পশ্চিমবাংলায় গত বছর এসেছিল অনীক দত্তর বানানো ‘অপরাজিত’। খোদ নন্দনেই হল পায়নি ছবিটা। কলকাতায়ও বেশি হল আর শো পাওয়া হয়নি প্রথম সপ্তাহে। বাংলা ছবির যে খারাপ দশা তাতো নতুন করে বলার নেই। তবুও নতুন ‘অপরাজিত’ যারা দেখেছেন, তাদের নাকি বেশ লেগেছে। তারপর লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছে এর অসাধারণত্ব। দারুণ ব্যবসা করেছিল ছবিটি। সত্যজিতের প্রথম ছবি বানানোর গল্পটাই অনীক দত্ত নতুন ছেলেমেয়েদের দিয়ে রূপালি পর্দায় এনেছেন। মৃণাল সেন বেঁচে থাকলেও হয়তো ভালো বলতেন কিংবা কড়া ভাষায় এক সমালোচনা লিখতেন। মৃণাল সেনকে নিয়েও সৃজিত মুখার্জি বানাচ্ছেন বায়োপিক, জানি না সেটা কেমন হবে।
মৃণাল সেনের একটা বিশ্বাস আমার বেশি প্রিয়। তিনি বলে গেছেন, “বাংলা সিনেমা বলে অধিকতর আবেগ তার ভালো লাগতো না। ভালো গল্পের তামিল চলচ্চিত্র করতেও আপত্তি নেই। তার দরকার শুধু ভালো চলচ্চিত্রটাই বানানো।” তিনি জানতেন সত্যজিতের দেখানো পথেও হাঁটবেন না, আবার আরেকটা ঋত্বিক ঘটকও তিনি হবেন না। তাই তিনি আজীবন এমন সিনেমা করেছেন যা আমাদের নাগরিক মিডিয়োক্রোটি ও মূল্যবোধের অবক্ষয়কে প্রশ্ন করবে। চলচ্চিত্র মানে তাঁর কাছে চলচ্চিত্রই হতে হবে, ভাষা ন্যারেটিভ ও মানে নতুন কিছু বলতে হবে। আজ তার শততম জন্মবার্ষিকী। ২০১৮ সালে চলে না গেলে হয়তো বলতেনই, “ওসব দিবস কেন্দ্রিক মাখোমাখো আবেগ আমার জন্য না।”
মৃণাল সেনরা শেষ প্রজন্ম, যারা সিনেমা দেখার আগে সিনেমা নিয়ে শত শত বই পড়েছেন। আর্নেস্ট হেমের ‘সিনেমা এন্ড আর্টস’ নামে ১৯৪৩ সালে বের হওয়া একটা বই পড়েই তিনি এত মুগ্ধ হন যে কলকাতায় চলচ্চিত্র বিষয়ক যত বই পাওয়া যেত সবই তিনি পড়ে ফেলতেন। ফরিদপুরে জন্ম নেওয়া এই মনীষী পড়াশোনা করেছেন পদার্থবিদ্যা, রসায়নে। সাংবাদিকতা, ওষুধ কোম্পানির চাকরি, এমনকি চলচ্চিত্রের শব্দ গ্রহণের সহকারীতেও তিনি কাজ করেছেন। জড়িত ছিলেন আইপিটিএর সঙ্গে, সারা জীবনই তিনি পড়াশোনা করতে ভালোবাসতেন। ওনার প্রথম ছবি, ‘রাত ভোর’ তেমন চলেনি। সমালোচকরাও আকর্ষণ পায়নি ছবিটায়। সেই ব্যর্থতার দায় নিয়েই তিনি বানান ‘নীল আকাশের নীচে’ আর ‘বাইশে শ্রাবণ’। দুটো ছবি দর্শক লুফে নেয়। তারপর তিনি আর জনপ্রিয়তার মোহে সিনেমা বানাননি। ‘আকাশ কুসুম’ এ তিনি যে গল্পটা বলেন, তা এর আগে বাংলা সিনেমায় কেউ আনেনি। ‘ভুবন সোম’ থেকেই তাঁর নতুন যাত্রা শুরু।
ইউরোপীয় মায়েস্ত্রোদের এরচেয়ে যোগ্য ট্রিবিউট আর কোনো ভারতীয় পরিচালক দিয়েছেন বলে আমার মনে পড়ে না। উৎপল দত্তের কী যে ভালো অভিনয়। অমিতাভ বচ্চনের প্রথম চলচ্চিত্র তার এক ছবিতে ভয়েস দিয়েই। নায়ক মিঠুন চক্রবর্তীকে জাত অভিনেতা বানিয়েছেন তিনি। তারপর থেকে তিনি ছাড়িয়ে গেছেন নিজেকেই। গল্প এবং আঙ্গিকই তার ছবির হিরো। কলকাতা ট্রিলজির মাধ্যমে পেয়েছেন ভারতীয় সিনেমা দিকপাল নির্মাতা হবার সম্মান। আর ‘আকালের সন্ধান’ ও ‘চালচিত্র’ দিয়েছে বিশ্বের অন্যতম মৌলিক চলচ্চিত্র পরিচালকের মুকুট।
শিল্পী কবীর সুমনের একটা গল্প আছে। সুমন তখন জার্মানিতে এক টেলিভিশনে চাকরি করতের। ‘আকালের সন্ধানে’ এর জার্মান ডাবিং খুবই ভালো ছিল। সুমনের বান্ধবী এই সিনেমা দেখে এত ইমপ্রেস হয়েছিলেন যে আবার সুমনের প্রেমে পড়েন। ক্যাথেরিন নামের সেই মেয়ের যুক্তি ছিল, “এরকম সিনেমা যে বানায় তার শহরের এক মানুষকে চোখ বুজে ভালোবাসা যায়।” রোমান পোলানস্কি থেকে শুরু করে কে ছিল না তাঁর ভক্ত। চার্লি চ্যাপলিনের মত মানুষের সঙ্গে তিনি উৎসবের মঞ্চ শেয়ার করেছেন।
বহুদিন পর সেদিন টিভিতে ‘চালচিত্র’ দেখাচ্ছিল। মৃণাল সেনের কাজ কত দারুণ। সমাজের বিদ্যমান অবস্থাকেই তিনি তুলে ধরেছেন। দীপু নামের চরিত্র কেচ্ছা খুঁজে বেড়ায়। সম্পাদক শিখিয়ে দেয়, পাবলিক খাবে এমন গপ্পো চাই। দীপুর মাও অদ্ভুত, জানলা বন্ধ করে রাখে যেন উনুনের ধোঁয়া পাশের উচ্চবিত্ত পরিবারের কাছে না যায়, তাতে সম্মানহানি হবে। ছেলের কাছে আবদার সামান্যই, একটা গ্যাসের সিলিন্ডারের। ওদিকে নায়ক দীপুর টাকা পয়সা নাই। কিন্তু সে ট্যাক্সি খুঁজে বেড়ায়। ছবিতে মধ্যবিত্তের যে নীতি বহির্ভূত আকাঙ্ক্ষা, তাকে খুবই সাটেলভাবে মক করাই ছিল মৃণাল সেনের লক্ষ্য। সারা জীবন মার্ক্সসীয় দর্শন, অস্তিত্ববাদ, অভিব্যক্তিবাদ, মানবতাবাদ—এসবেরই একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন মৃণাল সেন।
মৃণাল সেন নিজেকে কখনো অবসরে আছেন ভাবতেন না। জীবনের শেষদিকে এসেও তিনি প্রান্তিক মুসলমানদের জীবন নিয়ে বানিয়েছেন ‘আমার ভুবন’। সিনেমাটা নিঃসন্দেহে তাঁর সেরা কাজগুলোর ভেতরে থাকবে না। কিন্তু তিনি যে কী পরিমাণ কমিটেড পরিচালক, তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ভারতের অনেক পরিচালকের সিনেমায় মুসলমান নেই, তিনি ব্যতিক্রম। কাশ্মীরে ভারতীয় আগ্রাসন নিয়ে ছিলেন সোচ্চার। যেকোনো সরকারি নিপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করেছেন। আপোষহীনতা তার সবচেয়ে শক্তি। বাংলাদেশের পরিচালকদেরও তিনি চিনতেন। আফসোস করতেন, এদিকে কেন প্যারালাল সিনেমা ভালোভাবে দাঁড়ালো না। প্রয়াত মুহম্মদ খসরু ছিল তার বন্ধু। আলমগীর কবিরের ছবি তিনি ভালোবাসতেন। অনেকদিন আগে পানিতে ডুবে তার বোন মারা গিয়েছিল। ফরিদপুরে ভিটামাটি দেখতে এসে সেই বোনের জন্য কেঁদে ভাসিয়েছেন। কবি জসীম উদ্দীনকে খুব ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন পারিবারিক সূত্রেই। জসীমদা জসীমদা করতেন।
১৯২৩ সালের ১৪ মে জন্ম নিয়ে ২০১৮ সালে প্রয়াত হন। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা এই কিংবদন্তীকে। দেশে মৃণাল চর্চা বাড়ুক, এবারের জন্মশতবর্ষ পালিত হোক সাড়ম্বরে। যদিও তিনি ছিলেন এসব আনুষ্ঠানিকতার বিরোধী। ফুল দেওয়া, শব মিছিল, শোক সভা, ভালো ভালো কথা বলা এসব নিষেধ করেছেন জীবিত অবস্থাতেই। তাঁর চলচ্চিত্রের ভেতরেই তিনি বাঁচতে চেয়েছেন সবসময়।