স্মরণ

উচ্চাঙ্গসংগীতের পুরোহিত ওস্তাদ পি সি গোমেজ


শ্রী রঞ্জন চন্দ্র সরকার
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫, ০৭:০২ পিএম
উচ্চাঙ্গসংগীতের পুরোহিত ওস্তাদ পি সি গোমেজ
ওস্তাদ পি সি গোমেজ ও তার লেখা বই

উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী পাসকালস চার্লস গোমেজ সংগীত পুরোহতি; তথা এই উপমহাদেশের সংগীতে রূপ-রস-গন্ধ আস্বাদনের রূপকার। যিনি রেখে গেছেন এই উপমহাদেশের অসংখ্য অনুরাগী ও ভক্ত। তিনি সংগীতকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষার্থীদের সংগীতের রস আস্বাদনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তা ছাড়া তিনি অসংখ্য গুণী শিল্পী রেখে গেছেন। তাঁর জ্ঞান-গুণ সব বিলিয়ে দিয়ে গেছেন শিক্ষার্থীদের তরে। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা এই উপমহাদেশে সংগীতের একেকজন দিকপাল। ওস্তাদ পি সি গোমেজ তাঁর শিষ্যদের ভাব, ভাষা, আচরণ, রস সবকিছু সহজভাবে বিলিয়ে দিতেন।

তাঁর জন্ম বাংলাদেশে। উপমহাদেশে প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী পাসকালস চালস গোমেজ (পি সি গোমেজ) ১৯০৪ সালের ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জের বক্রনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম যোসেফ গোমেজ। মাতার নাম আনতনিয়া গোমেজ। পিতা-মাতা দুজনই সংগীত অনুরাগী ছিলেন। মা চার্চে প্রার্থনাসংগীত গাইতেন। মায়ের কারণেই তিনি সংগীতের প্রতি অনুরাগী হন। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর সংগীতের প্রতি অনুরাগ ছিল। তাঁর ঠাকুর দাদা ভিনসেন্ট গোমেজ সংগীতশিল্পী ছিলেন। তাঁর কাছ থেকেও তিনি সংগীতের অনুপ্রেরণা পান। 

১৮ বছর বয়সে তিনি সংগীতের সুবাস আস্বাদনের ও তালিম গ্রহণের জন্য কলকাতার উদ্দেশে পাড়ি দেন। এর কিছুদিন পর দিল্লিতে মোহনলাল শর্মার স্কুলে সংগীত শিক্ষার সুযোগ পান। মোহনলাল শর্মার মৃত্যুও পর তাঁরই ছাত্র বানোয়ারীর কাছে তিনি তালিম গ্রহণ করেন। তারপর তিনি ওস্তাদ পীর খাঁর কাছে সংগীতে দীর্ঘ চার বছর তালিম গ্রহণ করেন। এরই মধ্যে দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পর ১৯৬২ সালে তিনি অসুস্থতার কারণে মাটির টানে দেশে ফিরে আসেন। এখানে এসে তিনি শিক্ষকতা ও ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সংগীতের তালিমে ব্যস্ত সময় পার করেছেন। এই সময়ে তিনি বহু ছাত্রছাত্রীকে প্রতিষ্ঠিত করে রেখে যান। তাঁর সাবলীল শিখন পদ্ধতিতে তিনি দেশের একজন জনপ্রিয় ওস্তাদ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর অসাধারণ গায়কী ছিল। 

খেয়াল ঠুমরীতে তিনি অত্যন্ত নায়কী ঢং ব্যবহার করতেন। ১৯৮২ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহযোগিতা ও শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক আজাদ রহমান থাকাকালীন তিনি রাগ রংগ বিলাসিনী (পাসকালস চালস গোমেজ) নামে একটি রাগ সংগীতের বই বের করেন। এই বইটি তাঁর সারা জীবনের জ্ঞান, গুণ, রাগ রাগিণীর সুর জানা-অজানা কথা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এই বইটি দেশের সংগীত অনুরাগীদের জন্য অমূল্য সম্পদ বলে আমি মনে করি। রাগ রংগ বিলাসিনী বইটি প্রচার প্রসারে সরকারি বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নিলে আমাদের সংস্কৃতির বিকাশ হবে বলে আমি মনে করি। রাগ-সংগীতে তাঁর অসাধারণ গায়কী ও দক্ষতা ছিল। যার বিচ্ছুরণ আমরা দেখতে পাই তাঁর শিষ্যদের গায়কী শৈলীতে। তাঁর রেখে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের  মধ্যে রয়েছেন নিলুফার ইয়াসমীন, সাবিনা ইয়াসমীন যোসেফ কমল রড্রিক্স, সৈয়দ আব্দুল হাদী, রথীন্দ্রনাথ রায় আরও অনেকেই। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা সুনামের সঙ্গে সংগীতজগতে আছেন অনন্য ভূমিকায়। 

ওস্তাদ পি সি গোমেজের ভাবশিষ্য তরুণ কবি ও গবেষক রকি গৌড়ি ভারতের দৈনিক ত্রিপুরার ভবিষ্যৎ সাহিত্যের পাতায় ওস্তাদ পি সি গোমেজকে উৎসর্গ করে লিখেছেন, তাঁর তানপুরাটা হারিয়ে গেছে তাঁরই মতন অজানায়/ কিংবদন্তি শিষ্যদের খুঁজি অযথাই/ আহত রাগ রাগিণীরা কাঁদে মালকার, দেশহার, ভূপালী, গুজর্রী টংকীতে/ এবার হও বৃষ্টি ঝুম ঝুম সৃষ্টিতে/ তিনি কি ফিরবেন রাগ ভৈরব রাগিণী মধ্যমাদি, সুরে সুরে সিন্দুরায়/ পাখিগুলো অবাক হতো শুদ্ধ সুরের সুর গড়ায়। বাংলাদেশসহ তথা এই উপমহাদেশের সংগীতের সুরের সাধক ওস্তাদ পি সি গোমেজের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর জীবনাচার সাধনার রূপ তুলে ধরা অত্যন্ত প্রয়োজন। 

জ্ঞানীর মূল্য না দিলে এই প্রজন্ম জ্ঞান গুণ নিয়ে চর্চা করতে উৎসাহ পাবে না। তাই তাঁর জ্ঞান-গুণের সার্বিক মূল্যায়ন প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। তাঁর রাগ রংগ বিলাসিনী বইটি প্রচার প্রসারে সঠিক পদক্ষেপ সংগীতের ভান্ডার আরও সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হবে বলে আমি মনে করি। অবশেষে আমি তাঁর প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা রাখলাম।

 

লেখক: উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী, বাংলাদেশ বেতার

Link copied!