ছোট বন্ধুরা, তোমরা জানো বাঙালি সমাজে তিতাস একটি বেশ জনপ্রিয় নাম। তোমাদের মধ্যেও নিশ্চয় এই নামের অনেকেই রয়েছে। তবে আমার এই লেখার বিষয় কোনো মানুষ তিতাস নয়। নয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া সেই বিখ্যাত তিতাস নদটিও; এমনকি তার তীরে জন্ম নেওয়া সাহিত্যিক, সাংবাদিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১ জানুয়ারি ১৯১৪-১৬ এপ্রিল ১৯৫১) রচিত অমর উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ও নয়। এই লেখার বিষয় আসলে এই উপন্যাসটিকে নিয়ে নির্মিত একই নামের সেই অসাধারণ চলচ্চিত্রটি, যা একটি সূত্রমতে ইতোমধ্যে পৃথিবীর অন্যতম সেরা চল্লিশটি ক্ল্যাসিক ছবির মধ্যে স্থান করে নিয়েছে; যার বয়স এই ২০২৩ সালে ঠিক পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হলো।
ছবিটি নির্মাণের ইতিহাসটি খুব মজার। চলচ্চিত্রপ্রেমী যুবক হাবিবুর রহমানের অনেক দিনের শখ তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব, তাঁর অত্যন্ত প্রিয় চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটককে দিয়ে একটি সিনেমা বানাবেন, যে-ছবিতে বাংলাদেশের সত্যিকার পরিচয় ফুটে উঠবে। সেই সুযোগ এলো বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে, যেবার বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটক দুজনেই সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন মূলত সত্যজিৎ রায়কে অভ্যর্থনা জানাতে। সেখানেই তাঁর সঙ্গে প্রথম ঋত্বিক ঘটকের পরিচয় হয়, যদিও সেবার সিনেমা বানানো নিয়ে তাঁর সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা হয়নি। সেটি হলো এর কয়েকমাস পরে তিনি কলকাতায় বেড়াতে গেলে। ঋত্বিক তখন অনেক দিন ধরে কোনো ছবি বানাচ্ছেন না। সর্বশেষ ১৯৬২ সালে নির্মাণ করেছিলেন সুবর্ণরেখা, যেটি মুক্তি পেতে পেতে ১৯৬৫ সাল হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে তিনি একপ্রকার নিষ্ক্রিয়ই ছিলেন বলা চলে।
হাবিবুর রহমানের প্রস্তাবটি পেয়ে তিনি তাই নড়েচড়ে বসলেন। তাঁরও মনে মনে ইচ্ছে ছিল তাঁর জন্মভূমি বাংলাদেশে (ঋত্বিক ঘটক জন্মেছিলেন আমাদের এই ঢাকা শহরেই ১৯২৫ সালে।) গিয়ে একটি ছবি নির্মাণের। প্রায় এক যুগের নীরবতা ভেঙে সম্পূর্ণ নতুন চিত্রভাষায় একটি মহাকাব্যিক ছবি বানিয়ে তিনি তাঁর ভক্তদের চমকে দিতে চেয়েছিলেন। এর জন্য তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসটির কথাই ভেবেছিলেন প্রথমে। কিন্তু বাহাত্তরের মাঝামাঝি নাগাদ বাংলাদেশে আসার পর তিনি কুমিল্লায় তাঁর যমজ বোন প্রতীতি দেবীর শ্বশুর ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িতে বেড়াতে গেলে সেখানে তাঁর হাতে আসে অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসটি। সেটি পড়ে তিনি এতটাই উদ্বেল ও উত্তেজিত হয়ে পড়েন যে পূর্বের সব ভাবনা জলাঞ্জলি দিয়ে এটি নিয়েই ছবি বানাতে মনস্থির করেন। প্রতীতি দেবীর ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি বইটি পড়া শেষ করার পরপরই উত্তেজনার আতিশয্যে এর চিত্রনাট্য লিখতে বসে যান। এবং হাতের কাছে কোনো কাগজকলম না পেয়ে প্রতীতি দেবীর একটি সাদা শাড়ির জমিনেই লাল কালি দিয়ে সেটি লিখতে শুরু করে দেন। ঋত্বিকের নিজের কথায়, ‘আমি পদ্মা থেকে তিতাসে চলে গেলাম।’ পরে অবশ্য সেটি লেখা সমাপ্ত করেন তিনি পরে নারায়ণগঞ্জের ঢাকেশ্বরী জুটমিলের অতিথিনিবাসে বসে।
কিন্তু কেন তিনি পদ্মা নদীর মাঝির পরিবর্তে তিতাস একটি নদীর নামকে বেছে নিয়েছিলেন, তার উত্তরে ঋত্বিক বলেন: ‘তিতাস পূর্ব বাংলার একটা খণ্ড জীবন, এটি একটি সৎ লেখা। ইদানীং সচরাচর বাংলাদেশে (দুই বাংলাতেই) এই রকম লেখার দেখা পাওয়া যায় না। এর মধ্যে আছে প্রচুর নাটকীয় উপাদান, আছে দর্শনধারী ঘটনাবলি, আছে শ্রোতব্য বহু প্রাচীন সংগীতের টুকরো; সব মিলিয়ে একটা অনাবিল আনন্দ ও অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করা যায়, আমার মনে হয়েছিল, তাই এটা করছি। ব্যাপারটা ছবিতে ধরা পড়ার জন্য জন্ম থেকেই কাঁদছিল, সুযোগ পেয়েছি, ধরেছি।’ আসলেই অদ্বৈত মল্লবর্মন তাঁর এই উপন্যাসে জেলেদের জীবন, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, স্বপ্ন-সংগ্রাম, আশা-অকাঙ্ক্ষাকে যেভাবে ভাষা দিয়েছেন তেমনটি আর কেউ পারেননি, কেননা তিনি নিজে ছিলেন জেলে পরিবারের সন্তান। কলকাতায় সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন তিনি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে, মাত্র ৩৭ বছর বয়সে, মারা যাওয়ার কারণে এবং বইটি তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হওয়ার ফলে এর স্বত্ব ছিল একটি ট্রাস্টি বোর্ডের হাতে, খোদ সত্যজিৎ রায় ছিলেন যার একজন সদস্য। তিনি যখন শুনলেন ঋত্বিক এই উপন্যাসটি নিয়ে ছবি করতে চান তখন বোর্ডকে বলেছিলেন,‘সাবজেক্টটা ঋত্বিকের। উনি যদি এ উপন্যাস নিয়ে ছবি করতে চান তাহলে দিয়ে দেন।’
এবার আসা যাক ছবিটির নির্মাণের গল্পে। সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার পর ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে ঋত্বিক ঢাকায় আসেন। এর মহরত হয় ১৯৭২-এর ১৪ জুলাই এবং দুদিন পর ১৬ জুলাই শুটিং শুরু হয় সাভারের একটি বটগাছের নিচে। এরপর দলবল নিয়ে ঋত্বিক চলে যান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সেই বিখ্যাত গোকর্ণঘাটে, যেখানে অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্ম এবং তিতাস তীরবর্তী যে-অঞ্চলের পটভূমিকায় তিনি উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন। এই শুটিংপর্ব বিষয়ে ছবিটির কার্যনির্বাহী প্রযোজক আকন্দ সানোয়ার মুর্শেদ স্মৃতিচারণা করে লেখেন,‘আমরা প্রথমে তিতাসের লোকেশন দেখার জন্য গোকর্ণঘাটে গেলাম। দাদা আমাদের সবাইকে লোকেশন ও চিত্রগ্রহণের বিষয়টি বুঝিয়ে দিয়ে ঢাকায় ফেরত এলেন এবং আর্ট ডিরেক্টর মুনশী মহিউদ্দিন, আমি আর দু-একজন থেকে গেলাম সেট তৈরির জন্য। আমাদের সেট বানানো শেষ হলে ঢাকা থেকে অন্যান্যরা একটি লঞ্চ, একটি পাঁচমণি নৌকা ও একটি জেনারেটর নিয়ে এলেন। বেশ কয়েকজন বাই রোডে গাড়িতেও এসেছিলেন। একটা মহাকাণ্ড তখন শুরু হয়ে গেছে।’ ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, আরিচাঘাট, পাটুরিয়া, এফডিসি মিলিয়ে প্রায় একশ দিন শুটিং করে ছবির কাজ শেষ হয় ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে এবং ২৭ জুলাই সেটি দেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। এখানে উল্লেখ্য, এই ছবিতে ঋত্বিক ঘটক স্বয়ং অভিনয় করেছিলেন তিলকচাঁদ চরিত্রে। প্রযোজক হাবিবুর রহমানের শর্ত অনুযায়ী বাকিরা সবাই ছিলেন বাংলাদেশের শিল্পী, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবরী, প্রবীর মিত্র, রোজী সামাদ, খলিল, আবুল খায়ের, গোলাম মুস্তাফা,রওশন জামিল, নারায়ণ চক্রবর্তী,মালতী দেবী, রাণী সরকার, বনানী চৌধুরী,ফখরুল হাসান বৈরাগী,আবুল হায়াত,গোলাম রব্বানি, দিলীপ চক্রবর্তী, নূপুর প্রমুখ।
এই চলচ্চিত্রের অন্যতম আকর্ষণ এর গানগুলো। মূল সংগীত পরিকল্পনা ঋত্বিকের নিজের হলেও এর সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ারই আরেক কৃতি সন্তান, সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের ভাইয়ের ছেলে ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খান। নিজে মূলত উচ্চাঙ্গ সংগীতের মানুষ হলেও এই ছবিতে অনেকগুলো লোকগীতি ব্যবহার করেন তিনি। সিনেমায় ব্যবহৃত গানগুলো ছিল- ওরে নৌকার ওপার গঙ্গা বুঝায়; লীলাবালী লীলাবালী; রাই জাগো; রাধা-কৃষ্ণের মিলন হইলো; কোরানেতে প্রমাণ তার ও তোর আপন দোষে সব গানগুলো গেয়েছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ সংগীতশিল্পীদের কয়েকজন, যাদের মধ্যে আছেন ধীরাজ উদ্দিন ফকির,হরলাল রায়, রথীন্দ্রনাথ রায়, নীনা হামিদ,ইন্দ্রমোহন রাজবংশী,ধর্মীদান বড়ুয়া,আবিদা সুলতানা, দীপু মমতাজ, পিলু মমতাজ, আবু তাহর প্রমুখ। আর এর চিত্রগ্রাহক ছিলেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য ক্যামেরাম্যান বেবী ইসলাম।
এই সিনেমা তৈরিতে খরচ হয়েছিল ৮ লাখ টাকার কিছু বেশি। যদিও তখন বাংলাদেশে একটি সিনেমা তৈরিতে খরচ হতো লাখখানেকের মতো। সিনেমাটি মুক্তির পর ঢাকায় চারটি এবং চট্টগ্রামে দুটিসহ মোট ছয়টি হলে চালানো শুরু হলো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য পর্যাপ্ত দর্শকের অভাবে এর পরের সপ্তাহেই সিনেমাটিকে হল থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। তবে সেই সময় স্বদেশে এর সঠিক মূল্যায়ন না হলেও কালক্রমে তা বিশ্বময় কাল্ট ক্ল্যাসিকের মর্যাদা পায়। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের এক অনন্য মাইলফলক তিতাস একটি নদীর নাম ও তার কালাপাহাড়ি পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের সে রকম কয়েকটি স্বীকৃতি ও অর্জনের কথা উল্লেখ করে এই লেখার ইতি টানছি।
- ১৯৭৩ সালে এই ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পান ঋত্বিক ঘটক।
- ২০০৭ সালে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের এক জরিপে দর্শক ও চলচ্চিত্র সমালোচকদের ভোটে এটি সবার সেরা ১০টি বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের তালিকায় শীর্ষ স্থান লাভ করে।
- ২০১০ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ঋত্বিকের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মাননাস্বরূপ এই ছবিটির একটি বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করেন উদ্যোক্তারা।
- বিখ্যাত মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা মার্টিন স্করসিজের বিশেষ প্রিয় ছিল ঋত্বিকের এই ছবিটি যেটিকে তিনি তাঁর ওয়ার্ল্ড সিনেমা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে পুনরুদ্ধার ও কারিগরি পরিমার্জনা শেষে বিশ্বব্যাপী প্রদর্শনের উদ্যোগ নেন।
ছবিটির একটি ভালো প্রিন্ট ইউটিউবে রয়েছে। ছোট বন্ধুরা, তোমরা সময় করে সেটা দেখে নিও কিন্তু।