বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের সূচনা হয় গদ্যের মাধ্যমে। কবিতার সঙ্গে যুক্ত হয় কথাসাহিত্য। সে হিসেবে প্রবন্ধ খুব প্রাচীন শাখা নয়। এই শাখায় খুব বেশি লেখকও খুঁজে পাওয়া যায় না। কেউ কেউ তথ্য, তত্ত্ব ও উৎসের সন্ধান করতে গিয়ে প্রবন্ধ লেখেন। প্রবন্ধ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ‘বাংলা সাহিত্যের একাল-সেকাল’ লেখক সালাহ উদ্দিন মাহমুদের প্রবন্ধের বই।
বইটিতে মোট দশজন কবি-সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্ম নিয়ে বিষয়ভিত্তিক চমৎকার আলোচনা করেছেন লেখক। এই দশজন কবি-লেখকের মধ্যে পাঁচজন প্রয়াত হয়েছেন। ভূমিকায় লেখক বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও হুমায়ূন আহমেদের কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাকি পাঁচজন এখনো সাহিত্যচর্চা করে যাচ্ছেন। সেই অর্থে তাদের নিয়ে আলোচনা সামগ্রিক নয়। সাময়িক ছায়াপাত বলা যেতে পারে। তবে এই দশ রত্ন বাংলা সাহিত্যে হীরার চেয়েও দামি, তা বলতে দ্বিধা নেই।’
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ তার প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সোনার তরী’ কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। ‘সোনার তরী’ কবিতায় কাটা ধান নৌকা বোঝাই করার ঘটনাকে উপলক্ষ করে কবি জীবনের একটি সাময়িক বিষাদ করুণ মনোচ্ছবি চিত্রিত হয়েছে। কবি যেখানে তাঁর কর্মের ইতি টানতে চান, কবির প্রেরণাদাত্রী সেখানে তাঁকে দাঁড়ি টানতে দেন না। তাই বেদনার মধ্যেও আশ্বাসের একটি ব্যঞ্জনার আভাসও এই কবিতায় পাওয়া যায়। অন্যদিকে কবিতার মধ্যে ভরা বর্ষার ছবি ও গতি সুস্পষ্ট হয়ে আছে। কবিতাটির রচনাকাল ফাল্গুন ১২৯৮ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ইংরেজি ১৮৯২ সাল। ভরা বসন্তে কবি ভরা বর্ষার কথা লিখেছেন। তাই ‘সোনার তরী’ প্রসঙ্গে বলা যায়, কবিতাটি সেই জাতের কবিতা ‘যা মুক্তদ্বার অন্তরের সামগ্রী, বাইরের সমস্ত কিছুকে আপনার সঙ্গে মিলিয়ে নেয়’।
‘জীবনজয়ী কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন’ শিরোনামের প্রবন্ধে সেলিনা হোসেনকে নিয়ে লেখক আলোচনা করেছেন। তিনি যুক্তিসঙ্গতভাবেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, তাঁর সৃষ্টিকর্মে নারী চরিত্রগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। তিনি সব সময়ই রাজনীতি সচেতন ও সময় সচেতন লেখক। সেলিনা হোসেন বাংলা সাহিত্যের একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। এমনকি জীবনানন্দ দাশের চোখে হেমন্তের রূপরেখা কেমন? সে বিষয়েও তিনি আলোচনা করেছেন। আলোচনা করেছেন ফারুক মাহমুদের কবিতার বিষয়-বৈচিত্র্য সম্পর্কে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির ইতিহাস উঠে এসেছে কবি কামাল চৌধুরীর কবিতায়। সে প্রসঙ্গে বিস্তর আলোকপাত করেছেন লেখক।
‘‘সাম্যবাদী’ কবি নজরুলের সমকালীন ভাবনা’ প্রবন্ধে লেখক কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদী সৃষ্টির অনন্যতাকে চিহ্নিত করে বলেছেন, ‘‘যেহেতু সাম্যবাদ বাংলা সাহিত্যে নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে কাজী নজরুল ইসলাম যে মমতায় মানবতা মিশ্রিত এ বিষয়গুলোর প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন, তা একান্তই অভিনব। এখানেই নজরুলের কবি চেতনার নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে।”
‘বঙ্গবন্ধুর লেখা বই বাংলা সাহিত্যে অসামান্য সংযোজন’ প্রবন্ধে লেখক বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাঙালি জাতির পথপ্রদর্শক। বাঙালি জাতির পিতা, স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি (১৭ মার্চ ১৯২০–১৫ আগস্ট ১৯৭৫)। কেবল একজন জনদরদী নেতাই ছিলেন না। তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতির অনুরাগীও ছিলেন।’ যার প্রমাণ পাই আমরা তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়াচীন’ নামক বইয়ে। যদিও তিনি সাহিত্যে স্থান করে নেওয়ার জন্য লেখেননি। নিজের তাগিদে সময়ের প্রয়োজনে লিখেছেন। তাঁর সেই লেখাই এখন আমাদের আকাঙ্ক্ষা এবং জিজ্ঞাসাকে নিবৃত্ত করছে।
হুমায়ূন আহমেদ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজপুত্র। হুমায়ূন আহমেদের নাটকে মুসলিম রীতি-নীতি শীর্ষক আলোচনায় তিনি একস্থানে অভিমত প্রদান করেছেন, “ধর্মকে আঘাত না করেও অধর্ম বা গোঁড়ামিকে তুলে এনেছেন হাস্যরসে। জীবনকে পরিমাপ করেছেন বিজ্ঞ জহুরির দৃষ্টিতে। অন্যায়কে পরিহাস করেছেন উপমাচ্ছলে। অসঙ্গতিকে আঘাত করেছেন কোমল অথচ উদ্ধত ভঙ্গিতে। এত গুণের সমাবেশ কেবল হুমায়ূন আহমেদের রচনা কিংবা নির্মাণেই সম্ভব হয়েছে। ‘জনপ্রিয়’ শব্দটিকে তিনিই বহুল আলোচনায় নিয়ে এসেছেন। সাহিত্য সমাবেশে কিংবা চায়ের কাপে ঝড় তুলেছে তাঁরই নাম। অথচ কখনোই জনপ্রিয় শব্দের পেছনে ছোটেননি তিনি। নীরবে নিভৃতে কাজ করে গেছেন।”
‘আমিনুল ইসলামের কাব্যভাষায় নদী-প্রকৃতির স্বরূপ’ প্রবন্ধে লেখক বলেছেন, ‘কবি আমিনুল ইসলাম (২৯ ডিসেম্বর ১৯৬৩) কোন দশকের কবি, তা বিবেচ্য নয়। দশক চিন্তা এখানে মুখ্যও নয়। তার কবিতাই তাকে সর্বজনগ্রাহ্য করে রাখবে। দশকের পর দশক তিনি পঠিত হবেন। পাঠকের অন্তরে গেঁথে থাকবে তার কবিতার অমর পঙক্তিমালা।’ প্রবন্ধে লেখক উল্লেখ করেছেন, তাঁর কবিতায় শব্দের যে খেলা, তা আলোড়িত করে পাঠকের মন। কেননা তাঁর কবিতায় মানুষ, প্রেম, ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রকৃতি, প্রত্নতত্ত্ব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
তপন বাগচী একাধারে কবি, গল্পকার, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও গবেষক। তাঁর জন্ম ১৯৬৮ সালের ২৩ অক্টোবর মাদারীপুরের কদমবাড়ি গ্রামে। বাবা তুষ্টচরণ বাগচী ও মা জ্যোতির্ময়ী বাগচী। তাঁর লোককবি বাবাকে নিয়ে এখন গবেষণা হচ্ছে। তপন বাগচীকে নিয়েও একাধিক গবেষণাকর্ম সম্পন্ন হয়েছে। কিছুকাল সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বর্তমানে কর্মরত বাংলা একাডেমির উপপরিচালক হিসেবে। নব্বই দশকের শীর্ষস্থানীয় কবি, প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক ড. তপন বাগচী। তাঁর প্রধানতম বিষয় নান্দনিকতা তথা শিল্পকলার নানা অনুষঙ্গ, মিথ ও সাহিত্য-ঐতিহ্য যে-পাত্রে পরিবেশিত হওয়ার যোগ্য, তেমন ক্ল্যাসিকধর্মী আঙ্গিকও তিনি বেছে নিয়েছেন। ছন্দ-অন্ত্যমিলসমৃদ্ধ গাঢ় উচ্চারণ তার কবিতাকে বিশিষ্টতা দান করেছে।
মূলত সালাহ উদ্দিন মাহমুদের গদ্যের ভাষা সাবলীল, পরিষ্কার এবং সহজবোধ্য। পাণ্ডিত্যের কচকচানি নেই তাঁর কোনো বাক্যে অথবা অভিমতে। তিনি একইসঙ্গে কবি-কথাসাহিত্যিক বলে তাঁর গদ্যের ভাষা সচ্ছল ও উপভোগ্য। ‘বাংলা সাহিত্যের একাল-সেকাল’ বইটি অনবদ্য লেগেছে আমার কাছে। লেখক বেশ দারুণভাবে গুছিয়ে কবি-লেখকদের নিয়ে আলোচনা করেছেন বইটিতে। সব মিলিয়ে বইটি আমার কাছে সুখপাঠ্য লেগেছে। এছাড়া বইয়ের কাগজ এবং বাইন্ডিং, প্রচ্ছদ সবই ছিল অসাধারণ। আমি বইটির বহুল প্রচার ও প্রসার কামনা করছি। ২০২৩ সালের বইমেলা উপলক্ষে বইটি প্রকাশ করেছে কিংবদন্তী পাবলিকেশন। প্রচ্ছদ করেছেন চারু পিন্টু। বিক্রয় মূল্য ৩০০ টাকা। লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন তার সদ্যপ্রয়াত বাবা জেড এম এ মাজেদকে।