এবার মেলায় আপনার কী কী বই এসেছে?
মোহাম্মদ নূরুল হক: এবার মেলায় আমার দুটি গবেষণা ও প্রবন্ধের বই এসেছে। প্রথমটি ‘আধুনিক বাংলা কবিতা: ছন্দের অনুষঙ্গে’। দ্বিতীয়টি ‘বাক্-স্বাধীনতার সীমারেখা’।
‘আধুনিক বাংলা কবিতা ছন্দের অনুষঙ্গে’—বইটিতে কোন সময়ের কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন? কেন এই সময়কাল বেছে নেওয়া?
মোহাম্মদ নূরুল হক: এই বইয়ের আধুনিক বাংলা কবিতার প্রবণতা, ছন্দের প্রয়োজনীয়তা, ছন্দের উপকরণ, ছন্দ নিয়ে বিভ্রান্তি, প্রয়োগ, অপ-প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। পাশাপাশি জীবনানন্দ দাশ থেকে শুরু করে আল মাহমুদ পর্যন্ত মোট আটজন আধুনিক কবির কবিতায় ছন্দের প্রয়োগ ও ছন্দ নিরীক্ষার প্রয়োগ কিভাবে ঘটেছে, তার বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা করা হয়েছে। আধুনিক বাংলা কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এখনো জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে ও অমিয় চক্রবর্তীর কবিতাকেই ভিত্তি মেনেই আলোচনা করতে হয়। এরপর যারা আভির্ভূত হয়েছেন, তাদের মধ্যে অ্যাকাডেমিক বিবেচনায় যাঁদের কবিতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়, তারা হলেন আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ। কবিতার আলোচনায় আমি দশ বিভাজন করি না। তাই সময় বলতে আপনারা যে বিষয়কে ইঙ্গিত করেছেন, আমি সেই সময়বিভাজনে যাইনি। আমি মূলত রবীন্দ্র-উত্তর বাংলা কবিতার আধুনিকতা ও সেই আধুনিক কবিতার ছন্দপ্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করেছি। আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, উল্লিখিত ৮ জন কবির কবিতায় অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত; এই তিন নিরূপিত ছন্দের নানা প্রকরণ ও তার প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করেছি। এসব ছন্দের প্রয়োগ কার কবিতায় কিভাবে ঘটেছে, তাও গবেষণা-অনুসন্ধান করে দেখিয়েছি।
কবিতায় এখনো ছন্দবিষয়ক আলোচনা জরুরি কেন?
মোহাম্মদ নূরুল হক: শিল্পকলার প্রতিটি প্রকরণেরই রয়েছে স্বতন্ত্র চিহ্ন। স্বতন্ত্র রূপ। যেমন গানে রয়েছে সুর, তাল, লয়। চিত্রকলায় রয়েছে জ্যামিতিক পরিমিতি, যা ড্রয়িংয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, রয়েছে আলোছায়ার ব্যবহার, যা দিয়ে প্রকৃতিকে ফুটিয়ে তোলা হয়, রয়েছে রঙের ব্যবহার, যা দিয়ে বস্তুর প্রকৃত স্বরূর আঁকা হয়। গল্প-উপন্যাস-নাটকের রয়েছে আখ্যান, চরিত্র, সংলাপ, বিবরণ, ঘটনার পরম্পরা। এসব অনুষঙ্গে কোনো একটির অনুপস্থিতিতেই মূল রচনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে যায়। তেমনি কবিতার রয়েছে কিছু অনিবার্য অনুষঙ্গ। এরমধ্যে রয়েছে শব্দ, ছন্দ, অলঙ্কার, ভাষাশৈলী ও স্বরভঙ্গি। এগুলোর মধ্যে শেষের তিনটি ছাড়া কবিতা হতেও পারে, কিন্তু প্রথম দুটি অনুষঙ্গ ছাড়া কখনোই কবিতা হয় না। সহজ কথায় বললে শব্দ ও ছন্দ ছাড়া কবিতা অসম্ভব। ছন্দহীন রচনা কবিতা নয়, কবিতার মতো দেখতে কাব্যঘেঁষা গদ্য মাত্র। উপন্যাসে যেমন সমাজিক উপন্যাস, রাজনৈতিক উপন্যাস, মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের পাশাপাশি কাব্যধর্মী উপন্যাস থাকে, তেমনি গদ্যেও কাব্যধর্মী গদ্য থাকতে পারে। তাই ছন্দহীন রচনা মূলত কবিতা নয়, ওই কাব্যধর্মী গদ্য। এর বেশি কিছু নয়। এই বিষয়গুলো নিয়ে যেসব অস্পষ্টতা রয়েছে, তার সমাধানের জন্যও ছন্দবিষয়ক আলোচনা জরুরি।
লেখালেখির পাশাপাশি আপনি সম্পাদনাও করছেন। সেই জায়গা থেকে বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের কবিতাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মোহাম্মদ নূরুল হক: আমার লেখালেখির শুরু ৯১/৯২ সাল থেকে। সম্পাদনার শুরু ৯৪/৯৫ সাল থেকে। নিজের লেখালেখির ক্ষেত্রে সাহিত্যের যে-সব প্রকরণে আমি চর্চা করেছি, করে যাচ্ছি, তার সবগুলোয় আঙ্গিক ও প্রকরণ মেনে চলি। নিজে যে-সব বিষয় মেনে চলি, সম্পাদনার ক্ষেত্রেও সে-সব অনুসরণ করি। এক্ষেত্রে অনেক লেখকের সঙ্গেই মতানৈক্য তৈরি হয়। সম্পাদনাসূত্রে এই সময়ের কবিযশপ্রার্থীদের ভেতর একধরনের জেদ দেখেছি। সেই জেদ শেখার নয়, অজ্ঞতার। কোনো নিয়ম না জানার, না মানার প্রচণ্ড জেদ তাদের ভেতর রয়েছে। এই প্রসঙ্গে আমার একটি প্রবন্ধ আছে। শিরোনাম ‘বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যতের কবিতা’। ওই কবিতায় আমি বলেছি, ‘এ সময়ে যারা কবিতা লেখার কসরৎ করতে চেয়েছেন, তাদের সিংহভাগেরই রচনা হয় তীব্র ভাবাবেগের স্ফূরণ মাত্র, নয় কোনো মতবাদ বা ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভাষিক রূপ। যা তারা প্রেমিকা বা কোনো নারীর উদ্দেশে কিংবা মনোবিকলনের বিশেষ মুহূর্তে লিখেছেন। কিন্তু মনের স্বাভাবিক অবস্থায় ওই রচনার শিল্পমান নিয়ে কখনো ভাবেননি। প্রয়োজনও মনে করেননি। এ কথা সত্য-ব্যক্তিগত অভিরুচির প্রকাশ-প্রবণতা আধুনিকদের মজ্জাগত। কিন্তু আজকের যে তরুণরা কবিতা লিখতে এসেছেন, তাদের অভিরুচিই গড়ে ওঠেনি। যা গড়ে উঠেছে, তা হলো অন্যকে বোঝার চেয়ে বোঝানোর, বহির্জগতের নানা প্রপঞ্চ জানার চেয়ে নিজেকে বিজ্ঞপিত করার মানসিকতা।’ প্রবন্ধের এই কথাগুলো আজকের এই কথোপকথনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
প্রমিত ভাষা ও এ রীতি থেকে অনেকই বেরিয়ে আসতে চাইছেন। গল্প-কবিতার পাশাপাশি অনেকেই কথ্য রীতিতে প্রবন্ধও লিখছেন। আপনার বক্তব্য জানতে চাই।
মোহাম্মদ নূরুল হক: দেখুন, ভাষার প্রধান রীতি দুটি। একটি কথ্য, আরেকটি লেখ্য। আবার কথ্যরীতির দুটি রূপ রয়েছে, একটি প্রমিত, অন্যটি আঞ্চলিক। তেমনি লেখ্যরূপেরও দুটি রীতি রয়েছে, একটি সাধু, অন্যটি চলিত। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-দর্শন-ধর্ম-রাজনীতি থেকে শুরু করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুই নিয়মের অধীন। নিয়ম আয়ত্তে করতে কারও কারও কষ্ট হতে পারে। কষ্ট হলে সময় নিয়ে আয়ত্ত করা উচিত। কিন্তু নিয়ম আয়ত্ত না করে, আয়ত্ত করার চেষ্টা না করে, নিয়ম না মানার ঘোষণা দেওয়া আত্মহননের সমান। গল্প-উপন্যাসের চরিত্রের প্রয়োজনে আঞ্চলিক শব্দ থাকতে পারে, কবিতায়ও প্রয়োজনে এক আধটু থাকতে দোষ নেই। কিন্তু প্রবন্ধে কখনোই আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ থাকা উচিত নয়। যাঁরা এসব করছেন, হয় তারা সাহিত্যের বিবর্তনের ইতিহাস জানেন না, নয় তারা অলস। জানতে চান না। শর্টকার্ট পথে যাচ্ছেতাই লিখে আলোচনায় থাকতে চান। তারা হয়তো জনগণের মুখের ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়ার ওপর জোর দিতে চান, যুক্তিও তেমনি দিতে চাইবেন। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করবেন, সেই ‘জনগণের’ও সবাই একই রকম আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে না। সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী ব্যক্তি যে ভাষায় কথা বলেন, একজন নিরক্ষর সেভাষায় কথা বলেন না। আবার একজন শিল্পপতি যে-ভাষায় কথা বলেন, একজন দিনমজুর সেই ভাষায় কথা বলেন না। এমনকি একজন উকিল কথা বলার সময় যেসব শব্দ প্রয়োগ করেন, একজন সাংবাদিক বা শিক্ষক সেই ভাষায় কথা বলেন না। তাহলে দেখুন, গল্প-কবিতা-প্রবন্ধে আঞ্চলিকরীতির প্রয়োগ কেবল অযৌক্তিকই নয়, অবৈজ্ঞানিকও।
অনেকেই প্রচলিত বানানরীতিও মেনে চলছেন না। স্ত্রীবাচক সর্বনামের ক্ষেত্রে কেউ কেউ ‘সে’ এর বদলে ‘শে’ লেখার প্রস্তাব করছেন। এরকম বেশকিছু বানান নিজেদের মতো লিখছেন অনেকে। এটাকে কি নিরীক্ষা হিসেবে দেখছেন?
মোহাম্মদ নূরুল হক: প্রচলিত বানানরীতি না মানার জন্য ৯৯ ভাগ দায়ী বাংলা একাডেমি। এই প্রতিষ্ঠানটির নামের মধ্যেই রয়েছে গোঁজামিল। একটি প্রতিষ্ঠানের নামে দুটি শব্দ রয়েছে। এর একটি ‘বাংলা’, অন্যটি ‘ইংরেজি’ শব্দ। আবার ইংরেজি শব্দটির বাংলা প্রতিবর্ণীকরণেও গোঁজামিল রয়েছে। ইংরেজি Academy শব্দটির বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ হবে, ‘অ্যাকাডেমি’। কিন্তু আমাদের ‘বাংলা একাডেমি’ এই Academy শব্দটির বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ করেছে একাডেমি। প্রকৃতপক্ষে এই প্রতিষ্ঠানটির নাম হতে পারতো ‘বাংলা পরিষদ’। কিন্তু তা হয়নি। ফলে যারা বানান সংক্রান্ত নিয়ম-কানুন জানেন, তারা বাংলা একাডেমির চাপিয়ে দেওয়া প্রমিত রীতি মানেন না। আর স্ত্রীবাচক সর্বনামের ক্ষেত্রে যারা ‘সে’-এর পরিবর্তে ‘শে’ লিখছেন, তারা ইংরেজির ‘হি’ ও ‘শি’ সর্বনামের অনুকরণকারী। কিন্তু বাংলায় এমনটি গ্রহণযোগ্য নয়। লেখ্যরূপ ‘সে’ হোক কিংবা ‘শে’ হোক; উভয়েরই উচ্চারণ কিন্তু ‘শে’। ‘স’ শব্দের শুরুতে থাকলে তার উচ্চারণ ‘শ’ হয়। ফলে লেখার সময় যতই স্ত্রীবাচক সর্বনামের ক্ষেত্রে ‘শে’ আর পুরুষবাচক সর্বনামের ক্ষেত্রে ‘সে’ লেখা হোক, বলা ও শোনার সময় কিন্তু ‘শে’-ই হবে। ইংরেজিতে কিন্তু পুরষবাচক ও স্ত্রীবাচকের আদ্য বর্ণ একই নয়, ধ্বনিও একই নয়। ইংরেজিতে পুরুষবাচকে ‘হি’ আর স্ত্রীবাচকে ‘শি’। এছাড়া শব্দের প্রয়োগ হয়, যুগ যুগ ধরে চলে আসা অভ্যাস, আচরণ, চিহ্ন, সম্পর্ক, সম্বোধনের ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরম্পরার নিরিখে। হঠাৎ করে কেউ এসে সেখানে কোনো শব্দের প্রবর্তন করার বাসনা পোষণ করতেই পারেন, তাতে তার পাণ্ডিত্যেরও কিঞ্চিৎ চেষ্টার হঠাৎ আলোর ঝলকানি দেখাও যেতে পারে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক বিচারে তা কর্পূরের মতোই উবে যাবে। যায়ও। তই এই ধরনের নিরীক্ষাকে আমি পণ্ডশ্রম হিসেবেই দেখি।
বইমেলা বাংলাসাহিত্য বিকাশে কী ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?
মোহাম্মদ নূরুল হক: যারা মননশীল লেখক, সিরিয়াস ধারার লেখক, প্রকরণসিদ্ধ লেখক, তারা বইমেলাকে সামনে রেখে কখনোই লেখেন না। প্রকাশকরা হয়তো বইমেলাকে কেন্দ্র করে লেখকদের কাছ থেকে পাণ্ডুলিপি এনে জমিয়ে রাখেন। বইমেলা কাছে এলে তারা বই করেন। এতে প্রকাশকদের ব্যবসায়িক দিকটি রক্ষা হয়, কিন্তু সাহিত্যের তাতে কোনো লাভ হয় না। বরং উৎসব উৎসব আমেজের আড়ালে অপসাহিত্য, অনুকরণসাহিত্য, প্রতিধ্বনিসাহিত্যের প্রসার ঘটে বেশ। অর্থাৎ প্রকাশকরা যে ধরনের বই বিক্রি করে রাতারাতি লাভবান হতে চান, তাদের উপকার হয়। কিন্তু প্রকৃত লেখকদের তাতে কোনো লাভ হয় না। তাদের বইও বইমেলায় তেমন বিক্রি হয় না। এদিক থেকে দেখলে সাহিত্য বিকাশে বইমেলার ভূমিকা তেমন নেই। কিন্তু পাঠক তৈরিতে কিঞ্চিৎ ভূমিকা আছে। অর্থাৎ ওই হালকা-চটুল-বাণিজ্যিক বইগুলো পড়ে পড়ে কিছু মানুষ অন্তত সাহিত্যপাঠে আগ্রহী হন। এটুকুই লাভ।