সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬) একজন প্রথিতযশা লেখক। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, অনুবাদক। সাহিত্যের সব শাখাতে তাঁর সাবলীল পদচারণা পাঠককে মুগ্ধ করে। আর এজন্যই তাকে সব্যসাচী লেখক হিসেবে অভিহিত করা হয়। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে তাঁর স্বতন্ত্র আসন চিহ্নিত হয় বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে। বিচিত্র প্রতিভার সব্যসাচী এই লেখককে তাই কোনো একটি সাহিত্যকর্ম দিয়ে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। তাঁর গভীরতা সমুদ্রের মতো বিশাল, পর্বতের মতো অটল-অবিচল, ঝরণাধারার মতো প্রবাহিত হয়। কখনও তা আলোকোজ্জ্বল জীবনের অংশী হয়ে ওঠে, আবার কখনও মখমলে সময়কেও বেদনায় জর্জরিত করে। তাঁর অন্যতম কাব্যনাট্য ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ (১৯৭৬) মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত। এই কাব্যনাটকে তিনি যুদ্ধকালীন বাস্তবতা তুলে ধরেছেন।
কাব্যনাট্যের সূচনাকাল মুক্তিযুদ্ধ। সৈয়দ শামসুল হক দেখিয়েছেন, কালীপুর, হাজীগঞ্জ কিংবা ফুলবাড়ী, নাগেশ্বরী থেকে মানুষ আসছে। দলে দলে যমুনার বানের মতো মানুষ আসছে। কাব্যনাটকে তুলে ধরেছেন, “মানুষ আসতে আছে কালীপুর হাজীগঞ্জ থিকা/ মানুষ আসতে আছে ফুলবাড়ী নাগেশ্বরী থিকা/ মানুষ আসতে আছে যমুনার বানের লাহান/ মানুষ আসতে আছে মহররমে ধূলার সমান... মানুষ আসতে আছে বাচ্চাকাচ্চা-বৌ-বিধবা বইন/ মানুষ আসতে আছে আচনক বড় বেচইন”। নারী, পুরুষ, শিশু—সবাই দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসছে। আসেন একজন পীর সাহেবও। আর তারা সবাই জড়ো হয় গ্রামের মাতবরের বাড়িতে। মাতবরের কাছেই তাদের সব প্রশ্ন! তাইতো উৎকণ্ঠিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে সবাই মাতবরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। এই মাতবরই হচ্ছেন নাটকের প্রধান তথা কেন্দ্রীয় চরিত্র। তিনি মূলত পাকিস্তানের সহযোগী, দালাল অর্থাৎ রাজাকার।
গ্রামবাসীর সংলাপের মধ্যে দিয়ে নাটকটি শুরু হয় এবং শাখা-প্রশাখা ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়ে একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে যাত্রা করে। তাদের সংলাপের মাধ্যমেই উঠে আসে তৎকালীন প্রতিকূল-পরিবেশ-পরিস্থিতি। যুদ্ধকালে এ দেশে একশ্রেণির দালাল-ভণ্ড-পাকিস্তানের দোসরদের সৃষ্টি হয় যারা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাশবিকতায় অংশগ্রহণ করে। সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করেন মুক্তিযোদ্ধারাই এ দেশের শত্রু। আর পাকিস্তানি বাহিনীই বরং ইসলাম ধর্ম বাঁচাতে এসেছে। দেশের মানুষকে রক্ষা করতে এসেছে।
ক্রমাগত যুদ্ধজয়ের খবর শোনে গ্রামবাসী, পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় এবং এক এক এলাকার মুক্ত হবার খবরও পায় তারা। এতদিন মাতবরের কথায় ‘দেশবিরোধী’ কাজে যোগ দেয়নি জনসাধারণ; কিন্তু আর তাদের থেমে থাকা চলে না। মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখাতে চায় তারা। গ্রামবাসীর কথা: ‘আপনের হুকুম মতো এই সারা সতেরো গেরামে/ কোনোদিন কোনো ব্যাটা মুক্তিবাহিনীর নামে/ আসলেই খেদায়া দিছি যেমন ভিটায়/ খা-খা কাক ডাকলে দুপুর বেলায়/ লাঠি হাতে বৌ-ঝি খেদায়/ আপনের হুকুম মতো খোলা রাখছি চাইরদিকে চোখ/ গেরামের মধ্যে কোনো সন্দেহজনক/ ঘোরাফেরা দেখলেই পাছ নিছি সাপের মতোন/হুজুরে হাজিরও করছি দুই চাইরজন।’ কিন্তু সময়ের প্রবাহে ও সংগ্রামের প্রয়োজনে এই উদ্বিগ্ন ও আশাবাদী গ্রামবাসীর অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। তারা বোঝে মাতবর তাদের ভুল পথে পরিচালিত করেছে। তাই তাদের সব প্রশ্ন মাতবরকে ঘিরে। মাতবরকে জনসম্মুখে আসতে বলে এবং তাদের প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে বলে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে বাঙালি জাতি চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে। তবে এর পেছনের ইতিহাস শোণিতাক্ত। দীর্ঘ চব্বিশ বছরের কঠিন সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতার ইতিহাস রচিত হয়েছে। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৮-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬-এর ছয় দফা, ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচার আইয়ুব খানের পতন, ১৯৭০-এর জাতীয় পরিষদ নির্বাচন—সবই স্বাধীন দেশের সূচনায় বিশেষভাবে সহায়ক ছিল। সুদীর্ঘকালের শোষণ-নিপীড়নের বাঙালিরা প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠতেই দেশে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে মাতবরের মতো রাজাকার শ্রেণির। যারা মাতৃগর্ভে থেকেই মায়ের বুকে ছুরি বসাতে পিছপা করেনি। মাকে দালালের হাতে তুলে দিতে তাদের বুক কাঁপেনি। মাতবরের মতো দুরভিসন্ধি সৃষ্টিকারী সমাজ ও দেশের শত্রু তবে গ্রামের সাধারণ জনগণের কাছে তার মুখোশ উন্মোচনের আগে সেই সবার ভরসাস্থল ছিল।
মাতবর এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা গ্রামবাসীকে ধমকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে। মাতবর আগত গ্রামবাসীর প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেশরক্ষায় আহ্বান জানায়: ‘কও দেখি, বিপদ কোথায় নাই?/ কোন কামে নাই?/ আর সকল কামের চেয়ে বড় কাম হইল দেশ রক্ষা করা।’ গ্রামবাসী মাতবরের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। অতঃপর তারা নিজে নিজ বিবেক আর বুদ্ধিকে সম্বল করে সঙ্কল্পে অটল থাকে। তারা শ্রেণিবিভেদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও সামাজিক শোষণের বিপক্ষে মানসিক অবস্থান নেয়; যুক্তির ওপর দাঁড় করায় নিজেদের অবস্থা ও অবস্থানের বিচারের ভার। সৈয়দ শামসুল হক তাঁর কাব্যনাট্যে তুলে ধরেছেন এভাবে: ‘বুঝি না আল্লার/ কুদরত কারে কয়, কারে কয় বিচার আচার।/ যাদের জীবন হইল জন্তুর লাহান/ তারে কিছু দ্যাও নাই, দিয়াছো, অধিকার/ তারেই দিয়েছো তুমি দুনিয়ার ঈমান মাপার।’
যুদ্ধকালে পাকিস্তানপন্থিদের বিশ্বাস ও আস্থায় ফাটল ধরে। চোখের সামনে দেখতে পায় মুক্তিকামী মানুষের বিজয়বার্তা। মাতবরের চেতনার আলোড়নকে নাট্যকার কথামালায় রূপ দিয়েছেন এভাবে: ‘একি! দূরে য্যান শব্দ শুনি যমুনার।/ হঠাৎ ভাঙতে আছে খ্যাতের কিনার;/ স্রোতের আঙুল দিয়া খালি হাঁচড়ায়/ ভিটার তলের মাটি যমুনা সরায়।/ সাবধান, সাবধান। নাকি ভুল শুনতে আছি?/ কি হয়? কোথায়?/ ও কিসের শব্দ শোনা যায়?/ চুপ করো, চুপ করো শুনতে দাও, শুনি। ...আওয়াজ কি পাই খালি আমি একলাই?’ সৈয়দ শামসুল হক গণজাগরণের বার্তা দিয়েছেন। মাতবর অন্ধকারের আড়ালে রেখে তার অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু সেই পর্দা সরতেই জনগণ ফুঁসে ওঠে। তারা মাতবরকে বলে, ‘এখন যে তারাবসব ঝাড়ে মূলে এক্কোর উধাও /গায়েব কামান তাম্বু, সৈন্যরা ফেরার/ লোকে কয়, যুদ্ধের /কম বেশি সুবিধার/না যাওয়ার ফলে /পিছটান দিছে দলেবলে।’ তাদের প্রশ্নের জবাবে মাতবর আবারও ভণ্ডামির আশ্রয় নেয়। মাতবর বলে: ‘মিথ্যা কথা, ডাহা মিথ্যা কথা, তারা এখানেই আছে/ আছে এই তল্লাটেরই ধারে কাছে/ নতুন কৌশল নিয়া নতুন জাগাতে।’
সৈয়দ শামসুল হক এ কাব্যনাট্যে মাতবরের কৌশল, ভণ্ডামি তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন যুদ্ধচলাকালে একশ্রেণির রাজাকার পাকিস্তানিদের তোষণে ব্যস্ত ছিল। তারা দেশের বুকে ছুরি বসিয়ে রক্তাক্ত করতে পিছু হাঁটেনি।
মাতবর গ্রামবাসীদের সঙ্গে যেমন ধূর্ততার আশ্রয় নিয়েছে, তেমনই নিজ কন্যার সঙ্গেও অসৎ থেকেছে। পাকিস্তানিদের লালসার কাছে নিজ পুত্রীকে বিসর্জন দিয়েছে। যুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনী এ দেশের মা-বোনের সম্ভ্রম লুটেছে। হত্যা করেছে। পাকিস্তানি দখলদার ও এ দেশীয় দোসরদের হাতে লাঞ্ছনার শিকারে পরিণত হয় নারী। সৈয়দ শামসুল হক সে চিত্রও তুলে ধরেছেন: ‘মানুষের অধিকার নাই তারে সোয়াল করার/ তবে আছে অধিকার নামটি নিবার/ উচ্চারণ ক্যাবল করার/ আর তাই বা’জান আমার/ আল্লাহতালার নাম নিয়া তিনবার/ আমারে পাঠান তিনি পাপের রাস্তায়/ ‘পরে, পাপ হাজারে হাজার/ মানুষ নিশ্চিত করে, সাক্ষী নাম সেই তো আল্লার/ না, কিছুতেই বা’জানের কোনো বাধে নাই/ কারণ দিছেন তিনি আল্লার দোহাই।’
মাতবর, তার মেয়ে এবং গ্রামবাসীর একের পর এক সংলাপে মুক্তিসংগ্রামের বিষয়গুলো পরিস্ফুটিত হতে থাকে। মাতবর গ্রামবাসীকে জানান, তার মেয়েকে তিনি এক রাতের জন্য হলেও পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের কাছে বিয়ে দিয়েছিলেন। একপর্যায়ে মাতবরের মেয়ে অপমানে-লজ্জায় বিষপানে আত্মহত্যা করে। মেয়ে হঠাৎ বিষপান করে এবং মাটিতে পড়ে যায়। গ্রামবাসী রমণীরা তাকে কোলে নেয়।
ঘটনা এগোতে থাকে। গ্রামের মানুষ মাতবরের মৃত্যু চায়। এদিকে মাতবরের কানে বারবার পায়ের আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে। এই আওয়াজ আসলে মুক্তিযোদ্ধাদের পদধ্বনি। মাতবর সংলাপ আওড়ান, ‘আমারে মারলেই হবে গেরামের বিপদ উদ্ধার?/ আমার তো সকলই গ্যাছে, কিছু নাই আর। / গুলির আওয়াজ শুনি নিকটে এবার/ পায়ের আওয়াজ শুনি মাঠ হয়া পার/…./ আমার জীবন নিয়া তবে কও কি হবে তোমার?’ পীর বলে, ‘উঠায়া নিলেই সব উঠান কি যায়? দাগ একটা রাইখা যায়।/ মাটিতে সে দাগ এত সহজে কি যায়?’ শেষপর্যন্ত দেখা মেলে মাতবরের মৃতদেহ। লেখক বলেছেন: ‘দুম করে গোলা ফাটে। অন্ধকার হয়ে যায়। পর মুহূর্তে আলো জ্বলতেই দেখা যায়, মাথার ওপরে প্রকাণ্ড নিশান, মঞ্চ মুক্তিবাহিনীর লোকে লোকারণ্য। পাইকের এক হাতে লাঠির খোল, অন্য হাতে গুলির রক্তাক্ত ফলা। পড়ে আছে মৃত মাতবর।’
পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও এতে মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি তেমন কোন দৃশ্য নেই, আছে যুদ্ধের আবহ। নেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, আছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলার মানুষের পক্ষ-বিপক্ষের যুক্তি অবস্থান।
মাতবর, মাতবরের মেয়ে, গ্রামবাসী, পীরসাহেব, পাইক প্রভৃতি চরিত্রের উপস্থিতিতে সৈয়দ শামসুল হক মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপটের নির্মাণ করেছেন। সাধারণ মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে মাতবরশ্রেণি কিভাবে তাদের পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে তা দেখিয়েছেন। শেষপর্যন্ত ঝড়ের কবল থেকে নিজেকে ও একমাত্র সন্তানকেও রক্ষা করতে পারেননি। ভেসে গেছে সবটা। সৈয়দ শামসুল হক মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া ঘটনাকে অবলম্বন করেই এর দৃশ্যান্তর করেছেন। হাজার বছরের বাঙলির ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের যে গৌরব অর্জন হয়েছে, তা মতবরের মেয়ের মতো অসহায় নারী-পুরুষের আত্মত্যাগ ও রক্ত বিসর্জনের ফল।
সৈয়দ শামসুল হক যেমন দেখিয়েছেন নারীর ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নিষ্ঠুর অত্যাচারের চিত্র, তেমনই এই সময়ের চিত্র উঠে এসেছে শওকত ওসমানের জলাঙ্গী, দুই সৈনিক, জাহান্নম হইতে বিদায়, শওকত আলীর যাত্রা, রশীদ হায়দারের খাঁচায়, নষ্ট জোছনায়, এ কোন অরণ্য প্রভৃতি উপন্যাসে। মাতবর যেমন পাকিস্তানি জওয়ানের কাছে আল্লার নাম নিয়ে মেয়েকে সঁপে দিতে বাধ্য হয়েছে, ঠিক তেমনই এই চরিত্রের প্রতিফলন দেখতে পাই শওকত ওসমানের ‘দুই সৈনিক’ উপন্যাসে। পাকিস্তানের দোসর মখদুম মৃধা তার মেয়ে চামেলী ও সহেলীকে জওয়ানদের কাছে তুলে দিতে বাধ্য হয়। যদিও মখদুম মৃধা পাকিস্তানের দালাল, তবু তার নিজ সন্তানকে রক্ষা করতে পারেনি। শেষপর্যন্ত মখদুম মৃধার আত্মহনন। সৈয়দ শামসুল হক তাঁর পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাট্যে এই চেতনারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।