রোববার সেন্ট এন্ড্রুতে নেমে বোঝা গেল উৎসব আজ শেষ হতে চলেছে। রয় থমসন হলের সামনে বিছানো লালগালিচা গুটিয়ে ফেলা হচ্ছে। খুলে ফেলা হচ্ছে প্রিন্সেস অব ওয়েলস থিয়েটারের সামনের ছাউনি। বড় বড় বাক্স একটির ওপর একটি সাজানো হচ্ছে। উৎসবের নানা সরঞ্জাম গোছগাছ শেষ প্রায়। তবে এখনো বাকি বিজয়ীদের নাম ঘোষণা। আর সেটা করা হবে টিফের বেল লাইটবক্সের জাঁকজমকহীন এক হলরুমে। এই অনুষ্ঠানের জন্য আগের দিনই রেপোঁদে সিলভুপ্লে বা আরএসভিপি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম মেইলে। উৎসবের এগারোতম দিন লাইটবক্সের ষষ্ঠ তলার ছাদ লাগোয়া হলরুমে ঢুকেই চোখ গেল ওপরের দিকে। জামদানির নকশা আঁকা সিলিং।
একে একে চলচ্চিত্র নির্মাতা, প্রযোজক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জড়ো হচ্ছেন। সাংবাদিকরাও এসেছেন। উৎসবের প্রধান নির্বাহী ক্যামেরন বেইলেসহ প্রোগ্রামাররা বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাদের হাতে ফ্রেমে বাঁধাই করা প্রশংসাপত্র আর উপহার দেওয়া হলো, সঙ্গে পুরস্কারের অর্থও। আমার দেখা ‘ডিয়ার জেসি’ ছবিটি প্ল্যাটফর্ম অ্যাওয়ার্ড পেল। বাকি সব ছবি আমি দেখিনি। আমি আসলে মনোযোগ দিয়েছিলাম মূলত এশিয়া ও কিছুটা আরবের দিকে। মাঝে একটি হলিউডের ছবিও দেখা হয়েছে। একটি কথোপকথনে উপস্থিত থেকেছি। টিফের একটি ব্রেকফাস্ট পার্টি, একটি ককটেল পার্টি ও আজকের ব্রাঞ্চ পার্টিসহ পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে হাজিরা দিয়েছি। টিফের এই শেষ অনুষ্ঠানটি আমার বেশ ভালো লেগেছে, খুব সাদামাটা কিন্তু আন্তরিকতায় মাখা।
পুরস্কার ঘোষণার অনুষ্ঠানে প্রোগ্রামার মীনাক্ষী শেড্ডির সঙ্গে দেখা হলো। উনি নিজ থেকে আমার ছবি তুলে দিলেন। আলাপ হলো ইংল্যান্ডভিত্তিক এক প্রযোজকের সঙ্গে। টিফ কেমন লাগল, জিজ্ঞেস করাতে বললেন, টিফের দর্শকই এই উৎসবের প্রাণ। আসলেই তাই। টরন্টোভিত্তিক মানুষেরাই টিফে ছবি দেখতে আসে। কান বা বার্লিনে যেমন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসে, এখানে ও রকম দর্শক খুব একটা আসে না। যেহেতু টরন্টো শহরটাই নানা বর্ণের মানুষে সজ্জিত, তাই আপনি বিচিত্র জাতি-বর্ণের মানুষের দেখা পাবেন স্ক্রিনিংয়ের সময়। শুধু চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী, কলাকুশলী, চলচ্চিত্র সাংবাদিক, সমালোচকরা আসেন বিভিন্ন দেশ থেকে। যেমন আমার পরিচিত মারিওনা বরুল। ও থাকে স্পেনের বার্সেলোনায়। শেষ দিনের অনুষ্ঠানে ও এসে আমাকে খুঁজে বের করেছে। বলল, আজই ফিরে যাচ্ছে স্পেনে। বাইরে লাগেজ প্রস্তুত।
পুরস্কার প্রদান শেষে লাইটবক্সের ট্যারেসে ব্রাঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি ও মারিওনা পানীয় ও খাবার নিয়ে বসলাম। ও জানাল ফ্রিল্যান্সিং করেই জীবিকা নির্বাহ করছে সে। যদিও পূর্ণ অধ্যাপক হওয়ার প্রস্তাব ছিল এক বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু সেই জীবন তার পছন্দের নয়। উৎসব ঘুরে ছবি নিয়ে লেখালেখি করাতেই তার আনন্দ। তার বিশেষ আগ্রহের জঁরা ‘কুয়ের’। আমার ধারণা, সে নিজেও সেই কমিউনিটিতে বিলং করে। আলাপে জানা গেল, মেয়ে হয়েও ছেলের মতো গেটআপ নিয়ে থাকায় তার অনেক জায়গাতেই সমস্যা হয়। ফ্রান্সে বেশি সমস্যা। তবে কানাডায় সে ওটা অনুভব করেনি। সবাই তার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলেছে। আমার কথা বলল। মারিওনা ওর লেখায় জেন্ডার সেনসেটিভ শব্দ ব্যবহার করে সচেতনভাবে। বললাম, বাংলাতেও আমি চেষ্টা করি লৈঙ্গিক বিষয়টি যেন অসংবেদনশীল না হয়।
মারিওনা পরিচয় করিয়ে দিল টিফের মিডিয়া উইংয়ের কর্মকর্তা সোফিয়ার সঙ্গে। কেমন লাগল টিফ জিজ্ঞেস করাতে বললাম, প্রচুর ‘সোফিয়া’ অর্জন করলাম এই কদিনে, ২৬টি ছবি কম তো নয়! সোফিয়া আশ্চর্য হয়ে বলল, ছা-ব্বি-শ-টি ছবি? আমি বললাম, পরে জানাবে কেউ আমার রেকর্ড ব্রেক করেছে কি না। সোফিয়াকে আরও বললাম, টিফ বেশ উষ্ণ ও আন্তরিক। করপোরেটগন্ধী নয় সেভাবে। শুনে আপ্লুত হলো সোফিয়া। মারিওনা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমিও সোফিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দিলাম স্কশিয়াব্যাংকের দিকে। শেষ ছবি দেখব জাপানের ‘এভিল ডাজ নট এক্সিস্ট’, পরিচালক রাইয়ুসুকে হামাগুচি। হামাগুচি এরই মধ্যে বেশ বিখ্যাত হয়ে গেছেন ‘ড্রাইভ মাই কার’ পরিচালনা করে। ফেস্টিভ্যাল ও আর্ট হাউস ফিল্ম সার্কিটে হামাগুচি বেশ পরিচিত নাম। যাহোক, আমি অফিসের জন্য একটা লাইভ দিয়ে ধীরে ধীরে প্রবেশ করলাম স্কশিয়াব্যাংকের আইম্যাক্স থিয়েটারে। এই জায়গাতে আজই প্রথম ছবি দেখব।
আইম্যাক্সের স্ক্রিন বিশালাকৃতির। ৫২ গুণ ৭২ ফুট। এখানে ছবি দেখার অভিজ্ঞতা ভিন্ন। একদম পেছনের সারিতে গিয়ে বসলাম। শুরু হলো ‘অশুভ বলে কিছু নেই’। ছবির প্রারম্ভিক দৃশ্যের ভেতরেই হর্ষ-বিষাদমাখা প্রকৃতির দেখা মেলে। ফ্রেমের ব্যাকগ্রাউন্ডে সফেদ বরফে ঢাকা পর্বতমালা, ফোরগ্রাউন্ডে ঘন সবুজ বন, তার আকাশ ঢাকা গাছগাছালিতে, ঝরনার পানি প্রবাহিত হওয়ার মৃদু শব্দ, বুনো হাঁস ও পাখিদের কলকাকলি। এই বনানীতে বাস করে গুটিকয় পরিবার। তাদের ভেতর দেখা যায় তাকুমি ও তার আট বছরের মেয়ে হানার সহজ-সরল জীবনযাপন। মেয়েকে কাঁধে নিয়ে বিভিন্ন গাছের নাম শেখাতে শেখাতে বাবা বাড়ি ফেরে স্কুল থেকে। কন্যার প্রকৃতিপাঠ পিতার কাছে। অপার্থিব দৃশ্য মনে হয়েছে আমার কাছে। কিন্তু এই স্বর্গে ভাগ বসাতে চায় শহুরে পুঁজিবাদ ও লোভী শিকারির দল। হরিণ শিকারের লোভে, রিসোর্ট ও ক্যাম্পিং নির্ভর পর্যটনের লোভে টাকাওলারা ঢুকে পড়তে চায় এই ভূস্বর্গে, তাদের উদ্দেশ্য মুনাফা। প্রকৃতি ও এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষের ব্যাপারে তারা অনাগ্রহী।
অঞ্চলের উন্নয়নের নামে যেকেনো মূল্যে এখানে ‘গ্ল্যাম্পিং’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায় এক কোম্পানি। কিন্তু এলাকার মানুষ এতে রাজি নয়, কারণ এই ‘গ্ল্যামারাস ক্যাম্পিং’ হওয়া মানে এখানকার পানি দূষিত হবে, স্থানীয় দোকানপাট মার খেয়ে যাবে এবং এখানকার জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। নাছোড়বান্দা কোম্পানির লোক। তারা দুজনকে পাঠায় গ্রামের সবচেয়ে বিচক্ষণ লোক তাকুমির কাছে। কিন্তু তাকুমি বিক্রি হওয়ার পাত্র নয়। স্লো বার্নিং এই ছবির পরতে পরতে দৃশ্যমান হতে থাকে শহুরে বড় পুঁজি ও লোভী শিকারিদের প্রকৃতি ধ্বংসের চিত্র। শেষ দৃশ্যে দেখা যায় গুলির শব্দ, ছোট্ট মেয়ে হানাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে যায়। বাবা তাকুমি খুঁজতে খুঁজতে হাজির হয় বনের প্রান্তে, সেখানে সে দেখে গুলিবিদ্ধ এক ঘাই হরিণী, পাশেই বসে আছে মেয়ে হানা। পরের শটে হরিণটা নেই, খোলা প্রান্তরে পরে আছে হানার নিথর দেহ। মেয়ের লাশ দেখে বাবা আক্রোশে ফেটে পড়ে, টুঁটি চেপে ধরে কোম্পানি থেকে পাঠানো লোকটির। এরপর মেয়ের মৃত মুখ নিজের হাতে তুলে নেয় বাবা। এই জায়গাটি অনির্বচনীয় কাব্যিক ও করুণরসে পূর্ণ। শেষ দিনে এসে এত অপূর্ব একটি ছবি দেখে মনটা সত্যি আনন্দে ভরে গেল।
ঘড়িতে তখন বিকাল চারটা। সন্ধ্যায় ভোজের দাওয়াত আছে। বন্ধু সৈকত তার স্ত্রী নিয়ে আসবে স্কারবোরোর বাঙালি হোটেল ‘আড্ডা’য়। আমি তাই দ্রুত স্টেশনের দিকে হাঁটা দিই। ট্রেনে উঠলাম যথারীতি। দুই নম্বর লাইনের পূর্ব দিকের ট্রেনে চড়েছি, গ্রিনউড স্টেশনে এসে ট্রেন থেমে গেল। বলছে, একজন অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তার জন্য মেডিকেল টিম আসছে। দেখলাম পাঁচ মিনিটের ভেতর একটি মেডিকেল টিম চলে এলো বিছানাসহ। এরপর ট্রেন ছাড়ল। ট্রেনের ভেতরেই এগিয়ে এলেন এক বয়স্ক মানুষ। তাকে আমি ফেস্টিভ্যালে দেখেছি। তিনিও আমাকে এসে বললেন, তুমি তো আজ টিফের অনুষ্ঠানে ছিলে। ছিলাম তো। ভদ্রলোকের নাম ডিন ক্যামেরন। স্পেনের লোক। কিন্তু টরন্টোতে থাকে। একটি পত্রিকায় কাজ করেন, পাশাপাশি অনুবাদ ও ভাষা শেখান। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে জনৈকা রেজোয়ানা বলে এক বাংলাদেশি নারীর কথা বললেন, তার বন্ধু। রূপের খুব প্রশংসা করলেন। বললেন, ঈশ্বর নারীদের অনেক সুন্দর করে গড়েছেন। আমি বললাম, আলেলুইয়া!
ট্রেন থেকে নেমে তেইশ নম্বর বাসে চড়ে ভাবলাম সাঙ্গ হলো এবারের মেলা। আরও গোটা চারেক দিন যে আছি কানাডায়, এবার পুরো সময়টা দেব পরিবারকে। উৎসব ও উৎসবে দেখা ছবিগুলো নিয়ে একটি পর্যালোচনামূলক নাতিদীর্ঘ রচনা দিয়ে শেষ করব ‘টরন্টো টকিজ’।