মুখবন্ধ
কিছুদিন হইল—কবির দুইশত বৎসরপূর্তি উপলক্ষে—আমি ‘পারির পিত্ত’ নামে শার্ল বোদলেয়ারের কিছু কবিতার তর্জমা প্রকাশ করিতেছি। এক্ষণে ‘পারির পিত্ত’ নামটি যথার্থ মনে হইতেছে না। তাই নতুন তর্জমা করিলাম: পারির প্লীহা। অন্যান্যের মধ্যে আমার বন্ধুবর জহিরুল ইসলাম এই পরামর্শ দিয়াছেন। তাঁহার শোকর এখানে গুজার করিতেছি। ইতিপূর্বে ‘সংবাদ প্রকাশ’ পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে গোটা তিরিশ কবিতা ছাপা হইয়াছে। আরও কিছু ছাপার অপেক্ষায়।
আজিকার কিস্তিতে—ইহাকে অষ্টম কিস্তি বলা যাইতে পারে—রহিল ‘পারির প্লীহা’ পুস্তকের ৪৩ হইতে ৪৮ পর্যন্ত ছয়টি কবিতা। ৪৩ নম্বর কবিতার ফরাশি নাম ‘লো গালঁ তিরর’। বাংলা করিয়াছি ‘বীর গোলন্দাজ’। এই কবিতাটি ‘রেভ্যু নাসিওনাল এ এত্রঁজের’ নামক সাময়িক পত্রটি ১৮৬৫ সালে ছাপাইতে অস্বীকার করিয়াছিলেন। অগত্যা কবিতাটি প্রথম মুদ্রিত হয় কবির মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘পারির প্লীহা’ পুস্তকে। ৪৪ নম্বর কবিতার—‘স্যুপ আর মেঘ’ (‘লা স্যুপ এ লে নুয়াজ’)—নিয়তিও একই। দুঃখের মধ্যে, ইহাও ‘রেভু নাসিওনাল এ এত্রঁজের’ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত এবং পরে ‘পারির প্লীহা’ পুস্তকে প্রথম বিধৃত হয়।
৪৫ নম্বর কবিতা—‘চাঁদমারি ও গোরস্তান’ (‘লো তির এ লো সিমেতিয়ের’) প্রথম প্রকাশিত হয় ‘রেভু নাসিওনাল এ এত্রঁজের’ পত্রিকার ১১ অক্টোবর ১৮৬৭ সংখ্যায়—অর্থাৎ কবির পরলোকগমনের গোটা ছয় সপ্তাহ পর। ৪৬ নম্বর কবিতাটিও—‘হারানো টোপর’ (‘পের্ত দোরেওল’)—প্রথম প্রকাশিত হয় কবিবরের মরণোত্তরকালে—মোতাবেক ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত ‘পারির প্লীহা’ পুস্তকে। বলাবাহুল্য নহে, এই কবিতাটিও ১৮৬৫ সালে ‘রেভু নাসিওনাল এ এত্রঁজের’ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হইয়াছিল। এতদিনে এই কবিতাটি বোদলেয়ারের দশ সেরা কবিতার একটি বলিয়া সমাদৃত হইতেছে। বিশেষ বাহ্ল্টার বেনিয়ামিন ইহার কদর করিয়াছেন। ইহাতে মহিমার অবসান কি পদার্থ ধরা পড়িয়াছে।
৪৭ নম্বর কবিতাটিও—‘কুমারী ছুরিকা’ (‘মাদমোয়াজেল বিস্তুরি’)—১৮৬৫ সালে ‘রেভু নাসিওনাল এ এত্রঁজের’ প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন। ১৮৬৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পত্রিকাটি এই কবিতা প্রকাশিত হইবে বলিয়া তিন তিনবার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করিয়াও অবশেষে প্রত্যাখ্যানের অমর্যাদাটা প্রত্যাহার করেন নাই। এই কবিতাটিও শেষ পর্যন্ত প্রথম আলোর মুখ দেখে ১৮৬৯ সালে—অগতির গতি ‘পারির প্লীহা’ পুস্তকে। বর্তমানে ইহাও কবির শ্রেষ্ঠ কবিতার অন্তর্গত বলিয়া বিশ্বজোড়া কদর পাইতেছে।
৪৮ নম্বর কবিতার নাম ‘এই দুনিয়া বাদে আর যেখানেই হয়’ (‘অ্যানি হোয়ার আউট অব দি ওয়ার্ল্ড/ নিম্পোর্ত উ ওর দু মোঁদ’)—বোদলেয়ার ফরাশি ছাড়িয়া ইংরেজিতেই রাখিয়াছিলেন। ‘অ্যানিহোয়ার’ শব্দটি ভাঙিয়া তিনি দুই শব্দের আকারে (অ্যানি হোয়ার) লিখিয়াছিলেন। এই কবিতা প্রথম প্রকাশ করিয়াছিলেন ‘রেভু নাসিওনাল এ এত্রঁজের’ পত্রিকা—১৮৬৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর নাগাদ। সকলেই জানেন, শার্ল বোদলেয়ার পরলোকগমন করেন ১৮৬৭ সালের ৩১ আগস্ট তারিখে। এই বিচারে ২০২২ সালের এক তারিখে কবির তিরোভাবের ১৫৫ বছর পার হইবে।
এক্ষণে দুরধিগম্য দুই-চারি প্রসঙ্গে কয়েকটি টীকা সংযোজন করা বিশেষ দরকার মনে করিতেছি। ৪৫ নম্বর—‘চাঁদমারি ও গোরস্তান’—কবিতায় উল্লেখকৃত ‘গোরস্তানদর্শন, সরাইখানা’ নামের সরাইখানাটির সত্যকার দেখা বোদলেয়ার পাইয়াছিলেন ব্রাসেলস শহরের অদূরে কোন এক গ্রামে। তথ্যটা জানাইয়াছেন বোদলেয়ারের ইংরেজি অনুবাদক রেমন্ড ম্যাকেনজি। বোদলেয়ার বিশেষজ্ঞ ক্লদ পিশোয়াও জানাইতেছেন এই কবিতাটি বোদলেয়ারের বেলজিয়াম সফরের পর লেখা।
৪৪ নম্বর কবিতায় প্রাপ্তব্য ‘কু... বা...’ সংকেতটির মানে—খুব সহজেই বোঝা যায়—‘কুত্তার বাচ্চা’। এই গালমন্দ জবানটির সংক্ষেপ শার্ল বোদলেয়ার ইংরেজি বচনে লিখিয়াছিলেন ‘এস... বি...’—যাহার মানে ‘সান অব এ বিচ’। বাংলা ভাষার বিধি মানিয়া আমরা লিখিলাম ‘কুত্তির বাচ্চা’ নহে, ‘কুত্তার বাচ্চা’।
৪৭ নম্বর কবিতায় উল্লেখকৃত নাম ‘রেনিয়ের’ হইতেছেন—ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের ধ্রুপদী ফরাশি সাহিত্যসাধক সেরা বলিয়া বিশ্বনন্দিত ব্যঙ্গরসিক—অকালপ্রয়াত মাতুরাঁ রেনিয়ের (১৫৭৩-১৬১৩)। এই কবিতায় লিখিত ‘মা. সা. প. পা.’ কথাটা সাংকেতিক। ইহার পূর্ণাঙ্গ ভাষ্য হইতেছে ‘মাকরেল সাধুর পবিত্র পাপড়ি’। ইহা একপ্রকার ধর্মাবমাননাসূচক গালি বলিয়া গণ্য হইতে পারে। এই কথা ভাবিয়া বোদলেয়ার সাংকেতিক অক্ষরে লিখিয়াছিলেন ‘এস... এস... সে... দো এস... এম...!’ ইহার সম্প্রসারিত রূপ—‘সাক্রে সাঁ সিবোয়ার দো সাঁৎ মাকরেল!’—বোদলেয়ারের পাণ্ডুলিপিতে এমনটাই পাওয়া গিয়াছে। রেমল্ড ম্যাকেনজির তর্জমা: ‘স্যাক্রেড সিবোরিয়াস অব এ হলি মাকেরেল!’ একই কবিতায় উল্লেখ করা আরেকটি চরিত্র মোরাঁ—মানে আঁতোয়ান মোঁরা (১৭৯৩—১৮৬০)। এই প্রসিদ্ধ চিত্রকর লিথোগ্রাফিযোগে—অর্থাৎ পাথরের ছাপে ছাপা মুদ্রাযন্ত্রে—সমসাময়িক কালের অনেক বিখ্যাত লোকের ছবি আঁকিয়াছিলেন। বলাবাহুল্য তিনি জাতে ফরাশি। এই কবিতায় উল্লেখ করা ‘গণ্ডগোল’ শব্দে এয়ুরোপ মহাদেশের অনেক স্থলে ১৮৪৮ সালের জুন মাসে যে গণ অভ্যুত্থান ঘটিয়াছিল তাহার কথা নির্দেশ করিতেছে।
৪৮ নম্বর কবিতায়—‘এই দুনিয়া বাদে আর যেখানেই হয়’—শার্ল বোদলেয়ার সামান্য পরিবর্তিত আকারে যে ইংরেজি শিরোনাম ব্যবহার করিয়াছিলেন তাহার উৎস টমাস হুড় (১৭৯৯-১৮৪৫)। ১৮৬৫ সালে হুড়ের কবিতা ‘দি ব্রিজ অব সায়িস’ তর্জমা করিয়াছিলেন বোদলেয়ার।
এই মুখবন্ধে টীকাস্বরূপ উল্লিখিত যে সকল তথ্য পাইতেছেন তাহার সবটাই নিচের দুইটি কেতাব হইতে সংগ্রহ করা হইয়াছে। প্রকৃত প্রস্তাবে বেশির ভাগই প্রথমটি হইতে লওয়া। খোদ কবিতাগুলি প্রথম কেতাব অনুসারে অনুবাদ করা হইল। বলা নিষ্প্রয়োজন নহে, কোন কোন কবিতার কোথায়ও কোথায়ও যে সকল শব্দ কিংবা বাগধারা মোটা হরফে ছাপানো হইয়াছে সেইগুলি খোদ শার্ল বোদলেয়ার কর্তৃক নির্দেশিত। তাঁহার রচনাবলিতে বক্রাক্ষর ব্যবহার করা হইলেও আমরা কারিগরি কারণে মোটা হরফে প্রকাশ করিতে বাধ্য হইয়াছি।
২৯ আগস্ট ২০২২
দোহাই
১. Charles Baudelaire, Oeuvres complètes, I, texte établi, présenté et annoté par Claude Pichois (Paris: Éditions Gallimard, 1975), pp. 316-331.
২. Charles Baudelaire, Paris Spleen and La Fanfarlo, trans. Raymond N. Mackenzie (Indianapolis, Indiana: Hackett Publishing Company, 2008), p. 90.
৪৩
বীর গোলন্দাজ
গাড়িটি যখন বনভূমি পার হইতেছে তখন এক চাঁদমারির পাশে তিনি গাড়ি দাঁড় করাইতে বলিলেন। বলিলেন, মনে হইতেছে সময় ঘায়েল করিবার পক্ষে কয়েকটা গুলি খরচ করাই যুক্তিযুক্ত; আর ঐ দানবটি ঘায়েল করাই তো সর্বসাধারণের পক্ষে সর্বাধিক স্বাভাবিক, সর্বোচ্চ বিধিসম্মত, কাজ! এই বলিয়াই তিনি তাহার প্রিয়তমা, মধুরতমা, আর অসহনীয়া স্ত্রীরত্নের উদ্দেশ্যে বীরপুরুষের হাত বাড়াইয়া দিলেন। এই দুর্বোধ্য নারীটির কাছে তিনি আপন জীবনের যাবতীয় সুখের ঋণে, যাবতীয় দুঃখের ঋণে, আর হয়তোবা আপন প্রতিভার বড় একটা হিসসার ঋণেও ঋণী।
কয়েকটা গুলি উদ্দিষ্ট লক্ষ্য হইতে বেশ দূরে গিয়া পড়িল; এমনকি ছাদেও বিধিল একটা। স্বামীপ্রবরের অক্ষমতায় মনোহর প্রাণীটি হাসিয়া কুটিকুটি। আচমকা তাহার দিকে মুখ ঘুরাইয়া তিনি বলিলেন: “ঐখানে, ঐ ডানদিকের পুতুলটা, ঐ বাতাস বরাবর নাক-সিটকানো আর খানিক উদ্ধত স্বভাবের পুতুলটা দেখিতেছেন? আচ্ছা, প্রিয়তমা আমার—ধরিয়া লইলাম ঐটাই আপনি!” দুই চোখ বন্ধ করিয়া ঘোড়া টিপিলেন তিনি; পুতুলের মাথাটা আচ্ছামত উড়িয়া গেল।
তাই তিনি তাহার প্রিয়তমা, মধুরস্বভাবা, অসহনীয়া স্ত্রীরত্নের—আপনকার অনিবার্য আর অনমনীয় কলাদেবীর—উদ্দেশ্যে মাথা নত করিয়া আর শ্রদ্ধাভরে হস্তচুম্বন করিয়া যোগ করিলেন: “আহা! প্রিয়তমা পরীরাণী আমার, এই লক্ষ্যভেদে সাহায্য বাবদ আপনাকে ধন্যবাদ জানাইবার ভাষা কোথায় পাই!”
৪৪
স্যুপ আর মেঘ
আমার প্রিয়তমা বিড়ালিনী আমাকে সান্ধ্যখাবার পরিবেশন করিয়াছেন, আর খোদাতায়ালা যে চলমান স্থাপত্যের, অধরা-মাধুরীর যে অনবদ্য কাঠামো গড়িয়াছেন খাবারঘরের খোলা জানালা দিয়া তাহা বাষ্প দেখিতে দেখিতে ভাবিতেছিলাম আমি। মনে মনে বলিতেছিলাম: “এই আকাশকুসুমরাজি তো সৌন্দর্যে আমার এই সুন্দরীতমা প্রিয়তমা, আমার দানবতুল্যা হরিতনয়না ক্ষুদে বিড়ালিনীর চোখের প্রায় সমতুল্য।”
এমন সময় ঠাহর পাইলাম আচমকা আমার পিঠে মারাত্মক একটা কিল পড়িয়াছে। শুনিতে পাইলাম খসখসে, কামাতুরা, হিস্টিরিয়াগ্রস্ত আর কারণবারিসিঞ্চিত একটা কণ্ঠ, কণ্ঠস্বরটা আমার এই মধুর ক্ষুদে প্রিয়তমার, বলিতেছে: “আপনি কি আদৌ আপনার ঝোলটা গিলিবেন না, কু... বা..., মেঘ-ব্যাপারির পুত?”
৪৫
চাঁদমারি ও গোরস্তান
—গোরস্তানদর্শন, সরাইখানা।—“সরাইখানার পক্ষে অদ্ভুত নাম বটে”—কথাটা বলিলেন আমাদের মুসাফির, “তবে তৃষ্ণা উদ্রেকে সার্থক নিঃসন্দেহে! নির্ঘাত দাঁও মারিয়াছেন দোকান-মালিক, হোরেস আর এপিকুরসের ভাবশিষ্য কবিদের গুণের কদর তিনি করিতে জানেন নির্ঘাত। হয়তোবা প্রাচীন মিশরওয়ালাদের মর্মান্তিক সংস্কৃতরুচির পরিচয়ও রাখেন কিছুটা, উহাদের পক্ষে কংকাল কিংবা এই জীবনের হ্রস্বতাস্মারক অন্য কোন চিহ্ন ছাড়া উৎসবই সার্থক হইত না।”
সীমানার ভেতরে গেলেন তিনি, সারি সারি সমাধির মুখোমুখি বসিয়া একপাত্র বিয়ার সেবন করিলেন আর ধীরেসুস্থে একটা চুরুটও ধরাইলেন। অতঃপর গোরস্তানে নামিবার একটা বাতিক চাপিল তাহার মাথায়। এই জায়গার ঘাসটা না ভারি উঁচা উঁচা আর আদর-অভ্যর্থনায়ও বেশ উন্মুখ। আর কি উজ্জ্বল আলোটাই না ফেলিয়াছে সূর্য!
প্রকৃত প্রস্তাবে সেখানে আলো আর উত্তাপের রাজত্ব। বলা যায় মাতাল সূর্য মরদেহের উর্বর সারে লক লক করিয়া বাড়িয়া ওঠা ফুলের গালিচায় নিজেকে লম্বালম্বি ছড়াইয়া দিয়াছে। জীবনের প্রগাঢ় কোলাহল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব-জীবনের আওয়াজে বাতাসটা ভারি করিয়া তুলিয়াছে। অদূরের একটা চাঁদমারি, তাহাতে গোলাগুলি ফোটার পটপট আওয়াজ আসিয়া এই কোলাহলটা—নিয়মিত বিরতি সহকারে—ভঙ্গ করিতেছিল। আওয়াজটা ফুটিতেছিল গানবাজনার আওয়াজের মধ্যে মুখে কুলুপ আঁটা শ্যাম্পেনের ছিপি বিস্ফোরণের মতন।
রোদে তাহার মাথার খুলিটা তাতাইতেছিল আর মৃত্যুর সনির্বন্ধ সুবাসের আবেষ্টনে গোবরের উপর তিনি বসিয়াছিলেন। যে আসনে তিনি বসিয়াছিলেন তাহার তলা হইতে একটা গলার ফিসফিস আওয়াজ শুনিতে পাইলেন তিনি। ঐ গলাটায় বলিতেছিল: “আপনাদের এই চাঁদমারি আর আপনাদের কামান-বন্দুকের উপর গজব নাজেল হউক! উচ্ছৃংখল জীবাত্মার দল আপনারা, যাহারা বিগতপ্রাণ তাহাদের আর যাহারা পারলৌকিক আশ্রমে ঠাঁই লইয়াছেন তাহাদের এহেন থোড়া পরোয়াই করেন আপনারা! গজব নাজেল হউক আপনাদের উচ্চাভিলাষে, আপনাদের হিসাব-নিকাশে। বেসবুর জীবাত্মার দল, মৃত্যুর অভয়াশ্রম ঘেঁষিয়া খুনশিল্পের কায়দাকানুন শিখিতে আসিয়াছেন আপনারা! যদি শুদ্ধমাত্র এইটুকু জানিতেন যে এই পুরস্কারটা অর্জন করা কত না সহজ! লক্ষ্যটা স্পর্শ করা কত না সহজ! একমাত্র মৃত্যুর কথা ছাড়িয়া দিলে অন্য সবকিছুই শূন্যগর্ভ—এ কথাটা জানিলে, পরিশ্রমজীবী জীবাত্মার দল, আপনারা হয়তোবা কখনও এতটা হয়রান করিতেন না নিজেদের; আর যাহারা অনেক অনেক দিন আগেই স্ব স্ব জীবনের লক্ষ্যে, এই জঘন্য জীবনের একমাত্র সত্যকার লক্ষ্যে, উপনীত হইয়াছেন তাহাদের ঘুমটাও এমন ঘন ঘন ব্যাহত করিতেন না!”
৪৬
হারানো টোপর
“ওমা! একি দেখিতেছি! আপনি এখানে, বন্ধুবর? আপনি, এই বদখত জায়গায়! আপনি না নির্যাসপিপাসু! আপনি না অমৃতসেবী! প্রকৃত প্রস্তাবে এই ব্যাপারটাই আমাকে বিস্ময়ে অভিভূত করিতেছে।”
“বন্ধু আমার, জানেনই তো আপনি, ঘোড়ায় আর গাড়িতে আমার বড়ই ভয়। এই একটু আগে বড় তাড়াহুড়ায় সদর রাস্তাটা পার হইতেছিলাম। সেখানে মৃত্যু চারিদিক হইতে একসঙ্গে লাফাইয়া আসিতে থাকে। ঐ চলন্তিকা নৈরাজ্যের মধ্যে কাদার কুঁড়েটা ডিঙাইয়া যেই একটা লাফ দিলাম আচমকা আমার মাথার টোপরটা এক ধাক্কায় খসিয়া খোয়ার কুঁড়ে পড়িল। জিনিশটা আবার কুড়াইয়া লইবার সাহস জুটিল না আমার। মুকুট হারাইবার বেদনা হাড্ডি ভাঙাভাঙির কারণ হইবার চাহিতে কম দুর্ভাগ্যের মনে হইল। একটু পরে মনে মনে বলিলাম, কোন কোন দুঃখ হয়তোবা সৌভাগ্যের বার্তাও বহন করিয়া আনে! এখন আমিও আর দশটি সাধারণ প্রাণীর মতন লোকচক্ষুর অগোচরে চলাফেরা করিতে পারি, পারি ছোটলোকের মতন ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত হইতে আর আত্মসমর্পণ করিতে জঘন্যের করতলে। এই তো আমি, যেমন দেখিতেছেন, গোঁফে-লক্ষণে সর্বদিক বিচারে আপনারই মতন আছি।”
—“আপনার তো কমপক্ষে একটা হারানো বিজ্ঞপ্তি সাঁটা কিম্বা বিজ্ঞপ্তি হাতে পুলিশের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।”
—“ও আল্লাহ! মোটেই না! আমার তো এখানেই ভালো লাগিতেছে। আমাকে চিনিতে পারিয়াছেন শুদ্ধমাত্র আপনিই। তাহাছাড়া মানসম্ভ্রম জিনিশটা আমাকে বেশ বিরক্তই করে। তারপর বদ কোন কবিলোক জিনিশটা কুড়াইয়া প্রগলভ হইয়া মাথায় পরিধান করিবেন ভাবিতে বেশ মজাই লাগিতেছে আমার। অন্য কাহাকেও সুখী করিতে পারাটা যে কি মজার জিনিশ! বিশেষ এমন কাহাকেও সুখী করিতে পারা যাহাকে দেখিলেও হাসি পায়! বিসর্গ কিংবা চন্দ্রবিন্দুর কথাটা ভাবুন তো! বাহ্! কি যে মজা হইবে!”
৪৭
কুমারী ছুরিকা
শহরতলির একদম শেষমাথায়—গ্যাসবাতির আলোর নিচে—পৌঁছিয়াছি। এমন সময় ঠাহর হইল আমার বাহুর তলায় আলগোছে আরেকটা বাহু ঢুকিয়া পড়িয়াছে। শুনিতে পাইলাম একটা কণ্ঠ আমার কানে কানে বলিতেছে: “আপনি ডাক্তার না, মহাশয়?”
তাকাইয়া দেখিলাম; লম্বা তাগড়া একটি তরুণী, আঁখি ডাগর ডাগর, মুখে হালকা প্রসাধনের ছাপ, খোঁপাবাঁধা চুল সফিতা বাতাসে দোল খাইতেছে।
“না তো! আমি ডাক্তার নহি। পথ ছাড়ুন।”
“আজ্ঞে! জ্বি! আপনি ডাক্তার, ভালোই তো দেখা যাইতেছে। আমার বাসায় চলুন না, ওখানে আপনার বেশ ভাল লাগিবে, আসুন না!”
“নিঃসন্দেহে যাইব, তবে আজ নয়, কিছুদিন পর। ডাক্তার সাহেবের পর, কোন শয়তানের...!”
অনুক্ষণ আমার বাহু ধরিয়া ঝুলিয়া রহিল সে আর অট্টহাসিতে ফাটিয়া পড়িল: “হা! হা! রসিক ডাক্তার, আপনার জাতের অনেকের সঙ্গেই আমার পরিচয় আছে, আসুন না।”
রহস্যের তালগোল পাকানো ব্যাপারটা আমি প্রাণমনে পছন্দ করি, কেননা সর্বদা আশা জাগিয়া থাকে ব্যাপারটার একটা কুলকিনারা করিতে পারিব। তাই নিজেকে ছাড়িয়া দিলাম এই সঙ্গীটির হাতে—অথবা আরো ভালো হয় যদি বলি অপ্রত্যাশিত ধাঁধাটির পিছু পিছু চলিতে লাগিলাম।
খুপড়ির বিবরণটা বাদ দিতেছি; কারণ সুপরিচিত অনেক প্রবীণ ফরাশি কবির লেখায় জিনিশটা পাওয়া যাইবে। এখানে রেনিয়ের আমল করেন নাই এমন বিশেষের মধ্যে আছে শুদ্ধমাত্র দেয়ালে টাঙানো দুই কি তিনজন প্রসিদ্ধ ডাক্তারের চেহারা। কি জামাই আদরটা না পাইতেছি আমি এখানে! বিরাট আগুনের ভাঁড়, গরম গরম মদিরা আর চুরুট। উত্তম সব চিজ আগাইয়া দিতে দিতে হাস্যকর চিড়িয়াটি নিজেও একটা চুরুটে আগুন ধরাইল আর বলিল: “ও বন্ধু আমার, এই বাড়িকে আপন বাড়ি মনে করুন, সহজ হইয়া বসুন। এখানে আপনার হাসপাতাল জীবন আর সুন্দর যৌবনদিনের কথা মনে পড়িবে।—আহা, একি! আপনার চুল এরকম শাদা হইল কিভাবে? এমন তো ছিলেন না আপনি! বেশিদিন আগের কথা তো নহে, যখন আপনি এলের অধীনে শিক্ষানবিশ ছিলেন। মনে পড়ে কঠিন অস্ত্রোপচারের সময় তাঁহার সহকারীর কাজ করিতেন আপনি। লোকটা কাটিতে, ছাঁটিতে, আর ছুঁড়িয়া মারিতে ভীষণ পছন্দ করিতেন! তাঁহার অস্ত্রোপচারের সাজসরঞ্জাম, সুতাটুতা আর চোষকাগজ এসব হাতে রাখিতেন আপনি।—কিভাবে যে অস্ত্রোপচার শেষ হইবার পর হাতের ঘড়ির দিকে তাকাইতে তাকাইতে উনি বলিয়া উঠিতেন: “পাঁচ মিনিটেই, মহাশয়!”—জ্বি, হা! আমার, আমার সব জায়গায় যাওয়া-আসা আছে। এই মহাশয়দের ভালোমতই চিনি আমি!”
আর কয়েক মুহূর্ত পার হইবার পর আমার সহিত তুমি সম্বোধনে নামিয়া আদরের প্রসঙ্গটি সে আবার তুলিল আর বলিল: “তুমি তো ডাক্তার, তাই না, ও বিড়ালটি আমার?”
এই বোধাতীত ধুয়া শুনিয়া আমি ঠায় দুই পায়ে খাড়া: “মোটেও না!” রাগে গরগর করিতে করিতে বলিলাম।
“তো, শল্যচিকিৎসক?”
“নাহ্! নাহ্! অবশ্য তোমার মাথা কাটিবার কথাটা যদি ছাড়িয়া দিই! মা. সা. প. পা. কোথাকার!
সে বলিল, “তিষ্ঠ ক্ষণকাল, এই দেখাচ্ছি তোমাকে।”
একটা আলমারি খুলিয়া এক বান্ডিল কাগজ বাহির করিল সে। দেখা গেল ঐগুলি আর কিছুই নয়, মোরার আঁকা সেকালের প্রসিদ্ধ ডাক্তারদের লিথোচিত্রের সংগ্রহ। ঐগুলি কয়েক বছর পর্যন্ত ভলতেয়ার ঘাটের জেটিতে সর্বসাধারণের পক্ষে খোলা ছিল।
“থাম! থাম! এইটা চিনিতে পারিতেছ?”
“বিলকুল! এটা তো ‘এক্স’। তাহাছাড়া, নামটা তো নিচেই দেওয়া আছে। উহার সহিত আলাপ-পরিচয়ও আছে আমার।”
“জানি জানি! আরে! এই দেখ না ‘ওয়াই’। সে এক্সের কথা তুলিয়া বলিয়াছিল: “এই দানব ব্যাটা আত্মার কালিমাটা আপনকার মুখমণ্ডলে মাখিয়াছে।” তাহার সমস্ত মামলার উৎস ঐ একটাই—কোন এক রোগীর চিকিৎসায় একজন অন্যজনের দেওয়া ব্যবস্থাপত্রটা সঠিক মনে করে নাই! তখন ইহা লইয়া কলেজের সকলে কি নিদারুণ হাসাটাই না হাসিয়াছিল! মনে পড়ে?—আরে, এই দেখ না, এইটা হইল ‘কে’। এই ব্যক্তি নিজের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বিপ্লবীদের সরকারের হাতে তুলিয়া দিয়াছিল। যুগটা ছিল গণ্ডগোলের। এমন সুশ্রী চেহারার মানুষ কিভাবে এহেন হৃদয়হীন হয়?—এক্ষণে দেখ না, এই তো ‘বি’, বিখ্যাত ইংরেজ ডাক্তার। পারি সফরকালে ধরিয়াছিলাম ইঁহাকে। দেখিতে ইঁহাকে কুমারী মেয়ের মতন লাগে না, কি বল?”
যেই আমি একটা তারে মোড়া বান্ডিলে—ইহাও নিচু একটা টেবিলের উপর রাখা ছিল—হাত দিতে গেলাম অমনি সে বলিয়া উঠিল: “আরে রাখ, রাখ;—ইহা, ইহা তো শিক্ষানবিশদের আর এই বান্ডিলটা যাঁহারা বাহিরে কর্মরত তাঁহাদের।”
এইসব আলোকচিত্র হাতপাখার ঢঙে সাজাইল সে। মধ্যে শোভা পাইতেছিল অনেকগুলি অতি অল্পবয়সী চেহারা।
“আবার যখন দেখা হয়, তোমার একটা ছবি দেবে আমাকে, দেবে না, সোনামনি?”
যখন আমার পালা আসিল তখন আমিও আমার জেদটা ব্যক্ত করিলাম,—“তুমি আমাকে এইভাবে ডাক্তার ডাক্তার করিতেছ কেন?”
“তুমি যে এত ভদ্র আর এত নারী-বোদ্ধা, তাই!”
“আশ্চর্য যুক্তি তো!” আমি মনে মনে বলিলাম।
“আহা! ভুল আমার হয় কদাচিৎ। ইঁহাদের বেশ কয়জনের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। আমি এই ভদ্রলোকদের এতই ভালবাসি যে কখনো কখনো অসুখবিসুখ না হইলেও—দেখিতে যাই উঁহাদের—এমনিতেই যাই। একজন তো একবার আমাকে নিরুত্তাপ গলায় বলিয়াই বসিলেন: “আপনি তো মোটেও অসুস্থ নহেন।” কেহ কেহ আমার ভাবটা ধরিতে পারেন, আমি তাঁহাদের চোখে চোখ রাখি কিনা।”
“আর যখন তাঁহারা তোমার ভাব ধরিতে পারেন না...?”
“দূর ছাই! অকারণে তাঁহার সময় নষ্ট করিলাম বলিয়া ঝাঁকার উপর দশটা ফ্রাঁ রাখিয়া আসি।—লোকগুলি কি যে ভালো, কত যে মিষ্টি!—লা পিতিয়ে হাসপাতালে একবার এক ক্ষুদে শিক্ষানবিশের দেখা পাইয়াছিলাম। ফেরেশতার মতন সুশ্রী আর মার্জিত চেহারা তাঁহার। কি যে পরিশ্রম করিত বেচারা ছেলেমানুষটি! তাঁহার বন্ধুরা আমাকে বলিয়াছিল একটা কানাকড়িও নাই তাঁহার। পিতামাতা এতই গরিব যে কোন টাকাপয়সা পাঠাইতে পারিতেন না। জানিয়া আমার মনে আত্মবিশ্বাসের সঞ্চার হইল। শেষ কথা, খুব একটা তরুণ না হই, আমি মেয়েটা তো দেখিতে তেমন একটা মন্দও নই। বলিলাম: “আমার বাসায় আসিবে, আমার বাসায় আসিবে যখন ইচ্ছা আসিবে। আমার কাছে লজ্জার অবকাশ নাই। কিছুরই দরকার নাই, কোন টাকাপয়সা লাগিবে না আমার।”
কিন্তু বুঝিতেই পারিতেছ, কথাটা উঁহাকে শতভাষায় শোনাইবার ব্যবস্থা করিয়াছিলাম আমি; কাঁচা করিয়াও বলি নাই কথাটা, তবু ভয় হইতেছিল পাছে উঁহাকে—সোনামনিকে—অপমান করিয়া বসি!
—ও আচ্ছা! তোমার বিশ্বাস হয়, উঁহাকে একটা হাস্যকর কথা বলার ইচ্ছা আমার জাগিয়াছিল কিন্তু সাহসে কুলায় নাই?—ইচ্ছা হইয়াছিল সে হাতে ডাক্তারের ব্যাগ আর শাদা আলোয়ান পরিয়া আমাকে দেখিতে আসে। তাহাতে না হয় থাকে কয় ফোঁটা রক্তের ছিটা।”
কথাটা আন্তরিক ভাব লইয়াই বলিতেছিল সে। অনেকটা আপনার প্রিয় কোন বুদ্ধিমান অভিনেতাকে “আপনি অমুক চরিত্রে অভিনয়ের সময় যে পোশাকটা পরিয়াছিলেন সেই পোশাকে দেখিতে চাই আপনাকে”—বলার মতন।
আমার জেদটা বজায় রাখিয়া তাহাকে আবার জিজ্ঞাসা করিলাম: “কোন সময় এবং কি কারণে তোমার মনে এই আশ্চর্য আবেগটার জন্ম হইয়াছিল, মনে পড়ে?”
কি বলিতে চাহিতেছিলাম প্রকাশ করা দুঃসাধ্য হইলেও শেষ পর্যন্ত আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছিয়াছিলাম। এক পর্যায়ে আমার কথার উত্তর সে দিয়াছিল বড়ই বিষণ্ন মনে, যতদূর মনে পড়ে চোখ দুইটা অন্যদিকে ঘুরাইয়া: “জানি না... মনে পড়ে না আমার।”
আপনি যদি পথ চলিতে চলিতে মন দিয়া দেখিতে জানেন তো বড় বড় শহরে কোন বিদঘুটে জিনিশটা না চোখে ধরা দিবে আপনার? এ জীবন নিষ্পাপ যত দানবে গিস গিস করিতেছে।
—প্রভু, খোদাবন্দ করিম! আপনি স্রষ্টা, আপনি মনিব, আপনিই তিনি যিনি বিধিবিধান আর স্বাধীনতার কারণ। আপনিই রাজশক্তি যিনি অনুমতি দেন, আপনিই বিচারপতি যিনি ক্ষমা করেন। লক্ষ্যে আর কারণে পরিপূর্ণ আপনি। আর চিকিৎসকের ছুরির মাথায় যেমন উপশম, হয়তোবা তেমনই আমার হৃদয়ধর্মের রূপান্তর ঘটাইবার মতলবে আপনিও আমার প্রাণে তেমন ভয়ানকের আকর্ষণটা দান করিয়াছেন। প্রভু, করুণা দেখান না, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই উন্মাদদের আপনি করুণা দেখান না! হে সৃষ্টিকর্তা! এই দানবের দল কোন কারণে বিরাজ করে, কিভাবে তাহাদের বানানো হইল আর তাহাদের না বানাইয়া বা কি উপায়ই বাকি ছিল তাহা একমাত্র যিনি জানেন সেই তাঁহার চোখেও কি তাহারা দানব পরিচয়ে বিরাজমান?
৪৮
এই দুনিয়া বাদে আর যেখানেই হয়
এই দুনিয়া এমন এক হাসপাতাল যেখানে রোগী মাত্রেই বিছানা বদলাইতে উদ্গ্রীব। এই রোগী চাহেন আগুনের ভাঁড়ের কাছ ঘেঁষিয়া ভুগিতে আর ঐটা মনে করেন জানালার ধারে গেলেই সারিয়া উঠিবেন।
আমার তো মনে হয় আমি এখন যে জায়গায় থাকি না সেখানে গেলে অনুক্ষণ ভাল থাকিব। বাসাবদলের সমস্যাটা লইয়া আমি আমার আপন মনে অনবরত তোলাপাড়া করিয়াছি।
“মন আমার, বেচারা শীতেধরা মন আমার, বল দেখি, যদি লিসবনে গিয়া বসবাস করি, রাজি আছ? সেখানে নিশ্চয়ই হাওয়া গরম থাকিবে আর তুমিও টিকটিকির মতন সুখী হইবে। শহরটা সমুদ্রের তীরে। লোকে বলে মার্বেল-পাথরে গড়া। সবুজ তাহার বাসিন্দাদের এতই অপছন্দ যে তাহারা যাবত গাছপালার মূলোৎপাটন করিয়া সারিয়াছে। এমন দেশটি তোমার মনে ধরিবে। দেশটি তৈরি আলোকে আর খনিজদ্রব্যে, প্রতিফলনযোগ্য তরল পদার্থযোগে!”
আমার মন নিরুত্তর।
“আসা-যাওয়ার দৃশ্যের মধ্যে বিশ্রাম যখন তোমার এতই পছন্দের তো তোমার ওলন্দাজদের দেশে—শান্তিপুরে—যাইতে আগ্রহ জাগিবে? জাদুঘরে যে এলাকার ছবি দেখিয়া তুমি বরাবর মুগ্ধ হইয়াছ সেই এলাকায় হয়তো মজাই পাইবে তুমি। যে তুমি মাস্তুলে মাস্তুলারণ্য আর ঘরবাড়ির পায়ে নোঙর করা জাহাজ পছন্দ কর সে তুমি রটারডাম শহরটা কেমন পছন্দ করিবে?”
আমার মন নিরব।
“বাতাবিয়া হয়তো তোমার মুখে আরো হাসি ফোটাইবে? সেখানে —অন্যান্যের মধ্যে—আমরা এয়ুরোপের প্রাণের সঙ্গে বিষুবমণ্ডলীয় সৌন্দর্যের মেলবন্ধন দেখিতে পাইব।”
কোন কথা নাই।—মন আমার, তুমি কি মরিয়াই গেলে!
“তো তুমি কি এতক্ষণে অবসাদের সেই প্রান্তসীমায় পৌঁছাইলে যে আপন ক্লেদ ছাড়া আর কিছুতেই তোমার মন জুড়ায় না? ঘটনা যদি এই হয় তো চল ছুটি সেই সকল দেশের পানে যে দেশগুলি মৃত্যুর উপমা বৈ নহে। বেচারা মন, ঘটনাটা কি আমি বুঝিয়া গিয়াছি! চল, আমরা তর্নিওর উদ্দেশ্যে বাক্সপেটরা গোছাই। চল, আমরা আরও দূরে, অন্য কোথাও, বাল্টিক সাগরের শেষসীমায় যাই। সম্ভব হয়, জীবন হইতে দূরে, আরো দূরে, বহুদূরে, আর কোথাও যাই—মেরুপ্রদেশে বাসা বাঁধি। ওখানে সূর্যের আলো মাটিতে পড়ে মাত্র তির্যকরেখায়, আলো আর রাত্রির ধীর রূপান্তর বৈচিত্র্য ব্যাহত করে, বর্ধিত করে একঘেয়ে ভাব যাহা নাস্তানাবুদের অর্ধেক। সেখানে অনেকক্ষণ ধরিয়া অন্ধকার-স্নান সারিতে পারিব আমরা। মাঝখানে প্রমোদের প্রয়োজনে উত্তরের মেরুজ্যোতি মধ্যে মধ্যে আমাদের দিকে নরকের আতশবাজিতুল্য গোলাপি আলোর আভা পাঠাইবে!”
শেষমেষ আমার মন ফাটিয়া পড়ে। শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞের ভাষায় চেঁচাইয়া বলে: “কোথায় তাহাতে কি! কোথায় তাহাতে কি! যতক্ষণ না জায়গাটা এই দুনিয়ার বাহিরের কোথায়ও হয়!”
তর্জমা: সলিমুল্লাহ খান