আজ তাঁর জন্মদিন। আবার ২০১৭ সালের এ মাসেই ২১ তারিখে বিদায় নিয়েছিলেন প্রখ্যাত সুরকার, গীতিকার ও সংগীত শিল্পী জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। বয়স হয়ে গিয়েছিল ওনার। ৮৩ বছর বেঁচেছেন এই দুনিয়ায়। তবুও ওনার মতো শিল্পীর চলে যাওয়া সবসময় অকালেই। কী দারুণ গায়কী তাঁর, তেমন সুর। ছোটবেলায় আমরা সবাই ধরে নিয়েছিলাম, কী গান গেয়েছেন শ্রীকান্ত, ‘বঁধুয়া আমার চোখে জল এনেছে’, তেমন কেউ জানবেই না মূল শিল্পীর নাম।
আমার স্বপন কিনতে পারে, এরকম গান আর হবে না কোনোদিন। অভিমানী কণ্ঠে আর কেউ গাইবে না, ‘কেউ বলে ফাল্গুন কেউ বলে পলাশের মাস/ আমি বলি আমার সর্বনাশ।’ এই পৃথিবীতে এখন আর তেমন বিরহ জাগানিয়া কণ্ঠ নেই, স্বর্গে আপনার কণ্ঠে নিঃসন্দেহে জেগে উঠছেন সেখানের বাসিন্দারা। সলিল চৌধুরীর ‘পাগল হাওয়া তুমিও কি’ গানটা জটিলেশ্বরের কণ্ঠে এত ভালো লাগে, যদিও জানি, সুবীর সেনের গলায় তা সবার প্রিয়। এটা হিন্দিতে আবার চলচ্চিত্রে গাওয়া হয়েছে অন্যভাবে, লতা মুঙ্গেশকারের গলায়, ‘না জানে কিউ।’
আমাদের জীবন থেকে ক্লাসিক্যাল মিউজিক হারিয়ে গেছে, অথচ শোনা কত জরুরি এটা। সামান্য একটা উদাহরণ দেই, প্রয়াত জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় তখন সরকারি চাকরি করেন। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরছেন, ওনার গলিতে সেতার বাজছে। উনি ভাবলেন এই গলিতে সেতার বাজানোর কেউ নাই। পরে মন দিয়ে বাসায় বসে আবার শুনলেন, তখন রেকর্ড বাজছে কারো ঘরে, পণ্ডিত রবিশংকরের। সেই রেশটা থাকতেই থাকতেই তিনি লিখে ফেললেন, ‘এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার, ও কি সূর্য নাকি স্বপ্নের চিতা,
ও কি পাখির কূজন নাকি হাহাকার।’ ভাবতে পারেন একটা ক্লাসিক্যালের রেশ আপনাকে দিয়ে কীরকম লাইন লেখাতে পারে, যদি আপনি জটিলেশ্বর হন।
পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী একবার বলেছিলেন, ‘বাংলা গানে কেউ ভালো সুর করে, কেউ ভালো গায়, কেউ ভালো লিখে। তিনটা কাজই খুব উচ্চস্তরে পারতো খুব কম লোকই। জটিলেশ্বর হলেন সেই দলের লোক।’ পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর ওস্তাদ একদিন বলেছিলেন, ‘জটিল একটা গান আনলো। বললো কিছুতেই সুর করতে পারছে না। আমাকে দেখালো, স্বয়ং ঈশ্বর কৃপা না করলে এত ভালো লেখতে পারে না কেউ। আমি অবাক হয়ে শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।”
১৯৩৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর চন্দননগরে জন্ম হয় জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের। ১৯৬৩ সালে মেগাফোন থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গানের ‘রেকর্ড’। তাঁর প্রথম রেকর্ডে সুর ও কথা ছিল সুধীন দাশগুপ্তের। এরপর ১৯৬৪ সালে সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে মেগাফোন থেকেই বের হয় তাঁর দ্বিতীয় রেকর্ড, সেই বিখ্যাত গান ‘পাগল হাওয়া’। এরপর মেগাফোন, এইচএমভি থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতে শুরু করে তাঁর গাওয়া গান। বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগে অন্য মাত্রা যোগ করে তাঁর কণ্ঠ ও সঙ্গীতারোপের কুশলতা। ২০১৩ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত আকাদেমি কর্তৃক জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ পদকে ভূষিত হন। এছাড়াও তিনি সেরা সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছেন ‘দামু’ ও ‘নটী বিনোদিনী’ চলচ্চিত্রে সুরারোপ করে।
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী ‘আনন্দধারায়’ পড়েছিলাম, ‘গানের সাধনা একটা সময় নেশা হয়ে যায়। তখন দুনিয়ার কিছুতেই আর মন বসে না।’ জটিলেশ্বর ছিলেন সেই সাধনা ধারার মানুষ। যারা বিশ্বাস করতেন, আধুনিক বাংলা গানে কিছুটা ক্লাসিক্যালের রেশ রাখতে হয়। নয়তো কালোত্তীর্ণ হয় না। সংগীতের ঋণের কথা তিনি সবসময় বলতেন, চেষ্টাও করে যেতেন সেই আলো ছড়িয়ে দিতে।