• ঢাকা
  • শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩০, ১ শা'বান ১৪৪৬

শুভ জন্মদিন, আহসান হাবীব


আরাফাত শান্ত
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৫, ২০২২, ০৯:৪০ এএম
শুভ জন্মদিন, আহসান হাবীব

আহসান হাবীব, তার পরিবারের বিস্ময়কর মেধাবী সব ভাইবোনের ভেতরে হয়তো আন্ডাররেটেড, কিন্তু আমরা যারা ‘উন্মাদ’ সময়ে বড় হয়েছি, তাদের কাছে তিনি গড লেভেলের। অথচ তিনি বিদেশে পড়তে যাননি, বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়েও পড়েননি। তিনি ছিলেন পরিবারের আদরের ছোট ছেলে। ভারী চশমার কারণে হুমায়ূন আহমেদের মাথায় ব্যথা থাকত সব সময়। আহসান হাবীব মাথা টিপে দিলে উনি মজার সব গল্প বলতেন। শিশু আহসান হাবীব তা অভিভূত হয়ে শুনতেন।

তার কার্টুন আঁকার শুরুও পরিবার থেকে। জাফর ইকবাল আঁকতেন গণকণ্ঠে, সেখান থেকেই অনুপ্রেরণা পাওয়া। আর্ট কলেজে ভর্তি হতে চেয়েছিলেন। চান্স পাননি। শিল্পী আমিনুল ইসলাম তখন ডিন, আহমদ ছফা নিয়ে গেলেন তার অফিসে। ছফার সাহস বিস্ময়কর, জেরা শুরু করলেন, এ ছেলেকে নিলেন না কেন? পরে আহসান হাবীব চান্স পেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিস্ট্রিতে। যদিও তাদের পরিবার পিওর সায়েন্সের ভক্ত। হিস্ট্রিতে গিয়ে তার মনে হলো, ভালো লাগছে না। উনি ভূগোলে ভর্তি হলেন। ভূগোলে ম্যাপট্যাপ আঁকতে তার খুব ভালো লাগত। আহসান হাবীব লেখা আর কার্টুনেই ছিলেন তখন। বিখ্যাত কবি ও সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে নাম মিলে যাওয়ার কারণে একটু বিরক্ত হয়েছিলেন। অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিলেন নাম পরিবর্তনের। তিনি বাবার দেওয়া নাম চেঞ্জ করবেন না কখনোই। পরে আহসান হাবীবটাই রয়ে গেল।

আহমদ ছফা নিয়মিত তাদের বাসায় যেতেন। মাঝেমধ্যে থাকতেনও। একদিন তিনি আহসান হাবীবকে আড়ালে ডেকে নিয়ে একটা ঘড়ি দিলেন। সবুজ ডায়ালের ঘড়ি। উনি অবাক! দিয়ে বললেন, ‘নে, তোর জন্য একটা ঘড়ি।’ তার জীবনে পাওয়া প্রথম ঘড়ি। ওই ঘড়ি হাতে পরে নিজেকে বড় ভাবা শুরু করলেন (তখন স্কুলে এইট কি নাইনে পড়তেন)। কিন্তু কী আশ্চর্য! কদিন পর ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেল। এরপর যখন ছফা এলেন, উনি জানালেন, ঘড়ি বন্ধ। ছফা আবার আহসান হাবীবকে আড়ালে নিয়ে ৫০ টাকা দিলেন। বললেন, দোকানে নিয়ে ঠিক করে ফেলতে। ৫০ টাকা পেয়ে হাবীবের মাথা গরম হয়ে গেল। তখন ৫০ টাকা অনেক। কে ঘড়ি ঠিক করে, ওই টাকায় নাজ সিনেমা হলে (তখন গুলিস্তান হলের পাশে ‘নাজ’ নামে খুব সুন্দর ছোট্ট একটা সিনেমা হল ছিল) গিয়ে ওয়েস্টার্ন সিনেমা দেখতেন বন্ধুদের সঙ্গে। এটা-সেটা খান কিন্তু ঘড়ি আর ঠিক করেন না। ঘড়ি তো হাতেই আছে, সমস্যা কী? ঘড়ি নষ্ট না ঠিক, কে দেখতে যাচ্ছে। ছফা ভাই একদিন ধরলেন, ‘কিরে, ঘড়ি ঠিক করেছিস?’ আহসান হাবীব মাথা ঝাঁকান। দেখান তাকে। ওই সবুজ ডায়ালের ঘড়িটার সেকেন্ডের কাঁটা ছিল না বলে বোঝার উপায় নেই ঘড়ি বন্ধ, না সচল। তবে তখনই আহসান হাবীব জেনেছেন, একটা নষ্ট ঘড়িও দিনে দুবার অন্তত সঠিক সময় দেয় (পরে অবশ্য ঘড়িটা ঠিক করেন)।

ছফাকে নিয়ে তার আরেকটা গল্প আছে। একবার শামীম শিকদার আর ছফা গিয়েছেন তাদের বাসায়। স্কুলশিক্ষার্থী আহসান হাবীব সেই প্রথম দেখলেন শার্ট প্যান্ট পরা কোনো নারীকে। নন্দিত নরকের প্রথম প্রচ্ছদটা জাফর ইকবালের করা। শামীম শিকদার খালি একটু টাচ দিয়েছিলেন। নাম যায় দুজনেরই। আহসান হাবীব উন্মাদের প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদকও নন। তিনি আসেন দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে। এ রকম একটা ফান ম্যাগাজিন যে দশকের পর দশক চলবে কেউ ভাবেনি। সবাই চলে গেছে, তিনি উন্মাদ নিয়েই ছিলেন। বিশাল সার্কুলেশন চালাতে কষ্ট হয়নি। কিন্তু মামলা খেয়েছেন সমানে। জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নিয়ে কার্টুন করতেন বলে সিনেমার লোকেরাও অফিস হামলা করেছে। ম্যাডের বাংলা ভার্সন বলে এলিটরা নাক সিটকতেন। অথচ হুমায়ুন আহমেদের এলেবেলে থেকে জাফর ইকবাল, খন্দকার আলী আশরাফ এদের লেখাও ছাপাতো উন্মাদ। উন্মাদের সবচেয়ে সাফল্যের জায়গা হলো, তারা অসংখ্য তরুণকে তৈরি করেছে। লেখক হিসেবে, কার্টুনিস্ট হিসাবে, ভালো রম্য পাঠক হিসেবে। আহসান হাবীব খুবই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে ভাবা মানুষ। তার প্রিয় লেখক আইজ্যাক আসিমভ, প্রিয় বইয়ের একটা বিগিনিংস। তারাপদ রায়ও তার প্রিয়। সবার সবকিছু তিনি পড়েন। তা আহমেদ কবীর কিশোরের গল্পগ্রন্থ হোক আর কমিকস বা গ্রাফিক নভেল হোক।

‘বিচিত্রা’ থেকে তাকে আশির দশকে রম্য কলাম লিখতে বলা হয়। তারপর থেকে তিনি সবখানেই লিখছেন। তার জোকসের বই দেদার বিক্রি হয়। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম সেরা জোকস সংগ্রাহক। বাংলাদেশে তিনি ‘গ্র্যান্ডফাদার অব জোকস’ বলেও পরিচিত। উনি অবশ্য যাপিত জীবনেই ফানটা দেখেন। কোনো এক এটিএমের সিকিউরিটি গার্ড যখন বলেন, স্যার মেশিন নষ্ট। সেটাকেই তিনি হিউমার মিশিয়ে দারুণভাবে লেখেন। কার্টুন প্রশিক্ষণ কিংবা ট্রাভেল ম্যাগাজিন বের করা, দেশি কমিকস বের করা কত কিছুতে তিনি ছিলেন। দীপন যখন খুন হলেন, তিনি বিন্দুমাত্র আবেগ চোখে না এনে বললেন এক অনুষ্ঠানে, “কী দুঃসহ জীবন, যে ঢাকাকে এত ভালোবাসি তার বুকে দীপনের লাশ পড়ে থাকে, আমরা কিছুই করতে পারি না।”

আহসান হাবীব বিদেশি অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছেন। কিন্তু নিজে যাওয়ার কথা ভাবেননি। সব জেনারেশনেই সঙ্গেই তিনি মিশতে পারেন। ভাইয়ের মৃত্যু, মায়ের মৃত্যু, দুই দুলাভাইয়ের মৃত্যুর পরেও তিনি হাসাহাসি করেন, স্বপ্ন দেখেন একটা বাড়ি বানাবেন, ছয় ভাইবোন থাকবে ছয়টি তলায়। একটা তলা হুমায়ূন আহমেদ মিউজিয়াম, এ রকম সাবলীল আশাবাদী মানুষ বাংলাদেশে আসলেই কম। নিজের লেখা ও কাজ নিয়ে তিনি আরও কম বলেন সব সময়। এসব মানুষদের বেশি দরকার এ দেশে। জন্মদিনের শুভেচ্ছা আহসান হাবীব।

Link copied!