ফ্রিদা কাহলো, সিমোন দ্য বোভোয়ার, সিলভিয়া প্লাথ—বিংশ শতাব্দীর এ তিন নারীবাদী মুখকে একটি রেখায় দেখার চেষ্টা করলে যে মুখটি দর্শককে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আবেগাক্রান্ত করতে পারে, সে মুখের নাম ফ্রিদা কাহলো। মেক্সিকান কিংবদন্তি শিল্পী ফ্রিদা কাহলো যে আত্মপ্রতিকৃতিনির্ভর চিত্রকর্মগুলো তৈরি করেছেন, তার মধ্যে বিশ্বনারীর চিরায়ত ব্যথা, আবেগ ও গূঢ় সংবেদী অবয়ব খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও ফ্রিদা এঁকেছেন মূলত নিজেকেই। তথাপি ফ্রিদার আপাত নির্লিপ্ত মুখাবয়ব, একেক প্রতিকৃতিতে চোখের একেক রকম আবেগ, জোড়া ভ্রু, পুরুষালি গোঁফের রেখা এবং পুরো ক্যানভাসে কখনো পাখি, কখনো বানর, কখনো বেড়ালের প্রতীকী ব্যবহার যে বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করে, তা সংবেদী হৃদয়কে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। এমনকি গলায় বিচিত্র, কর্কট, অপ্রচল অলংকার অঙ্কনের মধ্য দিয়েও ফ্রিদা অভিঘাত সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন একটা প্রচলিত ব্যবস্থায়, যা তার আগে কোনো শিল্পীই কল্পনা করেননি। অথচ ফ্রিদা একজন স্বশিক্ষিত শিল্পী। ফ্রিদার ক্যানভাসে যে ঘোর ও বাস্তবতা হাজির হয়, তাকে কোনো ব্যাকরণ দিয়ে যেন ঠিক অভিধায়িত করতে পারেন না শিল্পবোদ্ধারা। যেমন ধরা যাক, শিল্পবোদ্ধারা বলেন ফ্রিদা কাহলো যে ধারার ছবি আঁকেন, বিশেষত আত্মপ্রতিকৃতিতে ব্যবহৃত মেনারিজম অনুসৃত লম্বাকৃতির গলা, মেক্সিকান লোক-উপাদান, বিলুপ্ত অ্যাজটেক সভ্যতার নানা বিষয়ানুষঙ্গের উপস্থাপন এবং তার সঙ্গে নিজের সময় ও হৃদয়ের অভিব্যক্তির মিশেলে যে চিত্রকল্পের পরিস্ফুটন ঘটে, তা পরাবাস্তব শিল্পরীতিরই (সুরিয়্যালিস্ট) অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বোদ্ধাদের এ ছাঁচকে রীতিমতো অস্বীকার করে ফ্রিদা বলেছেন, “আমি স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন কোনোটাই আঁকি না। আমি আমার বাস্তবতাকে আঁকি।” সুইস শিল্পী আলবার্টো জিওকোমিত্তি অবশ্য মানেন পরাবাস্তববাদিতা আসলে অতিবাস্তব কোনো ঘটনারই অভিব্যক্তি।
তো ফ্রিদা কাহলোর ছবিগুলোতে তার অতিবাস্তব জীবনের সমগ্রটাই বিম্বিত হয়ে আছে। ফ্রিদা তার ডায়েরিতে লিখেছেন, “আমি আত্মপ্রতিকৃতি আঁকছি, কারণ আমি প্রায়ই একা থাকি এবং আমি সেই ব্যক্তি যাকে আমি সবচেয়ে ভালো জানি।” লিখেছেন- “আমার চিত্রকর্ম আমার ব্যথাকে বহন করছে। আমার চিত্রকর্ম আমাকে সম্পূর্ণ করেছে।”
শরীরে দুর্বহ যন্ত্রণা, হৃদয়ে উপর্যুপরি ক্ষরণ নিয়ে এ শিল্পী কাটিয়েছেন জীবনের ৪৭টি বছর। ফ্রিদার বিখ্যাত ও আলোচিত চিত্রকর্ম ‘সেলফ পোট্রেইেট উইথ থর্ন নেকলেস ও হামিংবার্ড’ (Self-Portrait with Thorn Necklace and Hummingbird), যেটি আঁকা হয়েছিল ১৯৪০ সালে, সেখানে দেখা যাচ্ছে—দর্শকের মুখোমুখি ফ্রিদা। পেছনে বড় বড় সবুজ পাতায় পূর্ণ পটভূমিতে একটা প্রায়বিবর্ণ হলুদ পাতা উঁকি দিচ্ছে ফ্রিদার মাথার দিকে। পটভূমির সবুজ পাতার ওপর স্বচ্ছ ডানা মেলা ফড়িং বসে আছে। ফ্রিদার মাথার ওপর চুলবন্ধনীতে বসে আছে প্রজাপতি। ফ্রিদার গলায় একটা কাঁটার নেকলেস ঝুলছে। একটা বানর ডান কাঁধের দিক থেকে নেকলেসটি ধরে আছে। বাঁ কাঁধের দিকে বসে আছে একটি কালো বিড়াল। নেকলেসের নিচের দিকে লকেটের মতো ঝুলে আছে একটি হামিংবার্ড। নেকলেসের কাঁটাগুলো বিঁধে রয়েছে তার ঘাড় ও গলায়। কাঁটাবিদ্ধ ঘাড় থেকে রক্তপাত হচ্ছে। কিন্তু ফ্রিদার অভিব্যক্তি শান্ত ও গম্ভীর। যেন ধৈর্যের সঙ্গে সহ্য করছেন সব ব্যথা।
প্রতীকী এ চিত্রকর্মটির মধ্য দিয়ে ফ্রিদার অতিবাস্তব জীবন, জীবনের রং, আকাঙ্ক্ষা ও দৃঢ়তা এতটাই প্রাচুর্য নিয়ে প্রতিবিম্বিত হয়েছে যে, যেন একটি চিত্রকর্মেই ফ্রিদাকে খুঁজে পাওয়া যাবে তার সমগ্র নিয়ে।
ফ্রিদা কাহলো এই চিত্রকর্মটিতে অনেকগুলো প্রাণীকে প্রতীকীভাবে উপস্থাপন করেছেন। নানা প্রতীকী উপাদানের মাধ্যমে একটি বাস্তবসম্মত দৃশ্য এঁকেছেন। পাখি প্রায়ই স্বাধীনতা এবং জীবনের প্রতীক। বিশেষ করে একটি হামিংবার্ড যেটি রঙিন এবং সর্বদা ফুলের ওপর ঘোরাফেরা করে। কিন্তু এই চিত্রকর্মে হামিংবার্ডটি কালো এবং প্রাণহীন। এটি ফ্রিদার নিজের প্রতীক বলে মনে করা হচ্ছে। আঠারো বছর বয়সে বাস দুর্ঘটনার পর ফ্রিদা তার জীবনের বেশির ভাগ সময় শারীরিক যন্ত্রণায় কাটিয়েছেন। এর পরে তিনি তার শরীর ঠিক করার জন্য প্রায় পঁয়ত্রিশটি অস্ত্রোপচার সহ্য করেছিলেন। টানা কয়েক বছর শয্যাশায়ী অবস্থায় কাটিয়েছেন। ওই দুর্ঘটনার পর থেকে জেনেছেন তিনি কখনো সন্তান ধারণ করতে পারবেন না। এরপরও তিনি তিন তিনবার গর্ভধারণ করেছেন এবং প্রতিবারই গর্ভপাতের মতো অতি যন্ত্রণাদগ্ধ, করুণ ও বিষাদময় ঘটনার শিকার হয়েছেন। এসব ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক কষ্টই এ ছবির বিষয়বস্তু।
১৯০৭ সালের ৬ জুলাই জন্ম নিয়েছিলেন মাগদালেনা কারমেন ফ্রিদা কাহলো ই কালদেরন। ফ্রিদাই পরবর্তীকালে নিজের নাম সংক্ষিপ্ত করে রেখেছিলেন ফ্রিদা কাহলো। নিজেই নিজের বয়স তিন বছর কমিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি বলতেন পছন্দ করতেন, তার জন্ম ১৯১০ সালের ৬ জুলাই। ওই বছর মূলত মেক্সিকান বিপ্লবের শুরু। সীমাহীন রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্র অভিমুখী এক রাজনৈতিক যাত্রায় ধাতস্থ হচ্ছিল মেক্সিকো। সে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন ফ্রিদা কাহলোও। পরিণত বয়সে মার্কসবাদী দর্শনকে আত্মস্থ করেছেন তিনি। একইসঙ্গে একজন জাতীয়তাবাদী চরিত্র হিসেবে মেক্সিকোর জাতীয় মুক্তি এবং সেখানকার সর্ব-জাতিক অধিকার রক্ষার আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন। এইসবকে ছাপিয়ে তার প্রণিধানযোগ্য রাজনৈতিক পরিচয় হলো—একজন নারীবাদী অ্যাক্টিভিস্ট ও চিত্রকর। একজন নারীর রাজনৈতিক অভিভাষণ তিনি প্রতিনিয়ত হাজির করেছেন তার চিত্রকর্মে। তাই বিশ শতকে বিকশিত নারীবাদী দার্শনিকদের ছাপিয়ে ফ্রিদা কাহলো হয়ে উঠেছিলেন নারীর অন্তর্ভেদী হৃদয়, প্রজ্ঞাপূর্ণ প্রকাশ ও সর্ববিকশিত রূপের বিশ্বজনীন নান্দনিক এক প্রতীক। কাহলোর প্রায় ২০০ চিত্রকর্মের মধ্যে ৫৫টির মতো আত্মপ্রকৃতি। সেই আত্মপ্রকৃতিগুলোই ঘুরেফিরে আলোচনায় থেকেছে। কারণ ওই প্রতিকৃতিতেই বিশ্বের নারীরা খুঁজে বেড়িয়েছেন নিজেদের শরাহত ছায়া। ওই প্রতিকৃতিগুলোই বারবার প্রচলিত ব্যবস্থাকে ভেঙে প্রচলিত মানসের মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছেন একটি মুখ—ফ্রিদা কাহলো। ফ্রিদা কাহলো মানেই নারীসমগ্র! যারা কখনো সবুজ, কখনো ধূসর, কখনো উজ্জ্বল মাটির পটভূমিতে দাঁড়িয়ে ভাবলেশহীন মুখাবয়ব নিয়ে তাকিয়ে রয়েছেন সভ্যতার দিকে। সে “প্রতিকৃতির চোখ” আর “সভ্যতার চোখের” ব্যবধানে উৎকীর্ণ আছে নারীর ত্যাগ, অভিজ্ঞতা ও সাহস। ১৯১০ থেকে ১৯২০ পর্যন্ত ঘটনাবহুল মেক্সিকান বিপ্লব সেখানকার রাজনীতি, সংস্কৃতিতে যে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটায়, সমাজতান্ত্রিক স্রোতোধারায় মেশে যে নতুন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে তার পলিমাটিকে গায়ে মেখে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন ফ্রিদা। ফলে তার গভীর শিল্পসত্তার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে তার রাজনৈতিক উৎকর্ষও। ফলে ফ্রিদা স্বভাবকারণেই হয়ে উঠেছেন বিশ্বজনীন এক শিল্পী-প্রতীক।
মাত্র ছয় বছর বয়সে ফ্রিদা পোলিওতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এক পা সরু হয়ে পড়েছিল তাঁর। ১৯২৫ সালে ১৮ বছর বয়সে বাস দুর্ঘটনায় মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে তার মেরুদণ্ড, কলারবোন ও পাঁজরের একাধিক অংশ ভেঙে গিয়েছিল। এ রকম দুটি বড় দুর্ঘটনা তার জীবনকে প্রায় পঙ্গুই করে দিয়েছিল। কিন্তু ফ্রিদা এই প্রতিবন্ধতাকে অতিক্রম করেছেন নিজের সীমাহীন মানসিক শক্তি ও দৃঢ়তা দিয়ে। প্যারামেডিকেলের শিক্ষার্থী ছিলেন। স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হওয়ার। শারীরিক অক্ষমতার কারণে সে স্বপ্নকে জলাঞ্জলিই দিতে হলো। কিন্তু গড়ে তুললেন নতুন আরেক স্বপ্ন। স্বপ্ন না বলে জীবনই বলা শ্রেয়। নিজের সমস্ত রং ও অভিজ্ঞতাকে তিনি তুলে আনা শুরু করলেন চিত্রপটে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ফ্রিদা বলেছিলেন, “আমি অনুভব করছি আমার এখনো অনেক শক্তি আছে কিছু করার। কিন্তু লেখাপড়া করে চিকিৎসক হওয়ার মতো এত শক্তি নেই, আর কিছু না ভেবেই আমি আঁকতে শুরু করি...”। এমন না যে কাহলো দুর্ঘটনার পর শয্যাশায়ী অবস্থায় হঠাৎই আঁকতে শুরু করেন। আঁকাআঁকির অভ্যাস তার আগে থেকেই টুকটাক ছিল। সেটা ধারাবাহিকতা পাচ্ছিল না। স্কুলজীবনের শেষ দিকে পরিচয় ঘটেছিল মেক্সিকান শিল্পী দিয়েগো রিভেরার সঙ্গে। রিভেরার প্রভাব ও প্রেরণাই সঙ্গী হয়েছিল তার শিল্পযাত্রায়। দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়গুলো শয্যাশায়ী অবস্থায় একটানা ছবি আঁকাতেই ব্যয় করেছেন। ১৯২৬ সালে কাহলো প্রথম যে আত্মপ্রতিকৃতিটি আঁকলেন, সেটি হলো “ওয়ারিং আ ভেলভেট ড্রেস” (Self-Portrait in a Velvet Dress)। কাহলো তার তখনকার প্রেমিক আলেজান্দ্রোর জন্য উপহার হিসেবে এ চিত্রকর্মটি এঁকেছিলেন। আলেজান্দ্রো তখন ফ্রিদা থেকে দূরে। ইউরোপে তাকে ভ্রমণে পাঠিয়ে দিয়েছেন তার বাবা-মা। লক্ষ্য, ফ্রিদা থেকে তাকে দূরে রাখা। কারণ ফ্রিদার সঙ্গে আলেজান্দ্রোর সম্পর্ক তারা মেনে নিতে পারছিলেন না। ফ্রিদা শয্যাশায়ী অবস্থায় আলেজান্দ্রোকে গভীরভাবে অনুভব করতেন। তার সান্নিধ্যের জন্য আকুল ছিলেন। আলেজান্দ্রোও যে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে সেটা ধারণা করতে পারছিলেন ফ্রিদা। কিন্তু তার বিশ্বাস ছিল এ ছবি (চিত্রকর্মটি) আলেজান্দ্রোকে তার কাছে ফেরাতে জাদুকরি ভূমিকা রাখতে পারে। ভালোবাসার চিহ্নস্বরূপ আঁকা সে প্রতিকৃতিতে তেমন আবেদনই উৎকীর্ণ ছিল। কিন্তু আলেজান্দ্রো ফেরেননি। আলেজান্দ্রো ছবিটিও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ফ্রিদাকে। পরে সে চিত্রকর্মটি দেখে দিয়েগো রিভেরা মন্তব্য করেছিলেন, তিনি ফ্রিদার আত্মপ্রতিকৃতির ব্যাপারে সবচেয়ে আগ্রহী। কারণ, এটি একটি মৌলিক কাজ।
অন্ধকার পটভূমিতে রাজকীয় ধাঁচের একটি মখমল পোশাকে আবৃত প্রতিকৃতিটিতে তাঁর মুখাবয়বের কোমল প্রকাশ আছে, যা তার বাস্তবতাপ্রিয়তাকে প্রকাশ করে। ছবিতে যথারীতি তাঁর নির্বিকার দৃষ্টি, অপেক্ষাকৃতভাবে অতিমাত্রায় দীর্ঘ গ্রীবা আর আঙুল ম্যানারিস্ট রীতিকেই প্রতিফলিত করে। একইসঙ্গে পাওয়া যায় ইতালীয় রেনেসাঁ যুগের চিত্রকর্মের প্রতিফলনও।
১৯২৯ সালে দিয়েগো রিভেরার সঙ্গে প্রেম ও পরিণয়ে জড়িয়ে পড়েন ফ্রিদা। নিজের চেয়ে ২০ বছর বেশি বয়েসী এ শিল্পীকে বিয়ে করে পরিবারের লোকজনের নানা কটু কথা শুনতে হয়েছিল ফ্রিদাকে। ফ্রিদার বাবাই তাঁদের বিয়ে নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন “হাতি ও ঘুঘুর বিয়ে” বলে। রিভেরার সঙ্গে দাম্পত্য খুব একটা সুখে কাটেনি তাঁর। তবে সারাক্ষণ রিভেরাতেই বুঁদ হয়ে থাকতেন ফ্রিদা। রিভেরার সঙ্গে বিয়ের পর ফ্রিদার ছবি আঁকার ভঙ্গিতে দারুণ পরিবর্তন আসে। বিশেষ করে বিশেষ বিশেষ প্রতীক তার ছবিতে বাঙ্ময় হয়ে উঠতে শুরু করে। মেক্সিকোর ঐতিহ্যবাহী তেহুয়ানা পোশাক, ফুলের মুকুট, অলংকার, ঢোলা-ফোলা ব্লাউজ ও স্কার্ট তার ট্রেডমার্ক হয়ে ওঠে। রিভেরার নিজের কাজে মগ্ন থাকা, অন্য সম্পর্কে জড়ানো এবং দীর্ঘ সময় দূরে থাকার বিষয়টি তাদের দাম্পত্যে করুণ প্রভাব ফেলে, যা ফ্রিদাকে ভেতরে ভেতরে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল। ১৯৩৯ সালে সম্পর্কের টানাপোড়েনে রিভেরার সঙ্গে বিচ্ছেদ হলেও ১৯৪০-এ তাঁরা আবার একত্র হন। ৪০ থেকে ৫০ সাল পর্যন্ত ফ্রিদার শরীরে উপর্যুপরি অস্ত্রোপচার হতে থাকে। এতে তাঁর শরীর ক্রমাগত ভগ্নদশার দিকে ধাবিত হয়। শেষ দিকে তাঁর হাঁটার মতো অবস্থাও ছিল না। এ সময় তাকে হুইলচেয়ার গ্রহণ করতে হয়। তাই শেষ দিকে ছবিগুলোতে তাঁর আত্মপ্রতিকৃতির সঙ্গে যুক্ত হয় হুইল চেয়ারও।
ফ্রিদা কাহলোকে সারা জীবন ভুগতে হয়েছে দুর্বিষহ শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণায়। বিশেষ করে পোলিওতে প্রায় অকেজো পা, দুর্ঘটনায় বুকের মধ্যে রড ঢুকে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে যন্ত্রণাকাতর দিন যাপন, তার ওপর সন্তান ধারণ করতে পারবেন না জেনেও তিনবারের বেশি সন্তান ধারণের ব্যর্থ চেষ্টা, গর্ভপাতের দুর্বহ যন্ত্রণা সহ্য করা এবং পরে স্বামী রিভেরার কাছ থেকে প্রাপ্ত মানসিক আঘাত ফ্রিদাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। তবু একবারের জন্যও শিল্পের প্রতি মোহগ্রস্ততা বিঘ্নিত হয়নি তাঁর। অসীম মানসিক শক্তি নিয়ে একের পর এক নির্মাণ করে গেছেন অন্তর্জাত বেদনার দলিল। চিত্রকর্মের বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন নিজেরই দুর্বহ জীবন। জীবন, জীবনের যন্ত্রণা, আশা-হতাশা-ব্যথা, প্রেম, বিচ্ছেদ, শরীর ও মনের সমীকরণ, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সক্রিয়তা, আত্মদর্শন, জীবের আকাঙ্ক্ষা, জড়ের ঔদ্ধত্য— সব ধরনের দ্বন্দ্বে এমন জাদুকরি মিশ্রণ খুব কম শিল্পীর চিত্রপটেই পাওয়া যায়।
১৯৪৪ সালে তার বিশ্বখ্যাত “দ্য ব্রোকেন কলাম” (The broken column) চিত্রকর্মটি আঁকেন। এ আত্মপ্রতিকৃতিতে অন্যান্য আত্মপ্রতিকৃতির মতো তিনি একা। তবে কোনো বানর নেই, বিড়াল নেই, তোতাপাখি নেই এবং প্রতিরক্ষামূলক পাতা ও গাছপালাও নেই। পরিবর্তে ফ্রিদা কাহলো ঝড়ের আকাশের নিচে একটি বিস্তীর্ণ খালি সমভূমিতে কাঁদছেন। সম্ভবত তিনি নিজেকে বলতে চাইছেন তাকে অবশ্যই তার শারীরিক ও মানসিক ব্যথা মোকাবিলা করতে হবে। কাহলো যখন এ প্রতিকৃতিটি আঁকেন তখন তাঁর স্বাস্থ্যের এমন অবনতি হয়েছিল, যেখানে তাঁকে পাঁচ মাস ধরে স্টিলের কাঁচুলি পরতে হয়েছিল। তিনি এটাকে “শাস্তি” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কাঁচুলির স্ট্র্যাপগুলোকে মনে হয় শিল্পীর ভাঙা শরীরকে একসঙ্গে এবং সোজা করে ধরে রেখেছে। একটি আয়নিক কলাম বেশ কয়েকটি টুকরোয় ভাঙা যা তার ক্ষতিগ্রস্ত মেরুদণ্ডের প্রতীক। তাঁর হৃদয় ছিদ্র করা বড় একটা পেরেক দিয়েগো দ্বারা সৃষ্ট মানসিক ব্যথার প্রতিনিধিত্ব করে। আর সারা শরীরে ছোট ছোট বিদ্ধ পেরেক শরীরের সামগ্রিক যন্ত্রণাকে তুলে ধরে। ফ্রিদা কাহলো মূলত নিজেকে সম্পূর্ণ নগ্ন এঁকেছিলেন। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত নেন যে তার সম্পূর্ণ নগ্নতা চিত্রটির কেন্দ্রীয় থিম এবং ফোকাস থেকে দর্শককে সরিয়ে দেবে।
এর আগে ১৯৩২ সালে আঁকা চিত্রকর্ম “মাই বার্থ” (My Birth, 1932)— এর কথাই ধরা যাক। একটা সাদা বিছানায় একজন নারীর যোনিপথ দিয়ে বের হয়ে আসছেন ফ্রিদা। কিন্তু তার মাথা অস্বাভাবিক রকমের বড়। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বিছানা। মায়ের মুখ একটা চাদরে ঢাকা। আর বিছানার ওপরে দেয়ালে একটা চিত্রকর্মে একটা ক্রন্দনরত নারীর মুখ দেখা যাচ্ছে। এ ছবিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হচ্ছে— ফ্রিদার প্রিয় স্বামী দিয়েগো রিভেরা কাহলোর জীবনের প্রধান ঘটনাগুলোকে নিয়ে ধারাবাহিক চিত্র আঁকার যে প্রকল্প শুরু করতে উৎসাহিত করেছিলেন এই চিত্রকর্মটি সেই সিরিজের প্রথম চিত্রকর্ম। কাহলো নিজেই এ চিত্রকর্ম সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন যে, “আমি কল্পনা করেছি যে আমি জন্মগ্রহণ করেছি।” পরে কাহলো বলেছিলেন, এই চিত্রকর্মটি মূলত এইটাই চিত্রিত করে যে তিনি নিজেকে নিজে জন্ম দিচ্ছেন।
অনেকে মনে করেন এই চিত্রকর্মটিতে মায়ের শরীরের নিচে যে রক্তের ছোপ রয়েছে তা দিয়ে ওই সময়ে ফ্রিদার গর্ভপাতের অভিজ্ঞতার ইঙ্গিত দেওয়া হতে পারে। আর চাদরে মায়ের মুখ ঢেকে রাখার ব্যাপারটি মায়ের মৃত্যুর সাম্প্রতিক ঘটনার প্রকাশ হতে পারে। জন্মশয্যার ওপরে ঝুলে থাকা ক্রন্দনরত নারীর মুখকে ‘দুঃখের কুমারী’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, যিনি কুমারীর দুঃখ ও সহানুভূতির অংশীদার, কিন্তু তিনি ওই পরিস্থিতিতে কিছুই করতে পারছেন না।
জানা যায়, পপস্টার ম্যাডোনা এই চিত্রকর্মটি সংগ্রহ করেছিলেন। পপ কমিউনিটির মুখপাত্র ভ্যানিটি ফেয়ারের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে, ম্যাডোনা বলেছিলেন যে, তিনি এই চিত্রকর্মটি ব্যবহার করেছেন কে তার বন্ধু এবং কে নয় তা জানতে— “যদি কেউ এই চিত্রকর্মটি পছন্দ না করেন তাহলে আমি জানি তারা আমার বন্ধু হতে পারেন না।”
সেলফ পোর্ট্রেট এজ আ তেহুয়ানা (Self-portrait as a Tehuana-1943) শিরোনামীয় চিত্রকর্মটি দেয় আরেক ইমেজ। যেখানে স্বামী রিভেরাকে অধিকার করার তীব্র ইচ্ছা প্রকাশিত হয়েছে। ওই প্রতিকৃতিতে ফ্রিদার ভ্রু-যুগলের মাঝখানে কপালে অঙ্কিত হয়েছে রিভেরার আবক্ষ প্রতিকৃতি। পটভূমিতে রাখা একটি পাতার শিরা ও মাকড়সার জালের মতো শিকড়সদৃশ রেখা ওই প্রতিকৃতির চারপাশে ছড়িয়ে আছে। আর ফ্রিদা পরে আছেন ঐতিহ্যবাহী তেহুয়ানা পোশাক। রিভেরাকে আকৃষ্ট ও প্রলুব্ধ করতে এ চিত্র আঁকা হয়। তাতে বোঝানে হয় মাকড়সার জালে আটকাতে চান রিভেরাকে। রিভেরা এ চিত্রকর্মটির ভূয়সী প্রশংসাও করেছিলেন বটে।
আরেকটি ছবি, যেটি খুব প্রচারিত ও সমাদৃত— “দ্য ওন্ডেড ডিয়ার ১৯৪৬” (Self-portrait as wounded deer-1946)। এ আত্মপ্রতিকৃতিমূলক চিত্রকর্মটিতে দেখা যাচ্ছে— তিরের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত একটি তরুণী হরিণ। যে হরিণটির মুখাবয়বে হাজির ফ্রিদা কাহলো। করুণ ও নির্লিপ্ত সে মুখ। জানা যায়, ওই বছর নিউইয়র্কে তার মেরুদণ্ডে অস্ত্রোপচার হয়েছিল। মেক্সিকোতে ফিরে, তিনি শারীরিক ব্যথা এবং গভীর বিষণ্ণতায় ভুগতে থাকেন। ওই চিত্রকর্মটিতে ফ্রিদা নিজেকে তরুণ হরিণের শরীর এবং তার নিজের মাথায় শিং ও মুকুট দিয়ে নিজেকে উপস্থাপন করেন। তিরবিদ্ধ (শর) রক্তাক্ত হরিণটি একটি বনের ভেতর থেকে বের হয়ে দর্শকের দিকে তাকিয়ে আছে। যদিও দূরে ঝড়, বিদ্যুতের আলোকিত আকাশ দেখা যাচ্ছে। যাতে উপস্থাপন করা হয়েছে উজ্জ্বল আশা, যেখানে ওই হরিণ কখনোই পৌঁছাবে না। গাছে বেষ্টিত হরিণটি ভয় ও হতাশায় আটকে পড়ে আছে। অনেকে ওই চিত্রকর্মটিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেন যে, এই চিত্রকর্মটি তার নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে ফ্রিদার অক্ষমতাকে চিত্রিত করেছে, অথবা ব্যর্থ অস্ত্রোপচারের জন্য ফ্রিদার হতাশা অথবা লৈঙ্গিক যুদ্ধে ক্রুদ্ধ ফ্রিদার একটি পরাবাস্তব চিত্রকর্ম।
একটি সমাজ, যেটি অচলায়তনে আবদ্ধ, যেখানে মানুষের দুঃখ কেবলই ব্যক্তিক, সেখানে ফ্রিদা কাহলো সে ব্যক্তিক দুঃখ, বেদনা, হাহাকার, হতাশা এবং একাকিত্বের আমৃত্যু যাত্রাকে যে কায়দায় সর্বজনীন নারী-জীবনের লড়াইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন তা শিল্পের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। পৃথিবীর দেয়ালে ফ্রিদা কাহলোর ছবি তাই বিষণ্ণ ও বেদনাক্লিষ্ট সব জনয়িত্রীরই একাকিত্বের গাঢ় স্মারক; সব নারীরই অপার দুঃখগাথা।
১৯৫৪ সালের ১৩ জুলাই ৪৭ বছর বয়সে মারা যান ফ্রিদা কাহলো। ৪৭তম জন্মদিনের মাত্র এক সপ্তাহ পর। ডাক্তাররা যদিও বলেছিলেন, উপর্যুপরি অস্ত্রোপচারের ধকল এবং তাঁর শরীরে প্রদত্ত উচ্চমাত্রার ড্রাগের প্রতিক্রিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন ফ্রিদা কাহলো। কিন্তু অনেকেই মনে করেন শরীর ও মনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য কাহলো নিজেই এ মৃত্যুর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন অনেক দিন ধরে। ফ্রিদা আত্মহত্যার পথই বেছে নিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তার বিভিন্ন ছবি ও ডায়েরিতেও তার নানা ইঙ্গিত মেলে। মৃত্যুর আগে এক জায়গায় লিখেছেন— “আমি আশা করি প্রস্থানটি আনন্দদায়ক হবে এবং আমি আশা করি কখনোই ফিরে আসব না।”
যে জীবন তিনি পেয়েছেন, তা বেদনা ও বিষাদে পূর্ণ। কিন্তু যে জীবন তিনি যাপন করেছেন তাকে পূর্ণাঙ্গ জীবন বলেই মনে করেছেন ফ্রিদা। বলেছেন, তার চিত্রকর্মগুলোই তাকে সম্পূর্ণ করেছে। তাই তিনি এ পৃথিবীতে আর কোনো রূপেই ফিরে আসতে চাননি।
লেখক : কবি।