• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১,
পঞ্চম কিস্তি

সে ও নিমবিরিক্ষি যে গুপ্তকথা জানে


আকিমুন রহমান
প্রকাশিত: নভেম্বর ৮, ২০২৪, ১০:৫৯ এএম
সে ও নিমবিরিক্ষি যে গুপ্তকথা জানে

সেটা তখন গ্রীষ্মদিনের তপ্ত অপরাহ্ণবেলা। মর্ত্যের সেই অপরাহ্ণের কালে, ঢলে পড়তে থাকা সূর্যের সেই ঘোলাটে-কমলা আলো-ঢালার কালে, অবশেষে আমার প্রভুদ্বয় তাদের চলা বন্ধ করলেন। কোথায় এসে থামলাম তবে আমরা শেষমেশ? এত পরিব্রাজন শেষে, প্রভু দুজন, এখন তবে কোথায় এসে দাঁড়ালেন? পেছনে দাঁড়ানো আমি দেখতে পেতে থাকি, ওই তো সম্মুখে দেখা যায় সুমস্ত এক ফটকের খোলা দুই কপাট। লৌহ আর অতি পুরু কাষ্ঠনির্মিত দুই কপাট! সুবিপুল সুপ্রশস্ত প্রাচীরের দুই মাথা দুই দিক থেকে এসে, হয়ে উঠেছে যেনো কঠিন নিষেধ-জমকানো কপাট। প্রবেশাধিকার আটকে দেওয়ার কপাট।

কিন্তু ওই কপাটদ্বয় এখন অর্গলবদ্ধ নয়। তারা এখন হা হা খোলা। নগরীর প্রবেশদ্বারেরে এভাবে উন্মুক্ত করে রাখে কেন এই নগরীর বাসিন্দাগণ? পররাজ্যের শত্রু আক্রমণের আশঙ্কামুক্ত কি তারা? বা মরু অঞ্চলের লুটেরা দস্যুদের ভয়ও কি তাদের নেই? এমনই বীরবাহু বলশালী নাকি এইখানের লোকসকলে? আমার ভেতরে এমত নানা জিজ্ঞাসা-বুদ্বুদ বুড়বুড়ি তুলতে থাকে। কিন্তু ওই জিজ্ঞাসার উত্তর অন্বেষণের কোনো তাগাদাও আমি পাই না আমার ভেতরে। কী-ই বা প্রয়োজন এইখানে, মীমাংসা অন্বেষণের? আমার জন্য, যেকোনো রকম ঔৎসুক্য, নিষিদ্ধ নয় কি? আমি বরং চুপমুখে দেখেই যাই না কেন যাবতীয় বিষয়-আশয়? দেখে যেতে যেতেই নিশ্চয়ই সব ধন্দের মীমাংসা পেতে থাকব আমি। এমত মীমাংসা জাগ্রত হয় আমার ভেতরে। আমি মৌনমুখে চোখ খুলে দিই আরও ব্যাপক রকমে।

অবাধ নগর-ফটকের ওই পাড়ে, ওই দেখা যায় পথ! পাথর-বাঁধানো পথ। ধূসর বরনা রৌদ্র নিমগনা পন্থ, জনহীন। সেই পথে এখন কোনো মনুষ্যজনের ছায়াসুদ্ধ নজরে আসে না। শুধু খর রৌদ্র একা বিরাজ করে চলছে পথের সবটা জুড়ে। ওই তো দূরে দূরে দেখা যায় প্রস্তরনির্মিত গৃহসকল, গৃহবাসীগণের ছায়াও কাঁপে না কেন তবে কোনো দিকে?

এই যে নগরী, তার কী নাম?

তার নাম সাদোম।

এইখানে, এই সাদোম নগরের প্রবেশদ্বারের সম্মুখে, আমার প্রভু দুজন কতক্ষণ এমন থির দণ্ডায়মান থাকার মানস করেছেন? কেনই-বা এমন দাঁড়িয়ে থাকার মানস করেছেন তাঁরা! এই জিজ্ঞাসার মীমাংসা আমাকে কে দেয়! এই নগরীর কাছে আমাগণের বা কী প্রয়োজন!

প্রভুদ্বয় যেন আমাকে শোনানোর জন্যই, আচমকাই কথা বলে ওঠেন।

এই যে নগরী, এইখানে বসত করে এক দয়াবান মনুষ্যপুত্র। তার অন্তরে ন্যায়-অন্যায় বোধখানা চিরকাল ধরেই, অতি জাগ্রত। তাঁর হিতাহিত ধারণাও স্বচ্ছ-গভীর। ওই দয়ালু-মনুষ্যের নাম প্রলুত। প্রলুত নগর-প্রভু ঠিক, কিন্তু অশক্ত, নিঃসহায় এক নগরপ্রভু। বড়ো একা আজ সে। বড়ই বিপন্ন তার জীবন। তার সদাচার করার বাসনা ও তার প্রার্থনার সাধ- সবই বিষম বিপন্ন এখন, এইখানে।

এই সাদোম নগরীতে একা সে ধর্মশীল, একা সে সদাচারী, একা সে লোক-মঙ্গলকামী। এই নগরী লোকপরিপূর্ণ, কিন্তু প্রলুত ব্যতীত অপর সকলেই এইখানে, উৎকট ব্যভিচার-মত্ত। পশ্বাচারে ও অজাচারে তারা প্রতিজন অসহ সুখ পায়। তারা পুরুষকামী, প্রতিটি পুরুষই, পুরুষে উপগত হয়ে পায় কামনিবৃত্তি। তারা এখন আর নারীগামী নয় কেউ। শুধু পুরুষই গণ্য হয় এইখানে, সম্ভোগ ও রতিক্রিয়া সম্পন্নকরণের একমাত্র উপকরণ রূপে।

এই যে নগরী, এটি প্রলুতের সদাচারগুণে সদাপ্রভুর আশীর্বাদধন্য। তাই এর ভূমি অশেষ উর্বরা। এই ভূমি জলশালী। এইখানে শস্য সুপ্রচুর ফলে। এইখানে দ্রাক্ষাকুঞ্জ দ্রাক্ষাভারে নূব্জ। এইখানে পশুপাল অগুনতি। যব, দুগ্ধ, মধু ও দ্রাক্ষারস এইখানে, সংবৎসরই থাকে, অফুরান। থাকে এই সাদোম নগরীকে প্লাবিত করে দেওয়ার মতো অঢেল রকমে।

নারীগণ এই নগরীতে একদা সন্তানবতী হতো। তখন পুরুষসকলে, নারীতেই উপগত হবার, সুরীতি মান্য করে যেত। এখন দুই যুগ ধরে সাদোম শিশুশূন্য। কেননা, পুরুষ আর নারীমুখী নয়। নারীদেহ তাদের আর টানে না। ফলে বহু বহুদিন ধরে অভুক্ত থেকে থেকে, এই নগরীর বহু বহু কামউপোসী নারী; স্বেচ্ছায় নিজেকে তুলে দিয়েছে মরুভূমির তস্করদের হাতে।

নগর প্রাচীরের চারপাশে, মরুভূমির হু হু ধূ-ধূ বালুকারাশিতে, তপ্ত ধূলিঝড় তুলে ছুটে বেড়ায় বেজাত অশ্বারোহী তস্করগণ। স্বেচ্ছাসমর্পিতা নারীদের তারা যথেচ্ছ ভোগ করে, কিন্তু কোনোজনকেই নিজ গৃহে আশ্রয় দেয় না তারা। ভোগরতি সম্পন্ন করে, এই স্বেচ্ছাআগতা হতভাগিনীগণকে, তারা নিয়ে যায় দূর দূর দেশে। সেইখানের বাজারে বাজারে বিক্রি করে চলে সাদোম-কন্যাদের।

এই সব জেনেও সাদোম পুরুষ-অন্তরে কোনো বিকার-তাপ-ঘৃণা-অগৌরববোধ, কিচ্ছু জাগে না। কিচ্ছু জাগেনি কদাপিও। বরং নারীদেহের কাম-আহ্বান পাবার বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাওয়ার উল্লাস বোধ করে চলে তারা। তাদের যে পুরুষ-দেহ হলেই চরম চরিতার্থতা আসে। নারীতে কোন প্রয়োজন তবে! সাদোমের অন্য নারীরা যাতে সহজেই নগর ত্যাগ করতে পারে, সেই জন্যই নগরীর প্রধান অপ্রধান সকল ফটক, এইভাবে উন্মুক্ত রাখে তারা।

একা শুধু বয়োবৃদ্ধ প্রলুত তার অক্ষম অশ্রু ও বিলাপটুকু সম্বল করে ভূমিতে মাথা ঠুকে চলে। হায়, সাদোমকন্যাগণ! কেন সদাপ্রভু তোমাদের এই জালেমের নগরে জন্ম নিতে পাঠিয়েছিল একদা! হায়! তোমাদের সম্মান রক্ষার এতটুকু শক্তি যে এই বৃদ্ধ নগরপতির বাহুতে আর অবশিষ্ট নাই। হায়, কন্যাগণ! হায়! রাতের পর রাত এমত বিলাপ ও ক্রন্দনেই থাকে প্রলুত। ক্রন্দনে থাকতে থাকতেই তার মন একপ্রকার স্বস্তি পেয়ে ওঠে! এই ভালো, এই যে সাদোমে আর কোনো শিশু জন্ম নিচ্ছে না। এই-ই মঙ্গলকর যে, আর কোনো মেয়েশিশু এই সাদোমে জন্ম নিচ্ছে না। এই-ই ভালো যে, এমতে নির্বংশ হয়ে যাচ্ছে প্রলুতের নগর। এই-ই মঙ্গল।

এই যে সাদোমের প্রবেশদ্বার এমত উন্মুক্ত, মরুভূমি তস্করেরা যদি আচমকা হানা দেয় নগরীতে? লুটে নিতে আসে যদি নগর-সম্পদ! হায় রে! তেমন আশঙ্কা কিছুমাত্র করে না সাদোম-পুরুষ। তারা বরং খাউখাউ শরীর নিয়ে, বেচঈন হয়ে থাকে, অমন নব পুরুষদেহকে পাওয়ার জন্য।

আহা! দিক দিক, হানা দিক তস্করগণ! তারা পুরুষ তো, তাই না? আহা! সেই নব পুরুষদেহ আস্বাদ করার জন্য কত না দাউ দাউ হয়ে আছে সাদোমের পুরুষগণ! আসুক, আসুক, পুরুষদেহ! নতুন দেহ হে! আইসো! নবরকমে বাঞ্ছা চরিতার্থকরণের সুযোগ হয়ে আইসো! নব দেহ! আহা! আসুক! কিন্তু কোনো তস্কর ভুলেও এই নগরীর ভেতরে পা রাখে না! কে না জানে,সাদোম-পুরুষের পুংদেহ বুভুক্ষার কথা! তার শিকার হতে যাবে নাকি তস্করপুরুষ! কিছুতেই নয়।

তবে সাদোম যে এখন একেবারেই নারীহীন, তা নয়। অল্প গুটিকয় নারী এখনো কোনো না কোনো গৃহে বিরাজ করে ঠিক; কিন্তু তারা হয় উন্মাদগ্রস্ত, নয়তো বিকটরকমে ব্যাধি-আক্রান্ত ! তারা দেহধারী, কিন্তু মৃত। তাদের কথা এখন একা প্রলুত ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ আর মনে রাখে নাই। এই তো- এই তো এখন সাদোম! এই তো এমন এক ভয়াল পাপনগরী সে।

বহু দিবস ও মাস নিবিড় পর্যবেক্ষণ শেষে, সতর্ক হওয়ার বহু ডাক পাঠানোর শেষে; অদ্য আমার প্রভুদ্বয় সশরীরে এসে উপস্থিত হয়েছেন সাদোম নগরে। এসেছেন দণ্ড দিতে। সাদোম-পুরুষের পাপপ্রিয়তা যে সীমাহীন; তাদের কদাচারলিপ্ত অন্তর যে কোনো গ্লানি কখনোই বোধ করে না; এই লোকসকলের আত্মার ভেতরে যে কোনো তাপ-দাহ, কখনোই কিছু-কিঞ্চিৎও ঝিলিক দিয়ে ওঠে না। এই সত্য দেবলোকের প্রশাসকগণ তন্নতন্ন রকমেই জানে।

তা-ও তারা সরেজমিনে বিষয়টা না দেখে নিয়ে, কঠোরতা ঢালতে চায় না। তারা দেখে ও বুঝে নিতে চায়; প্রলুত বাদে অন্য সকল সাদোম-পুরুষ যা করছে, তার জন্য কণামাত্র বিবেক-কামড় কি কখনো কোনোজন পায়? পায় কি? সেটা বিশদ যাচাই-বাছাইয়ের জন্যই আমার প্রভু দুজনের এই আগমন।

এইখানে এই যে প্রলুত; শুধু সে-ই কি একমাত্র জন, যে কিনা ন্যায় ও সততার অনুশীলনে আছে? শুধু কি সে-ই শুদ্ধ যৌনাচারের বিধিমাফিক জীবন-যাপন-রত এইখানে? ওই প্রলুতই একমাত্র? তাহলে তাকে রক্ষা করাটাই সবচেয়ে বড় কাজ এখন।

অপরাহ্ণের অমন অসময়ে, প্রলুত দেখে তার সদর দরোজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে তিন আগন্তুক। কারা এরা? তাদের দেখে প্রলুত যে কী বোঝে, এই দেবভৃত্য আমি; সেটা অনুধাবন করতে পারি না। শুধু দেখতে পাই যে, সে পলকে মাটিতে উবুড় হয়ে যায়। আর আমার প্রভু দুজনের চরণে প্রণিপাত শুরু করে। বিরামহীন প্রণিপাত।

প্রণিপাত করতে করতেই সে, নানামতে মিনতি জানাতে থাকে। বিবিধ মিনতি। “হে অচিন অতিথি মহাশয়গণ! বিনয় করি, আপনারা এই দাসের গৃহ-অভ্যন্তরে পদার্পণ করুন। সায়াহ্ন সমাগতপ্রায়, মিনতি করি হে মহাত্মাগণ! আপনারা এই গৃহে রাত্রিবাস করুন! তারও আগে, হে পুণ্যাত্মা অতিথিগণ, আপনকার পদসকলের তপ্ত ধূলিরাশি যেনো আমি নিজ হস্তে ধৌত করার সুভাগ্য পাই! আমাকে অনুমতি দিন। অনুমতি দিন, আপনাদের ক্লান্ত দেহকে সুশীতল পানীয়সেবা দিয়ে নিজেকে ধন্য করার।”

আমার প্রভুদ্বয় ঠান্ডা গলায় প্রলুতের সেই সব খোসামদ আর কাকুতিসকল প্রত্যাখ্যান করে। তারা প্রলুতকে দণ্ডায়মান হওয়ার আদেশ করে, এবং জানায় যে, আমরা এই তিন অতিথিজন নগরের চকেই রাত কাটাবার কথা ভাবছি।

প্রভুদুজন তো বিকট কোনো ভীতিকর সিদ্ধান্ত দেন না, তা-ও তাদের কথাটুকু শোনামাত্র, প্রলুতের সর্বসত্তা যেন চিৎকার দিয়ে ওঠে। “তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, হে অতিথিসকল! অতি কদর্য সর্বনাশ। ওই সর্বনাশকে সামাল দিই, সেই সামর্থ্য আমার যে এখন নেই। আমাকে ক্ষমা দিন। আমাকে ক্ষমা দিন!” প্রলুতের কণ্ঠ বিষম আতঙ্কিত শোনাতে থাকে।

কী সেই সর্বনাশ?

অচিরেই সেটি আমার প্রভু দুজনের সামনে স্পষ্ট-প্রকট হয়ে ওঠে।

প্রলুতের বিনয় ও মিনতিগুণে, আমার প্রভুদুজনের চিত্ত কিঞ্চিৎ প্রসন্ন হয়ে ওঠে বলে, তারা প্রলুতের গৃহে রাত্রিবাস করার জন্য সম্মতি প্রদান করেন। সন্ধ্যা সমাগত দেখে তারা আসন গ্রহণ করে, শীতল দ্রাক্ষারসের পাত্র হাতে নিতেও সম্মত হন। আর আমাকে তাঁরা তাঁদের পেছনে দাঁড়ায়ে ব্যজনী নেড়ে যাওয়ার হুকুম দেন। আমি সফেদ ব্যজনী দুলিয়ে ব্যজন করে যেতে থাকি, প্রভুদ্বয় নিঃশব্দে দ্রাক্ষারস সেবন করে চলেন। সেবন করতে থাকেন। সবকিছু মসৃণ লাগতে থাকে। সহজ ও স্বাভাবিকই লাগতে থাকে। ওই তো প্রলুত, তার অতিথি তিনজনের আহার্যের বন্দোবস্ত করা নিয়ে, কেমন ত্রস্ত আছে। তার সমস্তটা দেহ যেন টলছে, তা-ও কত ছুট তার। কত রকমের খাদ্যের কত না আয়োজন, ওই গৃহকোণে! খাদ্যপাত্র থেকে কী সুগন্ধিই না ছড়ায়ে পড়ছে এই গৃহের শান্ত বাতাসে বাতাসে। তপ্ত উষ্ণ সুগন্ধ! আহা! এমনই সমধুর তবে মনুষ্যগণের রাত্রিভোজের গন্ধ! এমন মধুর! এমন শান্তশিথিল তবে মনুষ্যগৃহকোণ, আর তাদের জীবন; আর তাদের রাত্রিসকল! বাহ! আমার ওই সমস্তকিছুকে আমার কী যে মনলোভা লাগতে থাকে! কত যে বেআকুলকর লাগতে থাকে! আহা!

তবে অচিরেই ওই শ্লথশান্তিকে আমি দুমড়ে-থেঁতলে ল্যাতাভ্যাতা হয়ে যেতে দেখতে পাই। আচমকাই। রাত্রি প্রথম প্রহর অতীত তখন। আমাগণের নৈশভোজ তখন মাত্রই সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের সকলকার দেহ যেন তখন বিশ্রাম-উন্মুখ। অবিকল মনুষ্যদেহের মতোই যেন ক্লান্ত-শিথিল তখন আমাদের দেবদেহও। শয়ানলগ্ন হওয়ার জন্য আমার দেহ খানিকটা কাতর হয়ে ওঠে। আমার প্রভুদ্বয়ও সেই একই বাঞ্ছা জ্ঞাপন করেন প্রলুতের সন্নিধানে। প্রলুত আমাদের আরাম দেওয়ার জন্য সদা ছুটের ভেতরেই আছে, কিন্তু আমি দেখতে পাই, তার মুখে ক্লিষ্টতা। দেখতে পাই, তার চোখে যেন ত্রাস। দেখতে পাই, থেকে থেকে যেন সে শিহরিত-কণ্টকিত হয়ে উঠছে। যেন সে ভয় পাচ্ছে। কিসের জন্য যেন সে ভয়-চমকানো হয়ে যাচ্ছে থেকে থেকে। এ কী ব্যাপার! আমি যা লক্ষ করি, আমার প্রভু দুজন কি তা লক্ষ করেন না? করেন না নাকি? যদি করেনই, তাহলে তাদের অত নির্বিকার দেখায় কেন! আমি ভেবে ভেবে বিমূঢ় বোধ করতে থাকি।

আর ওদিকে দেখো, প্রলুতের ভৃত্যগণ! তারা শয্যা প্রস্তুত করছে, নাকি নিজেদের ঘুম পাড়াচ্ছে নিরিবিলি হাতে। তাদের যেন কোথাও কোনো তাড়া নেই, যেন শয্যা গোছাতে গোছাতে নিযুত প্রহর পেরিয়ে গেলেও কোনো সমস্যা নেই। এরা এমত তাড়াশূন্য কেন! তারা যেন অপেক্ষা করছে, কিছু একটার জন্য অপেক্ষা করছে। কিসের জন্য অপেক্ষা!

তারা কিসের জন্য অপেক্ষা করছে, সেটা অচিরেই স্পষ্ট হয়ে আসে। আমি দেখতে পাই, প্রলুতের বাসভবনের সদর দরজায় হামলে পড়েছে সকল সাদোম-পুরুষ। পুরো নগরের জোয়ান ও বৃদ্ধ-সকল পুরুষ। অনেকেই আছে ফটকের মুখে, বাকি সমস্তরা হাতে হাত ধরে ধরে, পুরোটা বাড়িকে ঘেরাও দিয়ে নিয়েছে, এই তো পলকের ভেতরে। আর ডাক-চিৎকার শুরু করেছে তারা।

তারা জেনে গেছে, সাদোম নগরে তিনজন নতুন পুরুষের আগমন ঘটেছে। প্রলুতের অতিথি তিন পুরুষ। এই নতুন তিন শরীরকে ভোগ করা যে চাই-ই তাদের! রাত্রির এই প্রথম প্রহরেই শুরু করতে হবে সম্ভোগকর্ম। একে একে সকল সাদোম-পুরুষকেই তো আস্বাদ করতে হবে এই নতুন শরীর ত্রয়। এই ক্ষণে শুরু না করা গেলে, সকলের পক্ষে তো রাতে রাতেই কামাচার সম্পন্ন করে ওঠা সম্ভব হবে না। রাতের অন্ধকারে কামক্রিয়া যতটা আঠালো সুখদায়ী মনে হয়, দিবসে তো তেমন ঘন সুখময় লাগে না। তাই এক্ষণ চাই। এক্ষণ।

ওহ! কত কত দিন ধরে সাদোম-পুরুষ-সকলে আছে নগরীর পুরোনো পুরুষ-শরীরে। আর কত, ওই নিয়ে মেতে থাকা যায়! প্রলুত! এক্ষণ দাও তাদের! সাদোম-পুরুষ সকলে বাঞ্ছাপূরণের জন্য এক্ষণ দাও তাদের!

সাদোম-পুরুষগণের কাম-গোঙানি আর অচরিতার্থ বাসনা গর্জে উঠতে থাকে, প্রলুতের বাসভবনকে বেষ্টন করে গর্জন করে উঠতে থাকে। তখন কেঁপে ওঠা ধরে রাত। আর কাঁপতে থাকে সাদোম নগরী। সাদোম-পুরুষের গর্জন একটুও থামে না। “প্রলুত! কোথায় তোমার নবমিত্রগণ? তারা কোথায়? তাদের বের করে আমাদের কাছে নিয়ে আসো। আমাদের ভোগ করতে দাও। এক্ষণ দাও।”

প্রলুত লজ্জায় অধোবদিত হয়। নিজ নগরবাসীকে নিবৃত্ত করার চেষ্টায়, সে ছুটতে তাকে। ছুটে ছুটে একেকজনের হাত-পা ধরে ধরে অনুনয় জানাতে থাকে। কিন্তু কোনোজনই প্রলুতের কথায় কান দেয় না। আচমকা এক সাদোম পুরুষ করে কী; অনুনয়-কাতর প্রলুতকে মস্ত একটা ঝাটকা দিয়ে, মাটিতে ফেলে দেয়।

তখন অন্য কয়েকজনের চিত্তে যেন উল্লাসের অগ্নি লম্ফমান হয়ে ওঠে। তারা হো হো হো ডাক ছেড়ে ছুটে আসে প্রলুতের দিকে, তারপর পদাঘাত শুরু করে। বেদম বেশুমার পদাঘাত পড়তে থাকে প্রলুতের বয়স্ক দেহটিতে। আহ! এ কী উন্মত্ততা!

অহো! আমার প্রভু দুজন কি এমত নিশ্চলই পড়ে থাকবেন আরাম কেদারায়! হায় হায়। আমার নিজের ভেতরটাতে তছনছ লাগতে থাকে। হায়। কিন্তু আমার কী করার আছে! আমি তো নতনেত্র বাকসংবৃত হতে বাধ্য থাকা এক দেবভৃত্য শুধু। হায় প্রলুত!

প্রলুতকে জখম করে করে তাদের আশ মেটে না, তারা রক্তাক্ত প্রলুতকে দূরে ছুড়ে দিয়ে, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বাসভবনটিকে ঘিরে থাকা প্রাচীর ও ফটকটির ওপর। প্রাচীর ও তার কাষ্ঠনির্মিত ফটকটি ভেঙে ফেলতে অতি সামান্য সময়ই লাগে তাদের। তারপর পালে পালে পুরুষ এসে খাড়া হতে থাকে প্রলুতের আঙিনায়। লালা সপসপ করতে থাকা মুখ তাদের, শীৎকার-গোঙানিতে ভরা।

“আইস, আইস নব পুরুষগণ! আমাদিগের নিকট হও সত্বর! তোমাদিগের নবদেহ আস্বাদনে আর বিলম্ব দিয়ো না। আমাদের নবত্ব আস্বাদ করতে দাও। আইস!” এমত রকমে পিচ্ছিল স্বরে, হাঁকডাক দিতে থাকে সাদোম-নগরীর সর্দার গোছের দুচারজন। অন্য বাকিরা শিস ছুড়তে থাকে, বেপরোয়া ধারালো তুমুল শিষ!

আমি তখন দেখি যে আমার প্রভু দুজন এইবার ওই ডাকে যেন সাড়া দিতে প্রস্তুত। ওই তো তাঁরা উঠে হাঁড়িয়েছেন আরাম কেদারা থেকে। ওই তো তাদের শান্ত শিথিল দেহ এগিয়ে যাচ্ছে ওই লোকসকলের দিকে। তাঁরা এগোলে আমি কি তবে স্থির খাড়া থাকতে পারি? পারি না। আমিও মন্থর কদমে তাদের পিছু নিই।

এই যে প্রলুতের অতি প্রশস্ত গৃহদ্বার। সেইখানে প্রভু দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যান। তাদের খানিকটা পেছনে আমি, একা আমি। আমাদের দেখামাত্র কামচিৎকারে ফেটে পড়ে সকল সাদোম-পুরুষ। তাদের ওই চিৎকার ফালাফালা করে দিতে থাকে নগরীটিকে। আমি দেখতে পাই আমাদের দর্শনমাত্রই কোনো কোনো সাদোম-পুরুষ রতিপাত পেয়ে গেছে। তারা অপরিতোষের যন্ত্রণায় চাপা চিৎকার দিতে থাকে। অন্যরা উল্লাস ও ব্যগ্রতার ঘোঙানি ছড়াতে ছড়াতে, এগোতে থাকে দণ্ডায়মান প্রভু দুজনের দিকে। পেছনে, একটু ভেতরে আমি।

এগোতে থাকা কামক্ষুধার্তদের দিকে ধীর পায়ে হাঁটা শুরু করেন আমার প্রভু দুজন। অল্পক্ষণের মধ্যেই কামোন্মত্ত সাদোম-পুরুষগণ, আমার প্রভুদের ঘিরে নেয়। তারপর তারা তাদের দুজনকে ঝাপটে ধরতে যায়। তাদের হাত পিছলে পড়ে যায়। লোকগণের হাতে বাতাস ছাড়া অন্য কিছুর স্পর্শ লাগে না।

এবার তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে ওই দুজনের ওপর। কিন্তু সাদোম-পুরুষেরা দেখে, আগন্তুক দুজনের শরীর ভেদ করে, তারা পড়ে যাচ্ছে নিচের ভূমিতে। আরেক দল আবার এগোয় নব ঝম্প নিয়ে, আবার ভূপতিত হতে থাকে। ঝম্প ও ভূপতন ক্রিয়া তারপর চলতে থাকে অবিরল, চলতেই থাকে। আমি তখন ওই ঝম্পন ও পতন খেলার দিকে নজর দেওয়ার আর অবকাশ পাই না। সাদোম-পুরুষদের এড়িয়ে, আমাকে দ্রুত ছুটতে হয় প্রলুতকে রক্ষা করার জন্য। আমার ওপর হুকুম আছে যে, প্রলুতকে তুলে নিয়ে, নগর ত্যাগ করতে হবে আমাকে। আলোর মতন তীব্র ছুট দিয়ে, নগরী ত্যাগ করতে হবে।

প্রলুত রক্তাক্ত অচেতন। নগরীর মূল প্রবেশদ্বারের থেকে অনেক দূরে, রাত্রির আকাশের নিচে, হিম বালুকার ওপর আমি সন্তর্পণে তাকে শুইয়ে দিই। আর তো কিছু করার নেই আমার, প্রলুতের জন্য। কোনো হুকুম পাইনি তো। শুধু তারপর আছে শুধু অপেক্ষা করা। নির্দেশ আছে, এইখানে এইমতে স্থির অপেক্ষা করতে হবে আমাকে। ব্যস।

প্রভু দুজনের পৌঁছুনোর জন্য অপেক্ষা। নাকি প্রলুতের জ্ঞান ফেরার জন্য অপেক্ষা। আমার বোধগম্য হয় না। তবে আমি অপেক্ষা করতে থাকি। অপেক্ষা করতে করতেই আমার জানতে ইচ্ছা হতে থাকে যে আমার প্রভুরা কী করছেন এখন! সাদোম-পুরুষেরাই-বা কী করছে এখন! জানতে ইচ্ছে হতে থাকে আমার।

তখন, ঠিক তখনই আমি দেখি যে দূরের অন্ধকারে আগুন জ্বলে উঠেছে। ভূমিজড়ানো কৃষ্ণবরণ অন্ধকার থেকে আগুন লাফিয়ে উঠছে, ওই তো আগুন! ওই তো দাউ দাউ ছড়িয়ে পড়ছে এইদিকে ওই দিকে। আর দেখো দেখো! মাথার ওপরের সুঘন ওই যে অন্ধকার আকাশ! সেইখান থেকে নামছে বৃষ্টি! আগুন-বৃষ্টি। পুড়ছে সাদোম। ওই যে! পুড়ছে তার সকল বৃক্ষ, সকল অট্টালিকা ও কপাট ও কেদারা। পুড়ছে তার মূল্যবান ধাতুসকল। পুড়ছে তার শস্যভরা ভাঁড়ার ও গুদামগুলো। পুড়ছে পশুপাল, তৃণগুল্ম ও পুষ্পসকল। নিজের সমস্ত কিছু নিয়ে দাউ দাউ পুড়ে শেষ হতে দেখতে থাকি আমি, সাদোমকে। পুড়ে ভস্ম হয়ে যেতে দেখি তার বিকার-থকথকা-পুরুষগুলোকে। পুড়ে অঙ্গার হতে দেখতে থাকি সাদোমের সেই গুটিকয় অসুখ-ছেঁড়া নারীগুলোকেও। ওই নারীরাও একইভাবে দগ্ধ হচ্ছে! পুরুষগুলোর সাথে, তারাও পুড়ে যাচ্ছে!

আরে, তারা কোনো! তাদের কী অপরাধ! এই বিপন্নাগণের তো নিস্তার পাওয়া উচিত। না না, তারাও পাপিষ্ঠ পুঙ্গবগণের সাথে একই দণ্ড পেতে পারে না। এটা হতে পারে না। একদম না। এই কথা আমার মনে আসে। যেই ওটা মনে আসে, আমি তখন প্রলুতকে ভূশয়ানে রেখেই, ছুটতে শুরু করি। আমি ছুটতে শুরু করি ছোটা ধরি উচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকা সাদোমের দিকে। নারী কয়টাকে উদ্ধার করে দেই তবে- আমি? ভুখা, বঞ্চিত ওই কয় সাদোম-নারী; জীবন না পাক, প্রাণে তো বেঁচে থাকুক অন্তত!

আমার আস্পর্ধায় স্তম্ভিত, বাক্রুদ্ধ হয়ে যায় আমার প্রভু দুজন!

“এই ভৃত্যের কর্তব্য কি?’

এই ভৃত্যের একমাত্র কর্তব্য হলো প্রভু-ফরমাশ প্রতিপালন। শুধু ওই-ই। শুধু ওই-ই।

তাহলে এই হুকুম-বরদার নিজ ইচ্ছমতো কর্ম করার স্পর্ধা কীভাবে পায়! কীভাবে সে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেয়, মর্ত্য-মনুষ্যের মঙ্গল ও অমঙ্গল সাধন করে ওঠার! সে কিনা লোকের ভবিতব্য বদলে ফেলার জন্য পা বাড়ায়! কীভাবে এতটা সম্ভব। দেবভৃত্য এতটা স্পর্ধা দেখাতে যায়! মূঢ়! মূঢ়!”

প্রভু দুজন আমাকে ভর্ৎসনা করে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেন না, কিন্তু তাঁদের অক্ষিসকল ছিটকে দিতে থাকে ওই ঘৃণা, অমন তাচ্ছিল্য ও বিষজ্বালাভরা উপহাস। আমার দিকে, আমার জন্য।

আমি নতশির নতনেত্র হয়ে মার্জনা ভিক্ষা করতে থাকি। সীমা লঙ্ঘন করার লজ্জায় পুড়তে থাকি নিঃশব্দে। কিন্তু তাঁদের ক্রুব্ধ চোখ শান্ত হয় না। আমাকে ধিক্কার দিয়েই চলে। আমি বারংবার নতজানু ক্ষমা ভিক্ষা করে চলি, দেব-বিধি-মোতাবেক।

তার মধ্যেই আমার কী হয়, হঠাৎই আমার মনে পড়ে যায় প্রলুতের আঙিনার দাড়িম্ব ঝোপটির কথা। পক্ব ও অপক্ব ফলভারে ও ঝাঁকালো রঙিন পুষ্পে পুষ্পে কেমন যে হয়ে উঠেছিল সেই ঝাড়। সেই অপরাহ্ণের আলোয় কী পূত, কী পবিত্র, কেমন যে দীপ্তিময় দেখাছিল ওটিকে। যেই মর্ত্যভূমির ওপর জন্মেছে সে, মনুষ্যসকলের পাপভারে সেই মর্ত্যভূমি সেই সাদোম ঘিনঘিনে হয়ে উঠেছিল তো! মনুষ্যের দণ্ড তাকেও তাই পেয়ে যেতে হলো! আহা! আয়ু আরেকটু পেতে কি পারত না সে। আমার অন্তর নিরালা বেদনা-জলে ভিজে যেতে থাকে। কাতরে উঠতে থাকে সেই দাড়িম্ব ঝোপটার জন্য, তর ফুল ও ফলদের জন্য। আহা!

দেবগণের অন্তর্লোকের চঞ্চলতা, অধীরতা, ভাবনা, কী আলোড়নকে পড়ে ওঠায় দেবদূতদের চেয়ে পারঙ্গম কে আর! কেউ না। সেই নতজানু, ক্ষমা-যাঞ্চাকারী, এই নব্য কাঠামো পাওয়া আমাকে, এই দেবভৃত্যকে, তখন ক্ষমা করার জন্য তার প্রভুদুজন একেবারে প্রস্তুত হয়ে উঠেছেন; তেমন সময়ে তারা দেখেন আমার ভেতরে নড়ে যাচ্ছে মর্ত্যলোকের পুষ্প ও বৃক্ষের অকারণ বিনষ্টির জন্য শোক ও বেদনা। এ কী অনাসৃষ্টি কাণ্ড এইখানে, এই ভৃত্যের অন্তর্লোকে! ধিক!

দেবলোকের বিধান এই যে, দেবদূতগণ নিজ কৃতকর্ম নিয়ে শোকতাপ, পিছুটান ইত্যাদি কদাপি বোধ করবে না। আমি এইখানে দেখো, এই দেবভৃত্য, সে কিনা বাহ্যত হয়ে আছে নতশির, কিন্তু ভেতরে সে পুড়ছে মর্ত্যলোকের জন্য বেদনায়। পুড়ছে অনুতাপে, নিজেদের কৃতকর্মের জন্য কিনা সে অপরাধবোধে দগ্ধাচ্ছে! পামর! মূর্খ! বিধিলঙ্ঘনকারী অজ্ঞান! হতভাগা। ক্ষমার চির অযোগ্য, এই অর্বাচীন মূঢ় ভৃত্য!

প্রভু দুজন তখন দণ্ডাদেশ ঘোষণা করেন আমার জন্য। আমি নির্বাসন-দণ্ড প্রাপ্ত হই। আকাশমণ্ডলের দেবলোকে ফিরে যাওয়ার অধিকারহীন হয়ে যাই আমি। আমি যে বিধান-অমান্যকারী। আমি মায়ামমতা নামক তুচ্ছ দুর্বলতাগ্রস্ত। অজস্রবার সতর্ককরণ সত্ত্বেও নিজেকে সংশোধন করতে ব্যর্থ হওয়া, অযোগ্য একজন আমি। অতি অবশ্য কুলাঙ্গার এই ভৃত্য। তাই এই আমাকে থাকতে হবে এইখানে, এই মর্ত্যলোকে। চিরকাল!

হায় রে! হায় রে! আমার ভেতরে অন্তর মাথা কোটা শুরু করে। হায় রে! আমি তো দেবলোকও চিনে উঠিনি সঠিকরকমে। আমি যে সেইখানে ফিরে যাবার জন্যই অধীরতাময় বেআকুল হয়ে আছি। সেইখানে, আমার গোত্রের সঙ্গে চেনাশোনার জন্য অপেক্ষা করছি না আমি? প্রভু দুজনের পিছু পিছু চলতে চলতে ক্ষণ গুনে চলছি না আকাশমণ্ডলে, নিজ ভূখণ্ডে প্রত্যাবর্তনের? আহ! এ কী ভয়ংকর শাস্তি তবে আমার জন্য আসে! পরিত্যক্ত, দণ্ডিত একজন হয়ে এইখানে কীভাবে থাকব! এইখানে আমি কে! প্রভুগণ, হে শক্তিমান দয়াবানগণ! আমাকে ক্ষমা দিন! আমার জন্য দয়া আসুক। বিভ্রান্ত, দুর্বলকে ক্ষমা দিন প্রভু। আমার নতজানু অশ্রুতে ধরণীর ধূলিসকল সিক্ত শিথিল হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু দেবপ্রভুগণের অন্তরকে সেই কান্না স্পর্শও করে না।

তাঁরা অটল, নির্বিকার পায়ে যাত্রা শুরু করেন আকাশমণ্ডলের দিকে। তাদের পেছনে ছুটতে থাকি আমি। ক্ষমা ভিক্ষা করে যেতে থাকি। একা এই পরবাসে আমি কীকরে থাকব! এইখানে আমি কে! কেউই তো না আমি। হায় রে! এমত অগুনতি আশঙ্কা আমাকে উন্মত্তপ্রায় করে তোলে। আমি আঘাত করতে থাকি আমার বক্ষে, আমার মস্তকে, আমার মুখমণ্ডলে; আর প্রভু দুজনের পিছু পিছু ছুটতে থাকি।

ক্ষমা ভিক্ষা দিন প্রভু!

মুক্তির উপায় অন্তত বলে দিন-প্রভু!

পরিত্রাণ কি কোনো দিন আসবে না? মুক্তি কি নেই?

আমার সকল বিলাপকে ছিঁড়ে ফেলার জন্য এমত কঠোর বজ্র নেমে আসতে দেখি আমি।

এক ধারালো রূঢ় কণ্ঠ বলে ওঠে: যদি খুঁজে পাও সেই এক নগর- পাপে ও অনাচারে সে সাদোম তুল্যই শুধু নয়, যে কিনা সাদোমকে অতিক্রম করে গেছে।

নির্দয়তা যেখানে সম্ভ্রম উদ্রেককর-
দুশ্চরিত্রা যেখানে কুর্নিশ পায়
হত্যাকারী যেখানে দাপটের সঙ্গে বিরাজ করে
বিশ্বাসহন্তা যেখানে অলজ্জ দাপটের সাথে বিচরণ করে চলে
অপরাধ যেখানে নিত্য ক্ষমা পায় ও অপরাধ বলে গণ্য হয় না আর
খাদ্য যেখানে বিষমাখা, বাতাসে বিষ জমে আছে যেইখানে
জল যেখানে পূতিগন্ধময়।
একটি বৃক্ষ যেখানে মাথা তোলার মৃত্তিকা পায় না সতর্তকর-
অন্তর্লোক যেখানে বিবেকশূন্য ও প্রস্তর অসাড়-অন্ধ-
মমত্ব যেইখানে তাচ্ছিল্য পায় শুধু
যদি এমন সে নগরীর সন্ধান পাও-যদি তাকে ধ্বংস করতে পারো-
মুক্তি পাবে তুমি।
দেবলোক তোমার জন্য সেই পর্যন্ত কাল অপেক্ষায় থাকবে।
এখন নিজের দণ্ডমুক্ত হয়ে ওঠা, তোমারই হাতে।

তারপর এই তো শুরু হলো আমার দণ্ডভোগের কাল। পরিত্রাণহীন দণ্ডভোগের কাল। শুরু হলো ঠিক, কিন্তু আর যেন শেষ নেই তার, শেষ নেই। ভূলোকে কত সভ্যতা গড়ে উঠল আমার চোখের সামনে। কত ক্রূরতা আধিপত্য বিস্তার করল, কত শক্তির দেমাক লয়ও হলো- আমার পরিভ্রমণরত চোখ এসব দেখল কতবার!

কতবার আমি লুপ্ত করে দিলাম কত নগর! কতবার আমি প্রলয় বইয়ে দিলাম কতভাবে, আর তারপর নিজেকে অভিশাপমুক্ত দেখার জন্য কী বিপুল ধুকপুকিয়ে উঠলাম! কিন্তু কোথায় মুক্তি! শাপমোচনের প্রহর তো এলো না আমার জন্য।

দণ্ডগ্রস্ত আমি চলতে চলতে এখন এই নগরে। এর জীবনচর্যা, লোকসকলের প্রবৃত্তি ও ক্ষুধা, সংঘের কার্যক্রম ও দাপট, বাতাসের গন্ধ, জলের গতিপ্রকৃতি-এই সকল কিছুর রূপ বুঝে উঠতে গেল কিছুকাল। বাতাসের মধ্যে ধূলিকণার মতো মিশে থাকা গেল দিনকতক। অমন করে না-থাকা গেলে, জনপদের প্রকৃত দশা ও পরিস্থিতিটাকে যে নির্ভুলরকমে জেনে ওঠা যায় না।

নির্বিঘ্ন অনুধাবনের জন্য অদৃশ্য আর কণ্ঠস্বরহীন যদি হও, সুফল পাবে। যদি স্বরূপে থাকো, যদি ঘটনার অংশ হয়ে যাও- তখন বিভ্রান্ত, প্রমাদগ্রস্ত হয়ে থাকবে তোমার বিচার-বিবেচনা শক্তি। অসঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে যায় তখন। ভুল করা হয়ে যায়। বহু ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে, ভুল প্রলয় সম্পন্ন করে করে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি আমি, তার আলো দিয়ে দেখে দেখে আমি বুঝতে পেরেছি- আমি শেষ পর্যন্ত সন্ধান পেয়েছি সেই পাপনগরীর। যাকে ধ্বংস করার দৈবদেশপ্রাপ্ত আমি, আমি পেয়েছি তার খোঁজ। আর তবে বিলম্ব কেন। শুরু করা যাক তবে প্রলয়যজ্ঞ। চলো বিনাশ- চলো সংহার- চলো ধস-চলো-

অসাড় অন্ধ, কেবলই ভোগবাঞ্ছায় গোঙাতে থাকা এই যে নগর! চলো তাকে ধ্বংসগ্রস্ত করা ধরি, চলো! চলো! তো, আমি অবশেষে এইখানে, সেই নগরে-যার ধ্বংস বিনাশ-এই আমার দুই হাতে।

(চলবে)

সে ও নিমবিরিক্ষি যে গুপ্তকথা জানে (চতুর্থ কিস্তি)

সে ও নিমবিরিক্ষি যে গুপ্তকথা জানে (তৃতীয় কিস্তি)
সে ও নিমবিরিক্ষি যে গুপ্তকথা জানে (দ্বিতীয় কিস্তি)
সে ও নিমবিরিক্ষি যে গুপ্তকথা জানে (প্রথম কিস্তি)
 

 

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগের আরো খবর

Link copied!