ব্রেন্টন স্ট্রিট থেকে যখন বাসে উঠি তখন টরোন্টোর আকাশ মেঘলা। বাংলার বর্ষাকাল চলছে এখানে। তবে সেটা রূপেই, কর্মে নয়। বাংলার বর্ষা সর্বপ্লাবিত। এখানে ওরকমটা পাইনি। আরো পার্থক্য হলো সকালের মর্মভেদী শীতল হাওয়া। বাঁচা গেছে এখানে এখন শীতকাল নয়। তবে ইদানিং নাকি বরফও আর আগের মতো পড়ে না। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব বলছে কেউ কেউ। পৃথিবী পাল্টাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর্কিয়ান যুগ থেকে সিনোজয়িক যুগ, লক্ষ কোটি বছরের ভেতর দিয়ে পৃথিবী বিবর্তিত হয়েছে, হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছাস-ভূমিকম্প তো আছেই। উৎসবের তৃতীয় দিন দেখা হলো ভূমিকম্পে তছনছ হয়ে যাওয়া এক পোস্ট-এপোক্যালিপটিক সিনেমা ‘কংক্রিট ইউটোপিয়া’।
দক্ষিণ কোরিয়ার পরিচালক উম তাই-হোয়ার বানানো এই ছবি মানুষের যত্ন করে বানানো কংক্রিটের দুনিয়া তছনছ হয়ে যাওয়ার গল্প বলে। ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত পৃথিবীতে একটি এপার্টমেন্ট কোনোরকম টিকে ছিল। সেই এপার্টমেন্টের মানুষের টিকে থাকার কাহিনি ধরা হয়েছে মানুষের লোভ, হিংসা, সহিংসতা ও বেঁচে থাকার আকুতির ভেতর দিয়ে। পৃথিবীতে মানুষের ইতিহাস শ্রেণি বৈষম্যের ইতিহাস, সেই ইতিহাসেরই এক চলচ্চৈত্রিক রূপ এই ছবি। এপার্টমেন্টের বাসিন্দারা এলিট শ্রেণির। প্রাকৃতির দুর্যোগের পর বাইরের অনেক মানুষ সেখানে আশ্রয় নেয়। কিন্তু তাদের তেলাপোকা আখ্যা দিয়ে ঝেটিয়ে বিদায় করে এপার্টমেন্টবাসীরা। খাবারের ভাগ তারা দেবে না। নিজেরা নিজেরা ভালো থাকার এক তরিকা তারা আবিষ্কার করে। তারা ভাবে ওটাই স্বর্গ, ইউটোপিয়া। কিন্তু ইউটোপিয়া ডিসটোপিয়া হতে বেশি দেরি হয় না। ভুখা মানুষের মিছিল দ্বিগুণ হিংস্র হয়ে ফিরে আসে। তছনছ হয়ে যায় এপার্টমেন্টে রচিত কংক্রিটের ক্ষণস্থায়ী বেহেশত। পরিচালক শেষ পর্যন্ত বলতে চান, সকল মানুষেরই বেঁচে থাকার সমান অধিকার আছে এই দুনিয়ায়। আমার দেখা অন্যান্য দক্ষিণ কোরিয়ার ছবি ও ধারাবাহিকের মতো এই সিনেমাতেও দেশটির ঋণগ্রস্ত মানুষের দুর্দশা বিধৃত। আর রক্তারক্তিও আছে যথারীতি।
সকালটা শুরু হলো ভালো ছবি দিয়ে। এরপর রয়েছে ‘দি রিডস’, তুরস্ক ও হাঙ্গেরির যৌথ প্রযোজিত ছবিটির পরিচালক জেমিল আগাজিকগলু। স্ক্রিনিং শুরু হবে পৌনে তিনটায়। অনেক সময় হাতে। কি করা যায়? কিছুক্ষণ বইয়ের দোকানে। আর কিছুক্ষণ বেল লাইটবক্সের চতুর্থ তলার এক প্রদর্শনীতে। চিত্র প্রদর্শনী, তাও আবার হলিউড তারকা সিলভারস্টার স্টেলনের। এই মারকুটে র্যাম্বো যে ছবিও আঁকেন তা জানা ছিলো না। দেখলাম, অনেক চিত্রকলাতেই তার নিজের করা চরিত্ররা রয়েছে। বিমূর্তধারার কাজ, নীরিক্ষার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়। প্রদর্শনীর মাঝখানে কাচের বাক্সে রাখা আমেরিকান স্পোর্টস ড্রামা ‘রকি’র (১৯৭৬) হাতে লেখা চিত্রনাট্য। এই ছবির চিত্রনাট্যকার স্ট্যালন নিজেই, তিনি এই ছবির মূল চরিত্রও বটে। টিফের পাঠাগারের পাশে এই প্রদর্শনী নিঃসন্দেহে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে উৎসবে। এবার স্ট্যালনের বানানো প্রামাণ্যচিত্র ‘স্লাই’ দেখানো হবে। আর এই ছবিটি দিয়েই পর্দা নামবে ৪৮তম টরোন্টো চলচ্চিত্র উৎসবের।
প্রদর্শনী দেখে নিচে নামতেই দেখি টিফের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক উপদেষ্টা ও প্রোগ্রামার মীনাক্ষী শেড্ডি দাঁড়িয়ে আছেন, অপেক্ষা করছেন কারো জন্য। আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন। ভারতের পুনেতে এফটিআইয়ে কোর্স করার সময় তার সাথে পরিচয় হয়েছিল। টিফে নানাবিধ বৈঠক ও প্রশ্নোত্তর পর্বের জন্য মীনাক্ষী তাড়ার ভেতর আছেন। তারপরও আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালেন টিফের ব্যাকড্রপের সামনে। পটাপট অনেকগুলো ছবি তোলা হলো। তারপর বললেন, দৌঁড়াতে হবে। বললাম, দেখা হবে।
লাইটবক্স থেকে বেরিয়ে আর্টস্কেপ স্যান্ডবক্সের প্রেস লাউঞ্জে গেলাম। দুপুরের সামান্য আহার খেতে খেতে আগের দিনের লেখাটি ঘষামাজা সেরে, বেরিয়ে পড়লাম স্কশিয়াব্যাংক থিয়েটারের উদ্দেশ্যে। ওখানে গিয়ে নাচোস নিয়ে চিবুচ্ছি, তখন এলেন বাবুল ভাই। উনি কি একটা ছবি দেখতে এসেছিলেন, কিন্তু একটু দেরি হওয়াতে আর আসন পাননি। বসে বসে গল্প করলাম। শুনলাম উনাদের টরোন্টো মাল্টিকালচারাল ফিল্ম ফেস্টিভালের কথা। ৬ষ্ঠ বারের মতো এবারও হতে যাচ্ছে সেটা, শুরু হবে টিফ যেদিন শেষ হবে, তার পরদিন থেকেই, ১৮ সেপ্টেম্বর। আমাকে আমন্ত্রণপত্র দিলেন। কথা বলতে বলতে আড়াইটা। বললাম, পাঁচটায় তো প্রেসের ককটেল পার্টি আছে, সেখানে দেখা হবে। আমি ছবি দেখতে গেলাম। উনিও বললেন, তারও শিডিউল আছে ছবি দেখার। সাময়িক বিদায় নিয়ে স্কশিয়াব্যাংকের একটি থিয়েটারে ঢুকলাম ‘দি রিডস’ দেখার জন্য।
ছবির আগাগোড়াই যে ল্যান্ডস্কেপ দেখা যায় তা অসাধারণ। নলখাগড়া কেটে জীবনধারণ করা গ্রামের সহজসরল মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনি বলে এই ছবি। আলি নামে এক অতি সামান্য শ্রমিক মহাজন ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের দ্বারা নির্যাতিত। কিন্তু দুর্ঘটনাবশত একদিন মহাজনের এক সহকারীকে সে ধাক্কা দেয়, লোকটি মাটিতে পড়ে গেলে নলখাগড়ার ধারালো মাথা ঢুকে যায় তার গলায়। আলি যেন তার জীবনের ক্লেদ থেকে উঠে দাঁড়ানোর মন্ত্র পায়। একে একে সে খুন করে আরো দুজনকে। গোটা গ্রাম যেহেতু এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলো, তাই পুলিশ নিখোঁজদের খুঁজতে এলে তারা সেভাবে সহায়তা করে না। গ্রামবাসীদের জীবনে যেন শান্তি নেমে আসে। এই ছবিতেও সকালের প্রথম ছবির মতো শ্রেণিচেতনার উন্মেষ ঘটেছে। ছবি শেষ হলে পরিচালক জেমিলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অভিনন্দন জানালাম। ইস্তাম্বুলে জন্ম নেয়া পরিচালক খুশি হয়ে আমাকে ধন্যবাদ দিলেন।
প্রেসের ককটেল পার্টিতে গিয়ে দেখি বাবুল ভাই আগেই চলে এসেছেন। দ্রাক্ষারস তার সামনে। আমিও একটি রোজে ওয়াইন নিয়ে বসলাম। কথা বলতে বলতে দুইএকজন পরিচিত ফ্রিলেন্সার লেখকের সাথে কুশল বিনিময় হলো। বাবুল ভাই জিজ্ঞেস করলেন, বঙ্গবন্ধু বায়োপিকের স্ক্রিনিংয়ে দাওয়াতপত্র পেয়েছি কি না। বললাম, পাইনি। আর এই ছবি আমি এমনিতেই দেখে নিবো নিজের সুযোগ সুবিধা মতো। দাওয়াত নিয়ে দেখার দরকার কি! কমার্শিয়াল স্ক্রিনিং যেহেতু টিকিটও পাওয়া যাবে হয় তো!
এক ঘন্টার মতো থাকার পর বললাম, এবার জাপানি জানালার সামনে বসতে হবে। পুনরায় স্কশিয়াব্যাংক থিয়েটার। কেই চিকা-উরা পরিচালিত ‘গ্রেট অ্যাবসেন্স’। কাব্যিক এই চলচ্চিত্রে পিতা-পুত্র এবং তাদের সাথে পিতার দ্বিতীয় স্ত্রীর এক চমৎকার সম্পর্কের বয়ান তৈরি হয়েছে। নাট্যকর্মী তাকাশির বাবা ইয়োজি একজন অধ্যাপক। বৃদ্ধ বয়সে তিনি স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে পড়েন। তার দ্বিতীয় স্ত্রী, তাকাশির সৎ মা নাওমি যেভাবে ইয়োজিকে দেখভাল করে আর ভালোবাসে সেটা দেখে অবাক হয়ে যায় তাকাশি। ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে গিয়ে স্মৃতির নুড়িপাথর কুড়িয়ে এনে তাকাশি নতুন করে বাবাকে আবিষ্কার করে। এই ছবি এক পুত্রের পিতাকে পাঠ করার অভিযান। ভীষণ কাব্যময় এই ছবি মন ছুঁয়ে যায়।
ছবি শেষ হতে হতে রাত নয়টা। হল থেকে বেরিয়েই আবার মীনাক্ষীর সাথে দেখা। পাশেই কিরন রাও দাঁড়িয়ে। আবার দাঁড় করালেন মীনাক্ষী। ফোনে দেখলাম কার সাথে কথা বলছেন, অপরপ্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে বলছেন, তুমি বিধান রিবেরুকে চেনো? ঢাকা থেকে এসেছেন, চমৎকার ফিল্ম ক্রিটিক? আমি একটু অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। কাকে বলছে, আমাকে চেনার কথা? পরে একপ্রকার টানতে টানতে নিয়ে গেলেন নিচে। গিয়ে দেখি একজন মানুষ হাসিমাখা মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মীনাক্ষীকে জড়িয়ে ধরলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন মীনাক্ষী, উনার নাম তাজিন আহমেদ। আমি আমার নাম বলতেই, তাজিন বললেন, উনি আমাকে চেনেন, আমার লেখাপত্র তিনি পড়েছেন। বাংলাদেশের মেয়ে। আইইউবিতে গণমাধ্যম পড়াতেন। এখন কানাডাতে থাকেন। আর এখানকার ডকুমেন্টারি ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেন। সংক্ষিপ্ত আলাপে ভালো লাগলো। রাতের খাবার একসাথে খাবো কিনা জিজ্ঞেস করলেন, বললাম, বাড়ি ফিরতে হবে। বিদায় নিয়ে ফোন দিলাম বাবুল ভাইকে। উনি ফোন দিতে বলেছিলেন, ছবি শেষ হলে একসাথে ফেরা যাবে। ফোন দিয়ে জানলাম আরো ত্রিশ মিনিট লাগবে তার। আমি এই ফাঁকে টিফের কনসার্টে ঘুরে এলাম। দেখলাম দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে একটি নাচের দল এসেছে। তাদের সে কি আনন্দ নৃত্য! উপস্থিত দর্শকরাও তালে তালে নাচছে।
বাবুল ভাই ফোন দিলেন। বললেন, চলেন তবে ফেরা যাক। পথে পরিচয় হলো কানাডা প্রবাসী টুকু ভাইয়ের সাথে। তিনজনে মিলে মেট্রোরেলে চড়ে মেইনস্ট্রিট স্টেশন পর্যন্ত এলাম। তারপর পথ ভিন্ন। তারা কুড়ি নাম্বার বাসে উঠলেন, আর আমি তেইশ নম্বর বাসে উঠে সারাদিনের তৈলচিত্র আঁকতে আঁকতে বাড়ি।