• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
শিল্পের সিন্দুক ৯

‘অগ্নিবীণা’র শতবর্ষ পূর্তি


আলম খোরশেদ
প্রকাশিত: জুন ১১, ২০২৩, ০৬:৪১ পিএম
‘অগ্নিবীণা’র শতবর্ষ পূর্তি

ছোট বন্ধুরা, তোমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে বছরখানেক আগে আমি এই পত্রিকাতেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার এক শ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি লেখা লিখেছিলাম। তো এই কবিতাটি নজরুলের যে বইটিতে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়েছিল সেই ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনারও শত বছর চলছে এখন। তাই মনে হলো, এই বইটির ইতিহাস ও প্রকাশনার গল্প নিয়েও তোমাদের জন্য কিছু একটা লেখা উচিত আমার। ‘অগ্নিবীণা’ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে। অনেকেই মনে করেন এটি নজরুলের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। তা কিন্তু নয়; এটি তাঁর দ্বিতীয় প্রকাশিত বই। কেননা, এর আগে ১৯২২ সালেরই গোড়ার দিকে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম বই ‘ব্যথার দান’, যেটি মূলত একটি ছোটগল্পের সংকলন। তবে কবিতার বইয়ের কথা বললে এটিই যে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। 
বইটি প্রকাশের আগে ও পরে নজরুল তাঁর নিজের সম্পাদিত পত্রিকা ‘ধূমকেতু’তে দুটো মজার বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। সেই দুটোর উল্লেখ করেই তবে আলোচনার সূত্রপাত করা যাক। বই প্রকাশের আগে যে বিজ্ঞাপনটি ছাপা হতো, সেটি ছিল এ রকম:
 

“‘ধূমকেতু’-সারথি ‘বিদ্রোহী’র সৈনিক-কবি
কাজী নজরুল ইসলাম-এর
কবিতার বই
অগ্নিবীণা! অগ্নিবীণা!!
ছাপা হচ্ছে —দাম এক টাকা।

এতে থাকবে কবির আজতক  লেখা সমস্ত গরম কবিতা ও গান। যেমন, ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’, ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘ধূমকেতু’, ‘আনোয়ার’, ‘কোর্ব্বাণী’, ‘মোহরম’, ‘শাতিল আরব’, ‘রণ-ভেরী’, ‘আগমনী’ প্রভৃতি কবিতা এবং ‘বন্দী-বন্দনা’, ‘মরণ-বরণ’, ‘জাগরণী’, ‘অভয়মন্ত্র’, ‘ভাঙার গান’ প্রভৃতি গান। যাঁরা বই কিনতে চান তাঁরা অনুগ্রহ করে আজই  চিঠি দিয়ে নাম রেজিস্ট্রি করে রাখুন, কিংবা টাকা পাঠিয়ে দিন...। শান্তিপদ সিংহ, ৩২ কলেজ স্ট্রীট (ওপরতলা) কলিকাতা।”

এই বিজ্ঞাপনটি ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যায় পরপর ছাপা হয়েছিল। আর বই বেরিয়ে যাবার পর ১৯২২ সালের ২৪শে অক্টোবর পত্রিকার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় যে বিজ্ঞপনটি ছাপা হয়েছিল সেটিতে এই দুটো বাক্য ছিল মাত্র:

‘অগ্নিবীণা! বের হল
কাজীর ফটোসহ সুদৃশ্য বাঁধাই — দাম এক টাকা।’

তবে বইটি প্রকাশিত হবার পর দেখা গেল বিজ্ঞাপনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গান-কবিতার সবকিছু তাতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। সব মিলিয়ে মাত্র বারোটি কবিতা নিয়েই প্রকাশিত হয়েছিল ‘অগ্নিবীণা’র সেই ঐতিহাসিক প্রথম সংস্করণটি। সেই বারোটি কবিতা হল যথাক্রমে, ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘বিদ্রোহী’, ‘রক্তাম্বর-ধারিণী মা’, ‘আগমনী’, ‘ধূমকেতু’, ‘কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার’, ‘রণভেরী’, ‘শাত-ইল-আরব’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘কোরবানী’ ও ‘মোহররম’। তোমরা জেনে অবাক হবে, বইটির প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করেছিলেন সেই সময়ের সবচেয়ে নামকরা শিল্পী শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং। তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী একটি বীণার আদলের মাঝখানে আগুনের ফুলকি আর  আরবি ক্যালিগ্রাফিতে বই ও লেখকের নাম লিখে এর চমৎকার প্রচ্ছদটি করেছিলেন তরুণ চিত্রকর বীরেশ্বর সেন। বইটির প্রকাশক হিসেবে ‘আর্য পাবলিশিং হাউস’ এর নাম থাকলেও এটি আসলে নজরুল নিজেই তাঁর গাঁটের পয়সা খরচ করে প্রকাশ করেছিলেন। নজরুল বিপ্লব ও বিদ্রোহের ভাবধারায় রচিত তাঁর এই গ্রন্থটি স্বাভাবিকভাবেই তাই উৎসর্গ করেছিলেন বিখ্যাত বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে, যিনি ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন ঋষি অরবিন্দ ঘোষের ভাই। উৎসর্গপত্রে লেখা ছিল:  “বাঙলার অগ্নিযুগের আদি পুরোহিত সাগ্নিক বীর শ্রীবারীন্দ্রকুমার ঘোষ শ্রীশ্রীচরণারবিন্দেষু; তোমার অগ্নি-পূজারী -হে- মহিমান্বিত, শিষ্য-কাজী নজরুল ইসলাম।”

কিন্তু মাত্র বারোটি কবিতা দিয়ে প্রকাশিত এই হালকা পাতলা বইটিই কিন্তু তৎকালীন বাঙালি সমাজে বিপুল আলোড়ন তুলেছিল। এতটাই যে, প্রথম সংস্করণে ছাপা হওয়া মোট ২২০০ কপি বই এক বছরের মধ্যেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। তবে শুধু পাঠক সমাজকে আলোড়িত করাই নয়, খোদ ইংরেজ প্রশাসনের ভিতও নাড়িয়ে দিয়েছিল এই বই তার বিপ্লব, বিদ্রোহ, সাম্য ও স্বাধীনতার মন্ত্রে। হতচকিত শাসক সম্প্রদায় প্রথমে বইটিকে বাজেয়াপ্ত করার কথাই ভেবেছিল, কিন্তু জনরোষের ভয়ে তা না করে তার লেখককে বন্দি করার ফন্দি আঁটে। তারা এর আগে প্রকাশিত নজরুলের আরেকটি জ্বালাময়ী কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’র জন্য তাঁকে কুমিল্লা শহর থেকে গ্রেপ্তার করে এনে এক বছরের জন্য জেলে পুরে দেয়। বইটি বেরিয়েছিল ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে, আর তার পরের মাসেই নজরুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নজরুলই সম্ভবত প্রথম লেখক যাঁকে সাহিত্য রচনার জন্য বন্দিত্ব বরণ করে কারাগারে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। ইংরেজরা তাঁকে বন্দি করেই খান্ত হয়নি, ‘অগ্নিবীণা’ বইয়ের প্রায় একই সঙ্গে প্রকাশিত তাঁর অপর একটি প্রবন্ধগ্রন্থ ‘যুগবাণী’কেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল।

সে যাক, বইটি প্রকাশের পরপর নজরুল ‘অগ্নিবীণা’র দ্বিতীয় খণ্ডও শিগগিরই বের হবে বলে ‘ধূমকেতু’র পাতায় ঘোষণা দেন। তবে সেটি শেষ পর্যন্ত আর প্রকাশিত হয়নি। এ সম্পর্কে নজরুল তাঁর ‘বিষের বাঁশী’ কাব্যগ্রন্থে ‘কৈফিয়ত’ শিরোনামে লিখেছেন: “‘অগ্নিবীণা’ দ্বিতীয় খণ্ড নাম দিয়ে তাতে যেসব কবিতা ও গান দেব বলে এতকাল ধরে বিজ্ঞাপন দিচ্ছিলাম, সেইসব কবিতা ও গান দিয়ে এই ‘বিষের বাঁশী’ প্রকাশ করলাম। বিশেষ কারণে কয়েকটি কবিতা ও গান বাদ দিতে বাধ্য হলাম। কারণ আইনরূপ ‘আয়ান ঘোষ’ যতক্ষণ তার বাঁশ উঁচিয়ে আছে, ততক্ষণ বাঁশীতে তথাকথিত ‘বিদ্রোহ’-রাধার নাম না নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। ঐ ঘোষের পো-র বাঁশ বাঁশীর চেয়ে অনেক শক্ত...।”  ‘অগ্নিবীণা’র দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত না হলেও এর প্রথম খণ্ড তথা আদি ‘অগ্নিবীণা’ বইটিই অগ্নিগর্ভ বীণার তারের ঝোড়ো ঝঙ্কারে বাঙালি পাঠকের নিদ্রা হরণ করে নিয়ে তাকে এমন উদ্দীপ্ত ও আপ্লুত করে তোলে যে, প্রতি বছরই তার নতুন সংস্করণ বেরুতে থাকে এবং পাঠকের চাহিদায় দ্রুতই তা নিঃশেষিতও হয়ে যেতে থাকে। এটি সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেলজয়ী বই ‘গীতাঞ্জলি’র পর বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত একক কাব্যগ্রন্থ। 
 

তবে নজরুল নিজে এ থেকে তেমন লাভবান হতে পারেননি, কেননা একসময় তাঁর হঠাৎ টাকার প্রয়োজন হলে তিনি এর সম্পূর্ণ স্বত্ব কলকাতার ডি. এম. লাইব্রেরির কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তা নইলে শেষজীবনে তাঁকে যে এমন শোচনীয় অর্থকষ্টে ভুগতে হয়েছিল তা থেকে হয়তো তিনি ও তাঁর পরিবার পরিত্রাণ পেতেন। সে যাক, বাংলা সাহিত্যের একটি দুঃসাহসী, অমর গ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ সম্পর্কে তোমরা কিছুটা হলেও অবগত হলে। এবার এ লেখাটির ইতি টানার পালা। তবে তার আগে তোমাদেরকে তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা পড়াতে চাই, যার নাম ‘প্রলয়োল্লাস’ এবং যে কবিতাটি দিয়েই শুরু হয়েছিল এই ‘অগ্নিবীণা’ বইটি। শুভ পাঠ।

 

প্রলয়োল্লাস
 

তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!

আস্ল এবার অনাগত প্রলয়–নেশায় নৃত্য–পাগল,
সিন্ধু–পারের সিংহ–দ্বারে ধমক হেনে ভাঙল আগল!
মৃত্যু–গহন অন্ধকূপে, মহাকালের চণ্ড–রূপে ধূম্র–ধূপে
বজ্র–শিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ংকর!
ওরে ওই হাসছে ভয়ংকর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!

দ্বাদশ রবির বহ্নি–জ্বালা ভয়াল তাহার নয়ন–কটায়,
দিগন্তরের কাঁদন লুটায় পিঙ্গল তার ত্রস্ত জটায়!
বিন্দু তাহার নয়ন –জলে
সপ্ত মহাসিন্ধু দোলে
কপোল–তলে!
বিশ্ব –মায়ের আসন তারই বিপুল বাহুর ‘পর –
হাঁকে ঐ “জয় প্রলয়ংকর!”
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!

মাভৈঃ, ওরে মাভৈঃ, মাভৈঃ, মাভৈঃ জগৎ জুড়ে প্রলয় এবার ঘনিয়ে আসে
জরায়–মরা মুমূর্ষুদের প্রাণ–লুকানো ঐ বিনাশে।
এবার মহা–নিশার শেষে
আসবে ঊষা অরুণ হেসে
করুণ্ বেশে!
দিগম্বরের জটায় লুটায় শিশু–চাঁদের কর!
আলো তার ভরবে এবার ঘর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!
 

Link copied!