‘টরন্টো’ শব্দটি এসেছে উত্তর আমেরিকার ইরোক্যুয়া আদিবাসীদের শব্দভান্ডার থেকে, যার অর্থ জলমগ্ন স্থান, যেখানে গাছের ডালপালা পুঁতে মাছ ধরা হয়, তাই এই শব্দের আরেক অর্থ সমাবেশস্থলও বটে। মাছেদের ঝাঁক রূপান্তর হয়ে এখন মানুষের ভিড়। ৪৮তম টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, যার সংক্ষিপ্ত নাম টিফ (TIFF), সেখানে দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্টরা ভিড় জমিয়েছেন টরন্টোতে। দুই শতাধিক মুভি দেখতে মীনদের এই আনন্দ সমাবেশে আমিও শামিল হয়েছি এবার—চলচ্চিত্রের স্রোতপ্রবাহে সাঁতার কাটতে আসা এক সামান্য চলচ্চিত্র লেখক।
মাসখানেক আগে এয়ারবিএনবি নামক এক ওয়েবসাইটের কল্যাণে বাড়ি ঠিক করেছিলাম। তো উৎসব শুরুর ঠিক আগের দিন রাত দশটা নাগাদ সেই বাড়ির আঙিনায় এসে দরজায় কড়া নাড়ি। বাড়িতে কোনো সাড়াশব্দ নেই। আধা ঘণ্টার চেষ্টাচরিত্র শেষে বেরিয়ে এলেন এক কৃষ্ণাঙ্গ বৃদ্ধা। তিনি যা বললেন, তাতে আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ট্রুডোর কসম, এতটা বিস্মিত আগে কখনো হইনি। ভদ্রমহিলা জানালেন, আমরা নাকি দিন তিনেক আগে বাড়িতে থাকার বিষয়টি বাতিল করেছি, তাই তিনি আরেকজনকে ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন। এই রাতে দারাপুত্রপরিবার নিয়ে, বিদেশবিভুঁইতে যাই কই?
ভাগ্যিস ভদ্রমহিলার ছোট ছেলের নামের সঙ্গে নাকি আমার নামের মিল আছে! মহিলা বললেন, আজ রাতটা তোমরা থাকতে পারো। তবে পরের দিন অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে। বললাম, তাতেই সই। কারণ আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর উৎসব শুরু, সেখানে যেতে হবে। আমরা মন্ট্রিয়ল থেকে সাত ঘণ্টা ড্রাইভ করে এসেছি। ক্লান্ত-শ্রান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থা! বিছানায় পিঠ ঠেকানো অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। মহিলা আবার কী এক স্প্রে করেছেন ঘরের ভেতর। গন্ধে মাথা ঝিঁঝিঁ করে। বহু কষ্টে চোখ দুটো ঘণ্টাখানেকের জন্য বন্ধ করে রেখে, ভোর ছয়টায় উঠেই উবার ডেকে ভেন্যুতে। আমরা উঠেছিলাম হুইসলিংস্টোন এলাকায়। অনেক দূর টিফের মূল ভেন্যু থেকে। এখানে যে আর থাকতে হবে না, তাতে আমি খুশিই হলাম। যিনি আমাদের মন্ট্রিয়ল থেকে টরন্টো গাড়ি চালিয়ে এনেছেন, সেই তারেক ভাই ঠিক করে দিলেন আরেক বাড়ি। ঠিক হলো প্রথম দিন উৎসব সামাল দিয়ে বিকেলে বাক্সপেটরা নিয়ে ছুটব নতুন বাড়ির দিকে।
টানটান উত্তেজনা নিয়ে আমি ভোরবেলা উবার নিয়ে পৌঁছালাম কিং স্ট্রিট ওয়েস্টের হায়াত রিজেন্সি হোটেলে। রাস্তায় প্রচুর যানজট। ঢাকার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে মনে হয়! জট ঠেলে হায়াতে প্রবেশ করে দেখি পিপীলিকার মতো লোকজন আবেহায়াত মানে আইডি কার্ড সংগ্রহ করছে। খোঁজ নিয়ে বুঝলাম এই লাইন আমার নয়। এটা ইন্ডাস্ট্রির লোকজনদের লাইন। বাংলাদেশে লোকজন লাইনঘাট ধরেই নাকি কাজ করে। আমি এসব বুঝি কম। তাই প্রথমে ইন্ডাস্ট্রির লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। পরে জিজ্ঞেস করাতে সময় বাঁচল। আমার আইডি যেখানে, সেখানে দেখি এক নারী হাসিমুখে হাত নেড়ে আমাকে ডাকছেন। আমি গিয়ে পাসপোর্টের ফটোকপি দিতেই তিনি দুই সেকেন্ডের ভেতর আমার আইডি বের করে ফেললেন। হাতে দিতে গিয়ে রসিকতা করে বললেন, পাসপোর্টের ছবি আর আইডির ছবির লোক কি এক? বললাম, তোমার ভাগ্য ভালো এনআইডির ফটোকপি দিইনি! তখন সারা দিন লেগে যেত চেহারা মেলাতে মেলাতে। যাহোক, চলচ্চিত্রের এই মেলায় মেলা লোক এসেছেন। তাদের আবার টিফ দাওয়াত দিয়েছে সকালের নাশতায়। হায়াত থেকে বেরিয়ে মউতের দিকে এগোলাম। হোটেলের নাম বিশা হোটেল। বিষের সঙ্গে বেশ মিল।
গিয়ে দেখি এক তরুণ মার্কিন চলচ্চিত্র লেখক দাঁড়িয়ে আছেন। উনিও আমার মতো আগেভাগেই চলে এসেছেন। অ্যানিমেশনের ভক্ত। প্রথমবার এসেছেন টিফে। বললাম, তোমার তো ভাগ্য ভালো। এবারই টিফের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো উদ্বোধনী ছবিতে দেখানো হবে অ্যানিমেশন ফিল্ম। জাপানি অ্যানিমেটর হাইয়ায়ো মিয়াজাকির “দ্য বয় অ্যান্ড দ্য হেরন”। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একটি ছেলের মায়ের মৃত্যুর পর অলীক অভিযাত্রা নিয়ে তৈরি হয়েছে এই ছবি। ঠিক সকাল নয়টায় বিশার দরজা খুলে গেলে সবার যাত্রার অভিমুখ হয় ভেতরে। থরে থরে সাজানো খাবার। তবে আমার দৃষ্টি কেড়েছে ফায়ার প্লেস। আমি খাবার ফেলে আগে ওখানেই গেলাম। বেশ অ্যান্টিক একটা লুক দেওয়ার চেষ্টা লক্ষ করলাম। খাবারের কাছে ফিরে দেখি বহুবিধ আহার্য পদার্থ। এর মধ্যে জাপানি সুশিও আছে। ঘটনা কী! টিফ কি জাপানি সাংস্কৃতিক বলয়ে ঢুকে পড়ছে নাকি! এখন তো যে যেভাবে পারছে নানা দিকে ঝুঁকে পড়ছে। কেউ চীন, তো কেউ রাশিয়া। টিফ দেখলাম ইউক্রেনের পক্ষে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছে খোলামেলাভাবেই। তারা প্রচুর উদ্বাস্তুকে আশ্রয়ও দিয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা অবশ্য এতে নাখোশ। তাদের করের টাকায় কেন বসিয়ে বসিয়ে ইউক্রেনের উদ্বাস্তুদের খাওয়ানো হবে? তাই গোস্বা।
সব লোভনীয় খাবার ছেড়ে আমি পাতে তুলে নিলাম ফল আর টক দই। এই ফলাহার করতে করতে আলাপ হলো ইংল্যান্ড থেকে আসা এক সাংবাদিকের সঙ্গে। তিনি শুধু সংগীতবিষয়ক চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করেন। সেই বিচারে তার ছবি দেখার তালিকায় রয়েছে চার কি পাঁচটি ছবি। আমাকে জিজ্ঞেস করাতে বললাম, কুড়িটির নিচে তো নয়ই। এবার চাঁদমারি করেছি এশিয়ার ছবি। ইউরোপ-আমেরিকার ছবি আমাদের কাছে জলের মতো চলে আসে। সেই তুলনায় চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, ইরান কিংবা ভারতের স্বাধীন চলচ্চিত্রও আমাদের কাছে খুব একটা আসে না। কথা শুনে ভদ্রমহিলা মাথা নেড়ে বললেন, বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছো। একটু পর আঙুল দিয়ে পেছনে তাকাতে বললেন। দেখো, টিফের প্রধান নির্বাহী ক্যামেরন বেইলি। দেখলাম কৃষ্ণাঙ্গ ভদ্রলোক বেশ সহজভাবে সবার সঙ্গে বাতচিত করছেন।
এমন সময় ফোন এলো প্রিয়াংকার। তিনি বাংলাদেশে চলচ্চিত্র বোঝাপড়া ও নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন টিফের তহবিল গঠনবিষয়ক বিভাগে কাজ করেন। আমাকে ডেকে নিয়ে স্টারবাকসে আলগ্রে চা পান করালেন। বাংলাদেশ নিয়ে তিনিও আমার সাড়ে সাত বছরের ছেলের মতো চিন্তিত। আমি চিন্তিত নই। হতাশ। হাত-পা ছড়িয়ে শুধু ভেবেই চলেছি, দেশটা রসাতলেই গেল তবে! আমাকে বলা যায় যদভবিষ্য। যারা অনাগতবিধাতা কিংবা প্রত্যুৎপন্নমতি, তারা আর কেউ দেশে নেই। আমার ছেলে অনাগতবিধাতা। সে কানাডা এসে আর বাংলাদেশে ফিরতে চাইছে না। যাক, সে আলাপ ভিন্ন।
প্রিয়াংকার অফিসে কাজ আছে। ও চলে গেলে, আমি কিছুক্ষণ একা একা বসে চা পান করি আর পরবর্তী দুই ঘণ্টা কী করা যায় তাই ভাবি। কারণ, পৌনে একটায় ‘আ হ্যাপি ডে’ দেখা কথা রয়েছে। কুর্দি বংশোদ্ভূত নরওয়েজিয়ান পরিচালক হিশাম জামানের ছবি।
চা পান শেষ করে বেল টাওয়ারে গিয়ে গোটা কয়েক বই কিনলাম। তার ভেতর রয়েছে বহুদিন ধরে খোঁজা জঁ-লুক গদারের একটি সাক্ষাৎকার সংগ্রহ। ফ্রান্সিস ফোর্ড কোপোলার লেখা ‘লিভ সিনেমা অ্যান্ড ইটস টেকনিকস’ বইটাও গুরুত্বপূর্ণ। বই দেখতে দেখতেই ফোন দিলেন কানাডাপ্রবাসী চলচ্চিত্র পরিচালক এনায়েত করিম বাবুল। বাবুল ভাই এলে তাঁর সঙ্গে টিফ-সংক্রান্ত আলাপটালাপ হলো। জানলাম বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকের কমার্শিয়াল স্ক্রিনিং হবে টিফে। আর সেখানে হাতে গোনা কয়েকজন দাওয়াত পেয়েছেন। দাওয়াত ছাড়া এই ছবি দেখা যাবে না শুনে হতাশ হলাম। আবার। শ্যাম বেনেগালের এত বড় বাজেটের ছবির প্রিমিয়ার আমি দেখতে পারব না, এত কাছে থাকা সত্ত্বেও? যাক দেশে ফিরে দেখা যাবেক্ষণ। এবেলা হিশাম জামানের ছবিটা দেখি।
বাবুল ভাইকে বিদায় জানিয়ে স্কশিয়াব্যাংকে ঢুকে দেখি এলাহি ব্যাপার। ১৪টি অডিটরিয়ামে সমান্তরালে চলছে চলচ্চিত্র। আমার তালিকাভুক্ত ছবিটি দেখানো হবে নয় নম্বর হলে। ক্যাফেতে বসে অপেক্ষা করছি। ফাঁকে ফোন দিয়ে খোঁজ নিলাম, ছেলে পার্কের খোলা মাঠে মন ভরে দৌড়াচ্ছে। সাধে কি বাচ্চারা বাংলাদেশে থাকতে চায় না? শহরের প্রায় সব মাঠ ভূমিখেকোদের পেটে! বাংলাদেশের শিশুরা বড় হচ্ছে ছাদে টেনিস বল দিয়ে ফুটবল খেলে! কপাল! শিশু-কিশোরদের বিকাশের এই ধারা বজায় থাকলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
‘আ গুড ডে’ ছবিটিও নির্মিত হয়েছে শিশু-কিশোরদের নিয়ে। সংশোধনাগারে অনেক কম বয়সী ছেলেমেয়ে আসে। তারা সঙ্গে নিয়ে আসা নানা রঙের স্বপ্ন। বন্ধুত্ব, প্রেম ও কবিতা—এই তিনের মিশেলে ছবিটি শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় কৌশোরক স্বপ্নের বিপ্লবী ইশতেহার। হামিদ ও তার বন্ধুরা স্বপ্ন দেখে একদিন তারা পাহাড় ডিঙিয়ে যাবে। সফেদ বরফের রাজ্যে তারা বন্দী থাকতে চায় না। বল্গা হরিণের পায়ে পায়ে তারা ডিঙাতে চায় দুর্লঙ্ঘনীয় পাহাড়! সিনেমাটোগ্রাফি লা-জওয়াব। শেষ দৃশ্যে দেখা যায় হামিদের আত্মা বল্গা হরিণ হয়ে পবর্তের দিকে রওনা দিয়েছে। আকাশ থেকে বর্ষিত হচ্ছে তুষার।
ছবিটি শেষ করে বেরিয়ে দেখি টরন্টোর আকাশ থেকে তুষার নয়, বৃষ্টি পড়ছে।
সন্ধ্যায় মিয়াজাকির অ্যানিমেশ ছবিটি দেখাবে। এই ছবির ব্যাপারে আমার খুব একটা আগ্রহ নেই শুরু থেকেই। তাই ঠিক করলাম এটি দেখব না। আর ‘আ গুড ডে’ দিয়েই শুরুর দিনটা শেষ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ফিরতি পথ ধরি। মাথায় ঘুরতে থাকে ‘আ গুড ডে’ ছবির কথা, হামিদের রূপান্তর, বল্গা হরিণ হয়ে ফিরে আসা, এ যেন জীবনানন্দের অনুরণন—“আবার আসিব ফিরে... হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে।”