কুণ্ঠা বা অপরাধবোধ হয় না। প্যাপ বিস্তর কুকর্মসম্পাদন করে এবং পাপিষ্ঠ হিসেবে লোকসমাজে চিহ্ণিত হয়ে ওঠে। এই প্যাপেরই গভীর ছায়া পড়েছে শাহজীর ওপর।
 

শাহজী সীমাহীন পামর। একেবারে বিবেকবর্জিত।  দরিদ্র-পুত্র শাহজীকে অন্নদা দিদির পিতা ঘরজামাই করে আনে এবং লেখাপড়া শিখিয়ে বিদ্বান করে তোলে। তবে শিক্ষিত ঘর-জামাই শাহজী, বিদ্বান হলেও মানুষ হয়ে ওঠে না। সে অন্নদা দিদির বিধবা জ্যেষ্ঠা ভগিনীকে খুন করে পলাতক হয়। ।  অন্নদা দিদির স্বীকারোক্তি থেকে আমরা জেনে উঠি যে: ‘আমার বাবা বড়লোক। তাঁর ছেলে ছিল না। আমরা দুটি বোন। সেইজন্য বাবা দরিদ্রের গৃহ হইতে স্বামীকে আনাইয়া নিজের কাছে রাখিয়া লেখাপড়া শিখাইয়া মানুষ করিতে চাহিয়াছিলেন। তাঁহাকে লেখাপড়া শিখাইতে পারিয়াছিলেন-কিন্তু মানুষ করিতে পারেন নাই। আমার বড় বোন বিধবা হইয়া বাড়িতেই ছিলেন- ইঁহাকে হত্যা করিয়া স্বামী নিরুদ্দেশ হন।’ 
খুনী পলাতক শাহজী শেষে সাপুড়ের জীবন গ্রহণ করে, এবং অন্নদা দিদিকে গৃহত্যাগী করে নিজ সাপুড়ে-জীবনসঙ্গী করে তোলে। প্রচলিত ধর্মমতে পত্নী যেহেতু পতির সহধর্মিনী, সেই ধর্মবিধি পালন করার জন্যই অন্নদা দিদি শেষে হয়ে ওঠে ধর্মত্যাগী শাহজীর সাপুড়ে জীবনের সঙ্গী। ধর্ম-পালনার্থেই সে গ্রহণ করে সমাজ-বহিরিস্থিতের জীবন। সহ্য করতে থাকে বিস্তর নিপীড়ন। 
এমন সব মানবিক জটিলতার পেষণে অবশ্য আমরা প্যাপকে পীড়িত হতে দেখি না। সে থাকে কেবলই এক দয়াবোধশূন্য, মদ্য-কাতর, অবিবেকী লোক হয়ে। প্যাপ এবং শাহজীর কাছে মদ্যপান বা অন্যবিধ সকল নেশাগ্রহণই হচ্ছে বেঁচে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য। নিজেদের ওই নেশা-নিবৃত্তির মুদ্রা জোটাবার জন্য যে-কোনো অপকর্ম করতে বেপরোয়া তারা দুজনেই।
 

প্যাপ-এর চরিত্রগত পাষণ্ডতা যেমন ঝলকে উঠেছে শাহজীর চরিত্রে,তেমনি তাদের দুজনের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের অভিন্নতাও আমাদের অগোচর থাকে না। হাকলবেরি ফিন তার জন্মদাতার শারীরিক গড়নের এমন বিবরণ দেয়:
“ He was most fifty,and he looked it. His hair was long sand tangled  and greasy,and hung down, and you could see his eyes shining through like he was behind vines.It was all black,no gray; so was his long,mixed-up whiskers.There warn’t no color in his face, where his face showed,it was white; not like another man’s white, but a white to make a body sick, a white to make body’s flesh crawl – a tree-toad white, a fish-belly white. As for his clothes – just rags,that was all. He had one ankle resting on t’other knee; the boot onthat foot was busted, and two of his toes stuck through,and he worked them now and then. His hat was laying on the floor – an old black slouch with the top caved in , like a lid.”
 

শাহজীও দেখতে প্যাপের মতোই বদখত। শ্রীকান্তের চোখে শাহজী এমন:  “ডানদিকে চাহিয়া দেখিলাম, সেই পর্ণকুটীরের বারান্দার উপরে বিস্তর ছেঁড়া চাটাই ও ছেঁড়া কাঁথার বিছানায় বসিয়া একটা দীর্ঘকায় পাতলাগোছের লোক প্রবল কাসির পরে হাঁপাইতেছে। তাহার মাথায় জটা উঁচু করিয়া বাঁধা,গলায় বিবিধ প্রকারের ছোটবড় মালা। গায়ের জামা এবং পরনের কাপড় অত্যন্ত মলিন এবং একপ্রকার হলদে রঙে ছোপানো। তাহার লম্বা দাড়ি বস্ত্রখণ্ড দিয়া জটার সহিত বাঁধা ছিল।”
হাকলবেরি ফিনকে, তার দত্তক নেওয়া ধনী বিধবা মিসেস ডগলাসের বাড়ি থেকে, ছিনতাই করে নিয়ে আসে প্যাপ। কারণ এইভাবে সে নিজ দখলে আনতে চায় পুত্রের টাকাকড়ির সবটা। বন্দী হাক যেনো নতুন করে পরিচিত হতে থাকে প্যাপ-এর নৃশংসতার সাথে। প্যাপ-এর মানসিক বিকার ও অসুস্থতার সাথে। বন্দী অবস্থায় এক মধ্য রাতে অকস্মাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরে হাক দেখে: 
“I don’t know how long I was asleep,but all of a sudden there was an awful scream and I was up. There was pap looking wild,and skipping around every which way and yelling about snakes. He said they was crawling up his legs; and then he would give a jump and scream, and say one had bit him on the check – but I couldn’t see no snakes. He started an run round and round the csbin, hollering “ Take him off! Take him off! he’s biting me on the neck !” I never see a man look  so wild in the eyes. Pretty soon he was all fagged out, and fell down panting;” 
 

অত্যধিক নেশাগ্রস্ততার কারণে শেষে প্যাপ চরম মানসিক অসুস্থতাগ্রস্ত হয়ে ওঠে। কল্পিত নানা ভীতিকর শত্রুর আক্রমণের ভয়ে সে যেমন আতঙ্কিত হয়ে উঠতে থাকে,তেমনি নানারকমে প্রলাপও বকতে থাকে।   প্যাপের সেই মানসিক বিকারগ্রস্ততার রূপটিকে হাকলবেরি ফিন এভাবে তুলে ধরেছে:   “By and by he rolled out and jumped up his feet looking wild, and he see me and went for me.He chased me round and round the place with a clasp-knife,calling me the Angel of Death, and saying he would kill me,and then I couldn’t come for him no more. I begged,and told him I was only Huck; but he laughed such a screechy laugh,and roared and cussed, and kept on chasing me up. Once when I turned short and dodged under his arm he mmade a grab and got me by the jacket between my shoulders, and I thought I was gone; but I slid out of the jacket quick as lightning, and saved muself. Pretty soon he was all tired out and dropped down with his back against the door, and said he would rest a minute and then kill me….. and said he would sleep and get strong,and then he would see who was who.” 
 

একই রকম মনোবিকলনগ্রস্ত শাহজীও। প্রবল নেশাসক্তি তাকেও অসুস্থ ও বিকারগ্রস্ত করে তুলেছে। শাহজীর ভয়াবহ নেশাসক্তির পরিচয় দেয় শ্রীকান্ত এভাবে:  ‘শাহজী  হাত তুলিয়া ইন্দ্রকে গাঁজার সাজ-সরঞ্জাম এবং কলিকাটি দেখাইয়া দিল। ইন্দ্র দ্বিরুক্তি না করিয়া, আদেশ পালন করিতে লাগিয়া গেল এবং প্রস্তুত হইলে শাহজী সেই কাসির উপর ঠিক যেন ‘মরি-বাঁচি’ পণ করিয়া টানিতে লাগিল এবং একবিন্দু ধোঁয়াও পাছে বাহির হইয়া পড়ে,সেই আশঙ্কায় নাকেমুখে বাম করতল চাপা দিয়া মাথায় একটা ঝাঁকানির সহিত কলিকাটি ইন্দ্রের হাতে তুলিয়া দিয়া কহিল, পিয়ো।’
 

অন্নদা দিদির পক্ষে শাহজীর নেশার পয়সা জোগানো সবসময় সহজ হয়ে থাকে না।  ওটা জোগাড় করতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব কওে ফেলে বলে তাকে শাহজী চরম ঘৃণা করে। নেশাগ্রস্ত অবস্থায়ও অনুপস্থিত অন্নদা দিদিকেও কটুকাটব্য করতে তার আটকায় না। শ্রীকান্ত দেখে- অনুপস্থিত অন্নদাদিদিকে উদ্দেশ্য করে ‘শাহজীর কণ্ঠস্বর ক্রমেই উত্তপ্ত হইয়া’ উঠতে থাকে; এবং ‘ দেখিতে দেখিতে তাহা উন্মত্ত চীৎকারে পরিণত’ হয়ে যায়। ‘ কাহাকে উদ্দেশ করিয়া সে যে এরূপ অকথ্য অশ্রাব্য গালিগালাজ উচ্চারণ করিতে’ থাকে, সেটা তখন নবাগত শ্রীকান্তের পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না। পরে শ্রীকান্ত বোধ করতে থাকে ‘ তাহা তখন বুঝিলে, ইন্দ্র সহ্য করিয়াছিল বটে,কিন্তু আমি করিতাম না।’ 
 

প্যাপ নিজপুত্র হাককে গণ্য করে নিজ নেশা-সামগ্রীকেনার পয়সা সরবরাহের  এক অক্লান্ত মনুষ্য-যন্ত্র বলে। আর, শাহজী অন্নদা দিদিকেই অমনটা বলে গণ্য করতে থাকে। তবে, পরে  সে সন্ধান পায় ইন্দ্রনাথ নামক আরেক উৎসের। তখন ইন্দ্রনাথ হয়ে ওঠে শাহজীর নেশাদ্রব্য ক্রয়ের পয়সা দেবার এক মজবুত জোগানদার। তুকতাক বিদ্যা অধিগত করার জন্য ব্যাকুল ইন্দ্রনাথকে শাহজী সেইসব বিদ্যা শেখানোর নানাবিধ টোপ গেলাতে থাকে। এবং পয়সা আদায় করতে থাকে। 
 

সে ইন্দ্রকে নানামতে ফুঁসলানি দেয়। বলে যে, সে তাকে“ একটি একটি করে... সব বিদ্যে” শিক্ষা দেবে। সাপ বশ করার মন্ত্রই শুধু নয়, শেখাবে “ ঘর-বন্ধন,দেহ-বন্ধন,ধূলো পড়া’ মন্ত্র। ‘মড়া জিয়োবার’ মন্ত্র তো আছেই। আরো আছে ‘ কড়ি-চালা মন্ত্র’; ‘ দুটি কড়ি মন্তর পড়ে ছেড়ে দিলে তারা উড়ে গিয়ে যেখানে সাপ আছে,তার কপালে গিয়ে কামড়ে ধওে সাপটাকে দশদিনের পথ থেকে টেনে এনে হাজির করে। এমনি মনÍরের জোর।’ এইসব মন্ত্র শেখানোর টোপ ফেলে ফেলে শাহজী ইন্দ্রনাথের কাছ থেকে কেবলই পয়সা আদায় করতে থাকে,আর নানান বাহানায় তাকে ‘ কেবল পট্টি দিয়ে দিয়ে’ ‘ আজ নয়,কাল নয় পরশু’ বলে ঘোরাতে থাকে। 
শেষে একদিন যখন অন্নদা দিদি ইন্দ্রের কাছে, সত্যটা এভাবে স্পষ্ট করে দেয়: “আমার এইকথাটুকু আজ শুধু বিশ্বাস কোরো ভাই, আমাদের আগাগোড়া সমস্তই ফাঁকি। আর তুমি মিথ্যে আশা নিয়ে শাহজীর পিছনে ঘুরে বেড়িয়ো না!”  তখন আশাভঙ্গের জ্বালায় ইন্দ্র  ফুঁসে ওঠে: “যদি জান না,তবে তোমরা দুজনে জোচ্চুরি করে ঠকিয়ে আমার কাছ থেকে এত টাকা নিয়েচ কেন?” 
 

আর, কঠিনরকম ক্রুদ্ধ-ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে শাহজী। সে যখন জানতে পারে,তার সব জারিজুরি ফাঁস করে দিয়েছে তার পত্নী স্বয়ং,তখন হিংস্র এক খুনেতে  রূপান্তরিত হয়ে যায় সে, মুহূর্তের মধ্যে। শ্রীকান্ত দেখে: “ শাহজীর চোখ-দুটা ধক করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। সে যে কি ভীষণ প্রকৃতির লোক, সে পরিচয় তখনও জানিতাম না। শুধু তাহার সেই চোখের দৃষ্টিতে আমার গায়ে কাঁটা দিয়া উঠিল।” তারপর সে শুরু করে প্রহার। সেই প্রহারের আঘাতে অন্নদা দিদি মৃতপ্রায় হয়ে উঠানে পড়ে থাকে। ইন্দ্র ওই দুর্বৃত্তটিকে সাজা দিতে তৎপর হয় বটে; কিন্তু শাহজী তাকেও আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত করে ছাড়ে। শ্রীকান্তের জবানীতে আমরা এমনটা জানতে পারি: “বিস্তর টানা-হেঁচড়ার পর যখন উভয়কে পৃথক করিলাম,তখন ইন্দ্রের অবস্থা দেখিয়া ভয়ে কাঁদিয়া ফেলিলাম। অন্ধকারে প্রথমে নজরে পড়ে নাই যে তাহার সমস্ত কাপড়-জামা রক্তে ভাসিয়া যাইতেছে। ইন্দ্র হাঁপাইতে হাঁপাইতে কহিল,শালা গাঁজাখোর আমাকে সাপ-মারা বর্শা দিয়ে খোঁচা মেরেচে- এই দ্যাখ। জামার আস্তিন তুলিয়া দেখাইল,বাহুতে ত প্রায় দুই-তিন ইঞ্চি পরিমাণ ক্ষত এবং তাহা দিয়া অজস্র রক্তস্রাব হইতেছে।”
 

জীবনে শাহজী বাঁচে অবিকল প্যাপেরই মতন বাঁকাচোরা, কুৎসিত এক পাপিষ্ঠ হয়ে; আবার মরেও সে অবিকল প্যাপেরই মতন অপঘাতে, পায় এক কষ্টকর মরণ। বাহ্যজ্ঞানশূন্য মাতাল প্যাপের মৃত্যু ঘটে জলে ডুবে। তারপর তার বেওয়ারিশ লাশ মিসিসিপির স্রোতে ভেসে ভেসে চলে যায় দূরের দিকে। যথোচিত সৎকার জোটে না তার মৃতদেহের ভাগ্যে। প্যাপের মতো মাতাল শাহজীও পায় এক আকস্মিক ভয়াল মৃত্যু।  বেহদ্দ মাতাল অবস্থায় সে, সদ্য ধরে আনা গোখরার সাথে খেলা করতে যায়। ওই খেলা-কালে গোখরার দংশনে তার মৃত্যু ঘটে। শ্রীকান্ত জানায়: ‘আজ দুপুরবেলা কাহার বাটীতে সাপ ধরিবার বায়না থাকে। সেখানে ঐ সাপটিকে ধরিয়া যাহা বকশিশ পায় তাহাতে কোথা হইতে তাড়ি খাইয়া মাতাল হইয়া সন্ধ্যার প্রাক্কালে বাড়ি ফিরিয়া দিদির পুনঃপুনঃ নিষেধ সত্ত্বেও সাপ খেলাইতে উদ্যত হয়। খেলাইয়াও ছিল। কিন্তু অবশেষে খেলা সাঙ্গ করিয়া তাহার লেজ ধরিয়া হাড়িতে পুরিবার সময় মদের ঝোঁকে মুখের কাছে মুখ আনিয়া চুমকুড়ি দিয়া আদর করিতে গেলে,সেও আদর করিয়া শাহজীর গলার উপর তীব্র চুম্বন’ করতে ছাড়ে না। তখনই শাহজীর ‘চৈতন্য’ হয় যে,‘ সময় আর বেশি নেই। বললেন,আয় দুজনে একসঙ্গে যাই, বলে পা দিয়া সাপটার মাথা চেপে ধরে দুই হাত দিয়ে তাকে টেনে টেনে ঐ অতবড় করে ফেলে দিলেন। তারপরে দুজনেরই খেলা সাঙ্গ হল।’ 
তবে শাহজী প্যাপের চেয়ে একঅর্থে ভাগ্যবান। প্যাপের ভাগ্যে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া জোটে না, কিন্তু করুণা-কাতর ইন্দ্র ও অন্নদা দিদি শাহজীর মৃতদেহটিকে যথোপযুক্ত ভাবে মাটির কোলে শায়িত করে দিতে অবহেলা করে না।
 

৪) উপাখ্যানগুলোতে, হাকলবেরি ফিন ও ইন্দ্রনাথকে ঘিরে , কিছু-না-কিছু অদ্ভুত আর গোলমেলে ঘটনা নিত্য-নিরন্তরই ঘটে চলতে দেখা যায়। তবে ওই ঘটনাগুলোর কোনোটিই সুস্থিত ও মন্থর সমাজ-কাঠামোর ভেতরে সংঘটিত হয় না। সেগুলো ঘটে  রীতি-নিয়ম-শাসিত লোকালয়ের বাইরে, ঘটে জনশূন্য কোনো-না কোনো- বিদঘুটে এলাকায়।  ঘটে শুধু প্রধান পাত্রদের ঘিরেই, বা ঘটে শুধু তাদের উপস্থিতিতেই। এগুলো একান্তই যেনো হাক বা ইন্দ্রের নিজস্ব ঘটনা। যার ফায়সালাও করে তারা নিজের নিজের সামর্থ্য অনুসারে। মার্ক টোয়েনের দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ টম সয়্যার-এ আমরা দেখি, পলি আন্টির হুকুমমাফিক সভ্য হওয়ার বিধিপালন করে করে ত্যক্ত-বিরক্ত  টম সয়্যার- শেষে একদিন - পালিয়ে  যায় মনুষ্যবসতিহীন এক দ্বীপে।  সে যদিও যায় তার শখের জলদস্যু জলদস্যু খেলার আবেগে, তবে তার সঙ্গে যায় হাকলবেরি ফিনও।  তারা যায় ভব্যসভ্য হয়ে ওঠার চাপ ও তাপ থেকে নিজেদের রেহাই দেবার মানসে। আবার, দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ হাকলবেরি ফিন-এ  হাকও তার বন্দীদশা থেকে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় খোঁজে অমনই এক বিজনে। পলাতক ক্রীতদাস জিমও গত্যন্তর না-দেখে শেষে ঠাঁই নেয় এক জনবিহীন দ্বীপে। 
সেখানে আরামের ঘাটতি আছে ঠিক, কিন্তু নিজের যেমন ইচ্ছা, তেমন করে দিন কাটানোর স্বাধীনতা আছে। বয়স্কদের হুকুমদারী আর খবরদারীর চাপ থেকে মুক্ত হয়ে, নিজেদের মতো করে, যেমন ইচ্ছে- তেমন বাঁচাটা বেঁচে থাকার পরিস্থিতিটা আছে। 
 

টম সয়্যার সবকিছু ছেড়ে মিসিসিপি নদী ধরে পালিয়ে যেতে পারে, অনেক দূরে। যেতে পেরে সুখী হয়। তখন সে পায় মুক্তির অনেক অগাধ উল্লাস। নিয়ম-মানার জগত থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিতে পারার উল্লাস: “ I reckon so,” said Huckleberry; “anyway, I’m suited. I don’t want nothing better’n this. I don’t ever get enough to eat, gena’lly – and here they can’t come and pick at a feller and bullyrag him so.”
“ It’s just the life for me,” said Tom. “ You don’t have to get up, mornings, and you don’t have to go to school, and wash, and all the blame foolishness.”
 

হাকের নির্দয় মাতাল বাপ প্যাপ- তার পুত্র হাককে - কিডন্যাপ করে এনে, বন্দী করে কোথায় রাখে? রাখে লোকালয় থেকে অনেক অনেক দূরের এক পোড়ো, পরিত্যক্ত এলাকাতে। সেই বন্দীশালাটিকে হাক এভাবে আমাদের কাছে স্পষ্ট করে তোলে: “So he watched out for me one day in the spring, and catched me, and took me up the river about three mile in a skiff, and crossed over to the Illinois shore where it was woody and there warn’t no houses but an old log hut in a place where the timber was so thick you couldn’t find it if you didn’t know where it is.Ó
ওই বন্দীদশা থেকে একসময়, বুদ্ধির জোরে, পালাতে সমর্থ হয় হাক। পালিয়ে হাককে শেষে আশ্রয় নিতে হয়, অন্য আরেক জনমনুষ্যহীন অঞ্চলেই:  “All right; I can stop anywhere I want to. Jackson’s Island is good enough for me: I know the island pretty well, and nobody ever comes there, ... Jackson’s Island’s the place.”
 

লোকালয়, হাকের কাছে, প্রিয় ও নিরাপদ গন্তব্য বলে গণ্য হয় না। জনহীন প্রকৃতি আর নদীই- শুধু তার কাছে গণ্য হতে থাকে চরম অভয়-আশ্রম বলে।
তবে বঙ্গসন্তান ইন্দ্রের পক্ষে অমন কোনো জনশূন্য ভূভাগ খুঁজে পাওয়ার ভাগ্য হয় না। তাই যতোদিন সে নিজ লোকালয়ে থাকতে বাধ্য হয়, ততোদিন থাকে আলগোছে। বাড়ির গুরুজনদের কেউই আর তাকে বিদ্যালয়ে  ফেরত পাঠাতে সমর্থ হয় না। সে যাপন করতে থাকে শিক্ষায়তনের সংস্পর্শহীন কিন্তু প্রকৃতি-জগতের নিবিড় সান্নিধ্য-মোড়ানো কিশোরবেলা। যখন লোক-সান্নিধ্য অসহ লাগতে থাকে তার; তখন ইন্দ্র নিজের ক্ষুদে ডিঙিটার ‘দাঁড় হাতে’ তুলে নেয়। ‘তখন.. .. সে সারাদিন গঙ্গায় নৌকার উপর।’ তখন ‘সে পশ্চিমের গঙ্গার একটানা-স্রোতে পানসি ভাসাইয়া দিয়া, হাল ধরিয়া চুপ করিয়া বসিয়া’ থাকে; তখন ‘ দশ-পনর দিন আর তাহার কোনো উদ্দেশই পাওয়া’ যায় না। আর, অন্য অন্য সময় ইন্দ্রনাথ নিজেকে নিয়ে ছুটতে থাকে রাতের অন্ধকারে, করতে থাকে নানা বিচিত্র রোমাঞ্চকর কর্ম,যেতে থাকে ভয়ঙ্কর সব জায়গায়। ভয়াল সব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে করে ইন্দ্রনাথ, নিজের জীবনকে নিজের মতো করে ভরে তুলতে থাকে। 
ইন্দ্রের যাত্রাসঙ্গী শ্রীকান্ত সেইসব পরিস্থিতির কোনো কোনোটিকে এভাবে বর্ণনা করে চলে: “খাড়া কাঁকরের পাড়। মাথার উপর একটা বহু প্রাচীন অশ্বত্থবৃক্ষ মূর্তিমান অন্ধকারের মত নীরবে দাঁড়াইয়া আছে এবং তাহারই প্রায় ত্রিশ হাত নীচে সূচিভেদ্য আঁধার-তলে পরিপূর্ণ বর্ষার গভীর জলস্রোতে ধাক্কা খাইয়া আবর্ত রচিয়া উদ্দাম হইয়া ছুটিয়াছে। দেখিলাম, সেইখানে ইন্দ্রের ক্ষুদ্র তরীখানি বাঁধা আছে। উপর হইতে মনে হইল, সেই সুতীব্র জলধারার মুখে একখানি ছোট্ট মোচার খোলা যেন নিরন্তর আছাড় খাইয়া মরিতেছে। … ইন্দ্র যখন উপর হইতে নীচে একগাছি রজ্জু দেখাইয়া কহিল, ডিঙির এই দড়ি ধ’রে পা টিপে টিপে নেবে যা, সাবধানে নাবিস, পিছলে পড়ে গেলে আর তোকে খুঁজে পাওয়া যাবে না; তখন যথার্থই আমার বুক কাঁপিয়া উঠিল। মনে হইল, ইহা অসম্ভব। কিন্তু তথাপি আমার ত দড়ি অবলম্বন আছে, কিন্তু তুমি?
 

সে কহিল, তুই নেবে গেলেই আমি দড়ি খুলে দিয়ে নাবব। ভয় নেই, আমার নেবে যাবার অনেক ঘাসের শিকড় ঝুলে আছে। ... ভয়ে বুকের ভিতরটা এমনই ঢিপঢিপ করিতে লাগিল যে,তাহার পানে চাহিতেই পারিলাম না! মিনিট দুই-তিন কাল বিপুল জলধারার মত্তগর্জন ছাড়া কোনও শব্দমাত্র নাই। হঠাৎ ছোট্ট একটুখানি হাসির শব্দে চকিত হইয়া মুখ ফিরাইয়া দেখি, ইন্দ্র দুই হাত দিয়া নৌকা সজোরে ঠেলিয়া দিয়া লাফাইয়া চড়িয়া বসিল। ক্ষুদ্র তরী তীব্র একটা পাক খাইয়া নক্ষত্রবেগে ভাসিয়া চলিল।”
 

এই খাপ-না-খাওয়া বহিরিস্থিতদের কাছে সমাজ-সংসার বিশেষ প্রীতিকর ও বাঞ্ছিত কোনো অঞ্চল নয়; তবে তাদের মুগ্ধ করে রাখে, বরাবরের জন্য অভিভূত করে রাখে- নদী। প্রবলা গতিশীলা স্রোতবতী নদী এই আখ্যানগুলোর ভূভাগে প্রবাহিত হতে থাকে নিজের নির্বিকারত্ব নিয়ে; প্রবাহিত হতে থাকে আপন নিয়মে। হাক বা ইন্দ্র ওই নদী দিয়ে দিয়ে মুগ্ধ হয়; তাকে নিজের বশীভূত করে তোলার জন্য চাঞ্চল্যও বোধ করে। কিন্তু সেই নদী থাকে চির অবশীভূত, থাকে নির্বিকার অনাত্মীয় আত্মমগ্নতায়। 
 

৫)  এই আখ্যানগুলোতে নদীর আছে এক বিপুল ভূমিকা। মার্ক টোয়েনের রচনার ওই বহতা বিশালা স্রোতস্বিনীর নাম মিসিসিপি। শরৎচন্দ্রের লেখার সেই প্রখরা গতিশীলা জলধারার নাম গঙ্গা। মিসিসিপি নদীটি ভরাপুরা স্রোতময়ী, তেজদৃপ্তা, কূলকিনারাহীন এবং ভয়-জাগানিয়া তো সে বটেই। এই নদী আত্মবিভোরা এক জলধারা বটে; তবে পলাতকদের জন্য সে আবার এক চরম আশ্রয়ও। আবার সে হয়ে ওঠে অবাধ মুক্ততারও আরেক নাম। হাকলবেরি মিসিসিপিকে এভাবে দেখে: “When I woke up I didn’t know where I was for a minute. I set up and looked around, a little scared . Then I remembered. The river looked miles and miles across. The moon was so bright I could a counted the drift logs that went a-slipping along, black and still, hundreds f yards out from shore. Everything was dead quiet, and it looked late, and smelt late, You know what I mean – I don’t know the words to put it in.”
তবে প্রায়শই ওই স্বমগ্না মিসিসিপির বিপুলত্ব হাকের অন্তরে ভীতি ও সংশয় জাগায়ে তোলে:  I was floating along,of course,four or five miles an hour; but you don’t ever think of that. No, you feel like you are lying dead and still on the water; and if a little glimpse of a sang slips by, you don’t think to yourself how fast you’re going, but you catch your breath and think, my! How that snag’s tearing along. If yoy think it ain’t dismal and lonesome out in a fog that way, by yourself, in the night,you try it once- you’ll see.”
 

যখন পলাতক ক্রীতদাস জিমকে সর্ব বিপদ থেকে আগলে নিয়ে, কায়রো শহরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যাত্রা করে হাক,তখন মিসিসিপিই হয়ে ওঠে একমাত্র ভরসা। তাকে তখন হাক নিজেদের রক্ষাকর্ত্রী বলেই মান্য করতে থাকে; কিন্তু তখনও ওই নদী নিকট ও অভয়দাত্রী হয়ে ওঠে না;  বরাবরের মতোই থাকে সে রহস্যময় আর দূরধিগম্য হয়ে : “we went drifting down into a big bend,and the night clouded up and got hot. The river was very wide, and was walled with solid timber on both sides; you couldn’t see a break in it hardly ever, or a light.”
 

ইন্দ্রনাথের গঙ্গাও অমনই আত্মমগনা,গতিশালী। যখন সে বর্ষার নদী,তখন সে তুমুল স্রোতময়ী আর নির্বিকার। তখন এই নদী উচ্চ তীব্র এবং ভয়াল। নিজের আশপাশের চরাচরকেও সে তখন সুশান্ত আর নিরাপদ রাখতে রাজি নয়। সে তখন বিভীষিকা-জাগানিয়া, তাণ্ডব ঘনিয়ে তোলার জন্য উদ্যত। মনুষ্য-সন্তান সেই প্রবল শক্তি ও গতি-তীব্র অবান্ধব নদী-প্রকৃতির এলাকায় নিতান্তই সামান্য আর নিরুপায় এক সত্তা মাত্র। বিষম অসহায় সে। প্রখর ও বিকারশূন্য সেই জল-প্রকৃতির রূপটিকে শ্রীকান্তের জবানীতে আমরা এভাবে বর্ণিত হতে শুনি: “ কয়েক মুহূর্তেই ঘনান্ধকারে সম্মুখ এবং পশ্চাৎ লেপিয়া একাকার হইয়া গেল। রহিল শুধু দক্ষিণ ও বামে সমান্তরাল প্রসারিত বিপুল উদ্দাম জলস্রোত এবং তাহারই উপর তীব্রগতিশীলা এই ক্ষুদ্র তরণীটি এবং কিশোরবয়স্ক দুটি বালক। .. .. .. আশেপাশে সম্মুখে কোথাও বা উন্মত্ত জলস্রোতে গভীর তলদেশে ঘা খাইয়া উপরে উঠিয়া ফাটিয়া পড়িতেছে,কোথাও বা প্রতিকূল গতি পরস্পরের সংঘাতে আবর্ত রচিয়া পাক খাইতেছে, কোথাও বা অপ্রতিহত জলপ্রবাহ পাগল হইয়া ধাইয়া চলিয়াছে। …
বহুক্ষণ এইভাবে চলার পরে কি একটা যেন শোনা গেল - অস্ফুট এবং ক্ষীণ; কিন্তু নৌকা যত অগ্রসর হইতে লাগিল, ততই সে শব্দ স্পষ্ট এবং প্রবল হইতে লাগিল। যেন বহুদূরাগত কাহাদেও ক্রুদ্ধ আহ্বান। ... মাঝে মাঝে এক-একবার ঝুপঝাপ শব্দ। জিজ্ঞাসা করিলাম, ইন্দ্র, ও কিসের আওয়াজ শোনা যায়? সে নৌকার মুখটা আর একটি সোজ্ করিয়া দিয়া কহিল, জলের স্রোতে ওপারের বালির পাড় ভাঙার শব্দ।
জিজ্ঞাসা করিলাম, কত বড় পাড়? কেমন স্রোত?
সে ভয়ানক স্রোতে। ওঃ, তাই ত, কাল জল হয়ে গেছে,আজ ত তার তলা দিয়ে যাওয়া যাবে না। একটা পাড় ভেঙ্গে পড়লে ডিঙ্গিসুদ্ধ আমরা সব গুঁড়িয়ে যাব। …
 

অনুকূল স্রোতে মিনিট দুই-তিন খরবেগে ভাঁটাইয়া আসিয়া হঠাৎ একস্থানে একটা দমকা মারিয়া যেন আমাদেও এই ক্ষুদ্র ডিঙিটি পাশের ভুট্টাক্ষেতের মধ্যে গিয়া প্রবেশ করিল।… আমি ত নৌকায় বসিয়া; কিন্তু ঐ লোকটি একবুক কাদা ও জলের মধ্যে এই বনের ভিতরে। এক পা নড়িবার চড়িবার উপায় পর্যন্ত তাহার নাই। মিনিট-পনর এইভাবে কাটিল। আর একটা জিনিস লক্ষ্য করিতেছিলাম। প্রায়ই দেখিতেছি,কাছাকাছি এক-একটা জনার, ভুট্টাগাছের ডগা ভয়ানক আন্দোলিত হইয়া ‘ছপাৎ’ করিয়া শব্দ হইতেছে। একটা প্রায় আমার হাতের কাছেই। সশঙ্কিত হইয়া সেদিকে ইন্দ্রের মনোযোগ আকৃষ্ট করিলাম।.. .. ..
ইন্দ্র অত্যন্ত সহজভাবে কহিল, ও কিছু না - সাপ জড়িয়ে আছে; তাড়া পেয়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
কিছু না - সাপ! শিহরিয়া নৌকার মাঝখানে জড়সড় হইয়া বসিলাম। অস্ফুটে কহিলাম, কি সাপ ভাই?
ইন্দ্র কহিল, সব রকম আছে, ঢোঁড়া, বোড়া, গোখরো, করেত, - জলে ভেসে এসে গাছে জড়িয়ে আছে - কোথাও ডাঙ্গা নেই দেখচিস নে?”
স্রোতবতী মিসিসিপির মতো এইখানে গঙ্গাও ভয়ঙ্করী; তারপরেও হাকলবেরি ফিন যেমন মিসিসিপিকেই আশ্রয় করে ছুটতে থাকে; তেমনি ইন্দ্রনাথও নিজের আশ্রয় বলে মানে এই গঙ্গাকেই। এই নদী অগাধ সুন্দর, কিন্তু অ-নিকট একজন। তার কাছে গেলে যেমন গা-ছমছমে আতঙ্কের সাথে দেখা হয়, তেমনি দেখা হয় আশ্চর্য সব রোমাঞ্চের সাথেও।
 

উপসংহার
শ্রীকান্ত (প্রথম পর্ব)- উপন্যাসের অনেকখানি জুড়ে ওই আতঙ্ক-মোড়ানো, রোমাঞ্চকর এক অভিযাত্রারই গল্প বলেছেন শরৎচন্দ্র। বলেছেন মার্ক টোয়েনকে দিয়ে অনেকখানি প্রভাবিত হয়েই। মার্ক টোয়েনের আখ্যানদ্বয় যেমন শুধুই দুটি রোমাঞ্চ-অভিলাষী কিশোরের আবেগ-আকুলতাজনিত আখ্যানমাত্র হয়ে থাকেনি; শেষ পর্যন্ত ওই আখ্যানগুলো, প্রধানত পলাতক ক্রীতদাস জিমকে কেন্দ্র করেই, হয়ে উঠেছে  সমকালীন সমাজবাস্তবতায় ঘটে চলা মানবিক নিপীড়নেরও এক দলিল।  শরৎচন্দ্র সেখানে তাঁর গল্পের এই পর্বে, দুটি কিশোরের দুরভিযানের বিবরণ রচনার সাথে সাথে, উদ্ঘাটন করেছেন সমাজের নি¤œতলবাসী প্রায় পশু-মানুষের জীবনের ক্লেদাক্ততা ও ক্লিন্নতার রূপটিকেও।  শরৎচন্দ্র হচ্ছেন এমনই এক অতুল্য কারুকার,যিনি দিগন্তে দিগন্তে কথা ও কাহিনীর করুণা-সঘন  ইন্দ্রধনু সৃজন করতে জানেন। জানেন তাঁর গল্পে মানবিক বেদনা ও বিহ্বলতাকে প্রগাঢ়রকমে জড়িয়ে দিতে। এই উপন্যাসের ক্ষেত্রেও সেটির ব্যত্যয় ঘটেনি। তিনি নিজ কল্পনাপ্রতিভাগুণে ওই প্রভাবকে  শুধু নিজস্ব শিল্প-সুষমা মণ্ডিতই করে তোলেননি; একই সাথে করে তুলেছেন বঙ্গ-ভূখণ্ডের জল ও হাওয়া ও করুণা-মমতাজড়ানো এক মুগ্ধকর সৃষ্টি।                            

(সমাপ্ত)

 

পরিশিষ্ট
শরৎচন্দ্রের আখ্যানগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, দুরন্ত সব মন্দ-কিশোরের  গল্প বলার দিকে ছিলো তাঁর গভীর আগ্রহ। তাঁর আখ্যানগুলোর একটা বড়ো অংশ জুড়ে আমরা  এই মন্দ-বালকদের উপস্থিতি দেখতে পাই। যেমন, শরৎচন্দ্রের একেবারে শুরুর দিকের রচনা দেবদাস-এ আমরা যে কিশোর দেবদাসকে পাই, সে যেমন উৎপাত সৃষ্টিকারী, একগুঁয়ে আর অবাধ্য; তেমনি তারও আছে মমতা করার ও তাকে মমতা দেওয়ার এক সঙ্গী। নিতান্ত বালিকা সে। তার নাম পার্বতী। দেবদাসের নিজের জীবন ও তার পারিপাশের্^র সবকিছু- তার দুরন্তপনার ঝাপটে একেবারে ছন্নভন্ন হয়ে যায়। অন্য উপাখ্যান রামের সুমতি-তেও উপস্থিত হয় ওই একইরকম অবাধ একগুঁয়ে আর অভিমানী এক বালক,তাকে রাম নামে চিনি আমরা। এই রামই যেনো মামলার ফল-এ এসে গঙ্গারাম নামে উৎপাত ঘটাতে থাকে। দেবদাস বা রামের মতোই অবিকল একই রকম মন্দ-গোঁয়ার আর দুরন্ত সে। অবিকল একইরকম স্নেহবুভুক্ষু। তবে সংসারে, এদের বুঝে ওঠার আর স্নেহ করার মতো, দরদীজন অতি অল্পই আছে।
এরা বাহ্যত মাথা-গরম, বুনো ও রাগী বালকের দল;  তবে অন্তরে অন্তরে তারা শুধু মমতা-কাতরই নয়, তারা প্রত্যেকেই পরম মমতাময়ও। এরা সকলেই, নিজ প্রিয়জনের মঙ্গলসাধনের জন্য জীবন বাজী রাখতে প্রস্তুত। দরদ ও সেবা দিয়ে এদেও অন্তর অতি সহজেই জয় করে নেওয়া যায়। কিন্তু কঠোর শাসন দিয়ে এদের সুশৃঙ্খল আর সুশীল বানানো কখনোই সম্ভব হয় না। বরং নিষ্করুণ কঠোর শাসনের সামনে এরা হয়ে ওঠে - আরো বেশী দুবির্নীত ও অবাধ্য। ওই একগুঁয়ে, খাপ-না-খাওয়াদেরই অন্য দুই সহযাত্রী হচ্ছে—এই ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্ত।

 

ব্যবহৃত গ্রন্থপঞ্জি 
১. রশীদ আল ফারুকী: শরৎ-সাহিত্য-জিজ্ঞাসা। বিবিধ প্রকাশনী,চট্টগ্রাম। চৈত্র ১৩৭৮।
২. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত:  শরৎচন্দ্র। এ.মুখার্জ্জী অ্যান্ড কো. প্রা. লি. , কলকাতা; একাদশ সংস্করণ: অগ্রহায়ণ ১৩৮০ বঙ্গাব্দ।
৩. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়: বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা। মডার্ন বুক এজেন্সী, কলকাতা; ষষ্ঠ পুনর্মুদ্রণ: ১৩৮০ বঙ্গাব্দ।
৪. নবনীতা দেবসেন: ঈশ্বরের প্রতিদ্বদ্বী ও অন্যান্য প্রবন্ধ। আশা প্রকাশনী,কলকাতা। মহালয়া ১৩৮৪ বঙ্গাব্দ।
৫. মোহিতলাল মজুমদার: শ্রীকান্তের শরৎচন্দ্র। বিদ্যোদয়,কলকাতা; ১৯৭১।
৬. খগেন্দ্র নাথ মিত্র ও অন্যরা (সম্পাদিত): বৈষ্ণব পদাবলী, কলিকাতা বিশ^বিদ্যালয়, নবম সংস্করণ: ১৯৭২।
৭. সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়: বাংলা উপন্যাসের কালান্তর। দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা; ১৯৮০।
৮. মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান (সম্পাদিত): বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ( আধুনিক যুগ)। আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা। এপ্রিল ১৯৭৯।
৯. ওয়াকিল আহমদ (সম্পাদিত): আধুনিক বাংলা সাহিত্য প্রতিভা: স্বাতন্ত্র্য বিচার। এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, ঢাকা। ১৯৮৭।
১০.    অশ্রুকুমার সিকদার: আধুনিকতা ও বাংলা সাহিত্য। অরুণা প্রকাশনী,কলকাতা।  জুলাই ১৯৮৮।
১১. যোগীন্দ্রনাথ সরকার: জয় পরাজয়  ( প্রকাশকাল অজ্ঞাত) , শিশুপাঠ্য গ্রন্থাবলী; শৈবা প্রকাশন বিভাগ, কলকাতা; ১৯৮৮।
১২. বিষ্ণু প্রভাকর: ছন্নছাড়া মহাপ্রাণ ( অনুবাদ: দেবলীনা ব্যানার্জি কেজরিওয়াল)। ওরিয়েন্ট লংম্যান,কলকাতা। দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৩৯৩ বঙ্গাব্দ।
১৩. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: শরৎসাহিত্যসমগ্র ১ ( সম্পাদক: সুকুমার সেন)। আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড,কলকাতা; প্রথম প্রকাশ: ভাদ্র ১৩৯৩ বঙ্গাব্দ।
১৪. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: শরৎসাহিত্যসমগ্র ২ ( সম্পাদক: সুকুমার সেন)। আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড,কলকাতা; প্রথম প্রকাশ: ভাদ্র ১৩৯৩ বঙ্গাব্দ।
১৫. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর:  “বর্ণপরিচয়- প্রথম ভাগ”, বিদ্যাসাগর রচনাবলী দ্বিতীয় খণ্ড (সম্পাদনা: তীর্থপতি দত্ত)। তুলিকলম, কলকাতা; দ্বিতীয় সংস্করণ: সেপ্টেম্বর ১৯৯৪।
১৬. হুমায়ুন আজাদ (সম্পাদিত): শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গৃহদাহ। আগামী প্রকাশনী, ঢাকা। ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯।
১৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: গল্পগুচ্ছ । চারদিক প্রকাশনী, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ: জুন ২০০৪।
১৮. সুকুমার রায়: ‘পাগলা দাশু’, সমগ্র শিশুসাহিত্য সুকুমার রায়। আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি., কলকাতা; চতুর্দশ মুদ্রণ: আশ্বিন ১৪০৮ বঙ্গাব্দ।
১৯. Henry  Nash Smith (ed.): Mark Twain : A collection of Critical Essays. Prentice-Hall,Inc. USA; 1963.
২০. Mark Twain : The Adventures of Tom Sawyer. First Published in USA, 1876. Reprinted by  FP Classics, India; 2018.
২১. Mark Twain : The Adventures of  Huckleberry Finn. First Published in USA, 1884. Reprinted by  FP Classics, India; 2019.
২২. Stuart Hutchinson ( ed.) : Mark Twain: Tom Sawyer Huckleberry Finn, Published by Icon Books, UK; 1998.
 

Link copied!